খড়ম

বাড়িতে মা খড়ম পায়ে হাঁটেন। কয়েক ঘর দূর থেকে তার শব্দ শোনা যায়। তবে যখন উঠানে হাঁটেন তখন শব্দ পাওয়া যায় না। নরমের ওপর শক্তের শব্দ হয় না। আমি আমার মায়ের খড়ম বেশ কয়েকবার পায়ে দিয়ে দেখেছি। বুঝি না, মানুষ কীভাবে এই যন্ত্রণাদায়ক জিনিসটা পায়ে রাখে! এটাকে হাঁটার সময় পায়ে আটকে রাখাও তো মুশকিল। আমার বিস্ময় কাটে না, যখন দেখি মা অবলীলায় হেঁটে যাচ্ছেন। আমার মুগ্ধতা তিনি দেখেও দেখেন না। আমার সঙ্গে কথা তিনি কম বলেন।

(মোস্তফার সাথে কথা কম বলার ব্যাপারটা সবাই লক্ষ্য করেছে, কিন্তু কেউ তার কারণ জানে না। হতে পারে মোস্তফা সবচেয়ে বেশি কষ্ট দিয়েছিল তাকে জন্মের সময়। বা মোস্তফা যখন পেটে তখন ভয়ানক কোনো দুঃস্বপ্ন দেখেছেন তিনি, যেটা যে কোনো মুহূর্তে বাস্তব হওয়ার অপেক্ষায় আছেন। ছেলেটার যত্ন-আত্তিতেও সমস্যা। তার খাওয়া, ঘুম কিছুই সুনজরে নেই। পরিবারের আর সব সন্তানের ভেতর কেবল এই একজনই ইচ্ছেস্বাধীন হয়ে যা খুশি করে বেড়াতে পারে। যদিও এর যথেচ্ছ ব্যবহার সে করে না।

মোস্তফার আরও দুই ভাই, এক বোন আছে। সেই বোন মায়ের জোয়াল কিছুক্ষণের জন্যে হলেও কাঁধে তুলে নেয়, মায়ের হেলা খানিকটা পুষিয়ে দেয়। ব্যাপারগুলো মানুষ, বিশেষ করে মেয়েরা জৈবিক কারণেই চেতনার ভেতর বয়ে নিয়ে আসে। বাকি দুটি ভাই মোস্তফার ব্যাপারে নাক গলায় না। নিজেদের ভেতর অনেক ব্যাপারে অমিল থাকলেও এই একটা জায়গায় দু’জনের বেশ মিল। মোস্তফার বাবা প্রায় দু’মাস আগে বুকের এক জটিল রোগে হেরে গেছেন। তার মৃত্যুতে পরিবার শোকগ্রস্ত হয়েছে কিন্তু কোনো দর্শন বদলায়নি। সবাই যেমন ছিল তেমনই আছে। শুধু একা হলে মায়ের চোখ জলে ভরে ওঠে। পায়ে খড়ম গলিয়ে তিনি ঘরের বাইরে চলে যান। সোজা গিয়ে পুকুরঘাটে বসেন। দূর থেকে তাকে লক্ষ্য করে মোস্তফা।

মোস্তফা আর ক’দিন বাদে ম্যাট্রিকুলেশন দেবে। তার আচরণ কোমল। এই কোমলতার সাথে তার বোন ও মায়ের মিল আছে। বাবার রূঢ়তার সাথে মিল আছে অপর দুটি ভাইয়ের। কে কার মতো, তার বিচারে বাড়িতে এক কোণে পড়ে থাকা মোস্তফার শত্রু-মিত্রের সমীকরণটা মেলানো কঠিন।)

খড়ম পায়ে মা-ই কেবল হাঁটেন না; আরও একজন আছেন যিনি ওই কাঠের শাস্তি পায়ে মাঝেমধ্যেই হেঁটে বেড়ান যখন রাতনিশিতে। তিনি আমার দাদা। কথাটা আমার বাবা বেঁচে থাকতে আমাকে একদিন বলেছিলেন। তখন আমি ছোট। বেশ ছোট। শরীরে অফুরন্ত প্রাণশক্তির পীড়নে সহজে ঘুমাতে চাইতাম না। বাবাও আমাকে কোনো সহজ ভূতের ভয় দেখালেন না। দেখালেন আমার দাদার ভয়, যাকে এমনকি কখনও দেখিইনি আমি। আমার দাদিকেও দেখিনি। দাদি আসেন না। কারণ তিনি খড়ম পরতেন না। মধ্যরাতে হঠাৎ শোনা যায় খট খটাশ খট… কেউ যেন টেনে টেনে হাঁটছে।

বাবা ছোটবেলায় আমাকে বলার পর বড় হয়ে যেদিন প্রথম আমি সেই খড়মের শব্দ শুনতে পেলাম, জিজ্ঞেস করেছিলাম, দাদার পায়ে কি কোনো আক্ষেপ ছিল? বাবা বললেন, হ্যাঁ। তিনি পা টেনে টেনে হাঁটতেন। তার একটা পা ছোট ছিল। খড়ম পরা লম্বা পা টেনে আনতে তার কষ্ট হতো। কিন্তু সে কষ্ট তিনি অভ্যাস করে নিয়েছিলেন।

একদিন শুনি, অন্য ভাইদের মতো আমাকেও একা থাকতে হবে। আমি অবশ্য মায়ের সাথে থাকতাম না। তবে আমরা একই ঘরে থাকতাম। মায়ের সাথে থাকত পাখি, আমাদের একমাত্র বোন। ওর পাখি নামটা একদম লাগসই হয়েছে। ওর নাকটা ঠিক যেন একটা পাখির ঠোঁট। আর ঠোঁট দুটোও যেন পাখির। আক্ষরিক অর্থেই ধনুকের মতো ভ্রুর নিচে তার নিখুঁত মীনাক্ষী। অবিকল মাছের মতো বাঁকা টানা। যখন কথা বলে মনে হয়, দোয়েল পাখি কিচিরমিচির করছে। আমার বুকের ভেতর বোধ হয় অনেক অকারণ অপ্রকাশ্য ভালোবাসা ওর জন্য জমা। বাবা বলতেন, ও নাকি অবিকল দাদির মতো দেখতে।

আমার দাদির নাম ছিল টুনটুন। পাখির নামে নাম। দাদি রোগেশোকে পরে খুব অসুন্দর হয়ে পড়েছিলেন। হাত-পায়ের আঙুল বেঁকে গিয়েছিল। তবে অনেক বয়সের কথা। দাদার একটি পায়ের এমন বড়-ছোট নিয়ে কিছু জল ঘোলা হতে লেগেছিল তাদের বিয়ের আগে। দাদি ওসব ঠেকিয়ে দিয়েছেন। তিনি স্বপেপ্ন দেখেছিলেন এক নির্জন বনে পা খোঁড়া এক হরিণ তাকে ঝর্ণা থেকে এনে জল খাওয়াচ্ছে। তার খুরের জায়গায় দুটো আঙুল। হাতের তালু খুবই ছোট। কিন্তু তার চোখে ভালোবাসার কোনো অভাব নেই।

দাদি ভেবেছিলেন তিনি দাদার ভেতর সত্যিকার ভালোবাসা পাবেন। পেয়েছিলেন কি-না জানি না।

(মোস্তফাদের বাড়িটা আগে অনেক লোকে জমজমাট ছিল। এখন ধীরে কমে এসেছে লোকজন। মধ্যখানে একটা ফাঁকা উঠান রেখে চারপাশে বাড়ি। বাংলার সনাতন গ্রামগুলোয় সম্পন্ন পরিবারগুলোয় এমন বাড়ি দেখা যেত। যখন লোকজন অনেক ছিল, স্বভাবতই চারপাশে ঝোপঝাড় তেমন বাড়তে পারেনি। কিন্তু ধীরে ধীরে, কয়েক দশকে কেউ মারা গেল, কেউ নতুন বেড়ে উঠতে থাকা শহরের ডাকে সাড়া দিল, কেউ এখানে বিদায় দিয়ে অন্যত্র চলে গেল খুনসুটির কাঁটায় বিক্ষত হয়ে। যেভাবে একদিন সুজুদ আর টুনটুনও ‘শান্তির খোঁজে’ এখানে এসে পৌঁছেছিল।

টুনটুন তার সত্যকার ভালোবাসার সন্ধান পেয়েছিল। তার স্বপ্ন সত্য হয়েছিল। সুজুদ একরখানেক জমিসহ এই উঠানসমেত এই ভিটা কিনে নিল এক যোগী গৃহস্থের কাছ থেকে। উত্তরাধিকারে পাওয়া এ বাড়ি সেই গৃহস্থের তেমন কাজে লাগত না। আধ মাইল দূরে সেই যোগীর উত্তরপ্রজন্মের বসবাস। যোগীর নিজ নিবাস দূরের ওই যোগীদের বন। সুজুদ এখানে আসার পর তার পিছু পিছু ক’জন ভাই-বন্ধুও বছর কয়েকের ভেতর চলে এলো। এক সাথে থাকার অভ্যাস তাদের বহু বহুদূর টেনে নিয়ে যেত। চারদিকে বন-বাদাড় রেখেই শন আর বাঁশের কুঁড়ে তৈরি হয়েছিল। তার দেয়াল দুলত হাওয়ায়। ক্রমে ঢেউটিন এলো, তখন চারপাশে শক্ত দেওয়াল পাতা গেল। বেগুন-টমেটোর মতো অপ্রধান কিছু সবজি চাষের জন্য কিছু জমি পরিস্কার করা হলো। সেসব লোক হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। ক্ষেত বীজতলা কোথায় হারিয়েছে! তার অনেক বছর পর চারপাশ আবার চেনা-অচেনা গাছে ভরে উঠেছে।

জায়গাটা কেমন সবুজ অন্ধকারে ছেয়ে থাকে এখন! যে রাতে চাঁদ ওঠে, গাছগুলোর দিকে তাকালে মনে হয়, ওরা ঝোপঝাড়ের হাঁটুজলে ডুবে থেকে দুলে দুলে নৃত্য করে যাচ্ছে। ঝিঁঝিঁ আর চাকা পোকার ডাক সারাক্ষণ মানুষের গলার ওপর বিজয়ী হয়ে থাকে। মহুয়া আর গাবগাছে বাদুড়ের ডানা ঝাপটা পাখির পাখসাটের সাথে পাল্লা দেয়। প্রাকৃতিক সব শব্দের ভেতর একটাই কৃত্রিম শব্দ কেবল; খড়মের শব্দ। একটা নিয়মিত বিরতিতে পা ফেলার। আরেকটা অনিয়মিত রকম নিয়মিত। যেন কেউ পা টেনে টেনে হাঁটছে। প্রথমটা সবাই পায়। দ্বিতীয়টা কেবল মোস্তফা।)

আমার নতুন ঘরটা উত্তর পাশে। এখানে আমার পড়ার টেবিল শোবার খাট সব চলে এসেছে। চৌকো ঘর। দিনে খোলা জানালা গলে আলোর একটা হেলানো স্তম্ভ এসে ঘরে ঢোকে। তার ভেতর ছোট ছোট ধূলিকণা উড়তে থাকে। কেমন স্বপ্নলোকের একটা টুকরো অংশের মতো। তবে এই খোলা জানালার আবার একটা বিপদ আছে। জানালাটা খুললে দূরে পথের বাঁকে একটা মাদার গাছ দেখা যায়। গ্রামের এক বধূ হাঁপানির যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে ওই মাদার গাছে ফাঁস নিয়েছিল।

বিকেল থেকে সন্ধ্যা হওয়ার কালে বা রাতের জোছনার আলো-ছায়ায় মনে হয় যেন ওখানে ঝুলন্ত একটা লাশ বুঝি বাতাসে অল্প অল্প দুলছে। আমি জানি, ওখানে কিছু নেই, তবু মন মানে না। আমি জানি, বিদেহী জীবরা এলেও ওভাবে আসে না এবং ওরা একই সাথে আছে আর নেই-এর জগতে বাস করে, যে জগৎটা অনেকটাই দর্শকের মনের বশ। আমি দর্শক। কিন্তু আমার মনের সব জোর খাটিয়েও সে জগৎটাকে বশ মানাতে পারি না। আমি আস্তে করে জানালার কপাট লাগিয়ে দিই। কোনো কোনোদিন রাতের দুঃস্বপ্নের ঘোর কাটে না বলে সকালেও খুলি না।

এ রকম একদিন কুপি জ্বালিয়ে বইয়ের পাতা উল্টাচ্ছি, ঘরের দুয়ার বন্ধ। এমন সময় বাইরে থেকে কৃষ্ণজ্যাঠাই দরজায় তালে তালে আঙুল ঠুকে বললেন, ভাতিজা আমার, কিসের ভয় কর! আমি দরজা খুলে দিলাম। পরস্পরের মন পড়তে দেরি হয়নি। আমাকে বুকে টেনে নিলেন জ্যাঠা। ফিসফিস করে বললেন, তোমার কোনো ভয় নাই। তোমারে পাহারা দিয়া রাখে। তোমারে সারাক্ষণ পাহারা দিয়া রাখে যেন… বাক্যটা তিনি শেষ করেন না। আমি থমকাই। কে পাহারা দিয়ে রাখে! জ্যাঠা গলা পরিস্কার করলেন। এটা তার স্বভাব। কিছুক্ষণ পরপর গলা পরিস্কার করে ওঠা এমনভাবে, যেন কিছু বলবেন। কিন্তু কিছু বলেন না। এবার বললেন।

‘জানালাটা খোলাই রাখো, কোনো ভয় নাই। এর পরও যদি কোনো ভয় কর তো জ্যাঠার নাম কইরা ডাকবা। ডাকবা নি?’

জানালাম তাকে, ডাকব।

এর পর ঘন ঘন ডাক পড়তে থাকল। রাত বড় হয়েছে। আমাকে হয়তো জলঘরে যেতে হবে, কিন্তু প্রাণের কোথাও বাধা পাচ্ছি। ভয় হচ্ছে। ডাকলাম, জ্যাঠা! রাত কত তা আর দেখিনি। কিন্তু যতই হোক, জ্যাঠা সাড়া দেবেন। গলা একবার পরিস্কার করে বলবেন, ‘হ জ্যাঠা। তুমি যাও। কোনো ভয় নাই।’

ধীরে ধীরে জানালাটা খোলা রাখতে শুরু করলাম। ওটার সাথেই ছিল আমার পড়ার টেবিল। যখন পড়তে বসতাম, দীর্ঘ সময় জানালা দিয়ে তাকিয়ে থাকতাম ওই মাদার গাছের দিকে। কী সুন্দর রূপালি তার কাণ্ড! পাতা তত ঘন নয়। বেশ ফাঁকা।

এক বিকেলে দেখি সেখানে এক লোক বসে আছে। পরনে একটা লুঙ্গি কেবল। শরীরের ওপরাংশে কোনো কাপড় নেই। লিকলিকে, কালো। বৃত্ত মাথায় খরা। সরু কাঠির ওপর সে এক লজেন্সের মতো। কৌতূহল হলো। দরজা ভেজিয়ে বাড়ির পেছনে এসে সেই মাদার গাছের দিকে হাঁটতে শুরু করলাম। হাঁটতে হাঁটতে ভাবছিলাম, কাজটা ঠিক হচ্ছে তো? মনকে প্রবোধ দিয়ে চললাম। হয়তো কোনো অজানা গল্প সে শোনাবে!

কাছাকাছি হতে লোকটা উঠে দাঁড়াল। তাকে আমি এর আগেও দেখেছি আশপাশে। কিন্তু কখনও কথা হয়নি। আর শেষ দেখেছি দেরি হয়েছে। মাঝখানে একটা বড় সময় লোকটা যেন আর কোথাও ছিল। দেখা হয়নি আমার সঙ্গে। কোথায় ছিল? লোকটাই আগে কথা বলে উঠল। কথা মানে, একটা শব্দ- ভাগিনা! ভাগিনা, মানে ভগিনির থেকে জাত। মানে আমার মা তার বোন। আমি হাসলাম। ততক্ষণে আরও খানিকটা এগিয়ে গেছি।

ধীরে ধীরে কথা এগোল। ভদ্রলোকের নাম হারাধন। সম্প্রদায়ে যোগী। বাবা বলতেন, দক্ষিণ থেকে কিছু যোগী সম্প্রদায় এখানে এসে ঘর বেঁধেছিল; সে অনেক দিন আগের কথা। আমি শুনে খুব অবাক হয়েছিলাম যোগীরা মুসলমানদের মতো লাশ কবর দেয়। কিন্তু পদ্ধতিটা ভিন্ন। মৃত্যুর পর মরদেহের বাহু-হাঁটুর ভাঁজ মুড়ে তাদের বসার ভঙ্গিতে কবরে রেখে মাটি ফেলে দেয়। তার ওপর গড়ে ওঠে একটা মণ্ডপ। তার ভেতরে আমি ফুল, খাবার এসব রাখতে দেখেছি।

আমি দেখেছি ওদের মণ্ডপগুলো ঘিরে ধীরে ধীরে কেমন একটা বন শোভায় বাড়ে। চারপাশ কেমন রহস্যময় হয়ে ওঠে। হারাধানদেরও অনেক স্বজনের কবর আছে, পেছনে আরও দূরে একটা উঁচু ঢিবির ওপর। চারপাশে ঘন গাছপালা আর ঝোপঝাড়ে ঘেরা। আমরা কথা বলতে বলতে হেঁটে হেঁটে দেখলাম। আমি দেখলাম বিকেল হয়ে ওঠায় আলো ক্রমশ সোনারঙ হয়ে উঠছে। আর ঢিবির ওপর যোগীদের কবরগুলোর ওপর দাঁড়ানো মণ্ডপের নীল রঙ, তার ওপর কালো শ্যাওলা আর জাদুর মতো ছেয়ে থাকা একটা নীরবতা কী অসহ্য বাগ্ধময়! মনে হলো, সরে পড়া উচিত। বেশিক্ষণ এখানে থাকা ভালো নয়। কার যেন শান্তি বিঘ্নিত হয়।

হারাধন বলে গেল তার জীবনের কথা। আরও দক্ষিণের চট্টগ্রাম অঞ্চল থেকে তাদের ধীরে ধীরে এদিকে চলে আসার কথা। ওটা স্বাধীনতা যুদ্ধের কালে হয়েছিল। আমাদের বাড়িটা তখন ওই সনাতনি গেরস্তের। তার বড় ছেলে রথীন খুব গানবাজনা নিয়ে থাকত। এদিকে আসার পর, যতদিন রথীন বেঁচে ছিল, হারাধন এবং তার মতো আরও যারা ছিল তাদের দারুণ দিন কেটেছে। রথীনের হয়ে ওদের সঙ্গত করতে হতো। দারুণ সময় কাটত। রথীনও ছিল খানিকটা পাগলাটে। আর খুব ভালোও বাসত ওদের। রথীন যক্ষ্ণায় মারা গেল। যক্ষ্ণার কোনো চিকিৎসা এখন থাকলেও তখন ছিল না। উপরন্তু তখন এদিকে লোকে যক্ষ্ণার রোগীকে ভালো চোখে দেখত না। মনে করত, কোনো ভালোমানুষের যক্ষ্ণা হয় না। রথীনের মতো ফুর্তিবাজ মানুষও খুব নীরবে মারা গেল।

এমন সময় আমার মনে পড়ল এই মাদার গাছে ফাঁস নেওয়া মেয়েটির কথা। হারাধনকে জিজ্ঞেস করলাম। না করলেই ভালো ছিল। এর পেছনে অদ্ভুত করুণ এক গল্প শুনলাম। কতদিন আগের কথা ওসব! হারাধনদের কয়েক ঘর পরের আরেক সনাতনি পরিবারের পুত্রবধূ ছিল- সুলকা। সুলকা তো নাম হতে পারে না; বুঝলাম এটা বিকৃতি। নাম হয়তো ছিল শুক্লা। মেয়েটার একটাই রোগ ছিল; হাঁপানি। ভীষণ ভোগাত। যখন কিশোরী বধূ হয়ে এসেছিল, তখনও রোগটা অত প্রকট ছিল না। ক্রমে বয়স বাড়তে বাড়তে রোগও বাড়তে থাকল।

এক শীতকালে ভয়ঙ্কর অবস্থা। বৈশাখী ঝড়ের রাতের শোঁ-শোঁ শোনা যায় তার বুকের ভেতর। চোখ উল্টে আসতে চায়। মেয়েটা কোনো সেবা পেল না। কেবল দূর দূর করত সবাই। রোগটা সারানোর কোনো উদ্যোগ কেউ নেয়নি। বরং আট প্রহর তাকে গঞ্জনা শুনতে হতো- তার বাবা রোগ গোপন করে তাকে এ ঘরে বিয়ে দিয়ে সর্বনাশের চূড়ান্ত করেছে। তার বরটা প্রথম প্রথম তার পক্ষ নিত। পরে মায়ের বোনের সুতার ফাঁদে পড়ে ঘুরে গেল। বলে বেড়াতে থাকল, তাকে ঠকানো হয়েছে। বলে বেড়াতে থাকল, শুক্লা মরলে সে বেঁচে যায়। এক চৈত্রসংক্রান্তির মেলায় শুক্লাকে দেখে পাগল হয়েছিল মানিক। সেই মুগ্ধতার কিছুই তখন অবশিষ্ট নেই। হারাধন তাকে ধরে কত বুঝিয়েছে! কিন্তু ভগবান তার বাইরে ছিল, অন্দরে ছিল না।

এদিকে সনাতনি বন্ধন। লাশ হওয়া ছাড়া শুক্লার বেরোনোর কোনো উপায় ছিল না। এক অভিমানী তরুণীর বুকে কত কষ্ট জমলে সে শীতের রাতে পাটের পাকানো দড়ি হাতে যোগীদের কবরস্থান পেরিয়ে এই নির্জনে এসে দাঁড়ায়। তার বুকের শোঁ-শোঁ তখন এই গাছের চারদিকের বাতাসের তন্তুতে জড়িয়ে যায়। বাতাসের তন্তুতে জড়ানো কোনো শব্দ, কোনো ঘ্রাণ সব সময় পাওয়া যায় না। যেদিন সেই দিন সেই ক্ষণ হুবহু এসে উপস্থিত হয়, সেদিন পাওয়া যায়। ফাল্কগ্দুনের কৃষ্ণপক্ষের পনের রাতের যে কোনো এক রাতে এখানে শুক্লার বুকের শব্দ বাজতে থাকে।

সেই রাতে শুক্লার কষ্ট আমার বুকে ঝোড়ো বাতাসের ঘূর্ণির মতো পাক খেতে থাকল। মনে হলো, এত সুন্দর যার নাম, সে না জানি দেখতে কত সুন্দর! মনে মনে শুক্লার একটা মোহনমূর্তি আমার মনে দাঁড়িয়ে গেল। এত সুন্দর যে পতনের উপলক্ষ তাতে ভর করে আছে। ইংরেজ কবি যেমন বলেছেন, সুন্দরের মৃত্যু হবেই। শুক্লার বুকে ঝড়ের শব্দ। তার দেহ কুঁকড়ে আছে। যে বিশুদ্ধ ভালোবাসার তন্ত্রমন্ত্র সেই ঝড় থামিয়ে দিতে পারত, তা ছিল আমার বুকেই কেবল। কিন্তু আমি তো তখন নেই। যদি থাকতাম, পরিবারের বাইরে বেরিয়ে শুক্লাকে যেন অনেক দূরে নিয়ে গেছি, এক চোখ আলো করা নীল সাগরের পারে। কী বাতাস! উদ্দাম, আদিম। বাতাসের তন্তুতে সূর্যের শক্তি এসে জমা। সেখানে রোদ পোহালে শরীরের আয়ু বেড়ে যায়। সেখানে শ্বাস নিলে ভেতর পরিশ্রল্ফম্নত হয়। যেন শুক্লাকে সুস্থ করে আমি দূরে কোথাও সুখের ঘর বেঁধেছি। আর আমার মায়ের মনের ভেতর সারাক্ষণ নিঃসঙ্গ হেঁটে বেড়াচ্ছি। মা যেন আমাকে পেছন থেকে ডাকতে চাইছেন খুব, কিন্তু তার যেন সেই মুখ নেই। তার চোখে জল, মুখটা কষ্টে বিকৃত। আমার বুকেও অনেক কষ্ট যেন। কিন্তু তার এক কণার আঁচ কেউ পাবে না। আমি এমন সিন্দুক।

(সুজুদ খড়ম পায়ে বাড়ির উঠানের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে। মোস্তফা গতজীবন দাদা মহাশয়। অনেকেই আছে এখানে আসা-যাওয়ায় কিন্তু কেউ তাকে দেখতে পাচ্ছে না। সন্ধ্যার প্রাণশক্তি শেষের পথে। তবু আলো পুরোপুরি নেভার আগে বেশিক্ষণ বাইরে দাঁড়ানো কঠিন।

সুজুদ ধীরে ধীরে বনের আড়ালে চলে গেল। বিকেল আর সন্ধ্যাটা কেমন হলুদাভ আজ! বুঝি রাতে ঝড়-বৃষ্টি হবে। একটা গাছের গুঁড়িতে হেলান দিয়ে সুজুদ দাঁড়িয়ে থাকল। চৈত্রের শেষবেলা চলছে এখন। বৈশাখের সূর্য, বৈশাখী মেঘ তাদের আঁচ আর ছায়া ফেলতে শুরু করেছে। বাইরে ঝড়বৃষ্টির রাতে বিদেহীরা শান্তি পায় না। তাদের কোনো ছাউনির নিচে আশ্রয় নিতে হয়। যোগীদের কবরস্থানের বনে শুক্লার নিঃশ্বাস মাথা কুটছে।

মেয়েটার অসুখ যখন বেড়ে গেছে, সুজুদ তার জন্য খুব উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছিল। কিন্তু কিছু করার ছিল না। পরের ঘরের বধূ। পরের বছর এমন একটা ঘটনা ঘটবে, এটা ভাবনার বাইরে ছিল। এর ক’বছরে সুজুদও বিপত্নীক হলো। বাতে বাঁকা হাত-পায়ের পাতা, ক্লিষ্ট শরীর নিয়ে কোটরগত চোখ চিরতরে বন্ধ করল টুনটুন। ছেলে কিবরিয়ার বিয়ে হলো, ছেলে ইদরিসের বিয়ে হলো, ছেলে জিবরানের বিয়ের বছর সুজুদও দেহ ছাড়ল। ধীরে ধীরে শরীরটা ছাড়ার উপলক্ষগুলো তৈরি হতে দেখা খুব করুণ অভিজ্ঞতা। যখন চোখের জ্যোতি কমে যায়, কেমন বিশ্বাস হতে চায় না। যখন শ্রবণক্ষমতা কমে যায়, একই অবিশ্বাসের অনুভূতি। তার পর যেদিন দম পড়ে যায়, সেদিন নিজের ওপর কেমন করুণা হয়। আর কেবলই মনে হয়, এই কি সেই শরীর, যাতে কোনোদিন জরা এসে বাসা বাঁধতে পারে বলে যৌবনে তিলমাত্র মনেও হয়নি? ছেলের ঔরসে তৃতীয় ছেলে হয়ে সুজুদ আবার দেহ ধারণ করল এবং এও বড় যাতনাকাতর অভিজ্ঞতা। সে অভিজ্ঞতার কথা ব্যক্ত করা নাস্তি।

টুনটুন কোথায় চলে গেছে, বহুদিন দেখা নেই! এখানে শুক্লাই সুজুদের আপন হয়েছে। কিন্তু কারও সাথে কারও দেখা এখানে হয় না, কেবল পরস্পরের উপস্থিতি তারা বুঝতে পারে। মৃত্যুর পরের বয়সহীন জগৎটা ভারি তরল! তরল যেমন তরলের ভেতর প্রবেশ করে, বিলীন হয়, পৃথক হয় কিন্তু পরস্পরের তন্তুতে রেশ রেখে রেখে যায়, এখানেও তেমন। সুজুদ এখানে ঠিক যেন চেনা সুজুদ নয়। শুক্লাও আর ঠিক সেই শুক্লা নেই। তবে সুজুদ এখন বিশুদ্ধ সুজুদ। শুক্লাও এখন বিশুদ্ধ শুক্লা। টুনটুন, মানিক, এমনকি মোস্তফার বাবা জিবরান পর্যন্ত সবাই এখন বিশুদ্ধ টুনটুন মানিক জিবরান।

মৃত্যুর পর ধীরে ধীরে সাড়ে সাত হাজার পরত খসে পড়ে। এর পর সবাই নিখাদ মানুষটি হয়ে আত্মপ্রকাশ করে। আর এই নিখাদ স্তরে সমস্ত প্রতিযোগিতার যেন অবসান ঘটেছে। কেবল একটাই ইচ্ছা এখানে জেগে থাকে। পারদ যেমন পারদের ভেতর প্রবেশ করে আরও বড় পারদগোলক তৈরি করে। মৃতের শক্তি তেমনই; যেন জল এখানে জলের সাথে মিলতে ভারি আকাঙ্ক্ষী। আর তখন যখন পরস্পরকে অনুভব করা গেলেও সংসর্গে আসা যায় না, যন্ত্রণা হয়। এখানে যন্ত্রণা হলে শক্তি সংকুচিত হয়ে আসে। সংকুচিত শক্তি বেশি ছোটাছুটি করলে জীবিতের জগতে শান্তি বিঘ্নিত হয়।

বিদেহী শক্তিকে চিন্তার মতো থাকতে হয়। চিন্তা যেমন ডাকলে সাড়া দেয়, আর নেই বললেই শূন্য, ঠিক তেমন। কিন্তু ওই এক ইচ্ছে এ অবস্থার সামনে বাধা।)

খোলা জানালার বাইরে জোছনায় দূরের মাদার গাছটা আজও ভেসে উঠেছে। রাত গভীর। হঠাৎ খড়মের শব্দ এসে থামল ঘরের দরজার সামনে। এখানে মাটির ওপর মেঝে বিলাতি মাটি লেপে পাকা করে তোলা। খড়মের শব্দ ধীরে ধীরে মোস্তফার ঘরটাকে প্রদক্ষিণ করতে থাকল। কোথাও কোথাও তা মিলিয়ে যায়, কোথাও আবার ফিরে ফিরে আসে। বিড়বিড় করে বললাম, ‘দাদা, তুমি এসেছ? দাদা?’ কেউ কিছু বলল না। বললাম, ‘তুমি কি দেখা দিতে পার না? তুমি দেখতে কেমন? বাবার তোলা একটা ছবি আছে। কিন্তু সেটার ওপর এমন বিদঘুটে রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটেছে যে, তোমার চেহারা বোঝার কোনো উপায় নেই। আমার মাঝে মাঝে মনে হয়, তুমি আমার ভেতর আমি হয়ে আছ। তোমাকে আমি খুব অনুভব করি। তুমিও কি তাই? তাই কি তুমি আমাকে এমন পাহারা দিয়ে রাখো? তুমি আমার ঘরে এসো।’

পাশের ঘর থেকে কৃষ্ণ জ্যাঠাইয়ের কাশির শব্দ এলো। এর পর মৃদু হাঁক। ‘মোস্তফা! জ্যাঠা! ঠিক আছ তো?

একবার দ্বিধা করে উত্তর দিলাম, ‘ঠিক আছি জ্যাঠা! আমি এখন একটু বাইরে যাব।’

‘না, এখন যাইও না। আরেকটু পরে যাও জ্যাঠা।’

‘আচ্ছা।’

চাঁদ ডুবল। ঘোরাল অন্ধকারে ডুবে গেল রহস্যময় গাঁ। সারাটা রাত অতীত সাঁতরে সকালে পৌঁছুল বর্তমান। অনেক বেলা করে বিছানা ছাড়লাম।

‘মা? তুমি প্রায়ই রাতে আমাকে দেখতে আসো। দিনের বেলায় কেন আসো না?’ খেতে বসে বললাম। মা কেমন অবাক হয়ে তাকালেন। বললেন, ‘রাতে যাব কেন? কই, যাই না তো।’ চিরাচরিত রূঢ় কণ্ঠ নয়। আজ তার কণ্ঠটা কেমন কোমল শোনাল।

‘আমি জানি, তুমি যাও না। তুমি ছাড়াও এ ঘরে আরেকজন খড়ম পরে।’

খাওয়া শেষ করে মুখ-হাত ধুয়ে উঠে পড়লেও মা কোনো কথা বললেন না। মাটির মেঝেতে ডাল-ঝোল, চালের গুঁড়া গোলানো জল পড়ে শুকিয়ে আছে। মায়ের পেছনে বাঁশির ছিলকের বেড়া। তার ফাঁক গলে রাতের অসংখ্য তারা যেন দিনে বিন্দু বিন্দু ফুটে আছে। মায়ের চুল একটা দুটো সাদা। চোখজোড়া নামানো। রান্নাঘরের খোলা দখিন দরজা দিয়ে বাইরে চরে বেড়ানো মুরগির দল চোখে পড়ে। আর চোখে পড়ে বন। রাতের বেলা যে বন দুর্ভেদ্য পাঁচিলের মতো চিবুক উঁচিয়ে রাখে। পূর্ণিমার আলোর নিচে ঝোপ-ঝাড়ের হাঁটুজলে নৃত্য করে। এখন ওরা কেমন সহজ সুন্দর! সরল বন্ধু। যেন এসো বললে আসবে, যাও বললে ফিরে যাবে। আমি পশ্চিমের দরজা দিয়ে বেরিয়ে এসে উঠানে দাঁড়ালাম। উত্তরে মায়ের ঘর। উঁচু মাটির ভিটায় খড়ম পরে আছে এক জোড়া।

আমি ধীর পায়ে হেঁটে আমার পাশের তালাবদ্ধ ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে ডাকলাম, ‘ও কৃষ্ণ জ্যাঠাই!’ কেউ উত্তর দিল না। কেউ থাকে না এ ঘরে। ছোটবেলার কৃষ্ণ জ্যাঠাই কবে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে! এই ঘরটা স্তূপীকৃত লাকড়ির গুদাম আজ বহুদিন। আমার ঘরে জানালার কপাট খোলা। বাইরে দূরে আঁকাবাঁকা আলের ওপর কোনো বৃক্ষ নয়, একটা মাদার গাছের সরু ডাল মাত্র পোঁতা। এলো বর্ষায় হয়তো সেই ডাল থেকে পাতা বেরোবে। বহু বছর পর হয়তো বৃক্ষের দারুণ এক ভাস্কর্যে পরিণত হবে গাছটা।

তারপর কোনো এক ফাল্কগ্দুনী রাতে শুক্লা নামে বধূ যদি এর ডালে আত্মাহুতি দেয়, তাকে নিয়ে বহু দূর চলে যাব আমি। দূরে যোগীদের কবরে বনের গাছপালা চৈতালি বাতাসে মাথা দোলাবে কী অবারিত স্বাধীন, সেই রাতে! খড়ম জোড়া নিয়ে যাব। ও জোড়া আমার।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত