আসসালামু আলাইকুম …।
– ওয়ালাইকুম আসসালাম। আপনি কে হে ভাই? আমার এই পর্ণকুটিরে …!
– আমি আজরাইল …।
– আজরাইল! তা, আমার বাড়িতে কী মনে করে, জনাব …?
– মহান আলস্নহতায়ালার হুকুম হয়েছে, আপনাকে এখন যেতে হবে। আমি আপনাকে নিতে এসেছি। স্ত্রী-পুত্র-পরিজন – কাউকে কিছু বলতে চাইলে ঝটপট বলে ফেলুন। আমার হাতে সময় কম …।
– নির্বোধ আজরাইল, তোমাকে আর কী বলবো! তোমার কি চোখ নেই, তুমি কি দেখছো না – আমি বঙ্গবন্ধুর কোলে চড়ে আছি, বঙ্গবন্ধুর পায়ের কাছে আমার প্রিয় স্টেনগানটি রাখতেই তিনি আমাকে কোলে তুলে নিয়েছেন; তোমার সাধ্য আছে, বঙ্গবন্ধুর কোল থেকে আমাকে কেড়ে নেবে …?
২৫ মে ২০০৯। তখন মধ্যদুপুর। মিরপুরের আকাশে পাথর-গলা রোদ। ঘরের ছাদ যেন ভেঙে পড়বে। শ্বাসটান উঠেছে লালুর। হাসপাতাল থেকে ফিরিয়ে দিয়েছে। যে-কোনো সময় তার প্রাণপাখি অচিন দেশের উদ্দেশে উড়াল দেবে। লালুর স্ত্রী মালা, দুই পুত্র ও এক কন্যা সজল-চোখে বোবার মতো তাকে ঘিরে বসে আছে। তাদের কারো বুঝতে বাকি নেই – লালু প্রলাপ বকছে …।
লালুর মাথা মালার কোলে। মুখ-চোখ সোজা ছাদের দিকে। হঠাৎ তার মুখম-ল ডানদিকে একটু কাত হলো। দুচোখেই ক-ফোঁটা জল জমে ছিল। গড়িয়ে পড়ল সেই জল। লালু কী যেন অস্ফুটে বলল। ঠিক বোঝা গেল না। মালার মনে হলো, ভাবলো সে, লালুর মুখ থেকে বেরিয়েছে মুক্তিযুদ্ধের সেস্নগান – জয় বাংলা …।
লালুর মুখ থেকে শব্দটি বেরুতে না বেরুতেই সব শেষ! তার প্রাণপাখি উড়াল দিয়েছে। মালা চিৎকার করে উঠল – ‘আমাগো সাগরে ভাসাইয়া তুমি কই গেলা গো …।’
দুই
লালুকে আপনারা নিশ্চয়ই চিনেছেন। না-চেনার তো কোনো কারণ দেখি না। লালু মানে – শহীদুল ইসলাম লালু। দেশের সর্বকনিষ্ঠ ‘বীরপ্রতীক’ খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা। মাত্র বারো-তেরো বছর বয়সে সে যুদ্ধে গিয়েছিল। বঙ্গবন্ধু তাকে আদর করে ‘বীরবিচ্ছু’ বলে ডাকতেন। সেই যে ঐতিহাসিক ছবিটা – হাফপ্যান্ট-গেঞ্জিপরিহিত, মাথায় ক্যাপ – বঙ্গবন্ধুর কোলে এক কিশোর – কার চোখে না-পড়েছে ছবিটা! ছবির এই কিশোরই তো আমাদের লালু …।
২৪ জানুয়ারি ১৯৭২; শনিবার। কী দিন যে ছিল সেটি, তা কাউকে বলে বোঝানো যাবে না। এই, এতদিন পর, দু-চারটে দিন নয়, পাঁচ-দশ বছর নয়; ৪৬টি বছর; সেদিন টাঙ্গাইল শহরে যারা ছিলেন তাদের চোখের সামনে এখনো সেদিনের সেই হাজার হাজার মুক্তিযোদ্ধার পদভারে প্রকম্পিত শহর, অগণন মানুষের জয় বাংলা সেস্নগানে স্পন্দিত শহর ভেসে ওঠে। দিনটি টাঙ্গাইলের জন্য অবিস্মরণীয় গৌরবের দিন। মুক্তিযোদ্ধাদের আমৃত্যু স্মরণযোগ্য মাহেন্দ্রক্ষণ। কাদেরিয়া বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধারা সেদিন বঙ্গবন্ধুর পায়ে অস্ত্রসমর্পণ করে। ঢাকার বাইরে, কোনো অস্ত্রসমর্পণ অনুষ্ঠানে, বঙ্গবন্ধু একমাত্র টাঙ্গাইলেই এসেছিলেন। এটিও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে স্বর্ণরেণুরচিত একটি অংশ …।
সকাল ১১টা। শীতের কুয়াশা কেটে গিয়ে রুপালি রোদে ঝলমল করছে শহর। শহরের প্রতিটি বাড়িতে এমনকি বিদ্যুতের খুঁটিতে, গাছের মগডালে পতপত করে উড়ছে রক্তকরোজ্জ্বল জাতীয় পতাকা। টাঙ্গাইল শহরকে সেদিন চেনাই কঠিন। যা হোক, বঙ্গবন্ধুকে বহনকারী টাঙ্গাইল-ক টয়োটা জিপ শহরের প্রবেশমুখে শিবনাথ হাইস্কুল মাঠে ঢুকল। এখানে বঙ্গবন্ধুকে সশস্ত্র অভিবাদন জানানো হবে। প্রবেশপথে দুপাশে দুটি, বেরোনোর পথে দুটি সিক্স পাউন্ডার গান সাজিয়ে রাখা হয়েছে। কাদের সিদ্দিকী বঙ্গবন্ধুকে অভিবাদন মঞ্চে নিয়ে গেলেন। বঙ্গবন্ধু মঞ্চে দাঁড়াতেই কাদেরিয়া বাহিনীর এক হাজার সুসজ্জিত মুক্তিযোদ্ধা তাঁকে সশস্ত্র অভিবাদন জানালেন। একদল মুক্তিযোদ্ধা তখন বাদ্যযন্ত্রে মৃদু তাল তুলে গাইছিলেন – ‘আমার সোনার বাংলা … আমি তোমায় ভালোবাসি …।’
কাদেরিয়া বাহিনীর বিখ্যাত জাহাজমারা হাবীব বঙ্গবন্ধুকে প্যারেড পরিদর্শনে আমন্ত্রণ জানালেন। মুগ্ধ বঙ্গবন্ধুর দুই চোখ তখন ছলছল করছে। কাদের সিদ্দিকীর চোখ এড়ায়নি তা। তিনি বঙ্গবন্ধুর হাতে রুমাল গুঁজে দিলেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু চোখ মুছলেন না। জলছলছল চোখেই বঙ্গবন্ধু তিন সারিতে দাঁড়ানো এক হাজার মুক্তিযোদ্ধার প্রত্যেককে ঘুরে ঘুরে দেখলেন। কারো কারো কাঁধে হাত রাখলেন, নাম-ধাম জিজ্ঞেস করলেন। প্যারেড পরিদর্শনশেষে আবার মঞ্চে ফিরে এলেন বঙ্গবন্ধু। কাদের সিদ্দিকীকে জিজ্ঞেস করলেন – ‘ওরা কারা? ওরা কি বেঙ্গল রেজিমেন্টের লোক …?’
বঙ্গবন্ধুর প্রশ্ন শুনে চকচক করে উঠল কাদের সিদ্দিকীর চোখ। আবেগে তাঁর কণ্ঠ বুজে আসছে। তারপরও বললেন, ‘না বঙ্গবন্ধু, না। ওরা সবাই কৃষক-শ্রমিক, ছাত্র-শিক্ষক; ওরা নানা পেশার মানুষ। ওদের নিয়েই আমি যুদ্ধ করেছি। বেঙ্গল রেজিমেন্টের কয়েকজন থাকলেও থাকতে পারে। তবে তা হাজারে পাঁচ-দশজনের বেশি হবে না …।’
বঙ্গবন্ধুর হাতে মাইকের মাইক্রোফোন। কিন্তু তিনি কোনো কথা বলছেন না। ভাবছেন – কৃষক-শ্রমিক, ছাত্র-শিক্ষক; কারো সামরিক প্রশিক্ষণ ছিল না, অস্ত্র ছিল না; এরাই প্রশিক্ষিত পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছে। আমি বলেছিলাম – যার কাছে যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রম্নর মোকাবেলা করতে হবে। ওরা জীবনবাজি রেখে আমার কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছে …।
কাদের সিদ্দিকী বললেন – ‘বঙ্গবন্ধু, কিছু বলুন। ওরা সবাই আপনার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে …।’
– কী বলবো কাদের? বলার মতো কোনো কথা আমি খুঁজে পাচ্ছি না …।
দেখুন, কোনো কোনো সময় এরকম হয় – রাজনীতির কবিও বলার মতো কোনো কথা খুঁজে পান না …।
কাদের সিদ্দিকী বললেন – ‘আপনার যা ইচ্ছা তাই কিছু বলুন …।’
বঙ্গবন্ধু এবার কাদের সিদ্দিকীর দেওয়া রুমাল দিয়ে চোখ মুছলেন। চোখ মুছতে মুছতেই বললেন – ‘তোমরা যা করেছো, তার কোনো তুলনা হয় না। পৃথিবীতে এরকম কোনো নজির নাই। আমার সৌভাগ্য যে, আমি তোমাদের কাছে আসতে পেরেছি। তোমাদের দেখে আমি মুগ্ধ। তোমরা যুদ্ধ করেছো, দেশের স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছো। এখন দেশ গড়ার যুদ্ধে নামতে হবে। তোমাদের একজন হয়ে আমি কাজ করবো …।’
বঙ্গবন্ধুর চোখে তখন বাঁধভাঙা পস্নাবন …।
এবার গন্তব্য বিন্দুবাসিনী বালক বিদ্যালয়। বঙ্গবন্ধু গাড়িতে উঠলেন …।
সকাল সাড়ে ১১টা। বঙ্গবন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে মঞ্চে উঠলেন কাদের সিদ্দিকী। সঙ্গে কাদের সিদ্দিকীর অন্যতম দুই সহযোগী – আনোয়ার-উল-আলম শহীদ ও এনায়েত করিম। মাঠে নানা ধরনের দশ হাজার হাতিয়ার সার করে দাঁড়-করানো। তিন হাজার সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধাও সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে আছেন। বিন্দুবাসিনী স্কুলমাঠে প্যারেড কমান্ডার মেজর আবদুল হাকিম। বঙ্গবন্ধু ও কাদের সিদ্দিকী মঞ্চে উঠতেই তিনি সারিবদ্ধ ও সুশৃঙ্খলভাবে দাঁড়িয়ে থাকা মুক্তিযোদ্ধাদের সতর্ক করলেন। তারপর সশস্ত্র অভিবাদন জানালেন বঙ্গবন্ধুকে। বঙ্গবন্ধু এখন আর জিজ্ঞেস করলেন না – ওরা কারা। তিনি তো শিবনাথ হাইস্কুল মাঠেই জেনে গেছেন – ওরা কৃষক-শ্রমিক, ছাত্র-জনতা, খেটেখাওয়া দিনমজুর; ওরা দেশমাতৃকাকে বাঁচাতে যুদ্ধে গেছিল …।
অভিবাদন শেষ। এবার আনুষ্ঠানিকভাবে অস্ত্রসমর্পণ। শহরের সব মানুষ – আবাল-বৃদ্ধ, শিশু-কিশোর, নারী-পুরুষ; সবাই ভেঙে পড়েছে বিন্দুবাসিনী বালক বিদ্যালয়ের চারপাশে। স্কুলের ছাদে মানুষ, ঘ্যাগের দালানের ছাদে মানুষ, রমেশ হলের ছাদে মানুষ; সব গাছের ডালে ডালে কাঠবিড়ালির মতো বসে আছে মানুষ। অস্ত্রসমর্পণের প্রতীক হিসেবে কমান্ডার হাকিম কাদেরিয়া বাহিনীপ্রধান কাদের সিদ্দিকীর ব্যবহৃত স্টেনগানটি প্রসারিত দুই হাতে তুলে দিলেন কাদের সিদ্দিকীর হাতে …।
যুদ্ধের পুরো নয় মাস এই স্টেনগানটি ছিল কাদের সিদ্দিকীর প্রিয় সঙ্গী। কখনো হাতছাড়া কিংবা হাতবদল হয়নি অস্ত্রটি। কাদের সিদ্দিকী বঙ্গবন্ধুর সামনে হাঁটু গেড়ে বসে তাঁর পায়ের কাছে স্টেনগানটি রাখলেন। কাদের সিদ্দিকী যখন বঙ্গবন্ধুর সামনে হাঁটু গেড়ে বসেছেন, তখন মাঠের তিন হাজার মুক্তিযোদ্ধাও তাদের নিজ নিজ অস্ত্র মাটিতে রেখে হাঁটু গেড়ে বসেছে …।
বঙ্গবন্ধু কাদের সিদ্দিকীর স্টেনগানটি তুলে তাঁর ডানপাশে দাঁড়িয়ে থাকা আনোয়ার-উল-আলম শহীদের হাতে দিলেন। বঙ্গবন্ধুর চোখে আবার পস্নাবন নেমেছে। কাঁদতে কাঁদতেই তিনি কাদের সিদ্দিকীকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন – বহুদিনের, বহুকালের বিচ্ছেদের পর যেন পিতা-পুত্রের মিলন ঘটেছে। দুজনেই হাউমাউ করে কাঁদছেন। মাঠের সব মুক্তিযোদ্ধার চোখেও তখন জল। আর চারদিকে গগনবিদারী সেস্নাগান – ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু …।’
বঙ্গবন্ধু মাঠে নেমে অস্ত্র পরিদর্শন করছেন। তাঁর সঙ্গে দেশি-বিদেশি বহু সাংবাদিক ও ফটোগ্রাফার। তাদের ভিড় ঠেলে মাঠে সাজিয়ে রাখা অস্ত্রগুলো ঘুরে ঘুরে দেখছেন। একবার কাদের সিদ্দিকীকে জিজ্ঞেস করলেন বঙ্গবন্ধু – ‘কাদের, এতো অস্ত্র তুই কোথায় পেলি …?’
কাদের সিদ্দিকীর সোজাসাপ্টা উত্তর – ‘যুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদারদের পরাজিত করে তাদের অস্ত্র দখল করেছি …।’
বঙ্গবন্ধু কাদের সিদ্দিকীর কাঁধে মৃদু চাপড় দিলেন …।
সারিবদ্ধ মুক্তিযোদ্ধা ও অস্ত্রের মাঝখান দিয়ে ধীরপায়ে হাঁটছেন বঙ্গবন্ধু। হঠাৎ তাঁর চোখে পড়ল বাচ্চা একটি ছেলে। বঙ্গবন্ধু সবিস্ময়ে তাকালেন হাফপ্যান্ট-গেঞ্জিপরিহিত ছেলেটির দিকে। কাদের সিদ্দিকীকে উদ্দেশ করে বললেন – ‘কাদের, এই বাচ্চা ছেলেটি কে? অ-ও কি মুক্তিযোদ্ধা …?’
কাদের সিদ্দিকী বললেন – ‘বঙ্গবন্ধু, ওর নাম শহীদ। তুরায় ট্রেনিং নেওয়ার সময় ব্রিগেডিয়ার সান সিং ওর নাম দিয়েছিলেন ‘লালু’। আমরাও ওকে লালু নামেই ডাকি। ও একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। গোপালপুর থানায় গ্রেনেড চার্জ করে ১২ হানাদারের ভবলীলা সাঙ্গ করে দিয়েছিল …।’
– বলিস কী, কাদের …!
– ঠিকই বলছি, বঙ্গবন্ধু …।
– এই এতটুকু ছেলে, দুধের বাচ্চা! গ্রেনেড ছুড়েছে …!
বঙ্গবন্ধু লালুর কাছে গেলেন। বললেন – ‘আয় আমার বীরবিচ্ছু লালু, তুই আমার কোলে আয়।’ বঙ্গবন্ধু লালুকে কোলে তুলে নিলেন। রাসেলের কপোলে যেভাবে চুমু খান, সেভাবেই চুমু খেলেন লালুর কপোলে। তারপর দেশি-বিদেশি সাংবাদিকদের বললেন – ‘দেখুন, এরাই আমার মুক্তিযোদ্ধা! এই লালুর মতো কিশোর ছেলে যখন যুদ্ধে নামে, তখন কেউ কি আমাদের দাবায়া রাখতে পারে, দেশ কি স্বাধীন না-হয়ে পারে …?’
তিন
গোপালপুর থানা-শহরের সূতিপলাশপাড়া লালুদের বাড়ি। দিনমজুর-পরিবারের ছেলে। তখন লালুর বয়স বারো কি তোরো। মা-বাবা নেই। পাঁচ বছর বয়সেই লালু মা-বাবা হারায়। তখন কলেরার খুব প্রকোপ ছিল। একদিনের ভেদবমিতেই মারা যায় তারা। তখন কলেরার চিকিৎসাও ছিল না। যাই হোক, মা-বাবা নেই তো লালুর কোনো বন্ধনও নেই। বেজায় দুরন্ত প্রকৃতির ছেলে। তিন ভাই, এক বোনের মধ্যে সবার ছোট। বড় ভাই-ভাবিরা ওর তেমন যত্ন-আত্তি করে না, সেও তাদের তোয়াক্কা করে না। সারাদিন বনবাদাড়ে ঘুরে বেড়ায়। বাটুল ছুড়ে পাখি মারে। লালুর বাটুল ছোড়ার হাতও খুব পাকা। কদিন প্রাইমারি স্কুলে গেছিল সে, কিন্তু লেখাপড়া ভালো লাগেনি …।
তখন দেশে যুদ্ধ শুরু হয়েছে। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী গোপালপুর থানায় ঘাঁটি গেড়েছে। হানাদাররা রাজাকারদের হাতে কেরোসিন তেলের টিন ধরিয়ে দিয়ে শহরে বের হয়। ঘরের বেড়ায় কেরোসিন ঢেলে অগ্নিসংযোগ করে। বাইশকাইল, বাসুরিয়াবাড়ি, পালপাড়ায় কয়েকশো বাড়ি ছারখার করেছে হানাদাররা। লালুর বয়স কম, তাতে কী – ওর কানেও আসে খবর। হানাদাররা যাকে সামনে পায় তাকেই গুলি করে মারে; পালপাড়ার মেম্বার মোহিনীচরণ পাল, বাসুরিয়াবাড়ির মেম্বার সেকান্দার আলী সরকারকে বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে বৈরান নদীর সান্দারবাড়ি ব্রিজের কাছে গুলি করে মেরেছে – এই খবরও শুনেছে লালু। হানাদাররা তো মানুষ না, পশু; না-হলে পাকুটিয়া আশ্রমে প্রার্থনা করছিলেন পুরোহিত প্যারীমোহন আদিত্য ও বামাচরণ শর্মা; প্রার্থনারত অবস্থায়ই হানাদাররা তাদের গুলি করে মেরেছে। ইস! লালু মনে মনে ভাবে – তার কাছে যদি বন্দুক থাকতো সেও হানাদারদের গুলি করে মারতো। দূর থেকেই লক্ষ্যস্থির করে গুলি ছুড়তো, বাটুল যেভাবে ছোড়ে …।
লালু দুরন্ত, তা বলেছি আগে; যা বলা হয়নি – লালু খুব সাহসীও। হানাদাররা শহর জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে তামা করে ফেলছে, যাকে ইচ্ছা তাকে ধরে নিচ্ছে, থানা ঘেঁষেই বৈরান নদী; আটককৃতদের গুলি করে মেরে নদীতে ভাসিয়ে দিচ্ছে, তারপরও লালু শহরজুড়ে ঘোরাঘুরি করে। হাতে বাটুল। একটা হানাদারের চোখও যদি বাঁটুল ছুড়ে কানা করে দেওয়া যায় …!
তখন এপ্রিল শেষ হয়ে এসেছে। গাছে গাছে ঝুলছে পাকা আম; কিন্তু শহরে আম খাওয়ার কোনো মানুষ নেই। এমনকি শহরে কোনো পাখপাখালিও নেই, যারা এখন সুযোগ বুঝে আম খেতে পারে। শহরের মানুষ এবং পাখিকুল; জীবন বাঁচাতে যে যেভাবে পারে পালিয়েছে। লালুর ভাই-ভাবিরা তখনো ছিল। বড় দুই ভাই-ই দিনমজুর এবং বোকার হদ্দ। তারা ভেবেছিল – গরিবগুরবো লোকদের হানাদাররা কিছু বলবে না। তার ওপর তারা মুসলমান। তারা শুনেছে, দেখছেও তো চারদিকে; হানাদাররা হিন্দুদেরকেই বেশি ধরে, মারে। কিন্তু সেদিন দুই ভাই মরতে মরতে বেঁচে এসেছে এবং বাড়িতে এসেই সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করেছে – গ্রামে আর না। বাঁচতে চাইলে গ্রাম ছাড়তে হবে। কী লজ্জায়ই না তারা পড়েছিল সেদিন …!
লালুর দুই ভাই আলিম-কলিম। সেদিন সাঁঝের আগে আগে বাড়ি ফিরছিল। কোদাল-পাইছা হাতে। যদুনাথপুর গেছিল মাটিকাটার কাজে। থানার সম্মুখ দিয়েই বাড়ি যাওয়ার পথ। থানার সামনে যেতেই হানাদার সেন্ট্রি হাঁক ছাড়ল – ‘এই বাঙাল লোক, ইধার আও …।’
সেন্ট্রির ডাক শুনে আলিম-কলিমের হাত-পা কাঁপতে লাগল। কলিম তো পেচ্ছাবই করে দিলো। কিন্তু থানায় না-ঢুকেও তো উপায় নেই। ওখান থেকেই গুলি করতে পারে …।
– তুম মুসলমান না হিন্দু মালাউন …?
– মুসলমান স্যার। সাচ্চা মুসলমান …।
– নাম বাতাও …।
– আলিমুদ্দিন …।
– কলিমুদ্দিন …।
– চার কলেমা বাতাও …।
কলেমা বলতে হবে শুনে আলিমও পেচ্ছাব করে দিলো। দুই ভাইয়ের কেউই কলেমা তৈয়ব ছাড়া আর কোনো কলেমা বলতে পারল না। কিছুতেই মনে করতে পারল না অন্য তিন কলেমা। সেন্ট্রি দুই ভাইয়ের পেটের মধ্যে বেয়োনেট দিয়ে খোঁচা মেরে বলল – ‘শালা মালাউনকা বাচ্চা। ঝুট বলে গা …।’
আলিম-কলিম দুই ভাই হাত জোড় করে বলল – ‘না স্যার। ঝুট বলি নাই। আমরা সাচ্চা মুসলমান …।’
– লুঙ্গি খোল শালারা। দ–র মাথা দেখি …।
দুই ভাই মুখ চাওয়াচাওয়ি শুরু করল। লুঙ্গি খুলতে হবে! মুসলমানিত্বের পরীক্ষা দিতে হবে। কিন্তু লুঙ্গি না-খুলে তো উপায় নেই। আলিম-কালিম দুজনেই লুঙ্গির গেরো খুলে দিলো …।
সেই রাতেই বউ-বাচ্চা নিয়ে বাড়ি ছাড়ল আলিম-কলিম। লালুকেও সঙ্গে নিল। গোপালপুর থানা সদর থেকে অনেক দূরের গ্রাম কেরামজানি, ওই গ্রামে দূরসম্পর্কের এক আত্মীয়বাড়িতে আশ্রয় পেল ওরা …।
চার
কেরামজানি হাইস্কুলে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প। এই এলাকাকে মুক্তাঞ্চল ঘোষণা করেছে মুক্তিযোদ্ধারা। লালু সারাদিন ক্যাম্পের কাছাকাছি ঘুরঘুর করে। হাতে বাটুল-গুলতি। তার আশা – সেও মুক্তিযোদ্ধা হবে। যুদ্ধ করবে; কিন্তু ক্যাম্পের ভেতরেই তো যেতে পারছে না। বয়স কম বলে মুক্তি সেন্ট্রিরা ঢুকতে দেয় না। তাড়িয়ে দেয়। লালু ইতোমধ্যে জেনে গেছে – হুমায়ুন বাঙ্গাল এই ক্যাম্পের কমান্ডার। সে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে, যা থাকে কপালে, কমান্ডারকে দেখলেই, সেন্ট্রিদের বাধা উপেক্ষা করে ক্যাম্পের ভেতর ঢুকে পড়বে। একবার ঢুকতে পারলে কমান্ডারকে সে বোঝাতে পারবে – তার বাঁটুল ছোড়ার তাক যেহেতু নির্ভুল, বন্দুকের গুলিও সে নির্ভুল লক্ষ্যবস্ত্ততেই ছুড়তে পারবে …।
মুক্তিযোদ্ধারা সাধারণত দিনের বেলা ক্যাম্পের বাইরে বেরোয় না। সেন্ট্রিদের ডিউটি বদল হয় মাত্র। সেদিন ১০ মে, লালু যথারীতি ক্যাম্পের কাছাকাছি ঘুরঘুর করছে, হঠাৎ দেখে মাথায় ক্যাপ, স্যান্ডো গেঞ্জিপরিহিত সুদর্শন এক যুবক স্কুলের বারান্দায় দাঁড়িয়ে বিড়ি কি সিগারেট টানছে। লালুর কেন জানি মনে হলো, এই লোকটাই কমান্ডার হুমায়ুন বাঙ্গাল। তারপরও সে সেন্ট্রিকে জিজ্ঞেস করল – ‘ভাই, ওই লোকটি কে …?’
সেন্ট্রি উত্তর দিলো – ‘উনি আমাদের কমান্ডার, হুমায়ুন বাঙ্গাল …।’
লালুকে আর পায় কে! সোজা ভোঁ-দৌড়। একেবারে কমান্ডারের সামনে। সেন্ট্রিও পেছনে পেছনে দৌড়ে এসেছে। অনাহূত লোক ক্যাম্পের ভেতরে ঢুকেছে, নিশ্চয়ই তার শাস্তি পেতে হবে …।
– এই ছেলে, তুই কে …?
– আমি শহীদ। শহীদুল ইসলাম …।
– বাড়ি কোথায় …?
– বাড়ি গোপালপুর থানা সদরের সূতিপলাশপাড়া, এখন এই গ্রামেই আছি, আত্মীয়বাড়ি …।
– তা, তুই এখানে কেন …?
– আমি মুক্তিযোদ্ধা হবো …।
– বলিস কী! তুই তো একটা বাচ্চা ছেলে …।
– আমি একদম নির্ভুল জায়গায় বাটুল ছুড়তে পারি …।
লালুর কথা শুনে মৃদু হাসলেন কমান্ডার হুমায়ুন। তারপর বললেন – ‘শহীদ, বাটুল ছোড়া আর বন্দুকের গুলি ছোড়া তো এক নয়। তাছাড়া যুদ্ধ অনেকদিন চলবে। আরেকটু বড় হ। তারপর আসিস …।’
শহীদ বলল – ‘আমাকে ছোট বন্দুক দেবেন। আমি এখনই যুদ্ধ করব …।’
‘সেন্ট্রি’, হুমায়ুন বাঙ্গাল বললেন, ‘আনোয়ারকে ডেকে আনো তো …।’
আনোয়ার এলেন। আনোয়ার মানে আনোয়ার হোসেন পাহাড়ি। ক্যাম্পের সহকারী কমান্ডার …।
হুমায়ুন বললেন, ‘দেখো তো আনোয়ার, ছেলেটাকে নিয়ে কী বিপদেই না পড়েছি। দুধের বাচ্চা, বলে কিনা মুক্তিযোদ্ধা হবে …।’
– তাই নাকি …!
– একেবারে নাছোড়বান্দা। কিছুতেই কিছু শুনছে না …।
– ঠিক আছে, ক্যাম্পে থাকুক। আপাতত ফুটফরমাশ খাটুক। তারপর দেখা যাবে …।
শহীদের খুশি দেখে কে? ক্যাম্পে থাকার সুযোগ ঘটেছে, এই তো যথেষ্ট। আর কী চাই! মুক্তিযোদ্ধাদের ফুটফরমাশ খাটতে লাগল শহীদ। তাদের পানি খাওয়ায়, চা খাওয়ায়। অস্ত্রশস্ত্র বহন করে। অস্ত্র পরিষ্কারও করে। অস্ত্র পরিষ্কার করতে ছোট্ট শহীদ বেশ পটু। বন্দুক বা স্টেনগানের যন্ত্রাংশ খুলে আবার ঠিকঠাকমতো লাগাতে পারে। এই করতে করতে দিন-পনেরো পরেই শহীদ একদিন কমান্ডার হুমায়ুন বাঙ্গালকে বলল – ‘স্যার, আমার একটা পরীক্ষা নেন। আমি গুলি ছুড়তে পারব …।’
– বলিস কী রে শহীদ! তুই গুলি ছুড়তে পারবি
একবার পরীক্ষা করেই দেখেন না …।
ক্যাম্পের পাশেই একটা তালগাছ। ন্যাড়া মাথা। ডালপালা নেই। গাছের ন্যাড়া মাথায় কি একটা পাখি বসে আছে। বেশ বড়োসড়ো। চিলটিল হবে হয়তো। হুমায়ুন বাঙ্গাল একটা থ্রি-নট-থ্রি রাইফেল শহীদের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন – ‘ওই যে ন্যাড়া তালগাছের মাথায় একটা পাখি বসে আছে, ওটাই তোর টার্গেট; ওটাকে গুলি করে নিচে ফেলতে হবে …।’
আমাদের শহীদ কিংবা লালু; অশিক্ষিত ছেলে; দু-চারদিন প্রাইমারি স্কুলে গেছিল মাত্র, কোনোমতে নিজের নাম লিখতে পারে; বিদ্যা এটুকুই; সুতরাং মহাভারত পড়ার প্রশ্নই ওঠে না। অর্জুন যে পৃথিবীবিখ্যাত তীরন্দাজ, তার ছোড়া তীর যে কখনো লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়নি – এটাই বা লালু জানবে কী করে! যাই হোক, তা অন্য গল্প; আমাদের লালু ঠিক অর্জুনের মতোই তালগাছের ন্যাড়া মাথায় বসা পাখিটাকে লক্ষ্যবস্ত্ত স্থির করে গুলি ছুড়লো এবং পাখিটা গুলি খেয়ে ছটফট করতে করতে মাটিতে লুটিয়ে পড়লো। কমান্ডার হুমায়ুন বাঙ্গাল লালুর পিঠ চাপড়ে দিলেন – ‘সাবাস, বাপের ব্যাটা …!’
পাঁচ
জুলাই মাসের মাঝামাঝি। চারদিকে থইথই জল। ’৭১ সালে খুব বর্ষা এসেছিল। তখন কেরামজানির একটি মুক্তিযোদ্ধাদল নৌকাযোগে মেঘালয়ে যায়। দলটির নেতৃত্বে ছিলেন আনোয়ার হোসেন পাহাড়ি। মেঘালয়ের তুরায় ট্রেনিং ক্যাম্প। ক্যাম্প-কমান্ডার ভারতীয় ব্রিগেডিয়ার সান সিং। এই ব্রিগেডিয়ার মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে ‘বাবাজি’ হিসেবে সুপরিচিত। যেমন সুন্দর চেহারা, পরিপাটি ও চৌকস অফিসার; তেমনি অমায়িক তাঁর ব্যবহার। বাংলাদেশের কৃষক-শ্রমিক, ছাত্র-জনতা মুক্তিযোদ্ধাদের ছোটভাইয়ের মতো, ছেলের মতো আদর-স্নেহ করেন। হাতে-কলমে যুদ্ধকৌশল শেখান। টাঙ্গাইলে যে কাদের সিদ্দিকী নামের এক তরুণ মুক্তিবাহিনী গঠন করেছেন, সখীপুর পাহাড়ে মুক্তাঞ্চল সৃজন করে নিজেই মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিং দিচ্ছেন, হানাদারদের সঙ্গে যুদ্ধ করছেন, বেশিরভাগ যুদ্ধেই জয়লাভ করছেন – এসব খবর ব্রিগেডিয়ার সান সিং নিয়মিতই পান। তিনি তার গোয়েন্দা ইউনিটকে বলেও রেখেছেন – তারা যেন ঠিকঠাকমতো কাদেরিয়া বাহিনীর খোঁজখবর রাখে …।
আনোয়ার হোসেন তুরায় এসেছেন কাদের সিদ্দিকীর চিঠি নিয়ে। চিঠি পেয়ে ব্রিগেডিয়ার সান সিং যারপরনাই খুশি। তিনি আনোয়ারের দলকে ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করে দেন …।
আনোয়ার হোসেনের এই দলে শহীদও ছিল। একদিন সকালে ব্রিগেডিয়ার সান সিং প্যারেড গ্রাউন্ডে ট্রেনিংরত মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে কথা বলছিলেন। হঠাৎ করেই তাঁর চোখ আটকে যায় শহীদের ওপর। তিনি আনোয়ার হোসেনকে ডেকে বলেন – ‘এই আনোয়ার, এই ছেলে তো একেবারেই বাচ্চা লোক! দুধের বাচ্চা। ওকেও তোমরা যুদ্ধে নামিয়েছো …!’
– স্যার, মাফ করবেন। ওকে আমরা যুদ্ধে আনতে চাইনি। কিন্তু ছেলেটা এতোটাই বেপরোয়া যে, ওকে ট্রেনিংয়ে না-এনে উপায় ছিল না। ও কোনোমতেই আমাদের ছাড়ল না। তবে স্যার, ও খুব সাহসী, ওর হাতের নিশানা একেবারেই নির্ভুল, আমাদের ক্যাম্পে প্রমাণ দিয়েছে …।
– তাই নাকি …!
– জি স্যার …।
– বাবা, তোমার নাম কী … ?
– শহীদ, শহীদুল ইসলাম …।
– বন্দুক ছুড়তে পারবে? গ্রেনেড ছুড়তে পারবে? তোমার থেকে বন্দুকের ওজন বেশি হতে পারে …।
– সব পারবো, স্যার। পরীক্ষা নিয়ে দেখুন …।
ব্রিগেডিয়ার সান সিংয়ের মনে হলো – ছেলেটি পারবে। আর এ-ধরনের কিশোর-ছেলেরাও যুদ্ধে নামছে বলেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভ অসম্ভব কিছু নয় …।
শহীদকে পছন্দ হয়েছে সান সিংয়ের। তাঁর কেন জানি মনে হলো – ছেলেটি গ্রেনেড ছোড়ায় ওস্তাদ হবে। পরপর সাতদিন সান সিং শহীদকে গ্রেনেড ছোড়া শেখালেন, পরীক্ষা নিলেন, একেবারেই নিখুঁত নিশানা …।
সান সিং শহীদকে রেকি করার ট্রেনিংও দিলেন। ছেলেটির বয়স কম। কেউ সন্দেহ করবে না – শত্রম্নবাহিনীর গোপন খবর ও স্বচ্ছন্দে সংগ্রহ করতে পারবে …।
মাসখানেকের ট্রেনিং শেষ। সান সিং শহীদকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন – ‘বাবা শহীদ, তোর বয়সী আমারো একটি ছেলে আছে। ওর নাম লালু। তোকে ট্রেনিং ক্যাম্পে দেখে আমার লালুর কথা মনে পড়ছে। তোর নাম দিলাম লালু। বেঁচে থাকিস বাবা। বাংলাদেশ স্বাধীন হলে হয়তো তোর সঙ্গে আমার আবার কোনোদিন দেখা হবে …।
ছয়
শহীদ সেই থেকেই লালু। কাদেরিয়া বাহিনীর কমান্ডার ইন চিফ কাদের সিদ্দিকী, কোম্পানি কমান্ডার আবদুল হাকিম,
ক্যাম্প-কমান্ডার হুমায়ুন বাঙ্গাল, আনোয়ার হোসেন পাহাড়ি – সব মুক্তিযোদ্ধাই শহীদকে লালু বলে ডাকে। তুরা থেকে ট্রেনিং নিয়ে কেমারজানি ক্যাম্পেই ফিরে আসে লালু। ওর মূল দায়িত্ব রেকি করা। হাফপ্যান্ট ও ছেড়ামতো একটা স্যান্ডো গেঞ্জি পরে লালু সারাদিন গোপালপুর, ঘাটাইল, ভূঞাপুরের বিভিন্ন স্থানে ঘুরে বেড়ায়। কোন শত্রম্নঘাঁটিতে কজন হানাদার ও রাজাকার আছে, রাতে কোন ঘাঁটিতে কোনদিক থেকে আক্রমণ করলে সহজেই শত্রম্নবাহিনীকে পরাভূত করা যাবে – এসবের নিখুঁত খবর সংগ্রহ করে নিয়ে আসে লালু। তার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে কাদেরিয়া বাহিনীর যোদ্ধারা বিভিন্ন ঘাঁটিতে আক্রমণ করে, সফলও হয়। এসব আক্রমণে লালুও অংশ নেয়। সে মূলত গ্রেনেড ব্যবহার করে। পাকিস্তানি হানাদাররা যতোই মার খায়, নাস্তানাবুদ হয়; লালুর উৎসাহ ততোই বাড়ে …।
৭ অক্টোবর ১৯৭১। গভীর রাত। কাদেরিয়া বাহিনীর যোদ্ধারা বৈরান নদীর পশ্চিম পাড় থেকে অতর্কিতে গোপালপুর থানা আক্রমণ করে। হানাদাররা শুরুতে কিছুটা হকচকিত হয় বটে, তারপরও পালটা আক্রমণ শুরু করে। শুরু হয় দুপক্ষে তুমুল যুদ্ধ। মুক্তিযোদ্ধারা থ্রি-নট-থ্রি বন্দুক, দুই ইঞ্চি রকেট লঞ্চার ব্যবহার করে। লালু ও আরো কয়েকজন গ্রেনেড ছোড়ে। হানাদাররা ব্যবহার করে মেশিনগান। দুই পক্ষের গোলাগুলির শব্দে পরিস্থিতি এমন হয় যে, যেন রাতের আকাশ চৌচির হয়ে ভেঙে পড়বে! হানাদাররা পরিস্থিতি বেগতিক দেখে সাহায্য চেয়ে ময়মনসিংহ ও টাঙ্গাইলে তার করে যোগাযোগ করে। ভোরের দিকে দুই জেলা থেকে দুই কোম্পানি পাকিস্তানি সেনা এসে হানাদারদের সঙ্গে যুক্ত হয়। পরদিন বিকেল পর্যন্ত চলে যুদ্ধ। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধারা শত্রম্নঘাঁটির পতন ঘটাতে ব্যর্থ হয়। পরিস্থিতি ভয়াবহ, নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে, হতাহত ও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বাড়ছে, হানাদারদের পরাস্ত করে থানা দখল করা অসম্ভব, মুক্তিযোদ্ধারা বাধ্য হয়ে পিছু হটে …।
এই যুদ্ধের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন কাদেরিয়া বাহিনীর কোম্পানি কমান্ডার আবদুল হাকিম। হুমায়ুন বাঙ্গাল ও আনোয়ার হোসেন পাহাড়ি তো ছিলেনই। রাত ১২টা থেকে পরদিন বিকেল ৪টা পর্যন্ত একটানা ১৬ ঘণ্টা যুদ্ধ করে গোপালপুর থানার পতন ঘটাতে না-পারায় কমান্ডার হাকিমের মন ভীষণ খারাপ হয়ে যায়। এই ঘটনা তো কাদেরিয়া বাহিনীর জন্য অবমাননাকর, অসম্মানের ব্যাপার। বাহিনীপ্রধান কাদের সিদ্দিকীই বা বিষয়টিকে কীভাবে নেবেন। তিনি তো জানেন – কবে, কখন, কীভাবে গোপালপুর থানা আক্রমণ করা হবে। কমান্ডার হাকিম কেরামজানি ক্যাম্পে বসে নিজের মাথার চুল ছিঁড়েন আর ভাবেন পরবর্তী রণকৌশল …।
– হুমায়ুন …?
– জি, স্যার …।
– লালু কোথায় …?
– ক্যাম্পেই আছে …।
– ওকে ডাকুন …।
কোম্পানি কমান্ডার ডেকে পাঠিয়েছেন, চিতাবাঘের বাচ্চার মতো ছুটে আসে লালু। ‘স্যার, ইয়েস স্যার …।’
– লালু …।
– জি স্যার …।
– তোকে একটা কাজ করতে হবে …।
– জি স্যার …।
– তোকে একটা কাজ করতে হবে …।
– কী কাজ স্যার, বলুন …।
– তোকে একেবারে থানার ভেতরে যেতে হবে। হানাদারদের কাজের ছেলে হয়ে ওখানে থাকবি কদিন। কাছাকাছি কোথাও গ্রেনেড লুকিয়ে রাখবি। তারপর সুযোগ বুঝে ওদের শেষ করে দিবি। পারবি না … ?
– কী যে বলেন, স্যার! অবশ্যই পারব …।
হাফপ্যান্ট আর ছেঁড়া গেঞ্জি পরে লালু থানার কাছাকাছি ঘোরাঘুরি করে। মাথায় নানা এলোমেলো চিন্তা – কীভাবে থানার ভেতরে ঢুকে হানাদারদের সঙ্গে খাতির গড়ে তোলা যায়। একদিন সেই সুযোগ ঘটে গেল। লালু যেই না থানার সামনে গেছে, এক রাজাকার-সেন্ট্রি ওর নাম ধরে ডাক দিলো – ‘এই শহীদ, কই যাস, এদিকে আয় …।’
রাজাকার-সেন্ট্রি আজিজ লালুর পাড়াতো ভাই। লালু বলল – ‘তুমি এখানে …!’
– রাজাকারে ভর্তি হয়েছি। তুই কোথায় থাকিস? তোকে তো অনেকদিন দেখি না …।
– চারদিকে যেরকম গোলাগুলি, ভয়ে নানার বাড়ি
গেছিলাম …।
– এখন, এদিকে কোথায় …?
– একটা কাজের তালাশ করছি। নানাবাড়িতে কাজও নাই, খাওয়াও নাই …।
– আহ্হা রে! তুই কোনো চিন্তা করিস না। চল, তোকে থানার ভেতরে নিয়া যাই। ক্যাপ্টেন স্যার খুব ভালো লোক। তারে চা-নাশতা বানাইয়া খাওয়াবি …।
লালু তখন থানায়ই থাকে। হানাদারদের ফুটফরমাশ করে। চা-নাস্তা তৈরি করে খাওয়ায়। ক্যাপ্টেন বাসেতের হাত-পা টিপে দেয়। ওর মনে যে কী আছে তা তো আর হানাদাররা জানে না। ওরা লালুকে খুব বিশ্বাস করে। একদিন গোপনে কেরামজানি ক্যাম্পে যায় লালু। তিনটি তাজা গ্রেনেড নিয়ে আসে। থানার পেছনে জঙ্গলের মধ্যে লুকিয়ে রাখে গ্রেনেডগুলো। তারপর অপেক্ষা করে, কবে, কখন সুযোগ আসে …।
থানায় তিনটি বাংকার। বাংকারগুলোর একটিতে তিনজন, একটিতে চারজন, অন্যটিতে পাঁচজন হানাদার সব সময় ভারী অস্ত্রসহ পজিশন নিয়ে থাকে। বাকি হানাদাররা রাজাকারদের সঙ্গে নিয়ে গ্রামে গ্রামে অপারেশনে বের হয় …।
২৫ নভেম্বর ১৯৭১। সাঁঝবেলা ঘনিয়ে আসছে। তিন বাংকারে বারো হানাদার পজিশন নিয়ে সতর্ক অবস্থায় বসে আছে। যারা অপারেশনে বেরিয়েছে, তারা তখনো ফেরেনি। লালু মনে মনে সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করে ফেলল – আজই, এখনই অপারেশন চালাতে হবে …।
জঙ্গলের ভেতর লুকিয়ে রাখা গ্রেনেড আনতে গিয়ে লালুর চক্ষু চড়কগাছ! সর্বনাশ! গ্রেনেডগুলোর ওপর কু-লী পাকিয়ে শুয়ে আছে মস্তবড় এক দাঁড়াশ সাপ। এখন উপায়? অপারেশনে যাওয়া হানাদাররা ফিরে এলে আজ আর অপারেশন চালানো যাবে না। কোম্পানি কমান্ডারের নির্দেশ – দ্রম্নত কাজ সারতে হবে। যুদ্ধের কৌশলগত কারণে গোপালপুর থানার পতন ঘটানো খুব জরুরি …।
লালু সাহস করে সাপটির মাথায় আলতো করে হাত রাখল। সাপটি বোধহয় ঘুমিয়ে ছিল। লালুর হাতের স্পর্শে চোখ মেলে তাকাল। তারপর বলল – ‘কী হে বাচ্চা লোক, তুমি কি কিছু বলতে চাও …?’
– গ্রেনেডগুলো নিতে হবে ভাই, এখনই অপারেশন চালাতে হবে …।
– জানি তো, এগুলো তোমার গ্রেনেড। তাই পাহারা দিচ্ছিলাম, যেন কোনো শত্রম্নর হাতে না-পড়ে …।
সাপটি আসেত্ম আসেত্ম গভীর জঙ্গলের দিকে চলে গেল। লালু দেরি না-করে দ্রম্নত সেফটিপিন খুলে তিনটি গ্রেনেড পরপর তিনটি বাংকারে ছুড়ে মারল। প্রচ- শব্দে বিস্ফোরিত হলো লালুর ছোড়া গ্রেনেড। বাংকার তিনটি ছোটখাটো পুকুরের মতো হয়ে গেল …।
গ্রেনেড ছোড়ার পর কিছুক্ষণ অপেক্ষা করল লালু। না, কোনো প্রতিরোধ নেই। এমনকি চিৎকার-চেঁচামেচিও নেই। তার মানে – বারোজনেরই ভবলীলা সাঙ্গ হয়েছে। লালু বাংকারের কাছে গেল। তার ধারণাই ঠিক। একটা হানাদারও বেঁচে নেই। চারদিকে ছড়িয়ে আছে দলা দলা মাংসপি- …।
লালু ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়াচ্ছে। না, দৌড়াচ্ছে বলাটা ঠিক হয় না। লালু যেন পঙ্খিরাজ ঘোড়ায় চেপে বসেছে। ঘোড়া ছুটছে বিদ্যুৎগতিতে। তারপরও লালুর তর সইছে না। কেরামজানি ক্যাম্প কতদূর? ক-সেকেন্ড লাগবে ক্যাম্পে যেতে? লালু কখন কমান্ডার আবদুল হাকিমকে বলতে পারবে – ‘স্যার, আমি পেরেছি। সবকটা হানাদার খতম …।’