শাড়িটা স্টক আউট

রাত ৩টায় মেসেঞ্জারের মেসেজে ঘুম ভেঙে গেল রুবিনার। অন্ধকারে হাতড়ে চশমা বের করে দেখতে পেল পেজ ম্যানেজারে মেসেজ। যারা অনলাইনে ব্যবসা করে তাদের ফেসবুকভিত্তিক পেজ ম্যানেজার নামে অ্যাপস চালাতে হয়। এতে ক্রেতাদের সঙ্গে লেনদেন সহজতর হয়। মেসেজ পাঠিয়েছেন রিতা হোসেন। সাধারণত বিদেশে থাকা কাস্টমাররা এত রাতে মেসেজ করেন। রুবিনা চট করে কাস্টমারের লোকেশন চেক করে নিল। গ্রিন রোডের লোকেশন দেওয়া। তার মানে, রিতা হোসেন দেশেই থাকেন। তার কেন এত রাতে নক করতে হবে? অন্যদিন মেসেঞ্জার সাইলেন্ট করে ঘুমায় সে। আজ মনে ছিল না।

তিনি নীল রঙের একটা জামদানি শাড়ি একটু গায়ে মেলে ধরে দেখতে চাইছেন। এবং এখুনি চাইছেন। এই সময় মেজাজ খিঁচে যায়। সকাল ৭টায় কুরিয়ারের ছেলেটা ডেলিভারি নিতে আসবে। সেগুলো রেডি করে দেড়টায় ঘুমুতে এসেছে সে। রুবিনার স্বামী ঘুমাচ্ছে। সে যদি এখন বউকে ফেসবুকে গুঁতাতে দেখে খুব বিরক্ত হবে। ফেসবুকে ব্রাউজিংকে একদম গাঁইয়া ভাষায় মোবাইল গুঁতানো নাম দিয়েছে তার স্বামী। এমনিতেই বউয়ের অনলাইন ব্যবসা নিয়ে তার অভিযোগের শেষ নেই। তার অনেক কলিগ রুবিনার ক্লায়েন্ট। এখন তাকে শাড়িওয়ালির জামাই হিসেবে পরিচিত হতে হয়। দেশের শীর্ষ করপোরেট প্রতিষ্ঠানের এক্সিকিউটিভের বউ শাড়ি বিক্রি করে- এটা কম লোকেই নিতে পারে। রুবিনার নিজস্ব কিছু একগুঁয়েমি আছে বলেই টিকে যাচ্ছে। নইলে মারুফ অসম্ভব বায়নাক্কা করা ছেলে।

সেদিন একদফা লেগে গিয়েছিল প্রায়। অফিসের ইয়ারলি ডিনারের রাতে রুবিনার পরা শিবুরি সিল্ক্কের শাড়ি দেখে এমডির বউয়ের তো সে কী প্রশংসা! কোথা থেকে নেওয়া, এটা জানতে চাইছিলেন তিনি। যখন শুনলেন, এটা রুবিনার বুটিকের। এমডির তো আচ্ছা ঝাড়ি। রুবিনার অনলাইন বুটিক আছে, বলো নাই তো! এমডির পাল্টা প্রশ্ন মারুফকে। মারুফের আমতা আমতা। এর মধ্যে ক্যাশের সাজিদ ভাই যিনি কিনা প্রায় প্রতিমাসেই রুবিনার বুটিক থেকে শাড়ি কেনেন বউ-শালিদের জন্য। তিনি টিপ্পনী কেটে উঠলেন। শাড়িওয়ালি বউ। রুবিনা এসব গায়ে মাখে না। নেহায়েত এমডির বউ তখনি ফেসবুক খুলে চারটা শাড়ি ফট ফট অর্ডার দিয়ে, হোয়াট এ কালেকশন হোয়াট এ কালেকশন বলে পালে হাওয়া দিলেন। এমডিও তৎক্ষণাৎ তার মা ও বোনের জন্য শাড়ি অর্ডার করলেন বলে বাঁচা গেল। এমডির বউ খুশি থাকলে এমডি খুশি, মারুফও সুনজরে থাকবে- এই থিওরিতে আপাতত রুবিনার সঙ্গে সে উষ্ণ আচরণ করছে। নিজেই দু’বার খোঁজ নিয়েছে এমডি ভাবির শাড়ি পৌঁছেছে কি-না। রুবিনাও ঝামেলা বাড়ায়নি। তবে রাত-বিরাতে ফেসবুক চালানো মারুফ একদম পছন্দ করে না।

ফোনের স্ট্ক্রিনলাইট কমিয়ে দিয়ে রীতা হোসেনকে উত্তর পাঠাল, সকালে দেখাই, আপা। এখন সম্ভব নয়। রুবিনার উত্তর দিতে দেরি পাল্টা উত্তর আসতে দেরি হলো না। ‘এত রাতে মেসেজ যখন সিন করেছেন, নিশ্চয় স্বামী আশেপাশে নেই। ঘুমিয়েও নেই। শাড়ি দেখাতে কী সমস্যা?’ রুবিনার মাথায় কেউ যেন আগুন ধরিয়ে দিল। বলতে ইচ্ছা করল, আমি রাত ৩টায় কী করি-না করি, সেই জবাবদিহি তোকে করতে হবে?- এমন কথা টাইপ করেও মুছে দিল। ক্লায়েন্ট চটানো যাবে না। যা-তা লোক ফেসবুক ইউজ করে। পরে শুধু রুবিনার কমেন্টের অংশটুকু স্ট্ক্রিনশট নিয়ে শেয়ার দিয়ে ফেসবুকের বিভিন্ন বিজনেস গ্রুপে অকথা-কুকথা বলে বেড়াবে। আড়াই বছরে যে ক্লায়েন্ট স্যাটিসফ্যাকশন আর গুডউইল তৈরি করেছে, সেটি এক স্ট্ক্রিনশটে উড়ে যাবে! ৫ মিনিট স্ট্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে শুধু লিখল- ‘দুঃখিত’। আবার পাল্টা উত্তর- দেখান না, এমন করেন কেন? আমার স্বামী দেখতে চাইছে। আচ্ছা, আপনার গায়েই মেলে ধইরেন। আপনি ফর্সা তো? আচ্ছা, আপনে কি মোটা? আমি একটু মোটা তো, আমার স্বামী মোটা মেয়েদের পছন্দ করে। আপনি মোটা হলে ও বুঝতে পারবে, আমাকে কেমন লাগবে। এবার রুবিনা আর পারল না, হেসে ফেলল। আইডিটা কেন জানি ফেক মনে হচ্ছে। শাড়ি নিয়ে ঝামেলা করবে বলে মনে হচ্ছে। যদিও তার ক্যাশঅন ডেলিভারি। তাই সে খুব একটা চিন্তিত নয়। রুবিনার ঘুম ছুটে গেছে। আজ আর সারারাত ঘুম হবে না। উঠে এখন স্টুডিও রুমে গিয়ে শাড়িটা মেলে ধরে ছবিও দিতে ইচ্ছা করছে। কিন্তু মারুফ জেগে গিয়ে বউ পাশে না দেখলে রিয়্যাক্ট করবে।

ওদের বিয়ের ৭ বছর হলো। ছেলে-পুলে নেই। বিয়ের পরপরই বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে জাঁকিয়ে সংসার করতে চেয়েছিল রুবিনা। কিন্তু মারুফের ইচ্ছা ছিল বেশ কিছুদিন পর বাচ্চা নেবে। সে সংসারের বড় ছেলে। ছোট ভাইবোন, মা-বাবাকে দেখা, নিজেদের সেটেলমেন্টের বিষয় আছে। রুবিনাকেও চাকরি করতে বলেছিল। রুবিনার ঠিক চাকরিটা পোষায় না। কোথাও ৮/১০ ঘণ্টা গাধার খাটুনি খেটে এসে ঘরের কাজ, বুয়া সামলানো কিছুই করা হবে না ভেবে চাকরি করেনি। আর ফিলোসফিতে অনার্স-মাস্টার্স পড়ে এ দেশে মাস্টারির চাকরি ছাড়া আর করার মতো কিছু তো নেই। তাতেও রুবিনা অনাগ্রহী। গাদা গাদা খাতা দেখা, বাড়ির কাজ, ক্লাস ওয়ার্ক চেক করা, প্রশ্ন বানানো। একটাই জীবন; এত মাথা নষ্ট করার কোনো মানে নেই। ঘরেই টুকটাক টিউশনি করত। এ থেকে একটা বিশাল সার্কেলকে পড়িয়ে আসছিল গত ৪ বছর ধরে। ছাত্র পড়াতে পড়াতেই শাড়ির বুটিক দেওয়ার আইডিয়া মাথায় এসেছিল। ছাত্রের মায়েরা সব সময় রুবিনার শাড়ির প্রশংসা করতেন। রুবিনা গাউছিয়া হকার্স থেকে শাড়ি কিনে এনে একটু লেইস লাগাত, একটু হ্যান্ডপেইন্ট নইলে হালকা ব্লক করে নিত। এতেই শাড়ির জেল্লা বদলে যেত। একবার গ্রিন হেরাল্ড স্কুুলের আয়মানের মা রুবিনাকে অনুরোধ করল তার ননদের গায়ে হলুদের শাড়ি আর বিয়েবাড়ির বাকিদের শাড়ি ডিজাইন করে দিতে। টাকা যা লাগে আয়মানের মা দেবেন। সাত-পাঁচ না ভেবে রুবিনা শাড়ি করে দিল। বউয়ের সিল্ক্ক শাড়িতে আফসানের ব্লক আর হাজার বুটির কাজ। বিয়েবাড়ির বাকিদের সুতি শাড়িতে ব্রাশ পেইন্টের কাজ। একটু বুদ্ধি করে খরচ যা পড়েছে সেই সঙ্গে নিজের জন্য বাড়তি দেড়শ’ টাকা করে রাখল। বিয়ের ছবি দেখে কত লোক প্রশংসা করল! কনের শাড়ি, বাড়ির বাকি মেয়েদের শাড়ি কোথা থেকে কিনেছেন এসব শুনতে শুনতে নাকি আয়মানের মায়ের কান ঝালাপালা। আয়মানের মায়ের থেকেই ছবি নিয়ে ফেসবুকে দিয়েছিল। ঝাঁপিয়ে পড়ল কলেজের বন্ধুরা। রিইউনিয়নে শাড়ি করে দিতে হবে। তখনই মনে হয়, এত মাথা খাটিয়ে ছাত্র পড়ানোর চেয়ে এই কাজ করলেই তো পারে। লাভ তো ভালোই আসে। বন্ধুদের উৎসাহেই পেজ খোলা। নিজের করা শাড়িগুলোর ছবি তুলে পেজে দেওয়া, টিউশনি বন্ধ করে দিয়ে অবশেষে থিতু হলো।

সংসারে থিতু হতে চাইলেই তো থিতু হওয়া যায় না। মারুফের এতদিনে মনে পড়ল, এবার তাদের একটা সন্তান নিতে হবে। সংসারের সাড়ে চার বছর পর মনে হলেই তো হবে না। তার ব্যাপক প্রস্তুতি লাগে। এমনিতে মানুষের ফটাফট বাপ-মা হয়ে যাওয়া দেখে পিতৃত্ব বা মাতৃত্ব যতটা সহজ বলে মনে হয়, ততটা সহজ নয়; সেটি গত আড়াই বছরে টের পেয়ে গেছে দু’জনই। মারুফ এ নিয়ে রীতিমতো উন্মাদ হয়ে উঠেছে। তাকে অবশ্য সামলেছেন রাইট ফার্টিলিটি সেন্টারের ডাক্তার মুনীরা বেগম। ৬৮ বছর বয়সী এই ডাক্তার মারুফকে প্রথম প্রশ্ন করলেন- সাড়ে চার বছর বাচ্চা নেন নাই কেন? মারুফ দায়-দায়িত্বের বর্ণনা দেওয়া শুরু করতেই তিনি থামিয়ে দিয়ে বললেন, এখন কি দায়-দায়িত্ব শেষ? মারুফ পাল্টা উত্তর দিতে গেলেই তিনি থামিয়ে দিচ্ছেন, শুনছেন না। চার বছরের প্রটেকশন মেথড গবেষণা করে বের হলো, রুবিনা পিল খেয়েছে আর মারুফ দিব্যি বউয়ের সঙ্গে শুয়ে আনন্দ নিয়েছে, অন্য পুরুষরা যা করে। ডাক্তার পারলে তখনই মারুফকে ঘর থেকে বের করে দেন। টানা চার বছর পিল খেয়ে রুবিনার হরমোনাল ইমব্যালান্স দেখা দিয়েছে। সুতরাং এখন চাইলেই কিছু করা যাবে না। এই থাইরয়েডি জটিলতা নিয়ন্ত্রণ করে চেষ্টা করতে হবে সন্তান নেওয়ার। রুবিনা সব চুপচাপ শুনে ওষুধপত্র লিখে নিয়ে মারুফের সঙ্গে বের হয়ে এলো। ফেরার পথে আশিয়ানা রেস্টুরেন্ট থেকে ক্লিয়ার ভেজিটেবল স্যুপ, অনথন ও চিলি বিফ দিয়ে থাই রাইস খেয়ে এলো। যেন কিছুই হয়নি। মারুফ গজগজ করতে করতে একবার বলার চেষ্টা করল, কী অদ্ভুত রোগ বাধিয়েছ! মারুফের মতো মধ্যবিত্ত স্বামী বউদের যে কোনো জটিলতাকেই রোগ বাধানো ভাবে। তাই সেটা নিয়ে জবাব দেওয়ার প্রয়োজনীয়তাও বোধ করেনি রুবিনা।

সে নিজেও খুব আহামরি বড় ঘরের মেয়ে নয়। মধ্যবিত্ত জীবনই তার। তবে বাপের কল্যাণে খুব স্বাধীনভাবে বড় হয়েছে। জীবন নিয়ে কোনো আক্ষেপ ছিল না তার। জীবন নিয়ে যে আক্ষেপ করতে হয়, সেটা শিখেছে এই বাড়ি এসেই। শাশুড়ি-ননদ-দেবরের হাজারটা বায়নাক্কা। এই নেই সেই নেই চাহিদা ওকে প্রায়ই বুঝিয়ে দেয় কত কম চাহিদার জীবন কাটিয়ে এসেছে! এ সংসারে ৭ বছর হয়ে গেল। একদিন শুধু চিৎকার করে উঠেছিল। যেদিন তার হরমোনাল ব্যালেন্স ঠিক হয় না কেন- এমন চিৎকার করেছিল মারুফ। একদিন চিৎকার করেই বুঝিয়ে দিতে সমর্থ হয়েছিল, ওর সঙ্গে অন্যায় করলে মেনে নেয় বলেই সব দায় চাপিয়ে দেওয়া যাবে না। তার পর থেকে সম্পর্কটা শীতল। মারুফ আর সে শুধু একই সঙ্গে থাকতে হয় বলে থাকে। কিংবা সুন্দরী ও গুণী বউ শোভা সেই হিসেবেই পাশে পাশে আছে। মারুফের বন্ধুমহলে ভীষণ জনপ্রিয় রুবিনা। সেখানে মারুফের চেয়ে বেশি বন্ধু রুবিনার। তাই হয়তো টিকে গেছে। রুবিনাকে নিয়ে শাশুড়ির অনেক অভিযোগ থাকলেও শ্বশুরবাড়ির অন্য আত্মীয়রা রুবিনাকে পীর মানে। এমনকি ননদ আর দেবরের শ্বশুরবাড়িতে রুবিনার ভক্তের অভাব নেই। এসব সামাজিকতা টপকে মা হতে না পারা রুবিনাকে একঘরে করে দেওয়া কিংবা কোণঠাসা করা একটু কঠিনই। রাত জাগলেই এত সাত-পাঁচ ভাবনা আসে।

এদিকে সেই ক্লায়েন্ট ইনবক্সে মেসেজ পাঠিয়েই যাচ্ছে- শাড়িটা দেখান। আমার স্বামী এখনই কিনে দেবে। ফজরের আজান দিচ্ছে। রুবিনা উঠে স্টুডিওর লাইট জ্বালল। শাড়ি বের করল। মেনিকুইনের ওপর ফেলে ছবি তুলল। ছবি এডিট করে পাঠাতে পাঠাতে আলো ফুটতে শুরু করেছে। এখন আর রীতা হোসেন মেসেজ সিন করছে না। এখন ভীষণ ঘুম পাচ্ছে রুবিনার কিন্তু ঘুমিয়ে পড়লে কেলেঙ্কারি হবে। ৭টায় ডেলিভারির ছেলেটা আসবে। দরজা খুলে প্যাকেটগুলো না দিলে ডেট অনুযায়ী ক্লায়েন্টের কাছে যাবে না। এই সপ্তাহে মারুফের সঙ্গে ঘুরতে যাচ্ছে সাজেক। ডাক্তার পরামর্শ দিয়েছে বাইরে কোথাও যেতে। একটু চেঞ্জে যেতে। এতে যদি এই অভাগার কোনো গতি হয়। সাত দিনের ট্যুর। মারুফের বন্ধুরা আয়োজন করে দিয়েছে। সুতরাং ১০ দিনের মতো শাড়ির কাজ বন্ধ থাকবে। একটা নোটিশ লিখে ঝুলিয়ে দিল ফেসবুক পেজে। চায়ের পানি বসাতেই ডেলিভারির ছেলেটার কলিংবেল চাপার আওয়াজ।

এদিকে সারাদিনে রীতা হোসেনের কোনো খোঁজ নেই। ভেবেছিল, কাছেই ডেলিভারি। বিকেলে টুকটাক বাজার করতে গিয়ে সে নিজেই রীতা হোসেনকে শাড়ি দিয়ে আসবে। মারুফ অফিসে চলে যাওয়ার পর ঘুম দিল। এক ঘুমে বেলা ২টা। মায়ের ফোনে ঘুম ভাঙল। মায়ের সেই একই খুনখুনে কান্না। তোর একটা ছেলেপুলে হলে আমি বাঁচি। মারুফের সঙ্গে ঝগড়া করিস না। ছেলেটারও বাপ না হওয়ার আক্ষেপ আছে। তারও হৃদয়ে দুঃখ আছে। এসব সাত-পাঁচ নিত্যদিনের প্যাঁচাল। কথা শেষে ফ্রিজ থেকে খাবার বের করে গরম করতে দিল। খেয়ে বের হতে হবে। ননদের ফোন। ধরতে ইচ্ছা করছিল না। না ধরলে কল করতেই থাকবে- ভাবি, তোমরা নাকি কক্সবাজার আর সাজেক যাচ্ছ! এই খবর আমার ভাইয়ার ফেসবুক থেকে জানতে হলো! আমাদের একটু বললে পারতে না? আমরাও একটু যেতাম। আমাদের খরচ আমরাই দিতাম। আমরা তিনজন মানুষ এমনকি জায়গা নিতাম! আর তুমি তো আমার স্বামীকে চেনো, ও কি কারও টাকায় চলা মানুষ? রুবিনার অনেক কিছু বলে ওকে আরও কিছু কষ্টে ফেলার ইচ্ছা ছিল। সেগুলো না করে রুবিনা খুব ঠাণ্ডা মাথায় ফিসফিস করে জানাল, আসলে তোমার ভাইয়ের অফিসের খুব সিক্রেট একটা সেমিনার হবে ওখানে। সেখানে একজন দোভাষী লাগবে। সেটাও খুব সিক্রেট লাগবে। তুমি তো জানোই, আমি ফ্রেঞ্চ শিখেছিলাম। আর তোমার ভাই কি তোমাকে জানিয়েছে, সে সাজেক যাচ্ছে? সে বরং হেঁয়ালি করে ঘুরতে যাওয়ার কথা লিখেছে। এবার ননদের টাশকি খাওয়ার পালা। ভাবি এসব কী বলে! সাত-পাঁচ বুঝিয়ে ওকে ঠাণ্ডা করে ফিরে এসে দেখল চুলায় দেওয়া তরকারি পুড়ে কালাভুনা। বাইরেই খেতে হবে। রাতে আজকে মারুফের বন্ধুর বাসায় দাওয়াত। আর চুলা জ্বালাতেও ইচ্ছা করছে না।

এমন সময় রীতা হোসেনের মেসেজ। যখন দেখাতে বললাম তখন দেখালেন না; পাট নিলেন। এখন আমার স্বামী কি বসে আছে আপনার শাড়ি দেখার জন্য? উনি অনেক বড় চাকরি করেন। আমরা এই শাড়ি নেব না। রুবিনার রাগ লাগার কথা থাকলেও হেসে ফেলল। মানুষের কত আবদার! ভালো হয়েছে, এই ক্লায়েন্ট শাড়ি নিচ্ছে না। আর শাড়িতে হাত দেবে না। ছুটি মানেই ছুটি।

খাঁচা থেকে বের হলে মানুষের আড়ষ্টতা কাটে। মারুফের সঙ্গে শীতলতর সম্পর্কটা কেমন করে জানি উষ্ণ হয়ে উঠছে। মারুফও ভীষণ ছেলেমানুষি করছে। দেখতে ভালোই লাগছে। সানগ্লাস কই রাখবে এই নিয়ে তিনবার পরিকল্পনা করল। সাজেকে একটু মেঘ-মেঘ আবহাওয়া। তাই চোখে রাখা যাবে না, আবার ঘুরতে এসে সানগ্লাস ছাড়াও ছবি তোলা যাবে না। দুপুরে ভীষণ রোদ উঠেছে সাজেকে। অনেক দিনের জমাট বরফ অবশেষে ভাংল।

মারুফের মেঘবাড়িতে ছবি তুলে দিচ্ছিল রুবিনা। এমন সময় মোবাইলে নোটিফিকেশন। সকাল থেকে সাজেকে নেট ছিল না, এবার ফিরে এসেছে বলে মনে হচ্ছে। পেজ ম্যানেজারের মেসেজ। এক ক্লায়েন্ট নির্ঘাত পাগল হয়ে গেছে। মণিপুরি শাড়ির পুরনো স্টকে কমেন্ট করেই যাচ্ছে। নোটিফিকেশনে এক ঝলক চোখ বুলালো রুবিনা। কিন্তু এখন পেজে শাড়ি ক্রেতাকে জবাব দিতে গিয়ে মারুফের মুড নষ্ট করার কোনো মানে হয় না। অনেক দিন পর দু’জন তারা কাছাকাছি এসেছে; এটিকে নষ্ট হতে দিতে চায় না। মারুফ কী একটা কবিতা আবৃত্তি করার চেষ্টা করছে। শুনে হো হো করে হেসে উঠল রুবিনা। চট করে ভিডিও মুডে দিয়ে দিল। দারুণ একটা ভিডিও হবে। ভিডিওর মাঝখানে ননদের ভিডিও কল। না ধরে উপায় নেই। সামনে ভাই দণ্ডায়মান। ও ভাবি, তোমরা কোন মিটিংয়ে? মারুফ বিস্ময় নিয়ে তাকাল। পরে বুঝিয়ে বলবে বলে সামলে নিল। কী সাজেকের মেঘ দেখবে! ৩০ মিনিট ননদ ও তার বাচ্চাকে সাজেক দেখাল। মারুফ নিজেই এক সময় বিরক্ত হয়ে কল কেটে দিয়ে বলল, তোমার মোবাইলের নেট অফ করে রাখো। এই ৭ দিন নেট লাগবে না। রুবিনাও বেশ হাঁপ ছেড়ে বাঁচল। ভালো সময় খুব দ্রুত যায়। চোখের পলকে ৭ দিন কেটে গেল। ফিরেই মারুফ অফিস নিয়ে পড়ল। রুবিনাও একটু একটু করে কাজে হাত দিয়েছে। এমনিতে যারা নিয়মিত ক্রেতা তারা কেউই এই ১০ দিনে নক করেনি। শরীফ আহমেদ নামে এক ভদ্রলোক অনেক শাড়িতে কমেন্ট করেছেন। ইনবক্সও করেছেন।

রুবিনা চট করে আলমারি খুলে দেখে নিল, ভদ্রলোকের চাহিদার একটি শাড়িও নেই। এগুলো পুরনো অ্যালবাম থেকে চাওয়া। এ ক্ষেত্রে ক্লায়েন্টকে দুঃখিত বলা ছাড়া উপায় থাকে না। রুবিনা লিখল, ‘দুঃখিত! শাড়িগুলো স্টক আউট।’ একই সঙ্গে এটাও জানিয়ে দিল, ১০ দিন কাজ বন্ধ ছিল। তাই জবাব দিতে দেরি হলো। ক্রেতা চাইলে এখনও আনিয়ে দেওয়া যেতে পারে। ভদ্রলোক সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিলেন- লাগবে না আপু। যার জন্য শাড়ি, সে আর নেই!

এমন পরিস্থিতিতে সাধারণত রুবিনা এই আড়াই বছরের ব্যবসায়িক জীবনে পড়েনি। কী লিখতে হবে বুঝছিল না। তবু লিখল- ইন্নালিল্লাহি … রাজিউন। কত গল্প থাকে আমাদের জীবনে! আমি ১০ দিন ছিলাম না। ঘোষণা দিয়ে গেছিলাম বিক্রি বন্ধের। আমি জানি না, তিনি আপনার কে হন। সমবেদনা রইল আপনার ও আপনার পরিবারের প্রতি।

আমার ছোট বোন- জবাব দিলেন শরীফ আহমেদ। সঙ্গে একটা ছবি পাঠালেন। মাথায় ফুলের টায়রা পরা একটা ২৬/২৭ বছরের মেয়ে। ভীষণ মুচড়ে উঠল রুবিনার ভেতরটা। শরীফ আহমেদ হড়বড় করে বলে যেতে থাকলেন- স্বামী মেরে ফেলেছে। গত ৬ দিন হলো। যেদিন মারা গেল সেদিন সকালেও মণিপুরি শাড়ির আবদার করেছিল। শাড়ি নিয়ে ভীষণ বায়না তার। আপনার এখানে জবাব না পেয়ে অন্য পেজে খুঁজেছিলাম। নিজে থেকেই জানালেন, ময়নাতদন্ত রিপোর্টের জন্য অপেক্ষা করছেন। পেলেই মামলা করবেন।

ছোট একটা বাচ্চার ছবি পাঠালেন শরীফ আহমেদ। তার বোনের বাচ্চা। কী ফুটফুটে! রুবিনা তখন ৬ দিনের আগের পত্রিকায় খুঁজে চলেছে একটা শাড়িপ্রেমীর মৃত্যুর খবর। পেয়েও গেল। শ্যামলীতে গৃহবধূর রহস্যজনক মৃত্যু। পেপারে দেওয়া ছবিতে মেয়েটা একটা নীল রঙের মণিপুরি শাড়ি পরে আছে। যে শাড়িটা স্টক আউট।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত