সবুজ ধানক্ষেত এবং রক্তমাখা শার্ট

মাঠে মাঠে সবুজের সমারোহ। দিগন্ত বিস্তৃত ধানক্ষেত। যতদূর চোখ যায় শুধু সবুজ আর সবুজ। যেন সবুজের গালিচা। এই সবুজ ধানক্ষেতের মধ্য দিয়ে সরু কাঁচা রাস্তা। এই রাস্তা দিয়ে প্রতিদিন কলেজে যায় পলিন। যখন হেঁটে যায় তখন নাকে আসে অসম্ভব ভালো লাগে ধানগাছের পাতার মৌ মৌ গন্ধ।

স্নিগ্ধ সকাল। সহনীয় তাপমাত্রার রোদ উঠেছে। ছোট্ট ছিমছাম বাড়ি। মা, দুই ভাই আর ভাবীদের নিয়ে সংসার। বাবা কামাল চৌধুরী তেত্রিশ বছর বয়সে বঙ্গবন্ধুর ডাকে যুদ্ধে গিয়ে পাক সেনাদের হাতে শহীদ হয়েছেন। এরপর মায়ের মুখে শুধু বাবার গল্প শুনে পলিন। সকাল এগারটার দিকে সবুজ টি-শার্ট, জিন্সপ্যান্ট পরে ছুটল কলেজে। আজ তিনটা ক্লাস হবার কথা।
কলেজে পৌঁছার আগেই মনিজার ফোন।

-হ্যালো পলিন
-ইয়েস মনিজা, তুমি কোথায়?
-আমি বাড়িতে।
-তুমি?
-কলেজে যাচ্ছি।
-বিকেলে আসবা?
-না আজ কাজ আছে।
-ওকে ভালোমতো থেকো।
-তুমিও। বাই..।

ফোন কেটে আবারও হাঁটা শুরু করল কলেজের উদ্দেশ্যে। মনিজার কথা ভাবতে ভাবতে হাঁটছে।

চরভোলা বাজার। বাজারের সাথেই বড় মাঠ। এই মাঠের পশ্চিম পাশে সোনামিয়া ডিগ্রি কলেজ। কলেজের পাশেই অবস্থিত সোনামিয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়। মনিজা এই বিদ্যালয়ে দশম শেণির ছাত্রী। পলিন ওই কলেজ থেকে এবার ডিগ্রি পরীক্ষা দিবে। দুজনের পরিচয়টা দুই বছর আগের। একদিন ক্লাস শেষে কলেজ মাঠেই দুজনের দেখা।

এরপর থেকে প্রায়ই তারা সাক্ষাৎ করে। একদিন তো পলিন সরাসরি মনিজার ডানহাত ধরে বলে ফেলল, চল ঝাল পিঁয়াজু, চা খাই। এরপর প্রায় দুই মাস লজ্জায় পলিনের সাথে দেখা ও কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছিল মনিজা।

কলেজে পৌঁছে দুইটা ক্লাস করার পর মায়ের ফোন। পলিন তাড়াতাড়ি বাড়ি চলে আসিস। মায়ের ফোনের পরই ঝিম ঝিম ভাব অনুভব করে পলিন। কী হলো আবার মায়ের। অবশ্য একটা চিন্তাতো মাথায় আছেই। বাড়িটার পাশের জমিটা নিয়ে টেনশন। মায়ের একটা কথা মনে পড়ে গেল। একাত্তুরের যুদ্ধে সময় ওই জমিতে পাক সেনার ক্যাম্প করার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। পরে গ্রামের সবাই মিলে পাকসেনাদের হটিয়ে জমি দখল করে। কিন্তু এই জমিটা আবার এখন স্থানীয় কিছু প্রভাবশালী দখল করতে চায়। এটা নিয়ে আবার কিছু হলো কি না- টেনশন করছে পলিন। ক্লাস শেষে শেখ রাসেল স্মৃতি সংসদের মিটিং ছিল। কিন্তু রমজানকে বলল তোরা মিটিং কর, আমি বাড়ি যাচ্ছি। দুইটা ক্লাস শেষ করে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিল পলিন।

দুইদিন পর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস। এ নিয়ে ওদের প্রস্তুতি সভা। পলিন ছাড়াই সভা শেষ হলো। সভায় সিদ্ধান্ত হলো, স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবসে এবার একটি কর্মসূচি পালিত হবে। বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী পাঠ। এতে দুইজন ছাত্র ও একজন ছাত্রী বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী বই থেকে কিছু অংশ পাঠ করে শোনাবেন শ্রোতাদের।

আজ সকালটা কেমন যেন গুমোট মনে হচ্ছে। আর মনে হবেই না কেন, গতকাল যে ঝক্কি-ঝামেলা গেল এর রেশ কোথায় গিয়ে ঠেকে কে জানে। পলিনের মা-তো অসুস্থ হয়েই পড়েছেন। আর অসুস্থ হবেই না কেন- ওই যে বাড়ির পাশে সবুজ ধানক্ষেতটা নিয়ে যে স্থানীয় প্রভাবশালীদের সঙ্গে ঝামেলা তা এখর চরম পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। নিজের সব দলিলপত্র থাকা সত্বেও ওরা জমিটা অবৈধভাবে দখল করতে চায়। পলিনের মনে পড়ল বঙ্গবন্ধুর জীবনের কথা। পাকবাহিনীরা কতনা জোর করে কতকিছু বাঙালিদের কাছ থেকে দখল করে নিয়ে গেছে সম্পদ। বঙ্গবন্ধুই তো সংগ্রাম ওদের বিরুদ্ধে লড়েছেন। আর পলিনের বাবাতো এই ধানক্ষেতটা পাক সেনাদের কাছে থেকে দখলে নিয়েছিলেন। মা তো প্রায়ই বলে এই দেশে এখনো পাকদরে প্রেতাত্মা রয়ে গেছে। এসব ভাবতে ভাবতে পলিন চলে গেল কলেজে। আজ স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস।

কিছুক্ষণের মধ্যেই শুরু হবে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবসের কর্মসূচি। এ কর্মসূচির জন্য সব আয়োজন প্রস্তুত। সোনামিয়া ডিগ্রি কলেজ মাঠের পশ্চিম পাশে ছোট্ট একটা মঞ্চ তৈরি করা হয়েছে। এরই মধ্যে রমজান মঞ্চে এসে মাউথ স্পিস নিয়ে ঘোষণা দিল, প্রিয় উপস্থিতি, শুভ দুপুর। আজ স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস। আজকের এইদিনে আমরা স্মরণ করছি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। আজকের এই কর্মসূচির শুরুতেই উদ্বোধনী বক্তব্য দেবার জন্য মঞ্চে আহ্বান জানাচ্ছি শেখ রাসেল স্মৃতি সংসদের আহ্বায়ক পলিন ইমতিয়াজকে।

পলিনের বক্তব্যের পরপরই শুরু হলো বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী পাঠ। প্রথমেই একাদশ শ্রেণির ছাত্রী ইশরাত নিশা অসমাপ্ত আত্মজীবনীর একুশ নম্বর পৃষ্ঠা থেকে পাঠ শুরু করলেন- ‘রেণু একদিন আমাকে খুব সেবা করল। যদিও আমাদের বিবাহ হয়েছে ছোটবেলায়। ১৯৪২ সালে আমাদের ফুলশয্যা হয়। জ্বর একটু ভাল হল। কলকাতা যাব, পরীক্ষাও নিকটবর্তী। লেখাপড়া তো মোটেই করি না। দিনরাত রিলিফের কাজ করে কূল পাই না। আব্বা আমাকে এ সময় একটা কথা বলেছিলেন, বাবা রাজনীতি কর আপত্তি করব না, পাকিস্তানের জন্য সংগ্রাম করছ এ তো সুখের কথা, তবে লেখাপড়া করতে ভুলিও না। লেখাপড়া না শিখলে মানুষ হতে পারবে না। আর একটা কথা মনে রেখ, `sincerity of purpose and honesty of purpose’ থাকলে জীবনে পরাজিত হবা না। এ কথা কোনোদিন আমি ভুলি নাই।
পাঠ চলছে…

এরই মধ্যে পলিনের সেলফোনে রিং…। মা ফোন দিয়েছে। রিসিভ করতেই বিমর্ষ হয়ে পড়ল পলিন। দর্শকসারিতে বসা মনিজা ব্যাপারটা খেয়াল করল। পলিন রমজানকে বলে ছুটল দ্রুত ওই ধানক্ষেতে। প্রভাবশালীরা ক্ষেতে এসেছে দখল করতে। এসে দেখে প্রভাবশালীদের সঙ্গে কথাকাটাকাটি করছে পলিনের ভাইসহ আরো কয়েকজন। পলিন এসেই হুঙ্কার দিল। সঙ্গে সঙ্গে প্রভাবশালীদের একজন পলিনের শার্টের কলার ধরে কিল-ঘুষি দিতে শুরু করল। পলিনের ভাইয়া তখন ঝাঁপিয়ে পড়ল ওদের ওপর। একপর্যায়ে প্রভাবশালীরা চলে যেতে বাধ্য হলো। যখন ওরা চলে গেছে ততক্ষণে পলিনের বাম হাত থেকে রক্ত ঝরছে। শার্ট রক্তে ভিজে গেছে।

দ্রুত পলিনকে নেওয়া হলো স্থানীয় ক্লিনিকে। এদিকে কলেজে স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পাঠ কর্মসূচি শেষে ক্লিনিকে চলে এসেছে শেখ রাসেল স্মৃতি সংসদের কর্মীরা। কিছুক্ষণ পর এলো মনিজা। পলিনের মা এ সময় কান্নাজড়িত কণ্ঠে ওদের বলছে, দেখ বাবা, যে কারণে দেশ স্বাধীন করেছি, সে শোষিত শ্রেণি এখনো আছে। শেখ মুজিব বেঁচে থাকলে হয়তো তা হতো না। তোমরা মুজিবের আদর্শ ধারণ করো। সমাজ থেকে এসব লুটেরাদের বিতাড়িত করতে হবে। রমজান, মনিজা, পলাশ, শিমুলসহ সবাই তখন মাথা নেড়ে সমর্থন জানাল। ততক্ষণে পলিন ঘুমিয়ে পড়েছে। ওরা পলিনের মাকে সান্তনা দিয়ে পাশে থাকার অঙ্গীকার করে চলে এল বাড়িতে।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত