সাধনের শরীরে অসীম শক্তি কিন্তু ওর মুখে কোনো কথা নেই; কেউ শোনেনি কোনোদিন। কিংবা ও ইচ্ছে করেই কথা বলা বন্ধ রেখেছে কি-না, এই তথ্যও জানা নেই কারো। সাধনকে এ বাড়িতে নিয়ে এসেছে এ বাড়ির মালিকের গার্মেন্টস কারখানার শিফ্ট ম্যানেজার একরাম হাওলাদার। সাধনদের গ্রামের বাড়ি হাওলাদারদের বাড়ির কাছেই, একই গ্রামের নমঃশূদ্রপাড়ায়। কয়েক ঘরই আছে অবশিষ্ট সেখানে, বাকিরা গেছে, চলেই গেছে। যারা আছে তাদের আসলে যাওয়ারও জায়গা নেই। সাধন এই কিশোর বয়সেও বেশ বড়সড় কিন্তু বুদ্ধিসুদ্ধি কম বলেই তাকে তার মা ননীবালা একরাম হাওলাদারের হাতে তুলে দিয়ে বলেছেন, ‘বাবা একরামরে, ছাওয়ালডারে দেলাম। জানডা জানি থাহে, পুইষ্যা পোলা জান থাকলি ধন-মানও আসফি কোনো না কোনোদিন।’ একরাম হাওলাদার তার মালিকের জন্য এ রকম একটি শক্ত-সমর্থ কিশোরকে জোগাড় করে দিতে পারছে, এতেই তার আনন্দের সীমা নেই। কারণ দীর্ঘদিন ধরে মালিকের দুটো দুধেল গাই দেখাশোনার জন্য লোক খুঁজছিলেন ভদ্রলোক। কেউই বেশিদিন টেকে না। আজকাল অবশ্য লোক পাওয়াও মুশকিলের।
কেউ বাড়িতে কাজ করতে চায় না। টাকা-পয়সার লোভেও না। এখন ছেলেপেলেরা একটু বড় হলেই ঢাকায় এসে হয় গার্মেন্টসে, না হয় মোটরসাইকেল কিনে ‘খেপ মারা’ শুরু করে। আর কিছুই না পেলে চুরি-ডাকাতিতেও আপত্তি হয় না।
কিন্তু কারো বাড়িতে কাজ করে খাওয়ার দিন কি আর আছে এদেশে? এ সত্য আজকাল ধনী কিংবা মধ্যবিত্ত প্রত্যেকেরই বসার ঘরের সবচেয়ে বেশি আলোচ্য বিষয়। এর বাইরে মেয়েদের কথাও যখন ওঠে, তখন গার্মেন্টস ব্যবসায়ীরা পড়েন তোপের মুখে, ‘এই, তোমাদের জন্যই আজকাল আর কাজের মেয়ে পাওয়া যায় না। নিজের কাজ নিজে করার মতো বিদেশ কি আর বাংলাদেশ হয়েছে, বলো? আর মেয়েগুলাও হয়েছে তেমনি। যেন গার্মেন্টসে কাজ করলেই সকল শান্তি; ঘরের কাজ করলে জাত যাবে’- আলোচনার এক পর্যায়ে যে মেয়েটি খাবার কিংবা পানীয় পরিবেশনের মধ্যে আলোচনায় ঢুকে পড়ে তাকে দেখেই সকলে আলোচনাটা বদলে ফেলেন ত্বরিত। কে জানে, গৃহকর্ত্রীর যদি তাকে কোনো অকল্যাণ হয়? অকল্যাণ এক্ষেত্রে এই বহু চেষ্টা-চরিত্তির করে একটি মেয়েকে জোগাড় করার পরও তার চলে যাওয়া।
তো এমন মানুষের আকালের বাজারে সাধনের মতো কিশোরকে পেয়ে একরাম হাওলাদারের মালিক তো বেজায় খুশি। তার গার্মেন্টস কারখানা থেকে মাইল কয়েক দূরেই যে বাগানবাড়িটি আছে সেখানেই তার গাই দুটি থাকে। বিদেশি জাতের কয়েক লাখ টাকা দামের দুটি গাই। তাদের যত্ন নিতে হয় ঘড়ি ধরে। খাবার দেওয়া থেকে শুরু করে স্নান করানো সবই সময়মতো না করালে তাদের অসুখ করে। সে কারণে যার-তার হাতে তাদেরকে ছাড়াও যায় না, আবার তাদেরকে বিক্রি করে দেওয়ার মতো কষ্টের কাজটিও একরাম হাওলাদারের মালিক ভদ্রলোক করতে চান না। কারণ তার কন্যারা মাঝে মাঝে এসেই এই গরু দুটিকে আদর করে যায়। আর এখন তো তাদের একটি যার নাম মেয়েরা দিয়েছে ‘ক্যাটস আই’, তার একটি বাছুরও হয়েছে, যাকে মেয়েরা আদর করতে করতে প্রায় মেরেই ফেলতে চায়। তারও নামটি মেয়েদের দেওয়া, ‘বিবার’; জাস্টিন বিবার নামক গায়ক যার জন্য পৃথিবীময় একাধিক কিশোরীর আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে বলে জানা যায় তিনি যদি জানতে পারতেন যে, তার নামে এদেশে একটি ধেনু-শাবক রয়েছে, তাহলে তার চেহারাটি কেমন হতো, সেটা কল্পনা করার শক্তি আমাদের বোধ করি নেই।
আমরা সে কল্পনাশক্তি খরচও করতে আগ্রহী নই। আমরা দেখতে চাই যে, অস্ট্রেলীয়-জাতের দুটি পাহাড়ের মতো গরুর সঙ্গে সাধনের সম্পর্কটি কেমন ও কতটা গভীর। সাধনকে মাসখানেক ধরে একটি গরুর খামারে গিয়ে গরু পালনে বিশেষ করে বিদেশি গরু পালনের ওপর প্রশিক্ষণ নিয়ে আসতে হয়েছে। সাধনের গরু দুটির মালিক গরু-খামারের প্রশিক্ষকের সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনা শেষে যখন নিশ্চিন্ত হয়েছেন যে, সাধনের পক্ষে সম্ভব তার মেয়েদের প্রিয় দুটি গরুর দেখভাল করা, তখনই কেবল তার হাতে গরু দুটিকে ছেড়ে দিয়ে তিনি নিশ্চিন্ত হয়ে ঢাকায় ফিরেছেন। তার তো আর সব সময় এই দুই গরু নিয়ে পড়ে থাকলে হবে না। তার তো অনেক ব্যবসা আছে। যার মধ্যে একটি পাশের দেশ থেকে গরু এনে দেশের বাজারে বিক্রি করাও। সে অবশ্য এখানে নয়, গরু নিয়ে আসা হয় সীমান্তবর্তী কোনো জেলায়। সেখানে কিছুদিন রেখে তারপর দেশের বাজারে বিশেষ করে চট্টগ্রামসহ অন্যান্য জেলায় পাঠানো হয়। তাই মালিক ভদ্রলোক সাধনের ওপরই সবকিছু ছেড়ে চলে আসেন। আর সাধনের দায়িত্ব ছেড়ে দেন একরাম হাওলাদারসহ অনেকের ওপর। মালিকপক্ষের এ রকম বহু লোক থাকে। সেটাই স্বাভাবিক, ক্ষমতা রক্ষার জন্য রক্ষিত নিয়োগের বিষয়টি পুরনো ও আদিম।
সাধনের সঙ্গে গরু দুটি এবং তাদের একটি শাবকের ভাব হতে বেশি সময় লাগে না। সাধন গ্রামের ছেলে, খাটুনিতে তার ক্লান্তি নেই। যে বিঘাদশেক জায়গা নিয়ে এই বাগানবাড়িটি, সেখানে প্রায় দেড় বিঘা জায়গাজুড়ে এই গরুদের জন্য বিদেশি ঘাস লাগানো হয়েছে। যে ঘাস কাটলে বাড়ে, না কাটলে দ্রুত মরে যায়। সাধনের বিস্ময় লাগে, এমন ঘাসও দুনিয়ায় আছে, যা সপ্তাহে একবার না কাটলে দুই সপ্তাহ পরে প্রায় শুকিয়ে ঢলে পড়ে! আর যদি গোড়া থেকে বিঘত খানেক ওপরে কেটে নিয়ে গিয়ে গরুকে খাওয়ানো যায় তাহলে পরের সপ্তাহেই আবার লকলকে সবুজ শরীর নিয়ে তরতর করে ওঠে ঘাসটি। শুধু ঘাস খাওয়ালেই হয় না; এই গরুর জন্য আনা হয় বস্তা ভরে বিশেষ বিশেষ খাবার। গমের ভুষির সঙ্গে কত কিছু মিশিয়ে যে এই খাবার বানানো হয়, তা সাধনের জানা নেই। সাধনের সবচেয়ে ভালো লাগে এই গরুগুলোকে ডলে ডলে স্নান করাতে। বোঝাই যায়, গরমের দুপুরে ওদের শরীরে জল ঢেলে যদি বিশেষ চিরুনির দাঁত দিয়ে ঘষা যায় তাহলে ওরা যেন খলখল করে হাসে। সাধন ঠিক শুনতে পায় ওদের হাসি। সাধন তখন দ্বিগুণ শক্তিতে গরুগুলোর গা ডলতে থাকে। তারপর ওদের শরীর মুছে পরিস্কার মেঝের ঘরটিতে এনে চারদিক থেকে পাখা ছেড়ে দেয়, বনবন করে পাখা ঘোরে আর বেশ জোরে বাতাস ওদের শরীরে যে আরাম এনে দেয়, সেটাও গরুগুলোর চোখ দেখে সাধন বুঝতে পারে। ওদের সামনে থাকে তখন নানাবিধ খাবার, ওদের শরীরের আনন্দ আর মুখের ভেতর খাবার চিবোনোর শব্দ; সব মিলিয়ে একটা অন্যরকম পরিবেশের সৃষ্টি হয়। আর ‘ক্যাটস আই’-এর বাছুরটি তখন মনের আনন্দে মায়ের দুধের বাঁট শুষে প্রতিদিনই গায়ে-গতরে বাড়তে থাকে।
কিন্তু বিবার নামের বাছুরটির খাবারে ভাগ বসানোর জন্য অনেকেই মুখিয়ে থাকে। এর মধ্যে মালিকের ঢাকার বাসায় ভোর-সকালে আধা ড্রাম দুধ পাঠাতে হয় প্রতি শুক্রবার। সপ্তাহের বাকি দিনগুলোর দুধ যদিও খাওয়ার কথা বিবারের, কিন্তু বিবারের ভাগ থেকে এই বাগানবাড়ি যারা রক্ষা করার জন্য বিভিন্ন কাজে নিয়োজিত তারা তা স্থানীয় বাজারে বিক্রি করে ভাগযোগ করে নিয়ে থাকেন। সে ভাগে অবশ্য সাধনের কোনো হিস্যা নেই। এমনকি সাধনের মুখ বন্ধ রাখার জন্য তাকে কখনও কেউ বলেনি, ‘এই নে দুটো টাকা, রাখ, কিন্তু মালিককে কিছু জানাবি না।’ তবে সাধন এ কথা নিজেই ওর বুদ্ধি দিয়ে বুঝেছে, এ বিষয়ে মুখ খোলা যাবে না। সাধন তো আসলে কথাই বলতে পারে না বা কথা বলে না। ও ওর দায়িত্বটুকু পালন করে যায় কোনো খুঁত না রেখে। তাই ওকে কথা বেশি বলতেই হয় না। অন্যেরা অবশ্য একথা আড়ালে-আবডালে বলে থাকেন যে, সাধন নাকি গরুগুলোর সঙ্গে নিয়মিতই কথা বলে। কতদিন হলো, মাত্র তো ছ’সাত মাস, এরই মধ্যে গরুরাও সাধনের ভাষা বুঝতে পারে; এটা কিন্তু এ বাড়ির রক্ষিতদলের কাছে বেশ বিস্ময়ের ব্যাপার। আমরা সে বিস্ময়ও পেছনে রাখতে চাই। কারণ হঠাৎ এই বিশাল বাড়িতে আরও অনেক অনেক গরু নিয়ে আসা হয়। অনেক অনেক বলতে শ’খানেক তো বটেই। কী করে এলো?
সেদিন আকাশটা মেঘলাই ছিল। এ বাড়িতে অবশ্য এত গাছগাছালি যে, সারাদিন বাড়িটায় মেঘ জমে থাকে। আর কোরবানির মাত্র সপ্তাহখানেক আগের ঘটনা। হঠাৎই রাতের বেলা একের পর এক ট্রাক ভরা গরু ঢুকতে লাগল এই বাড়িতে। এত গরু রাখার জন্য কোনো ব্যবস্থাও করা হয়নি। তারপরও এগাছে ওগাছে, অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে অনেক খাম পুঁতে তার সঙ্গে গরুগুলো বাঁধা হলো। আসলে সীমান্তে সেবার গরু আনানোয় নাকি অনেক কড়াকড়ি হয়েছে। তাছাড়া মালিকের গরু-ব্যবসার পার্টনারের সঙ্গেও লেগেছে গণ্ডগোল। তাই গরুগুলো এখানে এনে রাখা হয়েছে। সাধন গরুগুলোকে দেখেই বুঝেছে, এগুলো দীর্ঘদিনের অভুক্ত আর খুবই ক্লান্ত। কিন্তু গরুগুলোর চোখ কেন বন্ধ, সেটা ঠিক ঠাহর করতে পারেনি সাধন। তা ছাড়া মেঘলা দিন থাকায় সন্ধ্যেটাও সেদিন একটু তাড়াতাড়ি হয়েছিল। তবুও সাধন বালতি ভরে পানি এনে যত গরুর পেরেছে খাইয়েছে। শ’খানেক গরু তো হবেই। আশ্চর্য যে, ট্রাক থেকে নামানোর পরও গরুগুলোর একটিও শোয়নি, সব দাঁড়িয়ে থাকে সটান। আর থেকে থেকেই দীর্ঘ একটা শ্বাস ছাড়ছিল। মনে হচ্ছিল, ওরা এই বাতাস ওদের শরীরের ভেতরই জমিয়ে রেখেছিল। একেকবার একেকটি গরু শ্বাস ছাড়ে আর মনে হয়, এই শ্বাসের সঙ্গে বুঝি ওদের জীবনটাও বেরিয়ে যাবে। সাধনের বুকটা ভেঙে যাচ্ছিল যেন এই শ্বাস ছাড়ার শব্দে। সে রাতে ঝুম বৃষ্টি হয়েছিল, তবুও রাতভর গরুগুলোর জন্য যথেষ্ট করেছে সাধন। পানি খাওয়ানো, খাবার দেওয়া; কিন্তু একটা গরুও মুখে কিছু তোলেনি। দু’একটি হয়তো শুঁকে শুঁকে দেখেছে সামনে রাখা ভুষি বা বিদেশি ঘাস। কিন্তু মুখে তুলে চিবিয়েছে বলে সাধন মনে করতে পারে না। ও তখনও ভাবছিল, কেন গরুগুলোর চোখ বন্ধ। কাউকে জিজ্ঞেস করবে সে জো-ও নেই। ট্রাকের সঙ্গে আসা লোকজন গরুগুলো নামিয়েই মড়ার মতো ঘুমুচ্ছিল।
সকালে এই বাড়ির উঠোন ভরা কাদা। লাল মাটির আঠালো কাদার মধ্যেই গরুগুলো তখনও দাঁড়িয়ে আছে আর চোখ বন্ধ।
সাধন সবার আগে উঠে গরুগুলোর জন্য আবার পানি, ঘাস, ভুষির ব্যবস্থা করতে লেগে গিয়েছে। ও রাতভর একটুও ঘুমিয়েছে কি-না তা আমাদের জানা নেই। আমরা দেখতে পাচ্ছি, সাধন ছুটছে। পানি আনছে, ভুষি নামাচ্ছে বস্তা থেকে।
গরু নিয়ে আসা একটি ছেলে এসে তখনই সাধনকে ডেকে বলে, ‘এই ছ্যাড়া হুন, এই গরুডিরে আর খাওন দিবি না।
কাইলকা রাইতেই আবার রওনা দিতে ওইবো এইডিরে লইয়া। খাইলেই টেরাক মাখাইয়া ফালাইবো হাইগা। খবরদার, কোনো খাবার না।’
এই নির্দেশের সুযোগে সাধন জিজ্ঞেস করার চেষ্টা করে, গরুগুলোর চোখ বন্ধ কেন? কিন্তু ও তো আসলে কথাই বলে না।
ওর গলা দিয়ে কোনো স্বর বের হয় না। কিন্তু যে চোয়াড়ে ছেলেটা সাধনকে এই নির্দেশ দিতে এসেছিল তার হাতে একটি চটের থলে। সেটি সাধনের হাতে দিয়ে আবারও নির্দেশ দেওয়ার ভঙ্গিতে বলে, ‘আর হুন, এই ব্যাগডার মইদ্যে ধাইন্যা মইচ আছে। তুই মইচডি দুই ফালা কইরা ফাড়বি, তারপর পেত্যেকটি গরুর দুই চোখ থিক্যা আগের মইচডি বাইর কইরা নতুন কইরা মইচ দিবি। আগেরডির ঝাল গেছেগা। এট্টা এট্টা কইরা গরু অ্যাহন শুইবার লইছে। টিরাকে শুইয়া পড়লে মহা যন্তনা হইবোনে। মইচ চেন্জ না করলে নতুন টেরাক ভাড়া করন লাগবো, খরচ বাইড়া যাইবো।’
এবার সাধন বুঝতে পারে কেন গরুগুলো সারারাত এমনকি সকালেও দাঁড়িয়ে আছে। ও পেছন ফিরে উঠোনের দিকে তাকিয়ে দেখে সেখানে দুটি বা তার চেয়ে বেশিও হতে পারে গরু মাটিতে শুয়েছে আর বন্ধ চোখটা খোলার চেষ্টা করছে।
সাধন কী বলবে বুঝতে পারে না। ছেলেটির হাত থেকে মরিচ ভরা থলেটি নেয়, ভেতরে দেখে বেশ মোটা মোটা খাটোমতো মরিচ। কোনোটা কাঁচা, কোনোটা আধাপাকা, কোনোটা একেবারেই লাল হয়ে গেছে। সাধনের কোনো বক্তব্য যেহেতু নেই, ওর কথা বলার ক্ষমতাই আছে কি-না সেটাও যেহেতু আমরা জানি না, সেহেতু আমরা দেখি, সাধন মরিচের থলেটি হাতে নিয়ে একটা টিনের একচালামতো জায়গায় চলে যায়। কিছুক্ষণ পর সেখান থেকে বেরিয়ে আসে, দাঁড়িয়ে থাকা গরুগুলোর একেকটির সামনে এসে দাঁড়ায় আর কাঁপা কাঁপা হাতে তাদের চোখ খুলে পুরনো প্রায় গলে নরম হয়ে যাওয়া আধফালি মরিচ বের করে সেখানে নতুন করে কাটা আধফালি মরিচ ঢুকিয়ে দেয়। গরুটির ছট্ফট্ করার ক্ষমতাও তখন আর অবশিষ্ট আছে কি-না, বোঝা যায় না। কারণ তারা খুব বেশি বাধা সাধনকে দেয় না। সাধন দ্রুতই কাজটি শেষ করতে পারে। সাধন চাইছিলও তাই। যত দ্রুত এখান থেকে সরে যাওয়া যায়, ততই যেন ওর লাভ। আমরা অবশ্য এ কথা জানতেও পারি না, সাধনের কিসের লাভ! কারণ ওর কথা তো আমরা কখনও শুনিইনি।
পরদিন গরুগুলোকে আবার ট্রাকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়, রাতের অন্ধকারেই। সে রাতেও ঝুম বৃষ্টি হচ্ছিল, সাধনও জেগে ছিল রাতভর। শুধু সে রাত কেন, এরপর অনেক রাতেই সাধনের ঠিকমতো ঘুম হয়নি। যদিও দিনভর যে পরিমাণ খাটুনি ওর হয়, তাতে ওর সন্ধ্যে না লাগতেই মড়ার মতো ঘুমিয়ে পড়ার কথা।
সাধনের ঘুম হওয়া বা না-হওয়া এখানে মুখ্য বিষয়ও নয়। সাধন এই বাড়িতে আরও বছর দু’য়েক বিদেশি গরুগুলোর দেখভাল করেছিল বলে জানা যায়। একটি ঘটনা, যার সঙ্গে একটু আগে শোনা গরু ও মরিচ সংক্রান্ত ঘটনার কোনো মিল আমরা খুঁজব কি-না, তা আমাদের নিজস্ব বিবেচনা। কিন্তু ঘটনাটি আমাদের জানা থাকাটা জরুরি। সেবারও ঘটনাটি এক ঈদের সময়ের। রোজার সময়েই মালিক জানতে পেরেছিলেন, তার এবং তার কন্যাদের প্রিয় গরু দুটির দুধ দেদার বিক্রি হয়ে যাচ্ছে। তারা অবশ্য এ কথাও জেনেছিলেন, এই বিক্রির সঙ্গে সাধনের কোনো যোগসূত্র নেই। কিন্তু সাধন কেন তাদেরকে বিষয়টি জানায়নি কখনও, সে জন্য তাকেও চড়-চাপড় খেতে হয়েছে। কিন্তু ও তো কথাই বলতে পারে না- এ কথাও মালিক আলোচনা করেছে। আর যাদেরকে হাতেনাতে দুধ বিক্রিতে ধরে ফেলেছে তাদেরকে জুতো মারা থেকে শুরু করে চাকরিচ্যুত; সবই করেছে। পুরো একটা দলকে চাকরি থেকে বিদায় দিয়েছে, এসেছে নতুন দল। কিন্তু সেবার যেদিন ঈদের ছুটিতে মালিক যখন সপরিবারে বিদেশে বেড়াতে গেলেন তার পরদিনই ‘ক্যাটস আই’-র ওলানটি বেঢপ ফুলে উঠল।
গরুটি কিচ্ছু মুখে নেয় না, দিন গড়িয়ে যায়, রাতে তার মুখ থেকে ফেনামতো বের হতে থাকে। বাছুরটিও আর ওলানে মুখ দেয় না; সমানে হামলে যায় ক্যাটস আই, যে গরু মুখ দিয়ে কোনো আওয়াজ করেনি কোনোদিন, সাধনের মতোই যে সম্পূর্ণ নীরবই বলতে গেলে, তার অমন চিৎকার সাধনকে বিচলিত করে। সাধনকে সেই শ’খানেক গরুর বন্ধ চোখে নীরবে দাঁড়িয়ে থাকার দৃশ্যের কথা মনে করিয়ে দেয়। সবাই ছুটিতে, কাকে ডাকবে সাধন! মালিকের সঙ্গে সরাসরি ওর যোগাযোগ নেই, কথা বলতে পারে না, যোগাযোগ করবে কী? সব কথা মালিককে যে জানায় সেও গেছে ছুটিতে। সাধন সারারাত জেগে বসে থাকে, ভোরবেলা সাধনের চোখের সামনে ক্যাটস আই ছট্ফট্ করতে করতে মারা যায়- এ দৃশ্য সাধনকেও প্রায় মৃত করে ফেলে। সাধন পালাতে চায়, কিন্তু বাকি গরুগুলো রেখে কোথায় পালাবে সাধন? তা ছাড়া মৃত ক্যাটস আই-এর শরীর তখন আরও ফুলে গেছে, বাছুরটি দুধ না পেয়ে বারবার মায়ের কাছে এসে হামলাচ্ছে।
সাধনের পক্ষে এই কষ্ট নেওয়াও কঠিন হয়ে পড়ে। তারপরও প্রায় দু’দিন সেই মৃত গরু নিয়ে সাধন ওই বাড়িতে একা কাটিয়েছে। পরে লোকজন ফিরে এলে তারা প্রথমে সাধনকে দোষ দিলেও ডাক্তার ডেকে পরীক্ষা করানোর পর জানা যায়, কে বা কারা ক্যাটস আই-এর দুধের বাঁটের মধ্যে চিকন চিকন কাঠি ঢুকিয়ে রেখেছিল। বাছুরটিও খেতে পারেনি দুধ আর দুধ দোয়ানোর নিয়মই তো বন্ধ করে দিয়েছিলেন মালিক। ডাক্তার দুধের বাঁট থেকে সেই কাঠি বের না করলে সাধনকে নিঃসন্দেহে মালিক পিটিয়ে মেরে ফেলতেন। মালিকের মারে সাধনের মৃত্যু হয়নি সত্য, কিন্তু সাধন আর এই বাড়িতে থাকতে পারছিল না। দুঃস্বপপ্ন আর গরুর করুণ আর্তনাদ সাধনকে পাগলই করে দিয়েছিল, যেহেতু সাধন কথা বলে না, তাই ওর এই দুঃস্বপ্ন সম্পর্কে বিস্তারিত আমাদের জানা নেই। তবে এক রাতগভীরে সাধন ওই বাড়ি থেকে বেরিয়েই পড়েছিল। সাধনের পরবর্তী কর্মস্থল সম্পর্কে কিছুই জানা যায় না।