আজ আমার হাজবেন্ড মোটা-সোটা একটা থাপ্পড় দিয়েছে। এক থাপ্পড়ে গালে আমার পাঁচ আংগুল বসে গেছে। মেয়েদের প্রথম ভালবাসা আর স্বামীর কাছ থেকে প্রথম থাপ্পড় সেটা কখনো ভোলা যায় না। তেমনি আমিও ভুলতে পারছিনা।বিয়ের প্রথম ও জীবনের প্রথম থাপ্পড় খেলাম। যে আমি কলেজের সবার ক্রাশ ছিলাম, সে কিনা থাপ্পড় খাবে, আলতু-ফালতু লোকের কাছ থেকে? নো ওয়ে! এটা কখনই হতে পারেনা। আমার কি দোষ ছিল, আমি শুধু শাওনকে রাত ১২ টার সময় বলেছিলাম পিজ্জা খাবো বলে। সে আমাকে “মোটা” বলে ইনসাল্ট করলে, তাকে আমি “হারামজাদা” বলে গালি দেই। কিন্তু এত ছোট-খাঁটো বিষয়ের জন্য থাপ্পড়? তা আমি মানতে পারছিনা। পুরুষ জাতি নিজেকে মনে করেটা কি হুমম? যা ইচ্ছে তা করবে? আর সব মেয়ে বলে মুখ বুঝে সহ্য করবো! না তা আমার মতো ডিজিটাল মেয়ে কখনই হতে দিবেনা। নিজের মনের সাথেই কথা বলছে তামান্না। চোখে অঝোরে কান্না। টিপটিপ বৃষ্টির মতো পড়ছে।
এতো সুন্দর চেহারায় পাঁচ আঙ্গুল বসে আছে। আয়নায় সেটা দেখে ফুঁপিয়ে কেঁদেই চলেছে। কেউ গাল দেখলে ভাববে, ভূতের আঁচড় বলে। এবার, সকালে মুখ দেখাবে কী করে! ছোট বাচ্চারাও হা হা হা করে আংগুল দেখিয়ে হাসবে। মুখটা ফোলা ফোলা লাগছে? ওমা মুখটা যে ফুলে গেলো। সেটা ভেবেই কান্নার মাত্রা বাড়িয়ে দিলো তামান্না। রাত ১২টায় মুখের ১২টা বাজিয়ে দিলো। পিজ্জা খাওয়াতো হলোই না, উল্টো থাপ্পড় খেলাম। ভাগ্যিস সাইনিজ খাওয়ার কথা বলিনি! না হলে তো বরের কাছ থেকে লাত্তিও খেতাম। তামান্না হাজবেন্ড এই নিয়ে অনেকবার সরি বলেছে, কিন্তু তামান্না সেটা কানে নেয়নি। নিবে বা কেন? থাপ্পড় বলে কথা। তামান্নাও শাওন’কে মুখের উপর বলে দিয়েছে, থাপ্পড়ের বদল থাপ্পড়, খুনের বদল খুন। কিন্তু বর থাপ্পড় খাবেনা সেটা বলে দিয়েছে কারণ, থাপ্পড়ে নাকি হাজবেন্ডের এলার্জি থাকে।
তাই তামান্না আর দমছে না। কিন্তু এতো রাতে যাবেই বা কোথায়? যাই হোক না কেন আজিজুল হক শাওন মানে তার হাজবেন্ডকে ডিভোর্স দিয়ে ছাড়বে, এই থাপ্পড়ের জন্য। তাহলে, পুরুষ জাতির উচিৎ শিক্ষা হবে। কেউ কোনোদিন তার নতুন স্ত্রীকে হাত তুলতে সাহস করবেনা। সবাই উদাহরণ দিবে তামান্না আপার। তামান্না নারী নির্যাতন আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক। তার সাথে এই এমন হলে, সাধারণ মেয়েদের কোন অবস্থা হবে। আজিজুল হক শাওনকে থানার ভাত যদি না খাইয়ে ছাড়ছি, তাহলে আমার নামই তামান্না না। এত রাতে করবে টা কি! এখান থেকে বেরিয়ে যাবেই বা কোথায়? যেখানে থাপ্পড় খাওয়া হয়, সেখানে থাকা তো যায় না। লজ্জার বিষয়।
তামান্নার বিয়ে হয়েছে তিনমাস হতে চলল। চাকরীর সুবাদে ঢাকার বাড্ডায় থাকা। হাজবেন্ডের জন্য চলে এসেছে, এখানে। নিজের এলাকায় থাকলে বাপের বাড়ি চলে যেতে পারত সে। আর রাতের বেলা মাস্তান থেকে বড় ভয়, কুকুরের। কুকুরের কামড় যে বড়ই বেদনার। দেখা গেল, থাপ্পড়ও খেলো সাথে বোনাস হিসেবে কুকুরের কামড়ও। আর হাজবেন্ড চালিয়ে দিবে, মুখে কুকুরের থাপ্পড় বলে। কিন্তু এখন? বাড্ডাতে কে আছে, যার কাছে এখন যাওয়া যায়। হঠাৎ মনে পড়ে, তামান্নার বান্ধবী সালমার কথা। সালমা! যে ক্লাসে ক্ষেত ছিল। যার দিকে কোনো ছেলেই কোনোদিন তাকাতো না। সারাক্ষণ তামান্নার পিছেপিছে থাকত। আর তার নাকি বিয়ে হয়েছে এক ব্যবসায়ীর সাথে। যে অনেক টাকার মালিক। হীরে জহরতে আগাগোড়া মোড়া থাকে সালমা সারাদিন। ঢাকায় আলিশান নিজের বাড়ি আছে তাদের। আবার সালমার নামে একটা গাড়িও আছে। গাড়ির নাম সালমা, শুনতেই অদ্ভুত। এত সুখ যে সালমার, তামান্নাদের ক্লাসের সবাই তাকে হিংসা করে। আর তামান্না সবার ক্রাশ হয়েও, থাপ্পড় মার্কা হাজবেন্ড পেল। কপালটা বড্ড খারাপ!
দরজা বন্ধ করে রেখেছে তামান্না। ঠুক ঠুক শব্দ হচ্ছে, নারী নির্যাতন কারী হাজবেন্ডের। কিন্তু তাতে কোনো মনোযোগ নেই তামান্নার। তামান্না আঁচল দিয়ে তার চোখের পানি মুছে, ফোন দিলো সালমা’কে। কয়েকবার রিং বাজতেই ফোন ধরল, নাম্বার ওয়ান সুখী সালমা। ফোন ধরে ঘুম চোখে সালমা বলল,” হ্যালো! কে?” তামান্না কান্না ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো বান্ধবীর কণ্ঠ শুনে। কান্না করে বলল,” বান্ধবী! ই ই ই..” সালমা এবার নড়েচড়ে বসল। বেক সুইচ দিয়ে আলো জ্বালিয়ে দিলো। বিছানায় বসে চিন্তিত স্বরে এক নাগাড়ে বলল,” বান্ধবী! কী হয়েছে তোর? কাঁদছিস কেন?” তামান্না দুঃখ ভারাক্রান্ত হয়ে বলল,” আজিজুল হক শাওন মানে আমার হাজবেন্ড আমাকে কষে থাপ্পড় মেরেছে রাত ১২টা ৫৩ সেকেন্ডে। ই ই ই..”
– কি! তোর হাজবেন্ডের এত বড় সাহস? আমার বান্ধবীর গালে থাপ্পড়! আজ যদি আমার হাজবেন্ড থাপ্পড় দিতো, তাহলে আমি তাকে, ঠ্যাং ভাঙ্গিয়ে হাতে ধরিয়ে দিতাম। পাশে শোয়া হাজবেন্ড মাহমুহ ঠ্যাং ভাঙ্গার কথা শুনে নিজের পা দ্বয় চাদরে গুটিয়ে নিলো। তামান্না কান্না মুছতে মুছতে বলল: আমি এখন কি করবো বান্ধবী! আমার তো মান ইজ্জৎ গেলো বলে!”
সালমা উত্তর দিলো: তুই আমার বাসায় চলে আয়। আমি গাড়ি পাঠাচ্ছি। আর কাল সকালে তোর হাজবেন্ডের নামে থানায় মামলা দেবো। যে তামান্না তুই আমাদের ক্লাসের এক নম্বর মেয়ে ছিলি, সে মেয়েকে এক নম্বর থাপ্পড় দিলো কোন সাহসে? চলে আয় বান্ধবী চলে আয়। তামান্নার এক নম্বর কথাটা শুনে পুরো শরীরে আগুন লেগে যায় তার। সে পুরো শরীর তেতিয়ে বলল: ওকে বান্ধবী আসছি! এই সংসার আর করবোনা। লাত্তি মারি সংসারের! তুই তাড়াতাড়ি আমার ঠিকানায় গাড়ি পাঠিয়ে দে। আমি সব কাপড়-চোপড় নিয়ে নিচ্ছি। সালমা ফোন রেখে নাইট ড্রেসের ফিতা বাঁধতে বাঁধতে ফোন দিলো ড্রাইভার রহিম কাকার কাছে। তাকে কড়াভাবে বলে দিলেন, তামান্নাকে পাঁচমিনিটের মধ্যে নিয়ে আসার জন্য। তার বান্ধবীর গালের উপর পাঁচ আঙ্গুল, তা সে মানতে পারছে না।
রহিম কাকা গাড়ি নিয়ে চলল, তামান্নাদের বাড়িতে। এদিকে, তামান্না কান্না থামিয়ে সব কাপড়-চোপড় অলংকার সব একটা কালো ব্যাগে প্যাক করল। তারপর, ব্যাগের চেন্ট লাগিয়ে কাঁধে নিয়ে চলল বাইরে যেতে। দরজা খুললে বর দেখে তামান্না রাত ১ টায় চলে যাচ্ছে কোথায় যেন? সে সামনে গিয়ে বলল,” প্লিজ! কীসব পাগলামি করছো! এতো রাতে কোথায় চললে। আমার ভুল হয়েছে। পুরুষ মানুষ মানেই ভুল। প্লিজ! আমাকে ক্ষমা করো। এরকম আবলামী করোনা। সংসারে টক-ঝাল থাকবেই। তাই বলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাবে?” তামান্নার হাতটা ধরলে, তা ছাড়িয়ে তামান্নাও পাল্টা জবাব দিলো: নিকুচি করি তোর সংসারের। কালকে সকালে বুঝবি, পাঁচ আঙ্গুল বসানো কাকে বলে। তোকে বউ এর রেপ কেস এর আসামী যদি না বানাই, আমার নাম ক্রাশ তামান্না না।
– আমি কখন রেপ করলাম? থাপ্পড় একটা শুধু আদর করে মারলাম!…
– থাপ্পড় -ই পৃথিবীর বড় রেপ! আজকে থাপ্পড় অন্য দিন খুন! ভাবিস!
দেশে আইন নেই। তোকে দেখাবো থাপ্পড় কাকে বলে। ডিভোর্স পেপার পেয়ে যাবি ওয়ারেন্ট কাগজের সাথে। এবার বর আর শান্ত থাকতে পারেনা। সেও মেঘের মতো গর্জে উঠে বলে,” যা, যা, যা! কী আর করবি দেখবো। তোর মতো বউ থাকার চেয়ে বিধবা হয়ে মরা ভালো। জেলে ঢুকতে রাজি, কিন্তু তোকে আর ঘরে তুলতে রাজি না। আমার ঘর থেকে বেরিয়া যা।”
তখন রহিম কাকার সালমা গাড়ি হর্ন বাজিয়ে উঠল। হর্ন শুনার সাথে সাথেই তামান্না এক দৌড়ে গাড়িতে গিয়ে উঠল। গাড়িতে উঠতেই হাজবেন্ডের বাড়ি দূরে চলে যেতে লাগলো তার থেকে। বেলকনি দিয়ে চলে যাওয়া দেখতে লাগল, হাজবেন্ড। দীর্ঘশ্বাস ফেলল একটা বড়সড়। তামান্না গাড়িতে উঠতেই মনে পড়ল, বিয়ের আগের সুখের ঘটনা গুলি। কতইনা সুন্দর ছিল জীবন। বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেয়া, তার পিছেপিছে ছেলেদের চলা, র্যাগিং। ইশ্! কেন যে বিয়ে হলো ভেবে পায় না সে। চারতলা আকাশীরং এর বাড়ি। গেইট বরাবর আসতেই দারোয়ান দরজা খুলে দিলো। সব দেখে আফসোসে ডুকরে কেঁদে উঠে তামান্নার মন। যদি সালমার জায়গায় থামান্না থাকত, কতই না আনন্দ হতো! জীবনটাই বেদনার। হায়রে! অথচ বান্ধবীর বাসায় আসছে, মুখে পাঁচ আংগুল নিয়ে সে।
গাড়ি থেকে নেমেই ডোর বেল দিতেই নাইটি ড্রেসে বেরিয়ে এলো সালমা। তামান্না গুমড়ো মুখো হয়ে তাকিয়ে আছে সালমার দিকে। সালমা ছোটবাচ্চার মতো গাল দেখে বলল: হায়রে! গালের তো ১২টা বাজিয়ে দিয়েছে। কী যে স্বামী পেলি বুঝিনা বাপু। আমার হাজবেন্ড মাহমুদ আমার কথায় উঠেও, বসেও। সালমার কথা শুনে এক আকাশ কষ্ট হতে লাগল তামান্নার। পরনে সাদা-মাটা শাড়ি। তা দেখে সালমা বলে: একি হাল হয়েছে তোর! আয়নাই মুখ দেখেছিস! তোকে যে চিনাই যায় না। তারপর, তামান্নাকে ভিতরে নিয়ে একটা রুমে নিয়ে যায় সালমা। আর বলল: রাত প্রায় দুটো। এখানে ঘুমিয়ে যা। সকালে যা হবার দেখা যাবে। আর আমি খাবার গরম করছি, নো প্রবলেম। তামান্না জানালো থাপ্পড় খাওয়ার পর, তার পেটে ক্ষুধা নেই। সালমা চলে গেল।
তামান্না শুয়ে আছে আর ভাবছে, জীবন থাকে কিছুই দেয়নি। সব দিয়েছে সালমাকে। সেগুলো ভেবেই চোখ ভিজে বালিশ ভিজে যায় তার। চোখে ঘুম লেগে আসবে, ঠিক তখন, চেঁচামেচি আর ভাঙ্গা-ভাঙ্গির শব্দ। দরজা খুলে এগিয়ে গিয়ে দেখে, সালমা আর তার হাজবেন্ডের তুমুল ঝগড়া। বিষয়, মাহমুদের ফোনে কোনো এক মেয়ের এতো রাতে ম্যাসেজ। দেখতে দেখতে তারা মহাযুদ্ধ লাগিয়ে দিয়েছে। কিল, লাত্তি, গালিগালাজ, শেষমেশ টেবিলের উপর রাখা কাঁচের গ্লাস বসিয়ে দিয়েছে, সালমার মাথায়। সালমা ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয় হাজবেন্ডকে ড্রেসিংটেবিলের আয়নার উপর। ভেঙ্গে চুরমার একদম সব। অনেক চেষ্টার পর থামাতে পারল না তামান্না। তারপর, দুজনে রক্তাক্ত শরীর নিয়ে মেঝেতে শুয়ে শুয়ে এগোতে থাকল দেয়ালে ঠাঙ্গানো বন্দুকের দিকে। তামান্না উপায়ন্তর না দেখে ৯৯৯ এ ফোন দিয়ে পুলিশ ডাকল। ততক্ষণে বন্দুক পেয়ে গেল মাহমুদ। ফায়ার করতে লাগল ঘরে। তামান্না আর সালমা দুজনেই ভয়ে খাটের নীচে লুকিয়ে রইল।
সালমা সুযোগ পেতেই পিছন দিক থেকে হামলা করল হাজবেন্ডের উপর। মাথায় মোটা কিছু দিয়ে আঘাত করল। দুজনেই রক্তাক্ত অবস্থায় মেঝেতে পড়ে রইল। খাটের তলা থেকে এসব দেখে কাঁপতে কাঁপতে শেষ তামান্না। স্বামী -স্ত্রী দুজনেই অজ্ঞান। পুলিশ না জানি অপরাধী ভেবে তামান্নাকে ধরে যদি নিয়ে যায় তাহলে…? এম্বুলেন্স একটাকে আসতে বলে পালানোর সিদ্ধান্ত নিলো সে। দারোয়ান সামনে আছে, তাই সে শাড়ি পেছিয়ে বেলকুনি দিয়ে চোরের মতো, এক দৌড়ে পালিয়ে গেলো। তামান্নার হাজবেন্ড শুয়ে আছে। পাশে হঠাৎ হাত পড়তেই দেখে তামান্না শুয়ে আছে তার পাশে। সে ভয় পেয়ে লাইট জ্বালিয়ে দিয়ে দেখে, ” তার বউ!”
– তুমি না চলে গেছো?
– তোমাকে ছাড়া আমি থাকতে পারি। হাজবেন্ড একটা থাপ্পড় দিবেই, এতে রাগ করার কি আছে!
– আমার ভুল হয়ে গেছে তামান্না। এত তাড়াতাড়ি কীভাবে এলে।
– ওটা বুঝবেনা তুমি। আর সরি কীসের! তোমাকে হারামজাদা বলার জন্য উল্টো আমি, সরি।
এই কানে ধরছি আমি আর কোনোদিন তোমার অবাধ্য হবোনা। লাভ ইউ বেবি। হাজবেন্ড তামান্নাকে জড়িয়ে ধরল খুশিতে। পরেরদিন, সকালে খোঁজখবর নিয়ে তামান্না জানতে পারে তার বান্ধবী আর তার হাজবেন্ড আইসিউতে আছে। এই নিয়ে তাদের ৩য় তম আইসিউ বাস। মারা গেলে বড্ড ফেঁসে যেতো সে। কিন্তু না মরে বেঁচে গেল। সেটা ছিল তামান্নার জীবনে এক কালো রাত্রি। পাঁচমিনিটে দৌড়ে বাসায় পৌঁছানো, তা ছিল এক গ্রীনিচ রেকর্ড। যা ভাবতেই অবাক লাগে।
গল্পের বিষয়:
গল্প