বৈভব ও দ্বিতীয় মা

বিষয় হলো বিষ, বুঝলেন অভিষেক?

লাঞ্চ আওয়ার, আফসানা বেগমের চেম্বারে বসে আছে অভিষেক আর জুনায়েদ। এজিএম থেকে ডিজিএম হয়েছে আফসানা, লাঞ্চ আওয়ারে ওদের কাচ্চি বিরিয়ানি খেতে ডাক পড়েছে।

হ্যাঁ – প্রমোশন হলে খাওয়াতে হয়, এ এক ধরনের বিমল আনন্দ। সব ধরনের আনন্দে একটু খাওয়া-দাওয়া না হলে খুশির প্রকাশ ঠিকমতো ঘটে না।

পিয়ন তাহের পেস্নটে সাজিয়ে দিয়েছে চামচ, পাশে মিনারেল ওয়াটারের বোতল, ন্যাপকিন। গতকাল বিকেলে অফিসের সবাইকে স্ন্যাকস-কফি খাওয়ানো হয়েছে। এজিএম হিসেবে তিনজন একসঙ্গে কাজ করেছেন ক-কছর।

কাছের মানুষ বলেই কথাটি বলেন আফসানা।

– বিত্ত-বৈভব আপনজনকে বড্ড পর করে দেয়, আপনি কী বলেন জুনায়েদ? জমি আর সম্পদের মতো এত বাজে জিনিস আর নেই অভিষেক। রক্তের সম্পর্কও বিষিয়ে যায়।

বিষয়-সম্পত্তি অনেক সময় অশান্তির কারণ হয়, এ-কথা তো নিখাদ সত্যি, আপনজনের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি হয় – এসব চিরকালীন ব্যাপার কিন্তু আফসানা কেন যে মন্তব্যটি করল ঠিক বুঝে উঠতে পারল না দুজনের কেউই।

আফসানা বলে, রাজশাহী গেলাম কদিন আগে। আববা নেই, আম্মারও বয়স হয়েছে, বললেন – আমি থাকতে থাকতেই জমিজমা, তোমার আববুর রাখা ফিঙড ডিপোজিট যা আছে এবার ভাগ করে দেবো। কবে আছি কবে নেই। আর অমত করিসনে মা, নাটোর থেকে মোনাকেও আসতে বলেছি। ভাই আমার একটাই – আনোয়ার – আম্মার কথা শুনে কী মুখভার ওর, কথাই বলে না আমার সঙ্গে।

জুনায়েদ আর অভিষেকের খাওয়া থেমে যায়।

– মানে? তাজ্জব ওরা।

– তা আর বলছি কী। এক পেস্নটে আম্মু ভাত মেখে খাইয়ে দিয়েছেন। আমাদের ছোটভাই, টয়লেটে নিয়ে গেছি, সেই ভাই বিষয়-সম্পত্তির কথা উঠতেই পর হয়ে গেল।

জুনায়েদ বলে, আশ্চর্য তো, এ তো আপনার ন্যায্য পাওনা।

ব্যক্তিগত সুখ-দুঃখ শেয়ার করার মোক্ষম সময় এই লাঞ্চ আওয়ার।

আফসানা বলে, আরে বাবা, বুঝতে পারছেন না? তুমি শ্বশুরবাড়ি গেছ, বাপের বাড়ির সম্পত্তি নিয়ে টানাহেঁচড়া কেন বাপু? বুক মন্থন করা নিশ্বাস ফেলে আফসানা বলে, এই হলো দুনিয়া।

নিজের কেবিনে বসে ফাইল খুলে আর দেখতে ইচ্ছে করে না অভিষেকের। বুকের ভেতরটা হঠাৎ করেই গভীর বিষাদে ভরে যায়। নতুন করে আবার সিলেটের মির্জাজাঙ্গালের বাড়িটির জন্য চোরাটান অনুভব করতে থাকে অভিষেক। এ-কথা আজকাল আর মুখ ফুটে শ্রেয়াকে বলতে পারে না। চাকরির কারণে বেশিরভাগ সময় বাড়ি থেকে বাইরে থাকতে হয়েছে। সে-কারণেই পরিবারের

সঙ্গে দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে কিনা অভিষেক ঠিক বুঝতে পারে না। উৎসব-আনন্দের দিনগুলো আসে যথানিয়মে আবার চলেও যায়। অভিষেক কান পেতে থাকে, যে-কোনো সময়ে মোবাইল বা ল্যান্ডফোন বেজে উঠতে পারে। মা বলবেন, কী রে – পৌষসংক্রান্তিতে আসবি না?

দুভাই অপরেশ-অনিমেষ বলবে, বুবুন আর বাবলিকে নিয়ে চলে এসো বউদি। আম-কাঁঠাল খেয়ে যাবে।

শহরের এই বাড়িতে বেশকটা আম-কাঁঠাল গাছ রয়েছে। নাহ্ – তেমন কোনো ডাক আর আসে না। সম্পর্কে এখন ঘন শ্যাওলার আস্তরণ পড়েছে। কিন্তু কী কারণে?

বুক মন্থন করা নিশ্বাস বাতাসে মিশে যায়। আফসানা আপা যে বলেছে, বিষয় হলো বিষ, বিত্ত-বৈভবের কারণে সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যায় – তাই কি?

ছেলে বুবুন, মেয়ে বাবলি কেউ কাছে নেই। অভীক হায়ার স্টাডিজের জন্য অস্ট্রেলিয়ায়, শ্রেষ্ঠা শ্বশুরবাড়িতে ঢাকার উত্তরায় থাকে। ওদের সঙ্গে কথা বলে কিছুটা হলেও হালকা হতে পারত অভিষেক। শ্রেয়ার সঙ্গে ব্যাপারটি শেয়ার করতে গেলে তিক্ততা বাড়বে বই কমবে না।

তবু জগৎ-সংসারে কখনো-সখনো মিরাকল ঘটে। মির্জাজাঙ্গালের বাড়ি থেকে ফোন আসে। অবিশ্বাস্য ঘটনা এটি। প্রায় সাত বছর পর মায়ের গলা শোনে অভিষেক – বাড়ি একেবারে ছেড়ে দিলি বাবা? এবার আসতে হবে। সামনে পৌষসংক্রান্তি, এর আগেই চলে আসবি কিন্তু। সবাই মিলে আনন্দ করব।

মায়ের নির্দেশ শুনে অভিষেকের দুচোখ ভিজে ওঠে, ঠিক ছেলেবেলার মতো। বাবা নেই, মা শুধু রয়েছেন। এতদিনকার জমানো অভিমান মায়ের কথায় বৃষ্টিধারার মতো ধুয়েমুছে যায়। শ্রেয়াও উৎফুলস্ন হয়ে ওঠে। কতদিন পর চেনা শহরে যাওয়া, নিজের বাড়িতে পা রাখা।

দুই

চেনা বাড়িটিকে ভীষণ অচেনা মনে হয়। শৈশব, কৈশোর আর তারুণ্যের বেশ কিছুটা সময় যেখানে কেটেছে – সে-বাড়ি চিনতে এত ভুল হচ্ছে কেন? অভিষেকের মনে দারুণ অসোয়াস্তি।

শ্রেয়াও ভীষণ অবাক হয়ে গেছে। এখন রিনিউয়েলের যুগ। একঘেয়ে কিছু ভীষণ বোরিং লাগে। চেহারায় হেয়ার স্টাইলে সব সময় মানুষ নতুন লুক পছন্দ করে। বাড়িতেই বা নয় কেন!

পেলমেট থেকে ঝুলছে অফ হোয়াইট রঙের ছাপা পর্দা, মেঝেতে বেবি পিংক রঙের দৃষ্টিনন্দন টাইলস। পস্নাস্টিক ইমালশনের ছোঁয়ায় ঠিকরে পড়ছে আলো।

এমন হতেই পারে। সাত বছর হয়ে গেল বাড়িতে আসেনি ওরা। জীবনের প্যাটার্ন এখন অনেক বদলে গেছে – কথাটি বাবলি প্রায়ই বলে। যার স্কুলের নাম ছিল শ্রেষ্ঠা।

তবে শ্রেয়ার ব্যাপারটা অন্যরকম। রোমান হলিডে দেখে এখনো শিহরিত হয়। ভালো লাগার রোমাঞ্চে শরীর-মন ভরে যায়। এরপরও পুরনো স্মৃতির ছায়ায় মন আনমনা হয়ে যায়।

কোথায় ওর সেই স্বপ্নের বাড়ি? স্মৃতির গন্ধমাখা সেই বাড়িটি কোথায় হারিয়ে গেল?

ঊনত্রিশ বছর আগে মির্জাজাঙ্গালের বাড়ির গেট দিয়ে ঢুকেছিল শ্রেয়া, হাজার বুটির বেনারসি পরনে, মাথায় জরি-চুমকির কাজ করা ওড়না। বাড়ির ভেতরে মন্দিরের সামনে দাঁড়িয়ে শ্বশুরমশাই বলেছিলেন – তিনি আমাদের কুলদেবতা দামোদর, প্রণাম করো মা। বিপদে-আপদে তিনিই তোমাদের রক্ষা করবেন।

সিংহাসনের শালগ্রাম শিলাকে প্রণাম করেছিল শ্রেয়া। এরপর যে-ঘরটিতে পা রাখল সে-ঘরের মেঝে ছিল লাল অঙাইডের। মাঝখানে সবুজ, সাদা আর হলুদ রঙের আলপনা। শাশুড়ি আদুরে গলায় বলেছিলেন, এ তোমাদের ঘর বউমা।

অচেনা মানুষের আনন্দ কলরোলে গমগম করছে সারাবাড়ি। অল্পবয়সী শ্রেয়ার মনে ভয়ের দানা বাসা বেঁধেছিল। তবে ভয় ফেরারি হয়ে গিয়েছিল স্বামী-সাহচর্যে, বরং মধুর হয়ে উঠেছিল দিন-রাত।

এ- পুরুষটি একান্তই নিজের, এ-ভেবে টইটম্বুর হয়ে উঠেছিল মন।

প্রথম সকাল ভালো লাগায় ভরে উঠেছে। জানালা খুলে শ্রেয়া দেখতে পেয়েছিল বাড়ির পেছন দিকটা। টলটলে পুকুর, চারপাশ ঘিরে কলাগাছের সারি, চাঁপা-গন্ধরাজ-সন্ধ্যামালতি, জবা আর রঙ্গন ফুলের গাছ। অনেকটা জায়গা জুড়ে বুনো ঝোপ; তাতে বুনো ফুল ফুটে আছে। দারুণ লেগেছিল তার। প্রভাতি আলোয় বাড়িটির সঙ্গে শুভদৃষ্টি হলো শ্রেয়ার। প্রথম দর্শনেই প্রিয় হয়ে উঠেছিল পুরনো ধাঁচের এ-বাড়িটি।

এই মুহূর্তে বাড়ির চারপাশে তাকিয়ে অসহায়বোধ করতে থাকে। প্রিয় বাড়িটি আর আগের মতো নেই, টলটলে পুকুর ভরাট হয়ে গেছে। এখানে উঠেছে তিনতলা বাড়ি। অচেনা একজন লোকের কাছে জায়গাটি বিক্রি করা হয়েছে, বাড়ির ভেতরের অংশে বাইরের লোকের প্রবেশাধিকার – এ কেমন ডিসিশন নিল বাড়ির সবাই? শাশুড়িমাও একবার ফোনে জানালেন না?

অভিষেকও একই সঙ্গে ভাবতে থাকে। বাবা চলে গেছেন। আত্মসম্মানবোধ ভীষণ প্রখর ছিল তার। এখনো তো মা রয়েছেন – শুধু তাই নয়, ছোট দুভাই অপু-অনু রয়েছে। এছাড়া বড়ছেলে বা বড়ভাই হিসেবে কেউ তাকে জানানো প্রয়োজন মনে করেনি। আশ্চর্য!

হ্যাঁ, গত সাত বছর তিনি বাড়িতে আসেননি, এর কারণও ছিল। অপমান তো ছিলই, বুকভরা অভিমানও হয়েছিল অভিষেকের।

বুবুন যখন হায়ার স্টাডিজের জন্য অস্ট্রেলিয়া গেল, তখন টাকার জন্য ফোন করেছিলেন অভিষেক। অপরেশ স্থানীয় এক অফিসে চাকরি করে, বিজনেস রয়েছে তার। বাবার বিষয়-সম্পত্তি দেখাশোনা সে-ই করে। আর এটা তো অভিষেকের ন্যায্য পাওনা।

ভাইয়েরা বলল, বাড়িতে এসো, যা পারি তোমাকে সাহায্য করব দাদা।

চার-পাঁচদিন থাকার পর অনিমেষ জিজ্ঞেস করেন, আমার তো ছুটি শেষ রে অনু। আগামীকাল ঢাকায় ফিরতেই হবে। অপুকে বল যা হোক কিছু দিয়ে আমাকে সাহায্য করতে। এজন্যই তো এলাম।

সারাদিন কেটে যায়, সদাব্যস্ত অপরেশ কথা বলার আর সুযোগ পায় না। সন্ধ্যাবেলা অনিমেষকে দিয়ে হিসাবের কাগজ পাঠায়। গাঁয়ের বাড়ির বিষয়-সম্পত্তি থেকে আয় হয়েছে তিন লাখ টাকা, ব্যয় হয়েছে পাঁচ লাখ টাকা।

এ-ব্যাপারে মা একেবারেই চুপ। পরদিন ট্রেনে উঠে স্বরচিত যে-প্রশ্নগুলো শ্রেয়া আর অভিষেকের মনে ফেনিয়ে উঠেছিল, যদি একটি পয়সাও আমাকে না দেবার মনস্থ করে থাকো তো বাড়িতে আসতে বললে কেন?

তিন লাখ টাকা আয় যদি হয়ে থাকে, সেখান থেকেও কি আমার পাওনা ছিল না?

শ্রেয়া ভাবলেন, তিন লাখ টাকা আয় হলে পাঁচ লাখ টাকা ব্যয় করলে কেন? শ্বশুরমশাইয়ের সন্তান কি তোমরা একাই? বড় ছেলে নয়?

এভাবে গিয়ে একেবারে শূন্য হাতে ফিরে এলেন – এ-অপমানে বিক্ষত হতে থাকে দুজনার বুকের ভেতর।

এমন পরিস্থিতি এলে আফসানা আপার কথা বারবার মনে পড়ে যায় অভিষেকের।

বিষয় হলো বিষ কিংবা বিত্ত-বৈভব আপনজনকেও পর করে দেয়। প্রায় সাতটি বছর পর আবাহনের ডাক শুনে আবার এসেছেন দুজন। শিকড়ের প্রতি টান কার না থাকে? শৈশব-কৈশোরের মনিররত্নখচিত সময়গুলো সুখস্মৃতি হয়ে সারাজীবন মানুষকে জড়িয়ে রাখে। নানা অপমান কিংবা বুকভরা অভিমান থাকা সত্ত্বেও ঠিক আগের মতো ডাকলে অভিষেক কিছুতেই মায়াভরা এ-ডাক উপেক্ষা করতে পারে না।

জিজ্ঞেস করেছেন, কেন রে, ব্যাপারটি কী? বিশেষ কোনো কাজ? খুলেই বল অপু।

অপরেশ বলেছে, তোমাকে সারপ্রাইজ দিতে চাই। এখনই খোলাসা করে কিছু বলা যাবে না।

চায়ে চুমুক দিতে দিতে শ্রেয়া অনেক ভেবেছে। সারপ্রাইজ? নতুন আর কী সারপ্রাইজ অপু আর অনু দেখাবে?

শাশুড়ি সব জানেন, বোঝেন – কোনো সময় তিনি কোনো মন্তব্য করেন না। নিরপেক্ষ হয়েই থাকেন।

একবারও তিনি বলেননি, বুবুন বিদেশে যাবে, সব সময়ই তো তোরা জায়গা-জমি বিক্রি করিস, গাছ-গাছালি বিক্রি করে শেষ করে দিচ্ছিস – এমন সময় অভিকে কিছু টাকা দিয়ে সাহায্য করতে পারিস না!

নাহ্ – কখনো তিনি এমন কথা উচ্চারণ করেননি। শ্রেয়ার ক্ষক্ষাভ এ-জায়গাটুকুতেই। মনে হয় তিনি ওদের ভালোবাসেন, আবার বাসেনও না।

শুধু কি একবার? বারবার ওরা এমন করেছে। একবার বাড়িতে গিয়ে দেখলেন, বাড়ির বিক্রি করা গাছগাছালি দিয়ে ফার্নিচার তৈরি হচ্ছে। দুটো ড্রেসিং টেবিল, ডাবল বেড খাট, আলমারি, রিডিং টেবিল, দু-ভাইয়ের মধ্যে ভাগ হবে ফার্নিচার। বড় ছেলে অভিষেকের কোনো ঠাঁই নেই এ-সংসারে?প্রকারান্তরে স্বামীকে কাছে পেয়ে শ্রেয়া বলে, দ্যাখো – কী আশ্চর্য এই সংসার। হঠাৎ করে এলাম বলে দেখতে পেলাম তোমার দুভাইয়ের কীর্তি। কেন তুমি কি এই পরিবারের কেউ নও? বেঁচে থাকতেই তোমাকে-আমাকে বাদ দিয়ে দিলো। মাও হয়েছেন এমন, তিনি জ্ঞানপাপী – সব জানেন-বোঝেন অথচ কিছুই বলেন না। মুখোশপরা মানুষ। চাপা গলায় ধমক দেয় অভিষেক – মায়ের কথা কিছু বলবে না তুমি। কক্ষনো না।

এখনো মা?

শ্রেয়ার ঠোঁটের কোণে বিদ্রূপের হাসি ঝুলে থাকে। বাবলির বিয়ের সময় শাশুড়িকে জানানো হলে তিনি বলেন, – ভালো ছেলে পেয়েছ, একদম দেরি করবে না, কথাবার্তা বলে ডেট ঠিক করে আমাকে জানাবে। বাড়ির প্রথম নাতনির বিয়ে হবে, আমি টাকা-পয়সা, তত্ত্ব সাজানোর নারকেল-ক্ষীরের ছাঁচ-সন্দেশ সব নিয়ে আসব। তুমি চিন্তা করো না বউমা।সত্যি বিশ্বাস করেছিল শ্রেয়া। আশীর্বাদ গেল, আইবুড়ো ভাত খাওয়ানো, গায়েহলুদ, মেয়েলি সব আচার-অনুষ্ঠান, বিয়ের আনন্দময় রাত কেটে গেল – বাড়ি থেকে কেউ এলো না।

বাবলি চলে গেল পরের ঘরে – এ-অপমান, এ-দুঃখ ভুলতে পারেনি শ্রেয়া।

শ্রেয়া বারবার বলে স্বামীকে, এখনো ওদের বিশ্বাস করবে? অভিষেক এখন আর আগের মতো স্ত্রীর প্রতি জ্বলে ওঠে না। ভাবে, দূরে থাকলেই কি রক্তের সম্পর্কে ভাঙন ধরে! বিত্ত-বৈভব কি দূরত্ব সৃষ্টি করে প্রিয় পরিজনের মাঝে?

আফসানা আপার কথাই হয়তো ঠিক।

তিন

পাড়ার মাসিমা নিভাননী দেখা করতে এলেন। হাসিমুখে বলেন, কতদিন পর এলে তোমরা। জানি অনেক ঠকিয়েছে তোমাদের। তবে ধর্মের কল বাতাসে নড়ে শ্রেয়া। তোমাদের আবার আবাহন করে আনল।

– আবাহন?

– নয়তো কী?

কথাটি শুনে ভালো লাগল, দুচোখ ভিজে যায় হঠাৎ।

বুবুন-বাবলি তখন ছোট, স্কুলের ছুটিছাটা পড়লে চলে আসত ওরা সিলেট শহরের মির্জাজাঙ্গলের বাসায়। অনেকখানি জায়গা জুড়ে বিশাল বাড়ি, পাড়ার সমবয়সী ছেলেমেয়েদের সঙ্গে ওরা ছোটাছুটি করত। উঠোনে স্কিপিং করত।

ঢাকার বাসায় ছড়ানো জায়গা নেই; এ-বয়সটায় বুবুন-বাবলিকে ছোটাছুটি করতে দেখে খুব ভালো লাগত শ্রেয়ার।

তবে মনটা খারাপ হয়ে যেত অন্য একটি ব্যাপার দেখে। স্যুটকেস ট্রলিব্যাগ নিয়ে পুরনো কাজের লোক ধীরেন-হীরু ওরা বড় ঘর, যে-ঘরটিতে শ্বশুর-শাশুড়িমা থাকতেন – সে-ঘরে এনে ডাঁই করে রেখে দিত। কোন ঘরে তাদের জিনিসপত্র রাখবে –

এ-অপেক্ষায় গিন্নিমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকত।

মায়ের নির্দেশের জন্য।লাল অঙাইডের মেঝের সেই প্রিয় ঘরটি ততদিনে চলে গেছে দেবর অপরেশ-অপুর দখলে। দু-চারদিনের জন্য বাড়িতে এলেও ঘরটি সে কিছুতেই ছাড়ত না। অধিকার আর উপস্থিতি না থাকলে যে সব বেদখল হয়ে যায়, সেটি টের পেত শ্রেয়া।

অপরেশ-অনিমেষ-অপু-অনু ওদের নির্দিষ্ট ঘর রয়েছে থাকার। হ্যাঁ, বাড়িতে তো নিজস্ব ঘর থাকবেই, তাহলে শুধু অভিষেক-শ্রেয়ার বসবাসের ঘর থাকবে না কেন? শ্বশুরমশাই যে-ঘরটিতে বউমাকে নিয়ে এসে বলেছেন, এটি তোমাদের ঘর, সে-ঘরটি বেমালুম অপুর ঘর হয়ে গেল! স্বামী যে বঞ্চিত হচ্ছে – এ-কথা চোখে আঙুল দিয়ে বোঝাতে গেলে তিক্ততার সৃষ্টি হয় সংসারে।

শ্রেয়া একদিন বলেছে, তোমার মা সবকিছু দেখেও কেমন নির্লিপ্ত থাকেন। আসলে অপু-অনু ওনার নিজের, তোমার তো কেউ নন।

খুব রাগ করেছে অভিষেক এ-কথা শুনে।

খবরদার শ্রেয়া, মা সম্পর্কে কক্ষনো তুমি কিছু বলবে না। কিছুটা অভিমানে, কিছুটা অপমানে এরপর থেকে আর কোনোদিনও শ্রেয়া বাড়ির ব্যাপারে কথা বলেনি।

যে বঞ্চিত হচ্ছে জেনে প্রতিবাদ করে না, যে শুধু ভালোবাসায় মা-ভাইদের কথা বলতে বলতে আবেগে ভেসে যায় – তীব্র-তীক্ষন আঘাত না পেলে মগ্নচৈতন্য থেকে সে কখনো জাগবে না।

সাত বছর পর বাড়িতে এসে দেখল শ্রেয়া চাকচিক্যের জৌলুস – তখন কি উত্তুরে হাওয়ার মতো বুকের ভেতর এসে ঝাপটা দেয় না – বুবুনের অস্ট্রেলিয়া যাওয়ার আগের দিনগুলোর কথা? বাবলির বিয়ের সময়কার কথা? হিসাব-নিকাশ করতে করতে আনন্দের বিন্দুমাত্র রেশ সে উপভোগ করতে পারেনি সেই দিনগুলোতে।

বুবুন ফোনে প্রায়ই বলে, তোমার কিসের অভাব মা!কাকুরা-ঠাম্মি আমাদের সাহায্য করল না

– তাতে কী হয়েছে। আমরা তো বেশ আছি।

হ্যাঁ – বেশ আছে শ্রেয়া। শান্তিতে আছে, রাতে স্বস্তিতে গভীর ঘুমে তলিয়ে যেতে পারে।বাবলি মাকে খুব বোঝে। আত্মজা তো – প্রায়ই বলে, সবকিছু চেঞ্জ হয় মা, এতে মন খারাপ করার কিছু নেই। বাড়ি, পাড়া,

শহর কিছুই আর আগের মতো নেই। সবকিছু বদলে গেছে।খাওয়া-দাওয়া, জীবনযাপনের ধরনও পালটে গেছে।

অভিষেক আদুরে গলায় বলেছে, তোর নাম রেখেছি শ্রেষ্ঠা, শ্রেষ্ঠার মতোই কথা বলেছিস মা। মাকে বোঝা তো। নদী যেমন বাঁক বদলায়, জীবনও তেমনই। হ্যাঁ – তথ্যপ্রযুক্তিতে যেভাবে সাঁই সাঁই করে বিবর্তন এসেছে, আমাদের সময়ের মানুষরা বেশ খাবি খাচ্ছি, এ-কারণেই মাঝে মাঝে মন খারাপ হয়।

চোখ বড় করে বাবলি বলেছে, নো প্রবলেম পাপা। তোমার অফিসের ড্রাইভার হালিম এখানে-ওখানে মেসেজ পাঠায়, হুয়াটসঅ্যাপ-মেসেঞ্জারে কথা বলে – এগুলো কোনো ব্যাপারই না।

শ্রেয়া একদিন বলে, সবকিছুতে চেঞ্জ এসেছে, এ-কথা না বলে বলা উচিত পৃথিবীটা লাফিয়ে লাফিয়ে চলছে।

শ্রেষ্ঠা বলে, কথাটি ঠিক বলেছ মা। বাড়িতে অতিথি এলে নামি দোকান থেকে সন্দেশ-নিমকি-গোলাপজাম-রসগোল্লা আসে না, এখন রেস্টুরেন্ট থেকে আসে বার্গার-কেএফসি-দইবড়া-ফিশফ্রাই নিদেনপক্ষে ছোলে-বাটোরা। পাড়ার ছেলেদের কথা শোনোনি মা! এই পাঞ্জা লড়বি? বিন্দাস আছি। সময়টা এখন অনেক পালটে গেছে।

মির্জাজাঙ্গালের বাড়ির উঠোনে শীতের ঢলে যাওয়া দুপুরের আলো মাখতে মাখতে মনে হয়, বাবলির সব কথাই ঠিক। কিন্তু মেয়ে এখনো অভিজ্ঞতায় পরিণত হয়ে ওঠেনি – তাই জানে না জগৎসংসার মাস-বছর-যুগের পরিক্রমায় ঠিকই পালটাবে কিন্তু প্রিয় পরিজনরা লোভ-লালসায় ডুবে যে গেছে, হৃদয়হীন হয়ে গেছে আপনজনরা – তাও ওর না জানাই ভালো, কোমল মনে তা দীর্ঘস্থায়ী আঁচড়ের প্রভাব ফেলবে।

নিভাননী মাসিমা খুব সহজ-সরলভাবে খুশি হয়েছেন বড়ভাই আর শ্রেয়াকে ওরা আবাহন করে বাড়িতে ফোন করে ডেকে এনেছে বলে। শ্রেয়া জানে – প্রয়োজনে ভাইকে মনে পড়েছে, মনে পড়েছে স্বার্থের কারণেই। দেবর অপু-অনু বহুদিন পর আহবান জানিয়েছে অনাদৃত-অবহেলিত বড়ভাই অভিকে, যে এতই সহজ-সরল, ভালোবাসায় ভরপুর যার হৃদয়, সে-ভাইদের কাছে প্রায় বোকার পর্যায়েই পড়ে।

বিশাল বাড়িটি প্রমোটারের কাছে হস্তান্তর করা হবে। অগুনতি আকাশছোঁয়া ফ্ল্যাট হবে। কন্ট্রাক্ট পেপারে বড়ভাইয়ের সাইন প্রয়োজন। নিজেদের দরকারে এই কাছে ডাকা।

শ্রেয়ার অভিজ্ঞতা বলে, এককালীন মোটা অংকের অর্থ পাওয়া যাবে প্রমোটারের কাছ থেকে। হস্তান্তর করা হবে বেশকটি ফ্ল্যাট। সে জানে, ঠিকঠাকমতো কিছুই পাবে না ওরা, সমান ভাগ তো কখনো দেবে না। এ ওদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। বুবুনের হায়ার স্টাডিজের সময় কিংবা বাবলির বিয়ের সময় হাত পেতেও শূন্য হাতে ফিরতে হয়েছে। বেসিক্যালি ওরা এত স্বার্থপর যে, নিজের কোলে ঝোল টানতে শিখেছে। শরিককে যে ঠকাতে নেই, এ-বোধটুকু ওদের মনে ঠাঁই পায়নি।

মনমরা হয়ে ঘরে ঢুকে অভিষেক বলে, অপু আর অনুর সারপ্রাইজ এটি। বাড়িটা প্রমোটারের হাতে দেবে – একটিবার আমাকে জিজ্ঞেস করবে না? শুধু সিগনেচার করার জন্য আমাকে ডেকে আনা? মা পর্যন্ত মুখে কুলুপ এঁটে রইলেন। হোয়াট আ সারপ্রাইজ!

স্বামীর এই ভাবান্তর দুচোখে দেখতে থাকে শ্রেয়া। ওদের ব্যবহারে বুকের ভেতরটা বহুদিন থেকে সেঁকাপোড়া হয়ে আছে তার।খুশিতে আটখানা হয়ে দুই জা বলে, বড়দি এসো এসো, সেলফি তুলি।

পুকুর ভরাট করে তিনতলা বাড়ি, পেছনে কুলগাছ আর মৃদু এক সুরভির কথা মনে পড়তে থাকে শ্রেয়ার।পেছনে ফেলে রাখা স্মৃতিগুলো বরাবরই কাছে টানে তাকে। মুর্শিদাবাদি সিল্ক, শান্তিপুরি, মানে না মানা মায়ের তোরঙ্গের শাড়িগুলোর ভাঁজে ভাঁজে রাখা নেপথালিন। কান্তা সেন্টের মিঠে সুবাস, মায়ের ভেজা চুলে জবাকুসুম তেলের ছড়িয়ে যাওয়া গন্ধ – এগুলো তো কখনো ভুলতে পারেনি সে।

শ্বশুরবাড়ির এই ছড়ানো উঠোন, লাল অঙাইডের আলপনা- আঁকা ঘর সব হারিয়ে যাবে? স্মৃতির রেণুকণাও আর থাকবে না? মাও এতদিন পর ডাকল শুধু একটা স্বাক্ষরের জন্য। কোনো আলোচনা নয়, একটিবারের জন্যও বড় ছেলের মতামতের কথা জানতে চাইল না মা। বুকের ভেতরটা চৌচির হয়ে যেতে থাকে।

শুধু স্বাক্ষরের প্রয়োজন? এই নাও মা। তোমার আদেশ তো কোনোদিন আমি অমান্য করিনি। স্বাক্ষর চেয়েছ। এই দিয়ে গেলাম।

মনে মনে কথাগুলো উচ্চারণ করে অভিষেক।

ঢাকার ফ্ল্যাটবাড়িতে নিয়মের সকালের রোদ আবার ছুঁয়ে যায়। ডাইনিং টেবিলে দু-পেয়ালা গ্রিন টি আর সুগার ফ্রি বিস্কিট নিয়ে বসে থাকে শ্রেয়া। অভিষেক ওয়াশরুমে।স্বপ্নে মাখামাখি হয়ে থাকা পুরনো দিনগুলো চোখের সামনে ভাসতে থাকে কান্না হয়ে।

দূরাগত মানুষের কলকণ্ঠ আর চেনা ছবিগুলো বুকের ভেতর ঝাঁপিয়ে পড়ে।কী শূন্যগর্ভ এই বাড়ির আবাহন! বাষ্পের মতো জমে থাকা ধোঁয়াটে ক্ষক্ষাভ বুকের ভেতর থেকে সরে গিয়েছিল মিষ্টি-মধুর এই আবাহনে।

সম্মোহিত হয়ে পড়েছিল শ্রেয়া নিজেও। শ্বশুর চলে যাওয়ার পর শাশুড়ি ডেকেছেন, তিনি তো মায়ের মতোই। মাটির টান, মানুষের টান – এ তো মানুষ জীবনের কোনো পরিস্থিতিতেই ভুলতে পারে না।স্মৃতিগন্ধে শ্রেয়া কি কম বিভোর ছিল। ছোটবেলার সাথির মতো সুখ-দুঃখের স্মৃতিগুলো বড় কাছে টানে।

বহুদিন পর পরমাত্মীয়রা ডেকেছে এ-ভাবনায় যে কী সুখ তা শ্রেয়া আর অভিষেক – দুজনেই গভীরভাবে অনুভব করেছে।

বিত্ত-বৈভবের লোভ-লালসায় মানুষ আপনজনকে পর করে দিতে পারে – চায়ে ছোট চুমুক দিতে দিতে এ-কথাটিই ভাবতে থাকে শ্রেয়া। দুচোখ টলটলে কান্নায় ভরে আসতে থাকে। এর মধ্যে স্বামীর ভাবনায় উঠে দাঁড়ায়। অভিষেক এতক্ষণ ওয়াশরুমে করছেটা কী?

মৃদু নক করে শ্রেয়া। অভিষেক বলে, আসছি। ওয়াশরুমের বেসিনের ওপরে বেলজিয়াম আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দুচোখ তার জলে ভেসে যায়। বুকের ভেতরে উচ্চারিত হতে থাকে, – কে বলেছে পুরুষদের কাঁদতে নেই।

এই মুহূর্তে ক্ষক্ষাভে-কষ্টে হৃদয়টা ফেটে চৌচির হয়ে যেতে চাইছে। গলনালিতে জমে থাকা দুঃখ আর অভিমান যুগলবন্দি হয়ে দুচোখ থেকে অবিরল ধারায় কান্না হয়ে ঝরছে।

শ্রেয়া বারবার তাকে মনে করিয়ে দিত – মা নিজের নয়, স্বাভাবিকভাবে ভাইয়েরাও আপন নয় – ওরা নিজের হলে কি এভাবে তোমাকে দুঃখ দিতে পারত!

আজ নতুন করে মনে পড়ছে চিরবিচ্ছেদের পীতাভ এক স্মৃতি। তিন বছরের এক শিশুকে অনাথ করে দিয়ে মা অচিন দেশে চলে গেছেন। তার কোনো স্মৃতিই তো আমার মনে নেই। শৈশব থেকে কৈশোর, কৈশোর থেকে তারুণ্য, এরপর যৌবনকাল – এই মাকে দেখে বয়স বেড়েছে, পরিণত হয়েছি তারই সাহচর্যে। আপন আর প্রিয় বলে তাকেই জেনেছি।

যে-কথাটি ভুলে থেকেছি এতদিন, নতুন করে আবার মনে পড়তে থাকে। এই প্রথম আমি সারা মন-প্রাণ দিয়ে অনুভব করছি – তুমি আমার দ্বিতীয় মা।

ওয়াশরুমের দরজায় শ্রেয়া ধাক্কা দিচ্ছে অবিরত। উৎকণ্ঠিত স্বর – কী করছ এতক্ষণ? দরজা খোলো।

দরজা খুলতে এগিয়ে যায় অভিষেক।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত