– শুন তনু, আমি তোমাকে ভালবাসি ।
-কি বলছেন আরিফ ভাই ! আমাকে আপনি ভালোবাসেন !! আপনার সাইজ দেখছেন ? আপনার যে সাইজ তাতে কোন মেয়ে আপনার সাথে প্রেম করা তো দূরে থাক । আপনারে কেউ বিয়ে করবে কিনা তাতেই আমার সন্দেহ হয় । বলেই হাসতে হাসতে তনু বসে পড়লো ।
মেজাজ চরমে উঠে গেল । তনুকে হাসতে দিয়ে আমি রিক্সা ডেকে বাসায় চলে আসলাম । প্রথমে তনুর কথা শুনে মেজাজ খারাপ হলেও বাসায় আসতে আসতে ভাবলাম তনুর বলা কথাগুলো শুনতে খারাপ লাগলেও সত্যি । আমার শরীরের ওজন ১০৪ কেজি । এতো চেষ্টা করি তারপরেও ওজন কমাতে পারছিনা । জিমেও গিয়েছিলাম কয়েকদিন । কিন্তু ওরা যে ব্যায়াম গুলো করতে দেয় সেগুলো কয়েকদিন করেই আমি অসুস্থ হয়ে গেছি । তাই জিমে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে আম্মা । আজকে থেকে আমি আবার জিমে যাবো । খাবার দাবার সব বন্ধ । বাসায় এসেই নিজের রুমে ঢুকে দরজা দিলাম বন্ধ করে ।
– আরিফ বাবা, ভাত খেতে আয় ।
– আম্মা আমি ভাত খাবনা ।
– সে কি ! কেন ? দুপুর দুইটা বেজে গেছে । সেই কোন সকালে একটা রুটি খেয়ে বাহিরে গেছিস । বাহিরে কি খাইছিস?
– কিছু খাই নাই আম্মা । আমি আজকে থেকে দুই বেলা খাবো । সকালে একটা রুটি আর রাতে দুইটা রুটি সবজি দিয়ে – এই সব কি বলিস বাবা !! এই রকম করে খেলে তোর শরীর খারাপ হয়ে যাবে রে । লক্ষ্মী আব্বা দরজাটা খোল । আজকে আম্মা তোর পছন্দের মুড়ি ঘণ্ট করেছি । আর তুই বলছিস খাবি না !!
– আম্মা যাও তো ; যতই আমাকে লোভ দেখাও কোন লাভ হবে না । আমি ঠিক করেছি এই রকম ভাবেই খাবো । আম্মা আরো কিছুক্ষন চিল্লাচিল্লি করে চলে গেলেন । আমার খুব ক্ষিদা ও লেগেছে । কিন্তু যতই ক্ষিদা লাগুক আমি খাবো না । কয়েকদিন পরে এইটাই আমার অভ্যাস হয়ে যাবে । ঘুমিয়ে যাই তাহলে আর খাবারের কথা মনে হবে না । কিছুক্ষন পরেই আবার দরজায় দুমদুম শব্দ হতে লাগলো । আমি বিরক্ত হয়ে চিৎকার করে বললাম – আম্মা কি হইছে ? এমন করো কেন ?
– এই গোলটা দরজা খোল । তোর সাথে আমার গোপন কথা আছে ।
– দরজা খোলা লাগবে না আপা। কি গোপন কথা বাহিরে থেকে বলে বলে চলে যা ।
– এইরকম চিৎকার করে কথা বললে সেটা গোপন থাকে !! খোল দরজা । আমি নিরুপায় হয়ে বিছানা থেকে উঠে দরজা খুলে দিলাম । মানুষের বড় বোনেরা নাকি ছোট ভাইদের কত আদর করে । আর বড় বোন ঠিক উল্টা । সারাক্ষন আমারে জ্বালাইয়া মারে । শান্তি নাই আমার ।
– কি গোপন কথা তাড়াতাড়ি বলে যা তো আপা ।
– কি হইছে তোর ? তোর নাকি মাথা খারাপ হয়ে গেছে ।
– কি যা তা বলছিস ? আপা শুন আমার এমনেতেই মন মেজাজ খারাপ । তুই এখন গায়ে পড়ে কেন ঝগড়া করতে আসছিস ?
– আম্মা আমাকে ফোন করে কান্নাকাটি করে ভার্সিটি থেকে বাসায় আনলো তোর জন্য । আর তুই বলছিস আমি তোর গায়ে পড়ে ঝগড়া করতে আসছি !! তুই নাকি আজকে থেকে সব খাবার দাবার ছেড়ে দিয়েছিস ?
– হ্যাঁ ; আমি আজকে থেকে কঠিন ভাবে ডায়েট করবো । ১০৪ কেজি থেকে আমি আমার ওজন ৬০ কেজি তে নিয়ে আসবো । আদনান সামি যদি তাঁর এতো মোটা শরীর কমিয়ে চিকনা হইতে পারে তাহলে আমি কেন পারবোনা । আমাকে পারতেই হবে ।
– সব কিছুই বুঝলাম কিন্তু কেন হটাৎ এই কঠিন ডায়েট সেই গোপন কথা শুনতে আসছি আমি । তাড়াতাড়ি বল । আমার সময় কম ।
– আপা কারন লাগবে কেন বল ? আমি কি বিচ্ছিরি দেখতে । রাস্তায় বের হইলে মানুষ আমাকে ঘুরে ঘুরে দেখে । নিজের শরীর নিয়ে এক রিক্সায় কারো সাথে বসতে পারি না ।
– কেন আমি আর আম্মা দুইজনেই তো তোর সাথে রিক্সায় করে বাহির হই ।
– আপা শুন ; তোরা বাহির হবি কিন্তু অন্য কেউ তো হবে না ।
– আচ্ছা তো এই ব্যাপার । তনু তোকে কিছু বলেছে ?
– হ্যাঁ বলেছে । বলেছে আমার যে সাইজ তাতে আমার সাথে কোন মেয়ে প্রেম করা তো দূরে থাক কেউ নাকি আমাকে বিয়েই করবে না । জানিস আপা বলেই তনুর কি হাসি ।
– এই তনুকে আমার প্রথমেই ভাল লাগে নাই । বাদ দে ঐ মেয়ের কথা । দেখিস এর থেকে ভাল মেয়ে আমরা তোকে বিয়ে করাবো । লক্ষ্মী গোলটা ভাই আমার । আয় ভাত খেতে আয় । আম্মাও ভাত না খেয়ে বসে আছে । আমারও ক্ষিদা লাগছে ।
– না আপা আমি বলছি খাবো না তো খাবো না । তুই আর আম্মা খা ।
– দেখ এই জন্য তোর সাথে আমার ঝগড়া লাগে সবসময় । কোথাকার কোন মেয়ে তোকে কি বলল না বলল তাঁর জন্য তুই তোর বোন আর মাকে না খাইয়ে রাখবি এখন ? আর শুন এই যে তুই শুকাইতে চাইছিস । তুই জানিস শুকাইলে তোকে দেখতে কতো খারাপ লাগবে ? তোকে এখনি দেখতে ভালোলাগে বিশ্বাস কর গোলটা ভাই আমার ।
– তুই আমাকে আর গোলটা বলবি না আপা । আমি মোটা দেখে তুইও আমাকে গোলটা বলিস
– ধ্যাত পাগল মোটা বলে গোলটা বলি কে বলল তোরে ? এই যে তুই বসে আছিস গোল হয়ে তাই তোকে গোলটা বলি । আর যদি তুই শুকিয়ে লাঠি লাঠি হয়ে যাস তাহলে ভাব তোকে কি ভয়ংকর লাগবে । আর পাঁচ দিন পরেই আমার বিয়ে । মেয়েরা বিয়ের দিন যায় পার্লারে আর আমি যাবো হাসপাতালে । কি কপাল আমার ।
– সে কি আপা ! বিয়ের দিন তুই হাসপাতালে যাবি কেন ?
– এই যে তুই কিছু খাবি না । তুই না খেলে আম্মাও খাবে না । আম্মা না খেলে আমিও খাবো না । আর পাঁচ দিন এমন না খেয়ে থাকলে তো হাসপাতাল ছাড়া গতি নাই রে । আমি রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে খাবার টেবিলের সামনে এসে আম্মাকে ডেকে বলতে লাগলাম – আম্মা , আম্মা সবসময় আমি তোমার আর এই আপার জন্য ডায়েট করতে পারি না । আপা তো চায় শুধু তাকে ভালো দেখতে লাগুক । আর আমাকে নিয়ে সবাই হাসুক । কিন্তু তুমি তো আমার আম্মা । তুমিও কেন আমাকে ডায়েট করতে দেও না ? এই রকম ব্ল্যাকমেইল করে সবসময় আমাকে খাইয়ে দেও । আম্মা আমার মাথায় হাত দিয়ে বললেন – পাগল ছেলে, তুই তো জানিস তোর হরমোনের সমস্যা আছে । তুই বেশি ডায়েট করলে অসুস্থ হয়ে যাস । কি দরকার বাবা তুই শুকানোর ? তুই যেমন আছিস তেমনি ভালো । শুধু সুস্থ থাকলেই হবে ।
আজকে আপার বিয়ে হয়ে গেলো । কিছুক্ষন আগেই আপা চলে গেলো । আপা কে নিয়ে যাবার সময় আম্মা আর আব্বার সেকি কান্না । এতো কান্নার কি আছে আমি বুঝি না । আপা আম্মাকে বারবার আমার কথা জিজ্ঞাসা করছিলো । আমি ইচ্ছা করেই সামনে যাই নাই । সামনে গেলেই আমাকে ধরেও কিছুক্ষন কান্নাকাটি করতো । উফ ; আমার চোখে কি যে হল !! শুধু শুধুই চোখ দিয়ে পানি পড়ে । মনে হয় চোখের নার্ভেও সমস্যা হচ্ছে । এতোদিন তো কোন সমস্যা হয় নাই । আপাকে নিয়ে যাবার পর থেকেই শুধু পানি পড়ছে । বিরক্তকর ! আজকে আপার বৌ ভাত । আমি সাধারণত বেশি মানুষের জায়গায় যেতে চাইনা । আজকেও আসতে চাই নাই । কিন্তু আপা ফোনে এমন করতে লাগলো । নিরুপায় হয়ে আপার কিনে দেয়া পাঞ্জাবি পরেই আসলাম ।
– এ বাবা কে রে এই ছেলে ? এতো একাই আমাদের সব খাবার খেয়ে ফেলবে ।
– আস্তে বল এ হলো আমাদের নতুন ভাবীর ভাই ।
– ওহ ! তাহলে তো আমাদের বেয়াই হবে আস্তে বলার কি ! আমি কি মিথ্যা বলছি ? বলেই ছেলেগুলো আমার কাছে এগিয়ে এলো ।
– কি বেয়াই কেমন আছেন ?
– আছি ভালো ।
– বেয়াই বাসার সব খাবার কি আপনি একাই খেতেন নাকি ? না মানি আপনার আপা , বাবা, মা সবাই তো দেখি ঠিক আছে । শুধু আপনিই বলেই ছেলে্গুলো হা হা করে হাসতে লাগলো । একজন পাশ থেকে বলে উঠল – আল্লাহ জানে খাবারে টান পড়ে নাকি ।
ইচ্ছা করলো থাপড়ায়ে সবগুলার দাঁত ফেলে দেই । কিন্তু কিছু করাও যাবে না, কিছু বলাও যাবে না । কারন এরা আপার শশুর বাড়ির আত্মীয় । আমি এখন কিছু বললেই পরে যদি আপাকে কথা শুনতে হয় । আমি সোজা হেঁটে স্টেজের কাছে চলে গেলাম । সবাই আপা আর দুলাভাইর সাথে ছবি তুলছে । আমি আগেই ঠিক করেছি উপরে যাবো না । তাই পাশে দাঁড়িয়ে আপাকে দেখছিলাম । কি সুন্দর লাগছে আপা কে । এমন সময় আপা স্টেজ থেকে নেমে এসে আমার হাত ধরে টেনে আমাকে উপরে নিয়ে গেলো । আমি ওদের পাশে দাঁড়াতেই সেই ছেলেগুলো চিৎকার করে বলে উঠল – সাবধানে সাবধানে স্টেজ ভেঙ্গে যেতে পারে । ওরা এইকথা বলতেই সামনে দাঁড়ানো সকলে হো হো করে হাসতে লাগলো । অপমানে আমার চোখে পানি এসে গেলো । আমি কিছু বুঝে উঠার আগেই দেখি আপা সেই ছেলেটির হাত ধরে বলল – তুমি আমার সম্পর্কে কি হবে ? ছেলেটি একটু ভ্যবাচেকা খেয়ে গেলো । আমতা আমতা করে বলল – আমি আপনার খালাতো দেবর ।
– আচ্ছা তো দেবর সাহেব এক কাজ করুন আপনি এখনি আমার ছোট ভাইয়ের কাছে মাফ চাইবেন ।
– কি আজব মাফ চাইবার কি হল !! আমি মজা করছিলাম বেয়াইর সাথে ।
– আমিও ভাবি হিসেবে আপনার সাথে মজা করছি । বলেই আপা ঠাস করে ছেলেটির গালে থাপ্পড় মেরে দিল । আম্মা দৌড়ে এসে বলল কি করছিস কনা !! হায় হায় কি বলবে তোর শশুর বাড়ির সকলে ?
– কি বলবে আম্মা ? কি সাহস এই ছেলের ? আমি কিছুক্ষন আগেও দেখলাম এই ছেলেগুলো ভাইকে কি বলছে আর হাসছে । নিশ্চই মোটা নিয়েই হাসছিল । বেয়াদপ কে এভাবেই শিক্ষা দিতে হয় । আমার ভাই আমার বাপের খায় তাতে মানুষের এতো গায়ে লাগে কেন ? যারা মোটা তারা নিজেদের শরীর নিজেরা নিয়ে হাঁটে তাতে অন্য মানুষের এতো গায়ে লাগে কেন ? সবসময় মোটা মানুষ দেখলেই কিছু মানুষ এমনভাবে কথা বলে , এমনভাবে তাকায় যে ঐ মানুষগুলো নিজেদের কে নিয়ে লজ্জায় পড়ে যায় । কেন ভাই এমন কেন ? সবাইকে একরকম হতে হবে কেন ? শুধু লিখাপড়া শিখলেই শিক্ষিত হওয়া যায় না । মানুষকে সন্মান ও করতে জানতে হয় । আমার ভাইকে আমার সামনে কেউ অপমান করবে আর আমি চুপ করে থাকবো সেটা তো হতে পারে না । আমার ভাই আমার কাছে পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর । বলেই আপা ঝরঝর করে কেঁদে দিলো । আমি দৌড়ে গিয়ে আপাকে জড়িয়ে ধরে বললাম
– আপা কি করছিস ? কাঁদছিস কেন ? একদম কাঁদবি না । তোর মুখের সব মেকাপ তো নষ্ট হয়ে যাচ্ছে । পরে চোখের কাজল লেপটে গেলে দুলাভাই তোকে দেখলে ভয় পাবে তো । দুলাভাই এগিয়ে এসে আপার দিকে তাকিয়ে বলল – তাইতো আরিফ, দেখ তোমার আপা কে দেখতে ভুতের মতো লাগছে । আপা কাঁদতে কাঁদতেই হেসে দিলো ।
গল্পের বিষয়:
গল্প