ফলিত স্বপ্নের বাসনা

তারা আমাকে বলেছিল, ‘এ ব্যাপারে তাদের মায়েদের নিষেধ আছে।’ ফলে তারা নিজেদের দেখা খারাপ স্বপ্ন কাউকে বলে না। আমি আমার ক্লাস ফাইভের বন্ধুদের সেদিন বলেছিলাম, ‘কিন্তু, আমি যে বলে দিলাম!’ তারা আমাকে জানাল, ‘বলেই ফেলছিস, কী আর করা। যা, পানি পড়া বা তাবিজ নিলে ফলবে না।’

ফলবে কি ফলবে না, সেই চিন্তা করে বন্ধুদের স্বপ্নের কথা শোনাইনি সেদিন। ‘সারাদিন একলগে চলি, আর রাতে কী হলো বলব না!’

শুনে তারা বলল, আমাদের মায় বলেছে, ‘নিজেকে দেখলে পরের উপর দিয়ে যায়, আর পরকে দেখলে নিজের উপর দিয়ে যায়।’

আমি জানতে চাইলাম, ‘কী?’

বন্ধু স্বপন সবার আগে বলে উঠল,’স্বপন’।

পড়া অবস্থায় আর কোনোদিন কাউকে নিজের দেখা স্বপ্ন বলা হয়নি। শোনার প্রসঙ্গও ওঠেনি কখনও। পড়াতে গিয়ে পরিচয় এক শিক্ষার্থীর সঙ্গে। ও আমাদের ফোকলোর বিভাগের চতুর্থ বর্ষের। সেদিনও জানতে চাইলাম, ‘তুমি এখনও স্বপ্ন দেখ?’

‘জি স্যার, দেখি।’

‘এখন মারা যায়।’

‘জি, যায়।’

আমার এই শিক্ষার্থীর নাম এখানে প্রকাশ করা গেল না। আমাদের যে সমাজ, আর ওর যে স্বপ্ন এবং সেটার যে রিঅ্যাকশন, তাতে নাম বললে ওর বিবাহ হবে না! আসলে, এই শিক্ষার্থীটি বিবাহস্বপ্ন দেখে, দেখলেই কেউ না কেউ পরিচিত মারা যায়। আর এই কারণে, বিষয়টি যেখানে তার নিজের জন্যই আতঙ্কের, সেখানে ভবিষ্যতের জীবনসঙ্গীর জন্য চিন্তার বিষয় না হয়ে পারে?

‘স্যার, আমি আর আমার বোন স্বপ্নে দাঁত পড়ে যেতে দেখলাম। আম্মাকে জানাতেই বললেন, কাউকে আর বলিস না। বলছিস? আমরা জানতে চাইলাম আম্মার কাছে, কেন আম্মা?

আম্মা হুমকি দিলেন, বললে চড় দিয়ে দাঁত ফেলে দেব। বলছি বলতে না; বলবি না। কিন্তু আমরা আম্মার নিষেধ অমান্য করে দাদিকে বলে দিলাম। সেবারই আমাদের ভাই মারা গেল। শোক কাটিয়ে ওঠার পর আম্মা আমাদের জড়িয়ে ধরে আবার কাঁদলেন এবং মনে করিয়ে দিলেন, বলেছিলাম কাউকে জানাতে না। শুনলি না তোরা!’

এই শিক্ষার্থীর কাছে আমার কৃতজ্ঞতার সীমা নেই। সে তৃতীয় বর্ষে পড়াকালে সেই কৃতজ্ঞতার শুরু। আমার প্রথম উপন্যাস ‘গোসলের পুকুরসমূহ’ (২০১৮) লেখার সূত্রপাত ঘটিয়েছে সে। তাকে নিয়ে গোটা গল্পই লিখে ফেলছিলাম, ‘বিবাহস্বপ্নের কনে’। পরে যেটা উপন্যাসের একটা অধ্যায় হয়ে গিয়েছিল।

সেই সময়টায় আমার মনোযোগ কেন জানি রাশিফলের দিকে গেল। তারপর স্বপ্ন বিষয়ে সময়-সুযোগমতো পড়াশোনা, যাকে বলে ‘অনারোলজি'(স্বপ্নবিজ্ঞান)। সিগমুন্ড ফ্রয়েড, খোয়াবনামা, মুকছেদুল মুমীনীন, মুহাম্মদ ইবনে সীরীন (রহ.) এর বই ‘স্বপ্নের ব্যাখ্যা’, ইউসুফ নবীর স্বপ্ন, পৃথিবীর বিভিন্ন সময়ে স্বপ্নের ইতিহাস, বিভিন্ন ধর্মের দৃষ্টিকোণ থেকে স্বপ্নের গুরুত্ব ইত্যাদি জানাশোনা। ধারণা শেষে শিক্ষার্থীদের সহযোগিতা চাইলাম। ক্লাসে ক্লাসে বললাম, ‘শিক্ষার্থীরা, আমি এখন স্বপ্ন নিয়ে কাজ করছি। এই বিষয়ে আশা করি তোমাদের সাহায্য পাব। তোমরা ঘুমালে যে স্বপ্নটি দেখবে চেষ্টা করবে তা লিখে রাখতে। ভুলে গেলে বা আলিজালি কিছু দেখলে যেটুকু মনে থাকবে সেটুকুই টুকে রাখবে। তোমাদের স্বপ্নগুলো আমার গবেষণায় কাজে দেবে। সবাই চেষ্টা করবে লিখে জমা দিতে। খুব ব্যক্তিগত স্বপ্ন হলে, জমা না দিতে চাইলে অসুবিধা নেই।’

ওদের স্বপ্ন কেন প্রয়োজন আর কোন সে গবেষণা, সে বিষয়ে অল্পে বললে, বঙ্গে গড়ে ওঠা অন্যান্য আখ্যানের মতোই মানুষের স্বপ্নকে ঘিরেও গড়ে উঠেছে নানা আখ্যান। সেই স্বপ্নাখ্যান বিরাজিত, সেই স্বপ্ন কেউ দেখেছিল অথবা দেখেনি। অথবা স্বপ্ন দেখার পর একে অন্যকে যেভাবে স্বপ্নটি শোনায়, তার রয়েছে বিশেষ পরিবেশনা রীতি ও আঙ্গিক।

এদিকে আহ্বান শুনে ওই শিক্ষার্থী জানতে চাইল, ‘স্যার, আপনি কি স্বপ্নের ব্যাখ্যা দিতে পারেন? আই মিন কী দেখলে কী হয়?’

উত্তর দিলাম, ‘খোয়াবনামায় কিছু সাজেশন দেওয়া আছে। এ ছাড়া ফ্রয়েডের অবচেতন মনের ব্যাপার রয়েছেই। হযরত ইউসুফ আ. স্বপ্নের ব্যাখ্যা দিতে পারতেন। তিনি জেলে থেকে তৎকালীন মিসরের বাদশাহর স্বপ্নের ব্যাখ্যা দিয়ে পরে মুক্তিলাভ করেছিলেন। ইউসুফ নবীর ব্যাখ্যায় সাতটি গাভীর যে স্বপ্নটি, সেখানে গাভীর ব্যাপারটি প্রতীকী। এর সঙ্গে দুর্ভিÿের যে তুলনা সেটি সেই বাদশাহর স্বপ্নের ক্ষেত্রে হয়েছে। অন্য কেউ গাভীর স্বপ্ন দেখে থাকলে আগে তার জীবনে ঘটে যাওয়া অতীত ও ঘটমান বর্তমান সম্পর্কে শুনে নিতে হবে। তবেই আন্দাজ করা যেতে পারে। ধর, তুমি স্বপ্নে ঘোড়ায় চড়তে দেখলে। তোমার ভাই বা বোনও স্বপ্নে ঘোড়ায় চড়তে দেখল। আমিও স্বপ্নে ঘোড়ায় চড়তে দেখলাম। একজন ভিখেরি নিজেকে ঘোড়ায় চড়তে দেখল। সব স্বপ্ন যদিও ঘোড়ায় চড়তে দেখা তবুও সব স্বপ্নের ব্যাখ্যা কখনোই এক হবে না।’

‘ধন্যবাদ স্যার, আমি প্রায়ই বিয়ে স্বপ্ন দেখি এবং তা অনেক বছর ধরেই। এই স্বপ্ন দেখলে পরিচিত কেউ না কেউ মারা যান।’ জানাল শিক্ষার্থীটি।

এও জানতে চাইল, এই বিষয়ে আমার কোনো পরামর্শ আছে কি-না, যাতে সে মুক্তি পেতে পারে।

আমি তাকে রিং ফিঙ্গারে আংটি পরার পরামর্শ দিয়েছিলাম। অত ভেবে বলিনি। শুনে অনেক শিক্ষার্থীই হেসেছিল।

এ ঘটনা আমাকে ভাবিয়ে তুলেছিল। তারপর কীভাবে কীভাবে যেন তা গল্পে রূপান্তরিত হলো, এরপর উপন্যাসে। আরও মজার ঘটনা, এই শিক্ষার্থীর ঘটনাকে উপজীব্য করে ‘বিবাহস্বপ্নের কনে’ লেখার পর একদিন বাদেই লিখলাম, ‘গোসলের পুকুরসমূহ’ নামে আরেকটি গল্প। এর পর আরও লিখলাম, তবে সেগুলো এই দুটি গল্পকে উপন্যাসের আলাদা দুটি অধ্যায় হিসেবে ধরে নিয়েই।

উপন্যাসে আমার এই শিক্ষার্থী চরিত্রের নাম ফারিয়া। এবং তাকে আমি মূর্ত করে তুলতে লাগলাম উপন্যাসের নানা জায়গায়। বিবাহস্বপ্নের একটা জায়গায় যেমন আছে-

“এরকম সব বিয়ে স্বপ্ন দেখে মেয়েটি। কলেজে পড়ার সময় তার দাদিকে সে বিষয়টি জানিয়ে সেইবারই প্রথম কারো কাছে পাত্তা পেয়েছিল। মাকে বলার পর তিনি বলেছিলেন, ‘শাক ভালো করে ধুবি, নাইলে খেতে গেলে বালি কচকচ করবে।’ তিনি পাত্তা না দিয়ে যা করছিল মেয়েটি তাই আরো ভালোভাবে করার হুকুম দিলেন। বন্ধুদের বললে তাদের কেউ কেউ বলেছিল, ‘ওমা, স্বপ্নদোষ! হুজুরের তন তাবিজ ল।’ হেসেছিল। বাবার সাথে ফ্রি না বলে জানায়নি। দাদিকে জানানোর পর তিনি বেশ চমকে গিয়েছিলেন। একটা সমাধানও দিতে চেয়েছিলেন। মেয়েটি আবার বিবাহস্বপ্ন দেখল। এর দুই দিন পর দাদি মারা গেল! সুরাহা হলো না।’

আরেক জায়গায় আছে, “এর দু’দিন পর মেয়েটি আবার এসেছিল। এসে বলেছিল, ‘স্যার, একটা স্বপ্ন দেখেছি। দেখলাম, আপনি আমাকে পরামর্শ দিচ্ছেন বাম হাতের রিং ফিঙ্গারে একটা আংটি পরতে। আমি পরলাম আর এর পর থেকে বিয়ের স্বপ্ন দেখি না।’ নির্ঝর আলম বোবা হয়ে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে ছিলেন। তিনি এমনটিই ভেবে রেখেছিলেন! দেখা হলেই বলতেন। কিন্তু তার আগেই মেয়েটি! কীভাবে সম্ভব? এর পর থেকে ফারিয়া রিং ফিঙ্গারে একটা আংটি পরে ফলও পেয়েছিল। কিন্তু আংটিটা খুলতেই হলো। এনগেজমেন্টের দিন পাত্রপক্ষ পরিয়ে দিল নতুন আংটি।”

সবচেয়ে আশ্চর্য লাগবে শুনতে, এই লেখায় আমার নিজের দেখা কয়েকটি স্বপ্নকে আমি চরিত্রদের স্বপ্নে পরিণত করেছি, আর চরিত্ররা যে স্বপ্নগুলো দেখে উপন্যাসে, সেই দৃশ্য প্রায়ই এমনি এমনি আমার চোখে ভাসে; স্বপ্ন হয়ে আসে।

এখানে একটা কথা আছে। হিপোক্রেটস (৪৬৯-৩৯৯ খ্রিষ্ট পূর্বাব্দ) স্বপ্ন নিয়ে একটি সহজ তত্ত্ব দিয়েছিলেন- ‘দিনের বেলা মানুষের আত্মা স্বপ্ন সংক্রান্ত চিত্র গ্রহণ করে এবং রাতের বেলা পূর্ণাঙ্গ একটা ছবিতে রূপদান করে।’

এ প্রসঙ্গে আমার কথা বলা যেতে পারে। বিবাহস্বপ্ন দেখলেই কেউ মারা যায়- এই তথ্যটি আমার অবচেতন দখল করে নিয়েছিল। প্রায়ই আমি ভাবতাম, এবং দিনেই হয়তো এই স্বপ্নের আশপাশে আর কী কী স্বপ্নের মতো ঘটতে পারে সে বিষয়ে ভাবতাম। এতেই রাতে স্বপ্ন বিষয়ক স্বপ্নই দেখা শুরু করেছিলাম।

এমন একটি স্বপ্ন দিয়েই শুরু হয়েছিল বিবাহস্বপ্নের কনে অধ্যায়টি। ‘কপালে লাল টিপ পরা শাদা বিড়ালটা তার বুক-লাগোয়া ডান হাতে গোঁজা। তিনি মার্জারকে নবজাতকতুল্য পরম আদরে ধরে একটা আধো অন্ধকারময় স্থান থেকে বেরুচ্ছেন; যতই আলোয় প্রকাশমান ততই ক্রমধারায় স্পষ্ট হচ্ছে কোলের বিড়ালের কপালের কোনে লেগে থাকা মাকড়সার জাল। তাকে এইভাবে আসতে দেখে ঠিক বিপরীত দিক থেকে সেও আসছে একটা শাদা বিড়ালকে টেনে হেঁচড়াতে হেঁচড়াতে, এই বিড়ালটির কপালেও লাল টিপ। পরস্পর নিকটতম হতে থাকা দুটি মানুষের আলাপনের অভাবে বিড়াল দুটি চোখাচোখি করে সেই শূন্যতা ঘোচায়। এবার হালকা বাতাসে তার বিড়ালের মাকড়সার জালটি সুতার মতো পতপতে উড়তে থাকে, ঠিক যেদিকে সেটি উড়ে যেতে চায়, সেদিকে বহুদূরে একটা বিয়ের গেটে অসংখ্য বর্ণিল কাগজের সমারোহ। গেটের উপরে ‘শুভবিবাহ’ লেখা ব্যানারটি উল্টা করে লাগানো। ভেতরবাড়িতে কনের বোনেরা বরের নাগরা লুকিয়ে ঠাট্টা করছে টাকার জন্য! অপ্রস্তুত বরের বন্ধুরা উসুল দিয়ে লুকানো জুতা ফিরে পেতে গিয়ে দেখে খড়ের গাদার নিচে এক জোড়া জামাই-জুতা ৪০ জোড়া হয়ে গেছে। অলৌকিক! সবার সঙ্গে সঙ্গে সেও তাজ্জব হয়ে গেলে ঘুম ভেঙে যায়। স্বপ্ন! বিছানা ছেড়ে জানলার কাছে যায়। মধ্যরাতে বাড়িসুদ্ধ লোক ঘুমাচ্ছে। আর ঘুম আসবে?’

এর পরের অংশটুকু আমার বানানো। কিন্তু এই বানানো অংশটুকুই আমি পরবর্তীকালে স্বপ্নে দেখেছিলাম, ‘ওয়াশরুমে ঢোকে ফারিয়া। বাতি জ্বালানোই ছিল। বেসিনের পাশে সোপকেসে শাদা রঙের কী যেন একটা সাবান, ব্র্যান্ড মুছে গেছে শরীরে মাখার কারণে। সাবানটার গায়ে একটা ছোট কালো পিঁপড়া ঘুরে বেড়াচ্ছে। যেই মাঝ বরাবর গেল ওমনি ওটাকে তর্জনীর চাপায় চ্যাপ্টা করে দিল।’

ফারিয়া যে বিবাহের স্বপ্নগুলো দেখেছে বলে উপন্যাসে আমি দাবি করেছিলাম, কার্যত সেগুলোই, খোদ উপন্যাসের পরের অধ্যায়গুলো লিখিত হবার সময়েই আমি স্বপ্নে বারবার দেখেছিলাম। স্বপ্ন আমাকে পাইয়ে দিচ্ছিল আরও নিঁখুত চিত্র, যা আমি লিখতে অক্ষম ছিলাম। এইসব স্বপ্ন আমাকে বিহ্বল করে দিয়েছে। স্বপ্ন ও বাস্তবের মাঝের দূরত্ব কিছুকালের জন্য কমিয়ে এনেছিল। বিবাহের বর্ণনা উপন্যাসে রয়েছে, তবুও স্বল্প পরিসরে শোনালে এমন দাঁড়ায়-

বিবাহস্বপ্ন ১ :চারিদিকে পানি আর পানি। একটা কলার ভেলার একপাশে শুয়ে আছে মৃত্যুপথযাত্রী। শিয়রে একটা কাক। শতবর্ষপূর্তির আগে তাহার নিদারুণ পানির তেষ্টা পানিতে পানিতে বাজে, অথচ একরত্তি পানিও খাওয়ার যোগ্য নয়। শুয়ে থাকার মধ্যেই একই ভেলায় একটা বিবাহ সম্পন্ন হচ্ছে। কাজিসহ পাত্র-পাত্রী বসে আছে কবুলের আশায়। অথচ জেবুন্নেসার বহু যুগের পুরনো বুকের ছাতি ফেটে যাচ্ছে, এক ফোঁটা পানি নেই। ফোঁটা ফোঁটা ঘাম জমেছে কনের ঠোঁটের ওপর। জামাইয়ের আদর পাবে! ততক্ষণে বিয়ে পড়ানো হয়ে গেছে।

বিবাহস্বপ্ন ২ :সবার উলুধ্বনির মধ্যে, ঢোলের বাদ্যির মাঝে পুকুরের পাড়ে দাঁড়িয়ে আছে পাঞ্জাবি, ধুতি পরা কনে আর পুকুরে তরতর করে নেমে যাচ্ছে শাড়ি পরিহিত বর। বরের শাড়ির আঁচল বাঁধা কনের পাঞ্জাবির ঝুলের সঙ্গে। বর পানিতে নামছে, নামছে আর শাড়ির প্যাঁচ খুলে যাচ্ছে শরীর থেকে কিন্তু শাড়ির পাড়ই তখনও শেষ হচ্ছে না, জমিন তো ঢের বাকি! উলু আর শঙ্খের ধ্বনি সঙ্গ দিচ্ছে।

বিবাহস্বপ্ন ৩ :বঙ্গোপসাগরে চলছে নয় নম্বর বিপদ সংকেত। ঠিক গোধূলি পরবর্তী নাবালক সন্ধ্যায় সৈকতে আছড়ে পড়ছে জলরাশি। সাপের মতো ফনা তুলে এগিয়ে এসে তীরের পায়ে মাথা রেখে চলেছে স্রোত। সেই সময়ে মাছ ধরা নৌকায় ভাটিয়ালি সুর শোনা যায়। হারিকেনের আলো সবে জ্বলতে শুরু করবে, জোয়ার বাড়ছে, ব্রীড়াচ্ছন্ন কনে সেজেগুজে বসে আছে একটু পরে হতে যাওয়া কোনো জেলে বরের বউ।

এমন বিয়ে আমি কোথাও দেখিনি, কস্মিনকালেও কেউ দেখেননি নিশ্চিত। তবে কি কল্পনা? অবশ্যই। কল্পনার পর স্বপ্ন এবং তার পর ফলিত স্বপ্ন।

গোসলের পুকুরসমূহ উপন্যাসটি আরম্ভ হয়েছে একটি স্বপ্ন দিয়ে। উপন্যাসটি পড়ার পর এক পাঠকের ফোন, পাঠক খুব নিকটজন। তিনি জানালেন, প্রথম অধ্যায় পড়ে ঘুমালেন ভালোয় ভালোয়, জেগে উঠলেন বাথটাব থেকে গোসল করে। গোসল কি খারাপ? তা না। পুকুরের বদলে তিনি বাথটাব দেখলেন, আরও কী কী যেন! বলতে লজ্জা পাচ্ছিলেন। উপন্যাসে স্বপেপ্নর যে বর্ণনা, শুনলে বোঝা যায় তার ঘটনা। ‘গ্রামের পুকুরে গোসলের নিজস্ব নিয়মে একটা লুঙ্গি ও গামছাকে পাড়ে ঘাসের ওপর এবং সাবানের কেসটাকে ঘাটের কাছে থুয়ে আমি প্রথমে পানিতে ডান পা বাড়ালাম। বাম পা নামানোর আগেই ওদের দিকে চোখ গেল। আঁতকে ওঠার মতো পরিস্থিতি। এত বছর বাদে একসঙ্গে সবাইকে পেয়ে যাব ভাবিনি। কেউ সাঁতার কাটছে, কেউ হাঁটু মাজন করছে, কেউ কোমরপানিতে দাঁড়িয়ে আঁচল বিছাচ্ছে, কেউ ডুব দিচ্ছে, কুলকুচি করছে, কেউ-বা পা দিয়ে তল খোঁজার চেষ্টারত, কেউ তালুতে পানি তুলে ছুড়ছে ওপরে; প্রত্যেকেই কোনো না কোনো ভঙ্গিতে। ওরা বারো জন। পুকুরে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে। সত্যি আমি আশা করিনি। আমাকে দেখে তারা নিজ নিজ ভঙ্গিমা মুলতবি করে সমস্বরে আহ্বান করতে থাকল, ‘আসো, আসোও, আসোওও না।’ যেন আমি আসব, এটা ওরা জানত। আর এলেই ওদের সঙ্গে গোসলে ডাকবে, এটাও ঠিক করে রাখা। আমার ভয় বা অপ্রস্তুত হওয়ার কিছু নেই। আমি স্থলে ওদের সবার সঙ্গ পেয়েছি। জলে এই প্রথম। প্রেম পৃথিবীর সর্বত্র এক; স্থল কিংবা জল যেখানেই হোক। ওরা সবাই আমার প্রেমিকা। বিভিন্ন সময়ের, জীবনে প্রথম পুকুরে গোসল করার সময় থেকে শুরু করে। একে একে সবার দিকে তাকাচ্ছি আমি। এত বছর বাদে সবার সঙ্গে দেখা হওয়ার বিস্ময় নেই আমার মধ্যে। ধীরে ধীরে পুকুরে নামতে থাকলাম। কিন্তু অজানা কারণে ওরা পিছিয়ে যেতে থাকল।

শেষমেশ আমি সাঁতরে পৌঁছে গেলাম পুকুরের মাঝখানে, যেটাকে গোলাকার পুকুরটার কেন্দ্রও বলা যায়। ওরা ততক্ষণে পাড়ে উঠে গেছে। এটাও কি পূর্বপরিকল্পিত? পুকুরের পাড়ে, যাকে বৃত্তাকার পুকুরের পরিধিও ধরা যায়, নির্দিষ্ট দূরত্ব রেখে রেখে তারা একেকজন বসেছে সুবিধামতো আসনে। শুরুতে ব্যাপারটা মাথায়ই আসেনি। কয়েক সেকেন্ড পর বুঝতে পারলাম, ওরা এবং আমি মিলে একটা দেয়ালঘড়ি বানিয়েছি! আমি ঘড়িটার কেন্দ্রে আর ওরা বারো জন ঘড়ির বারোটা ঘরে। এবার আমি দুই হাত ছড়িয়ে আছি, যেন বাম হাত মিনিটের কাঁটা, আরেকটা ঘণ্টার। তাকিয়ে দেখলাম, সাড়ে বারোটা
বারোটার ঘরে বসেছে আমার প্রথম প্রেমিকা খাদিজা। ছয়টার ঘর হয়ে বসে আছে সর্বশেষ প্রেমিকা ফারিয়া। অন্যরা যথাক্রমে, একটার ঘরে আশা, দুইটার ঘরে রুমানা, তিনটার ঘরে রাবেয়া, চারটার ঘরে লায়লা, পাঁচটার ঘরে লিজা, সাতটার ঘরে তিশা, আটটার ঘরে তামান্না, নয়টার ঘরে তানিয়া, দশটার ঘরে নাফিজা, এগারোটার ঘরে দিশা। সাড়ে বারোটা মানে, এখন আমার বাম হাতটা ফারিয়া বরাবর রয়েছে আর ডান হাতটা খাদিজা ও আশার ঠিক মাঝ বরাবর।

নিরবচ্ছিন্নভাবে এই ঘড়িটায় ঠিক সময় বাজাতে চাইলে আমার দুই হাতকে সচল রাখতে হবে, অন্যদিকে ওদের এ ক্ষেত্রে কোনো ভূমিকা নেই। বারোটা বেজে পঁয়ত্রিশ মিনিটের অর্থ হলো, আমার বাম হাতটাকে ঠিকঠাক সেকেন্ড অনুসরণ করে ফারিয়া থেকে তানিয়া বরাবর নিতে হবে। ঘণ্টার কাঁটারূপী ডান হাতের যথাযথ মিনিট অনুসরণ তো আছেই, একটা বাজলে সেটাকে আশা বরাবর যেতে হবে। অন্যদিকে বাম হাত থাকবে খাদিজা বরাবর।’

তিনি লজ্জার কথা ঢাকলেন এই বলে, এখনও তার দুই হাত ব্যথা করছে!

এভাবেই একের স্বপ্ন অন্যে দেখে, কেউ কেউ স্বপ্নের ভেতর স্বপ্ন দেখে, একই স্বপ্ন বারবার দেখে তার রাত রজনী হয়ে যায়, একই স্বপ্ন বিভিন্ন সময়ে দেখেন, জীবনভর দেখেন, স্বপ্ন সাদাকালোই কিন্তু কেন যেন মনে হয় রঙিন। ছিল বন্ধু, স্বপ্নে দেখার পর হয়ে যায় প্রেমিকা, স্বপেপ্নর মধ্যেই বোঝা যায় স্বপ্ন, কিছু স্বপ্ন ভয়ঙ্কর, উত্তেজনাপূর্ণ, জাদুময়, মর্মান্তিক, সাহসিক বা যৌন উত্তেজনার। কেউ কেউ কাউকে স্বপ্ন দেখার আশায়-অপেক্ষায়-আক্ষেপে কাটিয়ে দেন কত না রজনী! তারা যদি জানতেন, তাহলে হয়তো মিসরীয়দের মতো স্বপ্নে পাওয়ার আশায় বিশেষ ধরনের ‘স্বপ্নের বিছানা’য় ঘুমাতেন।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত