এক
অধিবেশনে মূল প্রবন্ধ পড়া হয়ে গেলে সভাপতি উপস্থিত অংশগ্রহণকারীদের মন্তব্য করার জন্য আহবান জানালেন। তিনি এর জন্য প্রত্যেক মন্তব্যকারীকে সময় দিলেন দশ মিনিট। একে একে বেশ কয়েকজন এই সময়সীমার মধ্যে তাদের বক্তব্য রেখে গেলেন। সবশেষে এলেন এক মহিলা। তিনি দশ সেকেন্ডে তার মন্তব্য শেষ করে মঞ্চ থেকে নেমে এলেন। কোনো সেমিনারে বা কনফারেন্সে দেওয়া মন্তব্যের মধ্যে এটিই সংক্ষিপ্ততম, বললেন সভাপতি।
মহিলা তাঁর দশ সেকেন্ডের মন্তব্যে বললেন, জগৎসংসারে কেউ নামহীন গোত্রহীন নয়। যখন কেউ হয় তাকে এবং তাদেরকে করা হয়।
দুই
চেম্বার থেকে বেরিয়ে আসতেই চোখে পড়লো ছেলেটার হাতের ওপর। একটা ট্রেতে সে অনেক কাপ চা নিয়ে এসেছে ক্লিনিকের ডাক্তারদের জন্য। হয়তো রোজই আসে কিন্তু আজই তাকে প্রথম দেখলেন ড. আফিয়া। ছেলেটার বয়স বেশি না, কিশোরই বলা যায়। কিন্তু বয়সের তুলনায় বেশ শীর্ণ, মুখের চোয়াল শক্ত, গাল চিপসে গিয়েছে। চোখ দুটো গর্তের ভেতর, অপুষ্টিতে ভুগলে যা হয়। কিন্তু ড. আফিয়া ছেলেটার চেহারা দেখছিলেন না, তার চোখ আটকে গেল ডান হাতের কব্জিতে কালো সুতোয় বাঁধা চারকোনা রুপোলি রঙের চাকতির ওপর। তিনি জানেন ওটা কী, আর তার জন্যই হঠাৎ আসে বিবমিষা। তারপর মাথা ঘুরতে থাকে তার। বেশ পুরনো অসুখ এটা, রোগই বলতে হয়। এ ছাড়া কী? সবসময় এমন হয় না, আজ থেকে দশ বছর আগেও হয়নি।
একটু আগে চেম্বারের অন্য ডাক্তারদের সঙ্গে অপারেশনের পর বেশ খোশমেজাজে কথা বলছিলেন ড. আফিয়া। সহকর্মীদের মধ্যে পুরুষ যারা, যথারীতি, বদ কথকতা করছে। বদ মানে
সেক্স-রিলেটেড জোক। এরা এ-ধরনের জোক ছাড়া মনে হয় অন্য কিছু তাকে বলতে পছন্দ করে না। মনে হয় শুধু তাকে নয়, যে কোনো মেয়ে সহকর্মী হলেই তারা এমন করতো। এর কারণ কী? পঁয়ত্রিশ বছর বয়সেও তিনি আজো ভরা যৌবন নিয়ে বর্ষার নদীর মতো খলবলিয়ে দুকূল ছাপিয়ে রয়েছেন, সেই জন্য? হবে হয়তো। অথবা পুরুষ বলে এ-ধরনের জোকই ওদের পছন্দ। একে এক ধরনের সেক্সুয়াল হ্যারাসমেন্ট বলা যায়। নিতান্ত সহকর্মী বলে তিনি এখন পর্যন্ত সহ্য করে যাচ্ছেন। তিনি তাদের মুখের সামনেই মৃদু ভৎর্সনা করে বললেন, সব বদের হাঁড়ি। বললেন বটে কিন্তু নিজেই বোঝেন, নিরঙ্কুশ ভৎর্সনা সেটা নয়, তার মধ্যে প্রচ্ছন্ন থাকে অভয়। কোন মেয়ে তার দৈহিক সৌন্দর্যের প্রশংসা শুনে খুশি হয় না! বিশেষ করে যখন মেন্সট্রুয়েশন দরজায় এসে কড়া নাড়ছে। এন্সলারের সাড়া জাগানো বই ভ্যাজাইনা মনোলোগ তিনি পড়েছেন, একপেশে মনে হয়েছে তার কাছে। পোস্ট-মেন্সট্রুয়েশন মেয়েদের কথা বলা হয়নি সে-বইতে। মেয়েদের যৌনাঙ্গের সমস্যা কি বয়স-নিরপেক্ষ? মোটেও না।
ড. আফিয়া এই মুহূর্তে সহকর্মীদের সেক্সুয়াল ইনুয়েনডেশন রসিকতার কথা ভাবছেন না। তিনি ভাবছেন একটা তাবিজ-বাঁধা হাতের কথা। চা দিতে আসা ছেলেটার হাতে বাঁধা তাবিজ দেখে সঙ্গে সঙ্গে চোখ সরিয়ে নিয়েছেন হাতের ওপর থেকে। তার আগে একঝলক দেখলেন ছেলেটার মুখ। তারপর দেয়ালে এক হাত দিয়ে নিজেকে সামলাতে চেষ্টা করেছেন। মনে হচ্ছিল পড়ে যাবেন মেঝেতে। মাথা যখন বেশ ঘুরছে, ভেতর থেকে দৌড়ে এলো দুজন নার্স। একজন পুরুষ সহকর্মী। বেশ একটা হইচই হলো কিছুক্ষণ। স্ট্রেচার আনার পর ড. আফিয়াকে সেখানে শুইয়ে নিয়ে যাওয়া হলো চেম্বারের ভেতরে। রেস্ট নিতে দেওয়া হলো তাকে কেবিনে শুইয়ে রেখে। তারপর অবস্থা দেখে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে, এরপর কি করা হবে সেই বিষয়ে। এমারজেন্সিতে নেওয়ার প্রয়োজন হয়নি। এর আগে দুবার যখন তার এমন মূর্ছা যাবার মতো হয়েছে, সে-দুবার তার মাথা ঘুরেছে লাল রঙের বস্নাড দেখে। অথচ অপারেশন করার সময় বস্নাড দেখে তার কিছু প্রতিক্রিয়া হয় না। বাইরে দেখলে এমন হয় তার, প্রায় অজ্ঞাত কারণে। আজ যে অজ্ঞান হয়ে গেলেন তা রক্ত দেখে না, চা দিতে আসা ছেলেটাকে দেখে। তার হাতে-পায়ে কিংবা মুখে রক্তের ছাপ নেই, যা দেখে অন্যেরা বেশ ধন্ধে পড়ে। ড. আফিয়ার মাথা ঘুরবার কারণ কী হতে পারে?
ড. আফিয়া এক ঘণ্টা পর স্বাভাবিক হবার পর উঠে বসলেন। তাকে একটু বিব্রত দেখাচ্ছে। ডিপার্টমেন্টের হেড হিসেবে অন্যদের সামনে তাকে একটু রাশভারি হয়েই থাকতে হয়, পুরুষ সহকর্মীরা যত রং-তামাশা করুক না কেন। কিন্তু হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে যাবার পর কিছুক্ষণ তাকে ভালনারেবল হয়ে থাকতে হয়। ফলে তাঁর সংহত ব্যক্তিত্বে যেন চিড় দেখা দিলো কয়েকটা। এর জন্য তিনি মাথা নিচু করে থাকেন কিছুক্ষণ।
ড. সামাদ কাছে এসে বলেন, ঠিক আছেন? আর ইউ ফিলিং অলরাইট?
ড. আফিয়া মাথা নেড়ে জানান তিনি অলরাইট।
তিনি সুস্থবোধ করার পর ড. সামাদের দুষ্টুমি মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। তিনি বলেন, প্রেগন্যান্সির জন্য?
ড. আফিয়া ধমকের স্বরে বলেন, শাটআপ।
ড. সামাদ বলেন, এ নিয়ে তিনবার। বাড়িতে ক’বার হয়েছে তা বলেননি। এ তো একটা ডায়াগনোসিস করতে হবে না, ডক্টর!
ড. আফিয়া পেশেন্টদের বিছানা থেকে উঠে এসে জুতোজোড়া পায়ে গলিয়ে ভৎর্সনার স্বরে বলেন, না, করতে হবে না। ড. সামাদের পাশে দাঁড়িয়ে ড. নাসরিন বলেন, তাহলে ম্যাডাম এরকম তো হতেই থাকবে। সেটা কি ভালো হবে? একটা ইনভেস্টিগেশন করলে ভালো হতো না!
ড. আফিয়া কেবিনের বাইরে এসে একটা চেয়ারে বসে বললেন, ওই ছেলেটা কবে থেকে চা ডেলিভারি করছে এখানে?
কোন ছেলেটা? হেড নার্স বলল তার দিকে তাকিয়ে।
ড. আফিয়া বললেন, যে চা দিতে এসেছিল কিছুক্ষণ আগে।
হেড নার্স ঘরের বাইরে তাকিয়ে বলল, মনে হচ্ছে এ-সপ্তাহে। কেন ম্যাডাম, কাজে গাফিলতি করেছে কোনো?
হ্যাঁ, না। মনে পড়ল তো তাই জিজ্ঞাসা করলাম।
তিন
ছেলেটার নাম আক্কাস। বাবা নেই। মা তাকে আর ছোট বোনকে নিয়ে বসিত্মতে এক কামরার ঘরে থাকে। মা লোকের বাড়ি বাড়ি ঠিকা কাজ করে। দুপুরের আর রাতের খাবার বাড়ি নিয়ে আসে ছেলেমেয়ের সঙ্গে খাওয়ার জন্য। ছেলেটা এই প্রথম চাকরিতে ঢুকেছে। ক্লিনিকের এক ক্লিনার তাকে এখানে এনে ঢুকিয়েছে। তাকে অল্পই বেতন দিতে হয়।
তাবিজটা কে দিয়েছে? ড. আফিয়া জিজ্ঞাসা করেন।
হুজুর।
কোথাকার হুজুর? কী নাম?
আমি কইতে পারি না। মায়ে জানে। তাইনে নিয়া গেছে আমারে।
কেন, তাবিজ দিতে হলো কেন? কী সমস্যা তোমার?
আক্কাস বলে, আমি নাহি শোকনা। মায়ে কয় তাবিজ বাঁইধা চলাফেরা করলে মোটা হমু।
শুনে ড. আফিয়া আক্কাসের পাটকাঠির মতো হাত, শুকনো পায়ের নিচের অংশ দেখেন। ঠিক, ছেলেটাকে দুর্ভিক্ষ-পীড়িতদের মতো দেখায়। যেমন দেখানো হয় মাঝে মাঝে পোস্টারে বা সিএনএন কিংবা বিবিসিতে। তেমন ভয়াবহভাবে ম্যাচস্টিকের মতো দেখতে আক্কাসের হাত-পা মনে হয় না। কিন্তু সে যে অপুষ্টিতে ভুগছে সে-বিষয়ে সন্দেহ নাই। তার পায়ের হলুদ রং, চোপসানো গাল, চোখ তাই বলছে।
কতদিন হলো এই তাবিজ নিয়েছিস? ড. আফিয়া তাকালেন আক্কাসের দিকে।
ঈদের সময়।
রোগটা তখনই হয়েছিল? মানে তখন থেকেই শুকাতে শুরু করেছিস?
আক্কাস নিজের শরীরের দিকে তাকায়। তারপর বলে, কইতে পারি না। মায়েরে জিগান। তাইনে কইতে পারব।
হু। একটু ভাবেন ড. আফিয়া। তাবিজ-বাঁধা হাতটা চোখের সামনে ভাসতে থাকে। প্রায় বিচ্ছিন্ন হলে, অপারেশনের পর অনেক রোগী যেমন কেটে ফেলা পা দেখে থাকে তিনিও সেইভাবে তাবিজবাঁধা হাত শূন্যে, তার চোখের সামনে ভাসতে দেখেন। এক সময় চোখ খোলেন তিনি। তাবিজ-বাঁধা হাতটা যেন তাকে স্পর্শ করতে চাইছে। ভাবতেই তার শরীর কাঁটা দিয়ে ওঠে।
তাবিজ-বাঁধা হাত দেখলেই তার এমন হয়, অনেক দিন থেকেই হচ্ছে। দশ বছর হবে, মনে মনে হিসাব করার দরকার পড়ে না তার। মুখস্থই হয়ে আছে। শুধু প্রতিবছরের হিসাবটা এক এক বছর করে বেড়েছে।
তিনি আক্কাসকে বলেন, হাতটা শার্টের হাতা দিয়ে ঢেকে রাখবি। বুঝলি। আমার সামনে যখন আসবি।
আক্কাস তার ছেঁড়া হাফ শার্ট দেখে বলে, হাতডা যে ছোটু, কেমনে ঢাকুম?
ড. আফিয়া একটু থতমত খেয়ে যান। ছেলেটা তাকে হঠাৎ যেন বেকায়দায় ফেলেছে। তিনি বলেন, তোকে একটা ফুলহাতা জামা দিতে বলবো।
কাজ করতে অসুবিধা হইবো না? আক্কাস জিজ্ঞাসু চোখে তাকায়।
আমার সামনে যখন আসবি, হাতের তাবিজ ঢেকে আসবি। অন্য কাজের সময় আবার গুটিয়ে পরিস। পারবি না?
আক্কাস বলে, জি পারবো। তখন তাকে তার বয়সের চেয়ে বয়স্ক মনে হয়।
চার
আক্কাসের মা একদিন সন্ধ্যায় ক্লিনিকে এসেছে। তার সঙ্গে কথা বলছে। ড. আফিয়ার চোখে পড়ল, ময়লা শাড়ি পরা মেয়েলোকটা। তিনি পিয়ন পাঠিয়ে ডেকে আনলেন দুজনকে।
তুমি আক্কাসের মা?
জি। আক্কাসের মা হাত জোড় করে বলে, যেন অপরাধ করেছে।
ড. আফিয়া বলেন, বসো। একটা কথা জিজ্ঞাসা করবো তোমাকে।
আক্কাসের মা চকিতে ছেলের দিকে তাকায়। তার চোখে-মুখে সন্দেহ আর অনিশ্চয়তা।
বুঝতে পেরে ড. আফিয়া বলেন, না, আক্কাস খারাপ কিছু করেনি। কোনো গাফিলতি করেনি এই পর্যন্ত। আমি যা জিজ্ঞাসা করতে চাই তা হলো, ছেলের হাতে তাবিজ বেঁধেছো কেন?
শুনে আক্কাসের মা মুখ কাঁচুমাচু করে। তারপর বলে, হে তো শুকনা। যাতে মোটা হয় তার লাগি তাবিজ পরাইছি।
মোটা হচ্ছে তাবিজ বাঁধার পর? ড. আফিয়া জিজ্ঞাসা করেন কৌতূহল নিয়ে। তাঁর প্রশ্নে সংশয় মেশা।
আক্কাসের মা মুখ নিচু করে বলে, হুজুরে কইছেন আসেত্ম আসেত্ম হইব।
কোন হুজুর?
পীর সাহেব। তার কাছে নিয়া গেছে পাড়ার একজন। তিনি খুবই বুজুর্গ আর কামেল দরবেশ।
ড. আফিয়া বলেন, তাবিজে বিশ্বাস করো তুমি? তোমরা?
জি করি। না কইরা উপায় কী? করণ লাগে। বিপদে-আপদে তাবিজই আমাদের ভরসা। বলে সে ড. আফিয়ার গলায় ঝোলানো স্টেথেসকোপটা একবার দেখে। যেন সাপের মতো গলা জড়িয়ে থাকা ওটার উদ্দেশ্যেই তার এই মন্তব্য।
ড. আফিয়া বলেন, আমি ভিটামিন ট্যাবলেব দেব। নিয়ে যেও। ছেলেকে দুবেলা খাওয়াবে। তারপর বলেন, ধরো আক্কাসের স্বাস্থ্য ভালো হয়ে গেল। সে হৃষ্টপুষ্ট হলো, তখন কী করবে?
আক্কাসের মা বুঝতে না পেরে তাকিয়ে থাকে। তার মুখ হা হয়ে যায়।
ড. আফিয়া বলেন, তখনো তাবিজ বাঁধা থাকবে হাতে?। আক্কাসের মা মাথা চুলকে বলে, হুজুরকে জিগাইতে হইবো।
তারপর বলে, তিনি যা কইবেন তাই হইবো।
আক্কাসের মা চলে যায়। তার হাতে একটা পুঁটলি, মনে হয় দুপুরে যেসব বাসায় কাজ করেছে সেখানে পাওয়া খাবার। বাড়ি নিয়ে যাচ্ছে ছেলেমেয়ের সঙ্গে খাবে। ড. আফিয়া ছোট একটা শ্বাস ফেলেন। নাহ্! তার মতো স্পর্শকাতর মানুষের ডাক্তার হওয়া ঠিক হয়নি।
হেড নার্স বলল, এরা একবার তাবিজ পরলে আর খোলে না। না মরা পর্যন্ত পরে থাকে।
মরার পর! হঠাৎ কথাটা বেরিয়ে যায় ড. আফিয়ার মুখ থেকে।
দাফন-কাফনের সময় খুলে ফেলে। হেড নার্স ওয়াকিবহালের মতো বলে।
তাবিজ-বাঁধা হাতটা ড. আফিয়ার চোখের সামনে হঠাৎ ভেসে ওঠে। যেন শূন্যে ভাসছে। তার দিকে এগিয়ে আসছে। কালো, চিমসে যাওয়া হাতে তাবিজটা বাঁধা। ভেজা ভেজা দেখাচ্ছে। কটু একটা গন্ধ এসে নাকে ধাক্কা দিচ্ছে। সেই গন্ধে পেটের নাড়িভুঁড়ি বেরিয়ে আসতে চায়। ওয়াক থু! বমি করার ভঙ্গিতে ড. আফিয়া সামনে ঝোঁকেন।
একটু পর সামলে নিয়ে তিনি হেড নার্সকে বলেন, আক্কাসকে আমার সামনে আসতে দেবেন না।
হেড নার্স বুঝতে না পেরে একটু অবাক হয়ে তাকিয়ে বলেন, ও কি কিছু বেয়াদবি করছে? ম্যাডাম?
বেয়াদবি? ড. আফিয়ার চোখের সামনে তাবিজ-বাঁধা হাতটা ভেসে ওঠে। যেন সেই ভঙ্গিতে কিছু বলতে চাইছে হাতটা। তিনি চোখ বোজেন। তারপর আসেত্ম আসেত্ম বলেন, না। কোনো বেয়াদবি করেনি। ওর হাতের তাবিজটা দেখে আমার ভেতর যেন কেমন হলো। তারপর স্বগতোক্তির মতো বলেন, দশ বছর হলো,
তাবিজ-বাঁধা হাত দেলেই এমন হয়।
হেড নার্স অবাক হয়ে বলেন, সে-কথা শুনেছি। কিন্তু কেন এমন হয়?
ড. আফিয়া মেঝের দিকে তাকিয়ে বলেন, তা বলে বোঝানো যাবে না। বেশ জটিল।
শুনে হেড নার্স কিছুক্ষণ চুপ করে থাকেন। তারপর বলেন, আপনার কথামতো ফুলহাতা শার্ট কিনে দেওয়া হয়েছে ছেলেটাকে। সে এখন থেকে হাত ঢেকেই চেম্বারে ঢোকে আজকাল।
ড. আফিয়া বলেন, তা বটে। কিন্তু হাতার নিচে তাবিজটা আছে। সেটা তো মিথ্যে না? প্রশ্ন করেই তিনি বিব্রতবোধ করেন। হেসে বলেন, আমার এসব অসংলগ্ন কথা শুনে কিছু মনে করবেন না। মাঝে মাঝেই এমন হয়। যখন তাবিজ-বাঁধা হাত দেখি।
হেড নার্স অন্য নার্সদের সঙ্গে লাঞ্চের সময় ড. আফিয়ার তাবিজভীতি নিয়ে আলোচনা করেন। বেশ হাসাহাসি হয় তাদের মধ্যে এই বিষয়টা নিয়ে। হেড নার্স বলেন, অমন ডাকসাইটে সার্জন, অবলীলায় অপারেশন করেন। তিনি কিনা একটা ছেলের হাতে তাবিজ দেখে ভিরমি খান। কি কা-! অন্য নার্সরা তার সঙ্গে হাসিতে যোগ দেয়। ড. আফিয়াকে নিয়ে আলোচনা করার মতো একটা বিষয় পেয়ে তারা যেন খুশি। যারা কর্তৃত্বে আছেন তাদের দোষ-ত্রম্নটি নিয়ে আলোচনা করতে না পারলে অধস্তনদের পেটের ভাত হজম হয় না, এটা তারা বেশ জানে।
পাঁচ
ড. সামাদ অপারেশন থিয়েটার থেকে বেরিয়ে চেম্বারে ঢুকে বললেন, বুঝলেন ড. আফিয়া, ভালো সার্জন হওয়ার জন্য যে-তিনটা গুণের কথা আমাদের স্যার বলেছিলেন আপনার সে-তিনটে গুণই আছে। মনে আছে সে-কথা?
মনে নেই। বলুন তো সেগুলো কী। ড. আফিয়া হাত থেকে গস্নাভস খুলতে খুলতে বলেন।
প্রথম হলো, ঈগলস্ আই। এই দৃষ্টিশক্তি দিয়ে ক্ষতস্থানের সবকিছু দেখা যায়। দ্বিতীয় গুণ হলো লায়নস হার্ট, যা না হলে অপারেশন করতে গিয়ে হাত কাঁপে। থার্ড হলো, লেডিস ফিঙ্গার। এর দ্বারা সার্জনের রোগীর প্রতি সহমর্মিতা প্রকাশ পায়। এমপ্যাথি। রোগী যে মানুষ, যন্ত্র নয়, এই অনুভব।
শুনে ড. আফিয়া বলেন, তা এত দিনে এ-কথা মনে হলো আপনার? অনেক দিন থেকেই আমাকে দেখছেন।
তা দেখছি। কিন্তু তাবিজ-বাঁধা হাত দেখে আপনার যে ভাবান্তর হচ্ছে তার জন্য এ-কথা মনে হলো।
শুনে ড. আফিয়া বললেন, হু। তারপর আর কী কী বলবেন?
ড. সামাদ বললেন, আজ একটা ইন্টারেস্টিং নাটক হচ্ছে। দেখতে যাবেন?
কোন নাটক? ড. আফিয়া রোগীদের রেকর্ড দেখতে দেখতে অন্যমনস্কের মতো বলেন।
ভ্যাজাইনা মনোলগ। যে-বইটা পড়ার পর আপনি বেশ বিরক্ত হয়েছিলেন। বলে ড. সামাদ দাঁত বের করে হাসতে থাকেন। তারপর বলেন, ঠাট্টা না। ওই বইয়ের ওপর ভিত্তি করেই নাটকটা হচ্ছে। কাগজে খবর পড়ে জানলাম।
আচ্ছা আপনার মাথায় কি এমন বিষয় ছাড়া আর কিছু নেই? ভালো কিছু ভাবতে পারেন না? ড. আফিয়ার ভ্রূকুটি। ভৎর্সনার স্বর।
এটা খারাপ বিষয় বলছেন কেন? ফেমিনিস্ট আন্দোলনের চরম এক দৃষ্টান্ত। মেয়ে হিসেবে আপনাকে আকৃষ্ট করার মতো।
ড. আফিয়া বলেন, জ্বি না। আমি ওই ধরনের ফেমিনিজমে বিশ্বাস করি না।
কোন ধরনের করেন? ড. সামাদের মুখে দুষ্টুমির হাসি।
এই যে চাকরি। পুরুষদের সমান সমান হয়ে কাজ করা। এটাই আমার কাছে রিয়েল ফেমিনিজম। বাকি সব রেটরিক।
ড. সামাদ হেসে বলেন, তাবিজ নিয়ে যে কুসংস্কার, সেটাও কি আপনার ব্র্যান্ড অব ফেমিনিজম!
ড. আফিয়া কিছুক্ষণ চুপ করে থাকেন। তারপর গম্ভীর হয়ে বলেন, না। এটা একটা পোস্ট-ট্রাউম্যাটিক ডিজঅর্ডার। শুনেছেন কন্ডিশনটার নাম?
ড. সামাদ মাথা নাড়েন, না, তিনি শোনেননি।
ছয়
জানালা-বন্ধ ঘরে ছেলেমেয়েরা ঢুকেছে। ক্লাসে এখনো স্যার ঢোকেননি। উঁচু লম্বা টেবিলে ডেডবডিটা রাখা। সটান শুয়ে আছে, দূর থেকে দেখা যায়। কালচে হয়ে এসেছে পোড়া কাঠের মতো। ডোম এসে রেখে গিয়েছে সকালবেলা। মেঝেতে ফরমালডিহাইডের ফোঁটা ফোঁটা ভেজা দাগ। একটা তিতকুটে গন্ধ আসছে ডেডবডিটা থেকে। পেটের ভেতর থেকে বমি আসতে চায় ঠেলে।
ছেলেরা ডেডবডির সামনে গিয়ে পুরুষাঙ্গ দেখিয়ে হাসাহাসি করছে। ছাত্রীদের লক্ষ করেই তাদের এই বিশ্রী কা-। তাদের কেউ কেউ ডাকছে মেয়েদের কাছে এসে দেখার জন্য। মেয়েরা একপাশে জড়ো হয়ে আছে, সংকোচে এবং লজ্জায়। এই প্রথম তাদের ডিসেকশন ক্লাসে আসা। একজন ছাত্রী দূর থেকে দেখেই মূর্ছা গেল। তাকে ধরাধরি করে নিয়ে যাওয়া হলো পাশের ঘরে। নার্স তার দেখাশোনা করছে। ছেলেদের দুষ্টুমি বেড়ে গেল এতে।
প্রফেসর ঢুকলেন একটু পর। সবাইকে কাছে আসতে বললেন। ডেডবডিটা দেখে বললেন, ইয়ংম্যান। মে বি ইন হিজ টোয়েনটিজ। হু বলে তিনি কিছুক্ষণ চুপ করে থাকেন। তারপর ছাত্রছাত্রীদের দিকে তাকিয়ে বললেন, কীভাবে মারা গিয়েছে তা আমরা জানি না। জানার দরকার নেই। এটা বেওয়ারিশ লাশ। এর নাম নেই, গোত্র নেই, আমরা মেডিক্যাল সায়েন্সের সূত্র ধরে এই শব ব্যবচ্ছেদ করব। জানব অ্যানাটমি সবকিছু। যারা সার্জন হবে তাদের জন্য এই অভিজ্ঞতা খুব গুরুত্বপূর্ণ।
ডেডবডিটা ইয়ংম্যানেরই হবে। মেয়েটি খুব তীক্ষনভাবে মনোযোগ দিয়ে দেখছে। ডান হাতের দিকে তাকাতেই চমকে উঠল সে। কালো সুতো দিয়ে একটা তাবিজ বাঁধা।
বেওয়ারিশ লাশ! না। না। এটা বেওয়ারিশ লাশ নয়। মেয়েটি হঠাৎ বলে উঠল। তাঁর একটা পরিবার ছিল, ঠিকানা ছিল। তার মা অথবা স্ত্রী এই তাবিজ পরিয়ে দিয়েছে মানত করে। হয়তো অসুখ থেকে নিরাময়ের জন্য অথবা অশুভ দৃষ্টি থেকে বাঁচাতে। কথাগুলো তার মুখ থেকে স্বগতোক্তির মতো বেরিয়ে এলো। সে দেখছে, ডেডবডিটা নড়েচড়ে উঠছে চোখের সামনে।
মেয়েটি মূর্ছা গেল না কিন্তু দৌড়ে পালাল ঘর থেকে। একটা জীবন্ত মানুষ আসছে পেছনে পেছনে তাড়া করে। মেয়েটি সেই জীবন্ত মানুষের হাত থেকে পালিয়ে দূরে চলে যাওয়ার জন্য দৌড়াচ্ছে কলেজের করিডোর দিয়ে। যেতে যেতে সে অস্ফুট স্বরে বলছে, বেওয়ারিশ না। তার নাম আছে, ঠিকানাও। তাবিজ-বাঁধা হাত তাই বলছে।
প্রফেসর বললেন, এটা খুব কমন। ডেডবডি দেখে ভয় পাওয়া। মেয়েরাই বেশি ভয় পায়। কেউ মূর্ছা যায়। কেউ ক্লাস ছেড়ে সেই যে পালায় আর ফিরে আসে না। ডিসেকশনের জন্য আনা বেওয়ারিশ ডেডবডিই আলাদা করে দেয় কারা কারা ডাক্তার হবে অথবা হবে না। যাকে বলে এসিড টেস্ট। এসো আমরা ডিসেকশন শুরু করি।
সাত
সাইকিয়াট্রিস্ট বললেন, আপনি বেশ ব্যতিক্রমী। পোস্ট-ট্রাউম্যাটিক স্টেস ডিজঅর্ডার সবার জন্যে দীর্ঘদিন থাকে না। তারপর হেসে বলেন, এর অর্থ হলো আপনি খুব সেনসেটিভ। হয়তো সবসময়ই এমন ছিলেন। বলে তিনি হাসলেন।
মহিলার স্বামী পাশেই বসে ছিলেন। পুরনো রোগীর সঙ্গী হিসেবে সাইকিয়াট্রিস্ট তাকে এই সুবিধাটুকু দিয়েছেন। প্রথমবারের পর থেকে প্রতিবারই তিনি স্ত্রীর সঙ্গে সাইকিয়াট্রিস্টের চেম্বারে ঢোকেন। বসে বসে তাদের কথা শোনেন।
মহিলার স্বামী বললেন, এতো বছর হয়ে গেল এখনো এই রি-অ্যাকশন হচ্ছে, এটা কি খারাপ কিছুর দিকে যেতে পারে? মানে আরো কঠিন কিছু হতে পারে?
সাইকিয়াট্রিস্ট হেসে বললেন, তেমন কোনো সম্ভাবনা আছে বলে আমার মনে হয় না। কেননা আপনার স্ত্রী ঘরে বসে বসে স্মৃতিচারণ করছেন না। শি হ্যাজ এ ভেরি অ্যাকটিভ লাইফ।
তাহলে এত পুরনো বিষয়, প্রায় দশ বছর আগে, এটা বারবার ফিরে আসছে কেন?
সাইকিয়াট্রিস্ট বললেন, সাইকি বোঝেন? আপনার স্ত্রীর সাইকিতে ঢুকে গিয়েছে ওই সিম্বলটা। ওটা দেখলেই তার ভেতর এই রিঅ্যাকশন হয়। মানে তার পোস্ট-ট্রাউম্যাটিক ডিজঅর্ডার ফিরে আসে। এটা বেশি আনইউজুয়াল, কেননা এত দীর্ঘদিন এই মানসিক অস্থিরতা থাকার কথা না। তাহলে বোঝা যাচ্ছে ব্যাপারটা ব্যক্তিত্ব-নির্ভর। অর্থাৎ সবার ক্ষেত্রেই এমন হয় না। বিশেষ ব্যক্তিত্বের অধিকারীদের জন্যই এটা প্রযোজ্য। বেশ ইন্টারেস্টিং। তারপর কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, আমি একে ভয় বলব না। বিবমিষা, ইয়েস। নিজের ওপর চাপানো অপরাধবোধ থেকে আসে এই প্রতিক্রিয়া। যদিও অপরাধটা তার একার না, কালেকটিভ। যার সামষ্টিক দায় তিনি তাকেই ব্যক্তিগত পর্যায়ে নিয়ে আত্তীকৃত, অর্থাৎ ইন্টারনেলাইজ করে ফেলেছেন। অ্যাসোসিয়েশনের ইফেক্ট থেকে অপরাধবোধটা জেগে ওঠে মাঝে মধ্যে। বিশেষ করে যখন সিম্বলটা তিনি দেখেন।
মহিলার স্বামী বললেন, এই নিয়ে চারবার বাড়ির কাজ-করা ছেলে বদলানো হয়েছে। অবশ্য তাদের ক্ষতিপূরণ দিয়ে দেন আমার স্ত্রী। শি ইজ নট আনকাইন্ড। অফিসের কথা আলাদা। সেখানে ইচ্ছা করলেই কাউকে বরখাস্ত করতে পারে না সে। শি সাফার্স।
সাইকিয়াট্রিস্ট বললেন, তিনি বলেছেনে আমাকে। একটা গুড সাইন হলো একইভাবে রিঅ্যাক্ট করছেন। নতুন কোনো রিঅ্যাকশন হচ্ছে না। একটা প্যাটার্ন তৈরি হয়েছে।
মহিলার স্বামী বললেন, আমি বেশ চিন্তিত। এতদিন হয়ে গেল …।
সাইকিয়াট্রিস্ট উঠে বললেন, চিমত্মার কিছু নেই। তিনি অ্যাবনরমাল কিছু করছেন না। আমাদের সবার অপরাধের কথা জানিয়ে দিচ্ছেন। দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতার কথা বলছেন। তারপর তিনি বেশ গম্ভীর হয়ে বলেন, আশ্চর্যের কি জানেন, এই অসুখটাকে আমরা বিচ্ছিন্নভাবে দেখি। এর আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষিত সম্বন্ধে ভাবি না।
শুনে মহিলা মুখ তুলে বললেন, না, আমি কাউকে দোষারোপ করিনি কখনো। আই অ্যাম টু স্মল ফ্রাই টু কমপেস্নইন অ্যাগেইনস্ট অ্যানিওয়ান। বিশেষ করে সিস্টেমের বিরুদ্ধে।
সাইকিয়াট্রিস্ট বললেন, সিস্টেমের প্রসঙ্গ এসে যাচ্ছে। সিস্টেম না বদলালে আপনার মতো আরো মানুষের মধ্যে এ ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখা দেবে। তারপর একটু ভেবে বললেন, আপনার নাম না বলে আমি কি একটা কেস স্টাডি লিখতে পারি? আন্তর্জাতিক এক সম্মেলনে পড়ব। যদি অনুমতি দেন তাহলে আপনার বিষয়টা নিয়ে আমি পেপার লিখতে পারি।
মহিলা বললেন, অবশ্যই। আমাকে বলবেন আমি নিজে থাকব সেই কনফারেন্সে।
তার স্বামী অবিশ্বাসের চোখে তাকালেন। বোঝা গেল তার এই বিষয়টা পছন্দ হচ্ছে না।
মহিলা উঠতে উঠতে বললেন, আমরা একজন অনেক কিছু করতে পারি না, কিন্তু অন্তত ভয়েসটা তুলে ধরতে পারি। কেউ না কেউ, কখনো না কখনো শুনবে সেই ভয়েস।
ফেরার পথে স্বামী জিজ্ঞাসা করলেন, তোমার কী হয়েছে বলো তো? তুমি রাজি হয়ে গেলে? এতো জটিলতার মধ্যে গিয়ে কী হবে। কারো কিছু আসে-যায় না।
মহিলা বললেন, সেটাই তো সমস্যা।