স্বপ্নস্বস্তিকা ও কালো চশমা

তুই আমাকে বলেছিলি লিখতে। তোরও তো লেখালেখিতে হাত ছিল। কিন্তু নিজের কথা ওভাবে লেখার মতো সাহসী তুই ছিলি না। একমাত্র মার্কেজের হাতে নাকি বিষয়টা খেলতো ভালো। ক’দিন আগেও ফ্লোরিডা থেকে ভিডিও চ্যাটে যখন আবার অনুরোধ করলি, তখন ভাবলাম লিখেই ফেলি কিছু একটা ছাইপাঁশ। তোর ঘ্যানঘ্যানানি আর ভাল লাগে না। কিন্তু ফোন রাখার আগে যে নতুন বিষয়টা গল্পে সংযোজন করতে বললি সেটা শুনে তো আমার গা-হাত-পা কাঁপতে শুরু করেছে। তোকে কি ভূতে পেয়েছে?

তুই আর আমি কলেজ পর্যন্ত একসাথে পড়লেও বিশ্ববিদ্যালয় আলাদা হয়ে গেল। তুই ঢাকা, আমি মতিহার সবুজ মানে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। বন্ধুত্ব ছিন্ন তো হলোই না, ছুটিছাটায় একই মফস্বলের বাড়ি ফিরে দু’জন সে কি গল্প! ঢাকাওয়ালারা নাকি ব্রাহ্মণ। আমরা বলতাম ক্যাম্পাস হবে ক্যাম্পাসের মতো, সবুজে ঘেরা, শহর থেকে দূরে, প্যারিস রোড আছে, ইউক্যালিপটাস দাঁড়িয়ে থাকে, তা না হাইরোডের মাঝখানে ক্যাম্পাস, রাত-দিন রিকশা-বাস, ট্যা ভু, এখানে কলা ভবন তো বাসে চেপে কার্জন হল। কী ছিরি! তুই অবশ্য কোন তক্কে যেতিস না। জানতিস একধরনের হীনমন্যতা থেকেই আমার ওসব বাহাদুরি। আমি বলতাম- ‘একবার চল না আমাদের ক্যাম্পাসে। সব ছোড়াগুলোর মাথা ঘুরিয়ে দিয়ে আসবি।’

‘যেতে পারি। কিন্তু কেন যাবো?’ তুই পুরা শক্তি চাটুজ্জে আউড়িয়ে আমাকে অলসভাবে জিজ্ঞাসা করতিস ‘আমাকে কি তুই তাকে দেখাতে পারবি যাকে প্রতি সপ্তাহে একবার বা একাধিকবার আমি দেখে থাকি?’

তোর এই গল্পটাই আমাকে লিখতে বলেছিস। খুব যে জোর জবরদস্তি তাও না। তুই এখনও সেই উদাসীন উদিসা। কিন্তু ছেলেকে নিয়ে যে কথাটা বললি তাতে আমিই ভিরমি খেলাম। তোর যেন এমন কিছুই হলো না।

সে বার গরমের ছুটি আমাদের শেষ হয়ে গেলেও তোদের ক’দিন বাকি ছিল। তুই আমাদের ক্যাম্পাসে এলি। যেন গাবোর পেরুর মেয়ে। সবাই হুমড়ি খেয়ে দেখতে লাগল। একে সুন্দরী তার ওপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্রী। আমাদের ক্যাম্পাসের সবচেয়ে আকর্ষণীয় ছেলেটি এগিয়ে এসে হাত বাড়িয়ে দিল- ‘হাই, আই’ম জেমস। নাইস টু মিট ইউ।’

তুইও অবলীলায় হাত বাড়িয়ে দিলি। ওর হাত ধরে কী যেন খুঁজলি ওর মুখে। তারপর বললি- ‘উঁহু, এ সে না’।

সে রাতেও স্বপ্নটা তুই দেখেছিলি। একই স্বপ্ন- যা দেখে আসছিস কয়েক বছর ধরে। তোর নানাবাড়ির চিলেকোঠা। ওপরে ওঠার রেলিং কোথাও ভাঙা, কোথাও খানিকটা স্পষ্ট নকশি কাটা। রেলিংটার ঠিক মাঝ বরাবর একটা কালো-খয়েরি ডোরাকাটা মাফলার বাঁধা। চিলেকোঠায় ওঠার সঙ্গে সঙ্গে সিঁড়িটা উধাও হয়ে যায়। কোঠা ভরা বিচালি। দু’হাতে বিচালি সরিয়ে কালো চশমা পরা একটা লোক উঠে দাঁড়ায়। লোকটার পরনে লুঙ্গি, পায়ে জুতা কিন্তু খালি গা। হাতে একটা লাল গামছা। তোর দিকে হাত বাড়ায় আর লাল গামছাটা ওড়ায়। বিচালির নিচে ট্রেনের লাইন দৃশ্যমান হয়। তুই লাইন ধরে ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়াতে শুরু করিস; কিন্তু দুই পা-ও এগোতে পারিস না। হঠাৎ লাইন দু’ভাগ হয়ে গেলে তুই সিনেমার মতো স্লো মোশানে নিচে পড়তে থাকিস। তোর বালিকা শরীরের জলছাপ ফ্রক ঝড়ে উল্টানো ছাতার মতো উড়তে থাকে। লোকটা তোর পিঠের ওপর পড়লেই তোর ঘুম ভেঙে যায়। এ স্বপ্নের কোনো ব্যত্যয় নেই। অন্য কোনো সংযোজন-বিয়োজনও নেই। একই স্বপ্ন বারবার দেখার কী কারণ থাকতে পারে জানতে চেয়ে তুই তো মনোবিজ্ঞানীও দেখিয়েছিলি। তিনি কী সমাধান দিয়েছিলেন তা আর আমার শোনা হয়নি কখনও। তুই আমাকে ছাড়া ওই স্বপ্নের কথা তোর মাকেও বলিসনি, বলেছিলি?

তারপর পড়াশোনা শেষে আমরা কেউ প্রেমিককে স্বামী বানিয়ে ছেলেপুলে পয়দা করলাম। দু-তিনবার সম্পর্ক ভেঙে কেউ চোখ বুজে মা-বাবার পছন্দের গাড়লকে মেনে নিল। কেউ ভালো চাকরি করতে করতে বাচ্চা বিইয়ে সব ছেড়েছুড়ে পুরোপুরি জননী সর্বংসহা হয়ে ধুমসি হতে লাগল। প্রতিদিন দশটা-পাঁচটার ভয়ে আমি স্বনামধন্য লেখক হওয়ার মানসে মফস্বলের সাপ্তাহিক সাহিত্যপাতার একমেবাদ্বিতীয়ম হয়ে রইলাম। কেবল তুই কীসব কোর্সটোর্স করে ইউএন উইমেনে ঢুকে গেলি। বললি অসুস্থ মা যতদিন বেঁচে আছে- বিয়ে-থা করবি না। আমার শহর দিনাজপুরে অফিসের কী সব জরিপের কাজে এসে বাকি গল্পটা বলেছিলি। দিনাজপুরে সে বারই তোর প্রথম ট্যুর। দিন পাঁচেকের। তোকে আমার বাসায় উঠতে বলেছিলাম। তোর ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে নতুন করে জানার কিছু ছিল না। দেখা করবি কাজ শেষ করে, কিন্তু আমার বাসায় উঠবি না জানতাম। একটি এনজিওর রেস্ট হাউসে থাকার ব্যবস্থা হয়েছে। ওই অফিস থেকে মাইক্রোবাস আসবে বলে বাস কাউন্টারে অপেক্ষা করছিলি। কালো চশমা পরে মাঝবয়সী এক সুদর্শন রাস্তার বিপরীতে একটি দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে সিগারেট বের করে প্যাকেটের ওপর ঠুকছিল আর তোর দিকে তাকাচ্ছিল। তোর মাথা ভোঁ করে ঘুরে উঠল। তুই অবাক বিস্ময়ে ভদ্রলোককে হাঁ করে দেখতে লাগলি। যাকে তুই প্রতি সপ্তাহে বা এক পক্ষে তোর নিয়মিত অপরিবর্তিত স্বপ্নে দেখে থাকিস। অবিকল কালো চশমা পরা সেই মুখ। ধোপদুরস্ত কাপড়চোপড়। তুই খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে লক্ষ করলি জুতোর বদলে কেডস পরা। গলায় কালো-খয়েরি ডোরাকাটা রেলিংয়ে ঝুলানো সেই মাফলার। এ কীভাবে সম্ভব? লোকটাও বোধহয় কারও জন্য অপেক্ষা করছিল। তোর গাড়ি এসে দাঁড়িয়ে আছে, তুই স্বপ্ন থেকে বেরোতে পারছিস না। লোকটাও কালো চশমার ভেতর থেকে তোকেই যে দেখছিল তাতে কোনো সন্দেহ নেই। একজন অপরূপা কেউ হাঁ করে গিললে নিজেকেও কম সুন্দর ভাবার কারণ থাকে না। ড্রাইভার ‘ম্যাডাম, গাড়ি রেডি’ বলাতে সন্বিত ফিরল তোর। তুই অমনোযোগে হোঁচট খেয়ে গাড়িতে উঠলি। ভাবছিলি ভদ্রলোকের কি একবার এসে জিজ্ঞাসা করা উচিত ছিল না- ‘আচ্ছা আপনি কি আমাকে চেনেন?’ আর জিজ্ঞাসা করলেই-বা তুই কী জবাব দিতি? আপনি আমার স্বপ্নের সেই লোক- তা কি বলা যেত?

গাড়ি চলতে শুরু করল। কাচের জানালা দিয়ে যতদূর দেখা যায় দেখলি। একবার মনে হলো ড্রাইভারকে জিজ্ঞাসা করবি লোকটা কি এই এলাকার? তাকে চেনে? কিন্তু তোর ধাঁচ তো সেভাবে গড়া নয় তা তুই জানিস। শেষ দৃষ্টিতে যখন দেখছিলি, তখন তোর মনে হলো লোকটার ঠোঁটের কোণে কি একটু বাঁকা হাসি ছিল?

রেস্ট হাউসে ফিরে গোসল সেরে খেয়েদেয়ে রাতে জরিপের কাগজপত্র নিয়ে বসলি। কিন্তু কিছুতেই তোর ঘোর কাটছিল না। একবার ভাবলি বাস কাউন্টারে মাইক্রোর অপেক্ষায় বসে থেকে তোর একটু তন্দ্রা ভাব হয়েছিল। হয়তো লোকটাকে দেখাটা একটা স্বপ্ন ছিল। কিন্তু গাড়ির জানালা দিয়ে দেখা, সেটা? কাজেও মন বসছিল না। সহসা ঘুমও আসছিল না। অভ্যাস মতো উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ার পর সে রাতে আবার সেই একই স্বপ্ন। কেবল খালি গায়ে লুঙ্গি পরা লোকটা অবিকল রাস্তায় দেখা পোশাকে আবির্ভূত হলো। ট্রেনের লাইন দু’ভাগ হয়ে গেলে তুই যখন নিচে স্লো মোশানে পড়ে যাচ্ছিলি, তখন লোকটা তোর পিঠের ওপর পড়ার পরও তোর ঘুম ভাঙল না। তুই খুব কাঁপছিলি। কে যেন তোকে ধাক্কাচ্ছিল। বোবায় ধরার মতো মুখে শব্দ হচ্ছিল। ঘুম ভাঙতেই তুই নিজেকে চিৎ অবস্থায় পেলি। যা আগে কোনোদিনও পাসনি। উঠে দরজা-জানালা খাটের নিচে ভালোভাবে পরখ করলি। সব ঠিকঠাক। সকালে নাশতা শেষে জরিপ দলের সঙ্গে মিটিং শেষ করে এক দিনের মধ্যে যতটুকু পারা যায় কাজ শেষ করে তুই সে রাতে আমার বাসায় থাকলি। বললি সব। পরদিন ঢাকা ফিরে গেলি। তোকে অস্থির আর উদভ্রান্ত দেখাচ্ছিল।

এরপর অনেকদিন তোর সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ ছিল। তোর অসুস্থ মা মারা যাওয়ার পর তুই আমেরিকা চলে যাস। সেও হয়ে গেল প্রায় ছয় বছর। কিছুদিন আগে তুই নিজেই যোগাযোগ করলি। বললি বিয়ে করেছিস। বর স্প্যানিশ। একটা ছেলে হয়েছে তোদের বছর চারেক হলো। আমি তোর সেই অদ্ভুত স্বপ্নের কথা জিজ্ঞেস করলাম। তুই ভালো করে মনে করতে পারছিলি না। সম্ভবত দিনাজপুরের সেই ট্যুরেই তোর সেই অদ্ভুত স্বপ্নের সমাপ্তি। আর কোনোদিন দেখিসনি ওটা।

তোর অদ্ভুত জীবন নিয়ে লিখতে বললি। আমি তো জানতাম তোর বাবা মারা গেছেন তুই যখন চার-পাঁচ বছরের। তোর মা একা একটি স্কুলে চাকরি করে জীবন চালিয়েছেন। পুরুষদের প্রতি কী এক তীব্র ঘৃণা থেকে তিনি আর বিয়ে করেননি। কিন্তু তুই বললি-

‘না রে, বাবাকে আমার মা পরিত্যাগ করেছিল। মা ভালোবেসে একা বিয়ে করেছিল বলে আমার কড়া মেজাজের নানা তাদের বাড়িতে কোনোদিন জামাইকে আমন্ত্রণ জানাননি। বাবার চেহারাও আমার মনে নেই। মা তাকে এতই ঘৃণা করতো যে, আমি কোনোদিন তার সম্পর্কে কিছু জিজ্ঞেসও করতে পারিনি। ফটো তো দূরের কথা। মা বলতো বিদেশে গিয়ে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছে। যাই হোক আমার বর মানুষটা খুব ভালো রে। আমরা আমাদের ছেলেকে নিয়ে সুখে আছি। তুই তো জানিস আমার ছোট খালা যাকে আমি বুচি বলে ডাকতাম, সে আমাদের পাশের স্টেটে থাকে। অনেক আগে এসেছে এ দেশে। আমার ছেলের চতুর্থ জন্মদিনে প্রথম এলো আমার বাসায়। বিকেলে আমাদের ব?্যাকইয়ার্ডে জন্মদিনের আয়োজন। তখনও রোদ সরে যায়নি। আমার ছেলে একটি কালো রোদচশমা পরে কেকের সামনে বসে ছিল। বুচি আমার ছেলেকে দেখে কেমন চমকে উঠল। আমাকে একটু আড়ালে ডেকে নিয়ে ফিসফিস করে বলল- ‘ওর চোখ থেকে চশমাটা খুলে দে। আমি তাকাতে পারছি না। কী করে ছেলেটা অবিকল ওই হারামির মতো দেখতে হলো!’

বুঝেছিস? আমার জন্মদাতার কথা বলল বুচি।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত