অস্তিত্ব

অস্তিত্ব
রাত ৯টায় কলিংবেলের আওয়াজ শুনে দরজা খুললো মেহরাব। দরজা খুলতেই দেখলো মিহি দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। মেহরাবকে দেখামাত্র মিহি এসে মেহরাবকে জড়িয়ে ধরে বললো- “মেহরাব আমি প্রেগন্যান্ট”। কথাটা শুনে প্রচন্ড অবাক হলো মেহরাব। বললো-
–কি বললে বুঝিনি। আবার বলো”। মিহি এবার একটু চিৎকার করে বললো-
–মেহরাব আমি প্রেগন্যান্ট। বুঝতে পারছো আমি কি বলছি? আমি প্রেগন্যান্ট”।
–মানে কি মিহি? তুমি এতো রাতে আমার বাসায় এসে চিৎকার করে কথা বলছো কেনো? আর এরকম আজগুবি কথাই বা বলছো কেনো? তুমি প্রেগন্যান্ট হলেও এখানে চিৎকার করার কি আছে”?
–এখানে চিৎকার করার কিছু নেই? আমাদের এখনো বিয়ে হয়নি মেহরাব। তোমার কাছে বিষয়টা সহজ মনে হচ্ছে”?
–হ্যা, বিষয়টা একদম সহজ৷ আমরা আগামীকাল ডাক্তারের কাছে গিয়ে আবার টেস্ট করাবো।
তুমি প্রেগন্যান্ট হলে আমরা বাচ্ছাটা নষ্ট করে দিবো। ব্যাস এখানে এতো টেনশনের কি আছে”? কথাটা শুনে অবাক দৃষ্টিতে মেহরাবের দিকে তাকিয়ে রইলো মিহি। কেমন যেনো পিছনের সব কথা মনে পড়ছে তার। তাদের প্রেমের শুরু থেকে কতো সুন্দর সময় একসাথে কেটেছে। ওই রাতের একটা ভুল ছাড়া সব ঠিক ছিলো। কিন্তু আজকে অন্য একটা মেহরাবকে দেখতে পাচ্ছে সে। ঘোর কাটিয়ে মিহি বললো-
–মেহরাব আমি এই বাচ্ছাটাকে দুনিয়ার আলো দেখাতে চাই৷ তুমি প্লিজ বাচ্চাটাকে নষ্ট করতে বলিওনা। তারচাইতে চলো আমরা এখন ই বিয়ে করে ফেলি”। মিহির কথা শুনে একটু রেগে গেলো মেহরাব। বললো-
–আমি এখন কিভাবে বিয়ে করবো বলো? নতুন চাকরি। এখনো কিছুই গুছানো হয়নি। ক্যারিয়ারটা গুছিয়ে নিতে আমার সময় দরকার। তুমি প্লিজ পাগলামি না করে আগামীকাল আমার সাথে হসপিটালে চলো, আমরা বাচ্ছাটা নষ্ট করে ফেলবো”। মেহরাবের কথা শুনে মিহির চোখ থেকে টুপ করে একফোটা পানি পড়লো। মেহরাবের কাছ থেকে সে কখনোই এমন কথা আশা করেনি। হাত দিয়ে চোখের পানি মুছতে মুছতে মিহি বললো-
–আমাদের ভুলের জন্য আমি কখনোই একটা নিষ্পাপ প্রাণ নিতে পারবোনা মেহরাব। ভুল যখন আমি করেছি, তখন এর দাম ও আমি দিবো। আমি বুঝিনি তুমিও অন্য ছেলেদের মতো এমনটা করবে। অবশ্য ভুলটা আমার’ই ছিলো। তুমি ভাবিওনা আমি এখন তোমার পায়ে-হাতে ধরে বলবো ‘আমাকে বিয়ে করো’। আমার যা করার আমি করবো। তুমি আমাকে বিয়ে করার হলে প্রথমবারেই রাজি হয়ে যেতে। কিন্তু আমি বুঝে গেছি তুমি শুধুমাত্র আমার শরীর নিয়ে মজা নিছো। আমাকে কখনোই ভালোবাসোনি।
একটা কথা বলে যাচ্ছি তোমায় “একটা নিষ্পাপ জীবনকে হত্যা করে আমি কখনোই আমার এই জীবন নিয়ে বেঁচে থাকতে পারবোনা। আমি জানিনা আব্বুকে আমার পাপের কথা কিভাবে বলবো। কিন্তু আমি তোমাকে কখনোই ক্ষমা করবোনা। আমি যাচ্ছি”। মেহরাব পিছন থেকে ডাকতে থাকলো “মিহি শুনোওওও, মিহিইইই”। মেহরাবের ডাক না শুনেই বাসা থেকে কান্না করতে করতে বেরিয়ে গেলো মিহি। রাত ১০টা। মিহির কথাগুলো এখনো কানে বাজছে মেহরাবের। কিচ্ছু ভাললাগছেনা। এখন তার ঠিক কি করা উচিত এটাও বুঝতে পারছেনা। মিহির নাম্বারে বারবার কল দিচ্ছে। নাম্বার সুইচ অফ। মেহরাব একবার ঠিক করলো মিহির বাসায় যাবে। কিন্তু পরক্ষণেই ভাবলো এতো রাতে মিহির বাসায় যাওয়া কি ঠিক হবে? ওর আব্বু আবার কি’না কি ভাববে। নাহ, মনে একদম শান্তি পাওয়া যাচ্ছেনা।
ফ্রিজ থেকে পানি বের করে একটু পানি খেলো মেহরাব৷ ঘড়িতে তখনো রাত ১০টা ১৫মিনিট। আজকের রাতটা যে কিভাবে কাটবে মেহরাব ঠিক বুঝতে পারছেনা”। রাত ১১টা। ড্রয়িংরুমে বসে টিভি দেখছে মেহরাব। ভাবছে টিভি দেখলে হয়তো মুডটা একটু ভালো হবে। রিমোট দিয়ে একের পর এক চ্যানেল পাল্টাচ্ছে। দেখার মতো কিছুই নেই। প্রচন্ড রাগ লাগছে এসব চ্যানেলের প্রতি। রাগ করে টিভিটা অফ করে নিজের রুমে চলে যায় মেহরাব। রাত ১২টা। মেহরাব চোখ বন্ধ করে একটু আগে ঘটে যাওয়া ঘটনার কথা ভাবছে। মিহির কান্না যেনো এখনো কানের মধ্যে বাজছে। মেহরাব প্রচন্ড ভালোবাসে এই মেয়েটাকে। অথচ আজকে মিহি বললো-“আমি অন্য ছেলেদের মতো? দেড় বছর যাবথ তার সাথে রিলেশন করার পরেও চিনলোনা তাকে”?
নিজের প্রতি প্রচন্ড রাগ হচ্ছে মেহরাবের। মনে মনে ভাবছে “মেয়েটাকে কি প্রয়োজন ছিলো বাচ্ছা নষ্ট করার কথা বলার? ক্যারিয়ার তো বিয়ের পরেও ঠিক করতে পারতাম। ওইরাতে তো ভুলটা আমিই করেছি। মিহির কি দোষ? আমি চাইলেই তো মিহিকে বিয়ে করে নিতে পারি। আমার তো এই দুনিয়ায় মিহি ছাড়া কেউ নেই। তাহলে কেনো মেয়েটাকে এতো কষ্ট দিলাম”? নিজেকে কেমন জানি অপরাধী ভাবতে শুরু করে মেহরাব। মিহির নাম্বারে আবারো কল দেয়। এখনো নাম্বার সুইচ অফ। উফফফফ। আজকে রাতে আর ঘুমাতে পারবেনা সে। মিহির কথা ভাবতে ভাবতে কেমন যেনো ঘোরের মধ্যে চলে যায় মেহরাব। আর ঠিক তখন ই কলিংবেলের আওয়াজ। দরজা খুলেই প্রচন্ড শকড খায় মেহরাব। মিহি দাঁড়িয়ে আছে দরজার সামনে। মেহরাব কিছু না বলেই মিহিকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। ঠিক কতোক্ষণ মিহিকে জড়িয়ে ধরেছিলো সে জানেনা। নীরবতা ভেঙে মিহি বললো-
–দরজার বাইরে না থেকে ভিতরে যাই আমরা”?
–ওহ সরি। ভিতরে আসো”। মিহিকে রুমে ঢুকিয়ে দরজা লাগিয়ে দিলো মেহরাব। মিহিকে জিজ্ঞাস করলো-
–তুমি এতো রাতে কিভাবে আসছো? আংকেল কোথায়”? মিহি অদ্ভুত একটা হাসি দিয়ে বললো-
–আমি এখন যেকোনো সময় যেকোনো জায়গায় যেতে পারবো। হা হা হা”। মিহির হাসি দেখে মেহরাব বড়বড় চোখে তাকিয়ে রইলো। এরকম অদ্ভুত হাসি হাসতে মিহিকে আগে কখনো দেখেনি। মেহরাব বললো-
–যেকেনো সময় যেকোনো জায়গায় যেতে পারবে মানে? আংকেল কোথায়”?
–আরে মজা করছি মেহরাব। তোমার কথা খুব মনে পড়ছিলো। আব্বু ঘুমের মেডিসিন নিছে, তাই সাহস করে চলে এসেছি। সকালের আগে আব্বুর ঘুম ভাংবেনা। আচ্ছা তুমি কি আমার সাথে এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সব কথা বলবে? রুমে নিয়ে যাবেনা”?
–ও তাইতো। রুমে আসো। আমার ও অনেক কথা বলার আছে তোমাকে”। মিহিকে নিয়ে মেহরাব নিজের রুমে চলে যায়”। রাত ১টা। মেহরাব আর মিহি দুজন দু’জনকে জড়িয়ে ধরে বিছানায় শুয়ে আছে। দু’জনের চোখ বন্ধ। মনে হচ্ছে জীবনের সবচাইতে সুন্দর সময় পার করছে তারা। কয়েক ঘন্টা আগেও তাদের মধ্যে কিছু একটা নিয়ে ঝগড়া হয়েছিলো সেটা তাদের মাথায় নেই। মাথার উপর ঘুরতে থাকা ফ্যানের আওয়াজ ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই রুমে। আবারো নীরবতা ভাঙলো মিহি। চোখ বন্ধ রেখেই মিহি বললো-
–তোমার সব ইচ্ছা পূরন হয়েছে মেহরাব”? মেহরাব মিহির কথা বুঝতে পারলোনা। বললো-
–সব ইচ্ছা বলতে? বুঝিনি”। –আমার শরীরের জন্যই তো তুমি আমার সাথে প্রেমের অভিনয় করেছিলে তাইনা? এখনতো আমার শরীর তুমি পেয়ে গেছো। দেখো আমি তোমার কতোটা কাছে আছি”। কথাটা শুনামাত্র নিজের শরীরটা মিহি’র থেকে ছাড়িয়ে নিলো মেহরাব। শুয়া থেকে বিছানায় উঠে বসলো। মিহির দিকে তাকিয়ে রাগ করে বললো-
–দেড়টা বছর আমার সাথে থেকেও আমাকে চিনতে পারলেনা মিহি? ছিঃ। আমি কেমন তুমি জানোনা”? মিহি আবারো অদ্ভুত একটা হাসি দিয়ে বললো-
—হা হা হা হা। আচ্ছা তুমি রাগিওনা। দাড়াও, তোমার রাগ কমানোর জন্য এক কাপ চা করে নিয়ে আসি। এই মধ্যরাতে রাতে দুজন মিলে খুব মজা করে চা খাওয়া যাবে”। বিছানা থেকে উঠে রান্নাঘরের দিকে গেলো মিহি। মেহরাব বিছানায় বসে বসে মিহির হাসির কথা ভাবছে। মিহির হাসির আওয়াজ এখনো তার কানে বাজছে। মিহির হাসি আগেও বহুবার শুনেছে সে। কিন্তু এরকম অদ্ভুত হাসি আগে কখনো শুনেনি। মিহি এরকম ভয়ংকর আর অদ্ভুত হাসি দেওয়া কবে থেকে শুরু করলো”? মোবাইলের রিংটা বেজে উঠলো মেহরাবের। মেহরাব পাশ থেকে মোবাইলটা হাতে নিয়ে দেখলো আননোন নাম্বার। এতো রাতে আবার কে কল দিলো? রিসিভ করলো মেহরাব।
–হ্যালো মেহরাব বলছেন”?
–জ্বী মেহরাব বলছি। কে বলছেন আপনি”?
–আমি মিহির বাসা থেকে পুলিশ অফিসার রাহাদ বলছিলাম”।
পুলিশের নাম শুনে মেহরাব হাই ভোল্টেজের শকড খেলো। মিহির বাসায় পুলিশ? এতো রাতে? তাও আবার আমাকে কল দিচ্ছে? শকড কাটিয়ে মেহরাব বললো-
–আপনি ওদের বাসায় এতো রাতে কি করছেন? আমাকেই বা কেনো কল দিলেন”?
–মেহরাব সাহেব, আমরা আপনার নাম্বারটা মিহির মোবাইল থেকে পেয়েছি।
মিহি কিছুক্ষণ আগেই সুইসাইড করেছে। মিহির মোবাইলে লাস্ট ডায়েল করা নাম্বারটা আপনার ছিলো। সুসাইডের আগেও আপনি মিহির সাথে অনেকবার কথা বলেছেন। আপনি প্লিজ কাইন্ডলি আমাদের সাথে দেখা করুন”। পুলিশ অফিসারের কথাগুলো শুনে মেহরাবের বুকটা ধুক ধুক করতে থাকে। হাত পা গুলো কাঁপতে শুরু করে। মোবাইলটা কানে ধরে রাখার মতো শক্তি হারিয়ে ফেলেছে সে। কাঁপা কাঁপা কন্ঠে মেহরাব বললো-
–আপনি মজা কেনো করছেন আমার সাথে? মিহি তো আমার সাথে আছে এখন”। পুলিশ অফিসার রাহাদ হেসে বললেন-
-মেহরাব সাহেব, পুলিশের সাথে মজা নিচ্ছেন এতো রাতে? মিহির লাশ আমার সামনে। ঘুমের ঘোরে কথা বলছেন আপনি”?
কথাটা শুনামাত্র মেহরাবের হাত থেকে মোবাইলটা পড়ে গেলো। ঠোঁটগুলো কাঁপতে শুরু করেছে। গলা শুকিয়ে গেছে। কন্ঠস্বর থেমে গেছে। মিহিকে ডাক দেওয়ার শক্তি পাচ্ছেনা। প্রচন্ড ভীত চেহারায় রান্নাঘরের দিকে তাকালো মেহরাব। মিহি সুইসাইড করছে? মিহি মারা গেছে? তাহলে আমার সাথে এতোক্ষণ বিছানায় শুয়ে ছিলো কে? রান্নাঘরে চা বানাতে গেলো কে? কে ছিলো এই মেয়ে”?? বিছানা থেকে নেমে রান্নাঘরের দিকে গেলো মেহরাব। দেখলো মেয়েটা ওপাশ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মেহরাব পিছন থেকে কাঁপা কাঁপা কন্ঠে ডাক দিলো-
–মিহি। মিহিই”। মেয়েটা কোনো জবাব দিচ্ছেনা। মেহরাব আবার বললো-
–মিহি আমার ভয় লাগছে অনেক। প্লিজ মজা করিওনা”। মেয়েটা আবারো নিশ্চুপ। কোনো উত্তর নেই। মেহরাব এবার ছোট ছোট পা দিয়ে মিহির কাছে যাচ্ছে। প্রচন্ড ভয় লাগছে তার। মাথায় এখনো পুলিশের কথাগুলো ঘুরছে। মিহি মারা গেলে এই মেয়েটা কে? যে এখন আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে।
মেহরাব আস্তে আস্তে পা দিয়ে একদম কাছে গেলো মেয়েটার। এখনো মেয়েটা ওপাশ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। একটা চুল ও নড়ছেনা। মেহরাব প্রচন্ড ভীত কন্ঠে আবার ডাক দিলো- “মিহিইই”। আবারো কোনো উত্তর নেই। মেহরাব আস্তে আস্তে তার হাতটা মিহির কাঁধে রাখা মাত্রই মেয়েটা মেহরাবের দিকে ভয়ানক ভাবে তাকালো। মিহির চেহারা দেখা মাত্র প্রচন্ড জোরে চিৎকার করে উঠলো মেহরাব। কয়েক পা পিছনে গিয়ে মাটিতে পড়ে গেলো সে। মিহির চোখগুলো প্রচন্ড লাল হয়ে আছে। মুখটা আগুনে পুড়ে যাওয়া চেহারার মতো হয়ে গেছে। এই দৃশ্যটা দেখার পর জ্ঞান হারিয়ে ফেললো মেহরাব। তারপর মেহরাবের আর কিছুই মনে নেই। মেহরাবের জ্ঞান যখন ফিরে তখন সকাল ১১টা। মেহরাব চোখ খুলে দেখলো সে তার নিজের বিছানায় শুয়ে আছে। ডান দিকে তাকিয়ে দেখলো তার বেস্টফ্রেন্ড আবির দাঁড়িয়ে।
মাথাটা বাম দিকে ঘুরাতেই মেহরাব আবারো চিৎকার করে উঠলো। সে দেখলো মিহি দাঁড়িয়ে আছে। মেহরাব বালিশটা শক্ত করে ধরে চিৎকার করতে থাকলো। মেহরাবের চিৎকার দেখে আবির তাড়াতাড়ি এসে মেহরাবকে জড়িয়ে ধরে বললো- “দোস্ত আমি আছি। এই দেখ আমি আছি তোর সাথে। চিৎকার করিস না প্লিজ”। মেহরাব হাত দিয়ে মিহির দিকে ইশারা করে ভয়ে ভয়ে বললো- “মিহি মারা গেছে”। আবির মিহির দিকে তাকালো। দেখলো মিহি হু হু কান্না করছে মেহরাবের এই অবস্থা দেখে। চোখ থেকে অবিরাম পানি পড়ছে মেয়েটার। ঠিক এই মুহুর্তে আবির কাকে কি বলবে বুঝতে পারছেনা। আবির এখনো মেহরাবকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আছে। মেহরাব কিছুটা শান্ত হয়েছে। মিহি পাশেই চুপ করে দাঁড়িয়ে চোখের পানি ফেলে যাচ্ছে। মেহরাবের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে আবির বললো-
–দোস্ত এতো ভয় পাচ্ছিস কেনো? দেখ আমি তোর সাথে আছি। আমাকে বল কি হয়েছে”। মেহরাব কাঁপা কাঁপা কন্ঠে সব বললো আবিরকে। ভয়ে মিহির দিকে একবারো তাকাচ্ছেনা মেহরাব। সব কথা শুনার পর আবির একবার মিহির দিকে তাকালো। মেয়েটা এখনো কান্না করে যাচ্ছে অবিরাম। চোখের পানি মুছে আস্তে আস্তে মেহরাবের কাছে এসে বসলো মিহি। মেহরাবের হাতটা ধরে বললো-
–মেহরাব একবার তাকাও আমার দিকে। দেখো আমি তোমার মিহি। আমি মারা যাইনি। দেখো আমাকে”। মেহরাব আবিরের বুকে মুখ লুকিয়ে আছে। তাকানোর সাহস নেই তার। মেহরাবের মোবাইলটা হাতে নিয়ে কল লিস্ট বের করলো মিহি৷ বললো-
–দেখো কাল রাতে কেউ তোমায় কল দেয়নি৷ কোনো পুলিশ আমাদের বাসায় যায়নি। সব তোমার মনের ভুল। দেখো প্লিজ। একবার তাকাও”। মেহরাব আবারো তাকালোনা। মেহরাবের চেহারায় মিহি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে মেহরাব কতোটা ভয় পাচ্ছে তাকে। মেহরাবের এই অবস্থা দেখে এবার একটু জোরে হু হু করে কান্না করে উঠলো মিহি। নিজেকে প্রচন্ড অপরাধী মনে হচ্ছে। হয়তো রাগ করে গতকাল নাম্বারটা সুইচ অফ না করলে আজকে এসব দেখতে হতোনা। রুম থেকে বের হয়ে ফ্লোরে বসে কান্না করছে মিহি। মেহরাবের অতীত সম্পর্কে আবির সব বলছিলো মিহিকে। দশ বছর আগেও মেহরাবের লাইফে সব ছিলো। বাবা, মা, ফ্যামিলি, সব। একমাত্র ছেলে হওয়ার কারণে মেহরাবের মা প্রচন্ড ভালোবাসতেন মেহরাবকে।
নিজ হাতে খাইয়ে দিতেন, পড়া দেখিয়ে দিতেন, সবসময় মেহরাবের অনেক যত্ন করতেন। কিন্তু রাত হলেই মেহরাব শুনতে পেতো তার বাবা মা ঝগড়া করছে। প্রতিটা’দিন অনেক ঝগড়া। মেহরাব নিজ চোখে দেখতো বাবা তার আম্মুর গায়ে হাত তুলছে। তার আম্মুকে মারছে। যখন মেহরাব সকাল হলে তার আম্মুকে জড়িয়ে ধরে জিজ্ঞাস করতো- “আম্মু তোমরা প্রতিদিন কেনো ঝগড়া করো? আব্বু মারে কেনো তোমাকে”? মেহরাবের আম্মু কোনো উত্তর দিতেন না। স্রেফ মেহরাবকে জড়িয়ে ধরে কান্না করতেন। কান্না করতে করতে বলতেন- “বাবা আমি কখন কি করে বসি জানিনা। আমার এই কষ্ট আর সহ্য হচ্ছেনা। আম্মু যদি কখনো তোমার কাছে না থাকি, তাহলে তুমি ঠিকঠাক মতো চলিও। নিজের খেয়াল নিজে রাখিও”। এসব কথার মানে কি মেহরাব তখনো বুঝতে পারতোনা”। একদিন মেহরাবের বাবা রাগারাগি করে বাসা থেকে বের হয়ে যান। সেই যে বাবা চলে গেছেন, আর কখনো মেহরাব তার বাবাকে দেখেনি।
প্রায় ১মাস পর মেহরাবের মায়ের কাছে একটা চিঠি আসলো। মেহরাব তখন টেবিলে বসে অংক নিয়ে ব্যাস্ত। মেহরাব দেখলো তার আম্মু চিঠিটা পড়ে অনেক বেশি কান্না করছেন। কান্না করতে করতে রুমের ভিতরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলেন। ওইদিনের পর মেহরাব তার আম্মুকে আর কখনো কান্না করতে বা হাটতে দেখেনি। সবাই এসে যখন রুমের দরজা ভাঙলো, মেহরাব দেখতে পেলো তার মায়ের শরীরটা একটা ফ্যানের সাথে ঝুলানো আছে। সেই ছোট থেকেই আবিরের মা মেহরাবকে দেখাশুনা করছিলেন। কিন্তু মাঝে মাঝে তিনি দেখতেন মেহরাব পড়ার টেবিলে বসে একটা খালি চেয়ারের সাথে হেসে হেসে কথা বলছে। তিনি যখন মেহরাবকে বলতেন- “কার সাথে কথা বলছো বাবা”? মেহরাব হেসে উত্তর দিতো- “কেনো আমার আম্মুকে আপনি দেখতে পাচ্ছেন না”?
মেহরাব সারাদিন এমন করা শুরু করলো। একলা একলা কথা বলতো, হাসতো। কিন্তু একটা পর্যায়ে আবিরের আম্মু দেখতে পেলেন মেহরাব একলা থাকা অবস্থায় নিজের ক্ষতি করার চেষ্টা করছে। হাতের কাছে যা পাচ্ছে সেটা দিয়ে নিজেকে আঘাত করার চেষ্টা করছে। নিজের হাত কাটার চেষ্টা করছে। এসব দেখে আবিরের আম্মু মেহরাবকে একটা হসপিটালে ভর্তি করিয়ে আসেন। অনেক ট্রিটমেন্টের পর মেহরাব ঠিক হয়। ঠিক এই মুহুর্তে ডা: শামিমের সামনে বসে আছে আবির আর মিহি। ডা: শামিমের কথাতেই আবির আর মিহি ২য় বারের মতো মেহরাবকে হসপিটালে ভর্তি করালো। ডা: শামিম যিনি কয়েক বছর আগেও মেহরাবের ট্রিটমেন্ট করেছিলেন। মিহি ডাক্তারকে জিজ্ঞাস করলো-
–এতো বছর পর আবার মেহরাবের এই অবস্থা কেনো”? ডা: শামিম বললেন-
–আমি ভেবেছিলাম হয়তো ছেলেটা সুস্থ হয়ে গেছে।
কিন্তু এখনো তার মনের ভিতর কিছুটা আঘাত থেকে গেছে। মেহরাবের অবস্থা আর তোমাদের মুখ থেকে সব শুনে যেটা বুঝলাম, মেহরাব তোমাকে অনেক ভালোবাসে মিহি। ওইদিন রাতে তুমি যখন মেহরাবকে ছেড়ে চলে গেলে, মেহরাব ভাবছিলো সে তোমাকে হারিয়ে ফেলেছে। ওর ভিতরে প্রিয়জন হারানোর একটা প্রচন্ড ব্যাথা কাজ করছিলো। যে বাথ্যাটা সে আগেও একবার পেয়েছে। আর সেখান থেকেই তোমাকে নিয়ে ওর সাইকোসিস বা বাংলায় আমরা যাকে বলি মনোব্যাধী রোগটা এট্যাক করে। যেমনটা হয়েছিলো ওর মা’কে হারানোর পর”। ডাক্তারের কথা শুনে মিহি কপালে হাত দিয়ে কান্না করা শুরু করলো । ডাক্তারকে জিজ্ঞাস করলো-
–মেহরাবের ঠিক হতে কতোদিন লাগবে”?
ডাক্তার শামিম কোনো সময় বললেন না। শুধু এটা বললেন –খুব তাড়াতাড়ি আমরা মেহরাবকে ঠিক করে তুলতে পারবো। কিন্তু তোমার অনেক হেল্প লাগবে আমাদের। আমি যা যা বলবো তোমাকে তাই তাই করতে হবে। ইনশাআল্লাহ মেহরাব তাড়াতাড়ি ঠিক হয়ে যাবে”। ডাক্তার শামিমের কথা শুনে নিজের ভিতর প্রচন্ড অপরাধ’বোধ হচ্ছে মিহির। চোখ থেকে অবিরাম পানি পড়ছে তার। ডাক্তারের রুম থেকে বেরিয়ে সে মেহরাবের কেভিনে গেলো। দেখলো ঘুমের ইনজেকশন দেওয়ার কারণে মেহরাব ঘুমাচ্ছে।
মেহরাবের চেহারার দিকে তাকিয়ে কিছু সময় দাঁড়িয়ে থাকলো সে। মিহির চোখ থেকে অবিরাম পানি পড়েই যাচ্ছে।
মেহরাব তাকে ভালোবাসতো এটা মিহি জানতো, কিন্তু এতোটা ভালোবাসতো সেটা সে কখনোই ভাবেনি। আস্তে আস্তে পা দিয়ে মেহরাবের কাছে গেলো মিহি। মেহরাবের পাশে বসলো। মেহরাবের হাতটা নিজের গালের সাথে লাগিয়ে আরো কিছুটা সময় কান্না করলো। মিহি জানেনা তার এই কান্না কবে শেষ হবে। কিন্তু সে এটা জানে “এই মানুষটাকে সে আর কখনোই কষ্ট দিবেনা। আর কখনোই এই হাতের মুঠোয় থাকা হাতটা ছাড়বেনা। কখনোই না।
গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত