পুরো বাড়িতে আমি একা।
অনেক রাত। সোডিয়াম আলোতে রাস্তাটা ঝলসাচ্ছিল এই কিছুক্ষণ আগেও। এখন দেখলাম কেমন স্তিমিত হয়ে এসেছে। কেন তা জানিনে। মাত্র কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে আলোর বেশ-কম হয় নাকি? নাকি আমার চোখেরই কোনো ভুল!
হতেও পারে। অথবা ঝড় হচ্ছে। হচ্ছেই তো! বাইরে শন শন আওয়াজ পেলাম। বিড়ালটা কার্পেটের আরাম থেকে উঠে ছটফট করে দরোজার সামনে নাক ঘষল পর্দায়। মিঠে একটা আরাম ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে ঘরে। আমি বসে আছি পড়ার টেবিলে। টেবিল ল্যাম্পের আলোয় ঝিম ধরে আছে ঘরবাড়ি। সামনে জানালার ওই পাড়ে পান্থপথের টানা রাস্তা সুনসান। একটি দুটি টহল পুলিশ হেঁটে যায় মন্থর পায়ে। কমে আসা সোডিয়াম বাল্ক্বের আলো মধ্যরাতে উঠে আসা ঝড়ের বাতাসে বিপন্ন চোখে তাকায় বার কয়। তারপর আরও ঘন আর বিষণ্ণ হয়ে নেমে আসে মাটির দিকে। রাস্তার চিকচিকে পিচ এখন আর দেখা যাচ্ছে না তেমন। আমি পড়ার টেবিল থেকে উঠে এসে বারান্দায় বসি। দু’পা তুলে দিই গ্রিল বরাবর। একখানা সিগারেট ধরিয়ে চেয়ে থাকি ওই রাস্তা বরাবর। ওই যে একজন পুলিশ যাচ্ছে, আধা ঘুমন্ত; হ্যাঁ পুলিশই হবে, আধো অন্ধকারে তার ক্ষয়াটে সবুজ ইউনিফর্ম সামান্য চোখে পড়ে। লোকটি ক্লান্ত, ঘুমন্তপ্রায়। হেঁটে যাচ্ছে, আবার ফিরে আসছে। তার সঙ্গীরাও আছে আশেপাশে। হয়তো কোনো বড় সড় অ্যাপার্টমেন্টের সামনের রোয়াকে বসেছে। আয়েশ করে ধরিয়েছে বিড়ি; ধোঁয়া টানছে। এত রাতে হয়তো আর চা-টা পায়নি কোথাও। লোকগুলো দুঃখী ও অভাবগ্রস্ত। হয়তো ক্ষুধার্ত। রাত জাগলে সবারই তো ক্ষুধা পায়।
আমি বিড়ির আগুন পুড়িয়ে পুড়িয়ে রাতের ক্ষয়ে যাওয়া দেখি। রাত যত ক্ষয়ে পড়তে থাকে, যতই স্তিমিত হয় নাগরিক সোডিয়ামের আলো, ততই প্রকাণ্ড আঁধার দশ দিক দিয়ে ঘিরে ফেলতে থাকে আমাকে। তিনতলা বাড়ির এই ঝুল বারান্দা, রেলিং বেয়ে নেমে যাওয়া এই মালতীলতার ঝাড়, ওই চায়ের গেলাস যা আমি সন্ধ্যেবেলায় খেয়ে ফেলে রেখে গেছি মেঝের কিনারে, টবের মানিপ্লান্ট, টাইলসের মেঝে, ক্রিমরঙের দেয়াল, পেছনে আমার পড়ার ঘর, বই, লেখার টেবিল, আমার একাকী অবসন্ন জীবনযাপন, ফ্রিজে রাখা বাসি ভাত…!
ভাতের কথা মনে পড়তেই ফের খিদে পায়। রাস্তায় পুলিশের দিকে তাকাই। সে এখন একা নেই। আরও দু’জন এসে জুটেছে। তারা গল্প করছে, নিচুস্বরে। তবু অন্ধকারের ঝিম ধরা নীরবতার ভেতরে সেইসব টুকরো শব্দও ছোট ছোট কাচের গেলাসের মতো আছড়ে পড়ছে এদিক-ওদিকে। লোকগুলো হাসছে। আবার গুনগুন করে কী সব বলছে! হয়তো সংসারের কথা, হয়তো বাড়তি রোজগার, বড় সাহেবের দু’নম্ব্বরি, ক্রমাগত মানসিক চাপ, শরীরের ব্যথা-বেদনা, গোপন অসুখ, জ্বর-তাপ, বউয়ের জরায়ুর ইনফেকশন, বাচ্চার গলাব্যথা, পরিবার পরিকল্পনা, পাশের পাড়ার মাগি, তার স্তনের মাপ ও যোনির গভীরতা, কাঁচাবাজারের দামদর, পেঁয়াজ-রসুন, নতুন ওঠা শজনে ডাঁটা, সরিষা, লাল চাল, মোটা চালের বর্তমান দর! এ সবই তারা বলে চলেছে, নিরন্তর; একটানা। মাঝে মাঝে গলা খাকারি দিচ্ছে কেউ একজন বা দুইজন অথবা তিনজনই। হয়তো তারা তিনজনই ক্ষয়কাশের রোগী। হয়তো তিনজনই কোনো এক ভিটামিন কি খনিজের শূন্যতায় ভুগছে। হয়তো কেউ একজন নপুংসক। কেউ সন্তানহীন। কী একঘেয়ে, বিরামহীন, চক্রাকার এই বয়ে যাওয়া অন্ধকার রাত্রির ভেতরে!
আমি ওদের ক্রমশ নিভে আসা সোডিয়াম বাতির আলোর ভেতরে রেখে চলে এলাম ঘরে। একটা কিছু খাওয়া চাই। অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়ে ফ্রিজের ঘরে আসি। তবু ইচ্ছে করে না, আলো জ্বালি। বেড়ালটা পিছু পিছু আসে। ওরও খিদে পেল নাকি!
ফ্রিজ খুলতেই এক ঝলক আলোয় ভরে যায় ডাইনিং রুম। আমি গলা ঢুকিয়ে দিই। নিজের বাড়িতে আমজনতার মতো আচরণ করি। একেবারে হাভাতের মতো টেনে টেনে নামাই ভাত, ডাল, লইট্যা শুঁটকি, মুরগির মাংস ভুনা। ফ্রিজটা বন্ধ করতেই ফের আঁধার নামে। বেড়ালটা ম্যাঁও করে ওঠে। হয়তো ওর ভালো লাগছে না এই ব্যাপারটা যে, এই আমিও ওর মতো অন্ধকারে দেখতে পাই!
প্লেটে ভাত, ডাল, মুরগির রান, একটু শুঁটকির ভুনা সাজাই। মাইক্রোওভেনে গরমে দিই এক মিনিট। ওভেনের ভেতরে আলো ঝলমল করে, তার নিচে মৃদুলয়ে ঘুরতে থাকে ডাল-ভাত, শুঁটকি ও একটি মুরগির পা।
ওভেন থেকে খাবারের প্লেট বের করে হাতে নিয়ে আমি ফের বারান্দার দিকে এগোই। সেদিক থেকে ঠাণ্ডা বাতাস আসছে। ঝড়ের ভাবটা কমেছে। লোকগুলো এখনও আছে?
লোকগুলো এখনও আছে। তিনজনই। হয়তো এই রাস্তায় এই তিনজনই আজ ডিউটি দিচ্ছে। গল্পের তোড়টা কমে এসেছে। ওরা কি ঘুমিয়ে পড়েছে?
আমি ভাতের সাথে ডাল আর শুঁটকি মিশিয়ে গোল গোল করে মুঠো ভরে মুখে চালান দিই। অমৃতের মতো লাগে। লোকগুলো কি ঝিমাচ্ছে? নাহ! টুকটুক কথা কইছে। একজন বেশ নড়েচড়ে উঠে দাঁড়াল। হাঁটছে; আবার ফিরছে দলের কাছে। আমি খাই। ওরা কি খাবে? নাহ, ওদের খাবার দেওয়া যাবে না। বাড়িতে খাবার নেই তিনজনের অনুপাতে। তা ছাড়া ওরা এখন এই গভীর রাতে আমার কাছ থেকে খাবার নিতেই বা যাবে কেন? আমিই বা দিতে যাব কেন? যদি দিই, যদি ওদের ডাকি, তাহলেই বা সেটা কীভাবে সম্ভব? আমি সম্ভাবনাগুলো নিয়ে ভাবতে থাকি। যদি আমি এই বারান্দা থেকে ওদের ডাকি! প্রথমেই আশেপাশে যারা জেগে আছে মুহূর্তে সচকিত হয়ে উঠবে। যদি ঘুমিয়ে থাকা কেউ ঘুমের মধ্যে অনুভব করে- একটি নারীকণ্ঠ এই রাত দুটো ২৫ মিনিটে রাস্তার ওই পাড়ে কাউকে ডাকছে, আর যাদের ডাকছে তারা তিনটি পুলিশ, এবং তাও কি না খেতে ডাকছে? ভাত? তবে কী হবে?
আর যাদের আমি ডাকব বলে ভাবছি, ওরা কী ভাববে? ওরা মুহূর্তে সচকিত ও সতর্ক হয়ে উঠবে! ওরা ভয় পাবে? নাহ! ওরা সন্দেহ করবে। ওরা পাল্টা জানতে চাইবে। ওরা চলে আসবে কাছে, এই বাড়ির নিচে। যেহেতু ওরা পুলিশ আর ওদের সর্বত্রই যাবার অনুমোদন রয়েছে। ওরা চলে আসবে এই বাড়ির নিচে আর দোতলার বারান্দায় আবিস্কার করবে এমন একজন নারীকে, যে এই রাত প্রায় আড়াইটায় বসে রয়েছে একা, অন্ধকারে। যদিও তার নিজের বারান্দায়, তবু পুলিশগুলো মুহূর্তে সতর্ক হবে। জানতে চাইবে, একাকী এই নারী কেন তাদের ডাকছে।
সব সম্ভাবনা, আশঙ্কা ও সংকোচ ভুলে গিয়ে আমি হুট করে গলা ছেড়ে ওদের ডাক দিই।
‘এই যে শুনছেন…এই যে এই পুলিশ ভাইয়েরা …এই যে এইখানে… জি জি এইদিকে! এই দোতলায়!’
লোকগুলো অন্ধকারে মূর্তির মতো স্তব্ধ হয়ে যায়। তারপরই মুহূর্তে ছুটে আসে! ওদের প্রশিক্ষণ পাওয়া মন কিসের ঘ্রাণ পায়? অপরাধের? না বিপদের?
লোক তিনটে এসে দাঁড়ায় দোতলার ঝুল বারান্দার নিচে, রাস্তায়। আশেপাশে আর কারা কারা জেগে ওঠে আমি জানি না।
‘আপনাদের কি খিদে পেয়েছে? খাবেন? খুব ঝাল লইট্যা শুঁটকি আর শজনে দিয়ে রাঁধা ডাল আছে। খাবেন?’
লোকগুলো পরস্পর মুখ চাওয়াচাওয়ি করে। তারা হতভম্ব্ব। একটু সামলে নিয়ে তারা মুখ উঁচু করে ঘাড় বাগিয়ে আধো অন্ধকারে বসে থাকা নারীটিকে পর্যবেক্ষণ করে।
আলো জ্বালুন।
কেন?
আপনার চেহারা ভালো করে দেখা যাচ্ছে না।
দেখার দরকার কী? আপনারা খেতে চাইলে আমি একটা টিফিন ক্যারিয়ারে খাবার ভরে দেব। এই বারান্দা থেকেই নামিয়ে দিতে পারব।
খাবার দেবেন কেন?
মনে হলো, আপনারা খুব ক্ষুধার্ত। আর আমি নিজেও খাচ্ছিলাম।
তাতে কী?
তাতে কিছুই না। খেতে না চাইলে সমস্যা নাই। যান। ডিউটি করুন।
লাইট জ্বালান। গেট খুলুন।
কেন?
আমরা সার্চ করব।
কেন! আমার কী অপরাধ?
আপনাকে সন্দেহজনক লাগছে।
কেন? কী করেছি আমি? আপনাদের ডেকে জানতে চেয়েছি ডিউটিরত অবস্থায় আপনাদের খিদে পেয়েছে কি না! আপনারা দুটো ভাত খাবেন কি না- এই জন্য?
হ্যাঁ এই জন্যই।
কেন?
এমন অন্ধকারে কেউ কাউকে খেতে ডাকে নাকি? নিশ্চয় মতলব আছে।
শেষ বাক্যটি হয়তো নিজেরা নিজেদের বলে। আমাকে নয়।
লাইট জ্বালুন। রাষ্ট্রীয় কাজে বাধা দেবেন না।
অবশেষে লাইট জ্বলে। বারান্দার ঢিমে আলোতে ওরা দেখে, আমার পরনে একটি ছোট্ট হাফ প্যান্ট আর টি-শার্ট। চুলগুলো ছড়ানো পিঠময়। চোখে চশমা। খালি পা।
এই পোশাক কেন?
বা রে! বাড়িতে আমি এমনি থাকি!
বাঙালি না আপনি? মুসলমান না আপনি? এসব কী পোশাক! ছিঃ ছিঃ!
আমার পোশাক কেমন হবে, তাও বাড়িতে, সেও কি আপনারা ঠিক করে দেবেন?
‘আরে মাগি কয় কী!’
এই বাক্যটি বলে নিজেদের মধ্যে চাপাস্বরে। তবে আমি শুনতে পাই। আমি দাঁড়িয়ে আছি। ওরাও দাঁড়িয়ে আছে। আমি তাকিয়ে আছি ওদের দিকে। ওরা তাকিয়ে আছে আমার স্তন বরাবর, যা কিনা ফুটে উঠেছে আমার হালকা গোলাপি টি-শার্ট ভেদ করে। ওরা তাকিয়ে আছে আমার উন্মুক্ত ঊরুর দিকে। আমার গলা, হাঁটু, পায়ের পাতা, বাহুদ্বয়- সবই পরখ করছে। যেন এটি একটি রাষ্ট্রীয় কাজ, রাতের ডিউটি।
আপনার খাবেন না, বেশ চলে যান।
না যাব না। আপনি আমাদের সাথে চলেন।
আমি যাব কেন!
খাওয়াতে চাইলেন না? চলেন, খাওয়াবেন।
হি-হি করে হাসে ওরা। গা দুলিয়ে। একে অপরকে ঠ্যালা দেয়। এই অন্ধকারেও আমি দেখতে পাই ওদের দাঁতগুলো হলদেটে আর মাড়িগুলো রক্তবর্ণ। আমার গা গুলিয়ে ওঠে, শরীর কেঁপে যায়। মনে হয়, আমি পড়ে যাচ্ছি- পড়ে যাচ্ছি- হুম- অবশেষে আমি পড়েই যাই।
টুল থেকে।
ঘুম ভেঙে যায়। স্বপ্নটাও। বুকের ভেতরে তেমনি ধুকপুক চলছে। যেন এখনও ঘটে চলেছে। যেন এখনও তিনটে পুলিশ দাঁড়িয়ে আছে দোতলার বারান্দার নিচে। ওদের দাঁতগুলো হলদে আর দুর্গন্ধে টেকা যাচ্ছে না মোটেই।
আমি নড়েচড়ে বসি। নাহ, আমি তো খাচ্ছিও না। তার মানে খাবারের অংশটুকুও স্বপ্ন ছিল। আমি এখানে বসে বসে খিদে নিয়ে ভাবতে ভাবতে তন্দ্রা পেরিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। আশ্চর্য বটে। যেহেতু আমি নিদ্রাহীনতার রোগী। হয়তো আজকের ঝড়ো আবহাওয়া এর কারণ হবে।
তবে লোকগুলো আছে। সোডিয়ামের আলো আর নেই বললেই চলে। পান্থপথের টানা রাস্তাটা অন্ধকারে ঘোলাটে হয়ে উঠেছে। লোকদের মূর্তি এখন ক্ষয়াটে সবুজ রঙ হারিয়ে ছায়ামূর্তি হয়ে উঠেছে। ওরা তিনজনই বসে আছে আইল্যান্ডে। ওদের মাথাটা ঝুঁকে পড়েছে বুকের কাছে। শরীর তিনটে কেমন গোল করে জবুথবু পাকিয়ে আছে। একটা দুটো দ্রুতগামী গাড়ি কি ট্রাক চেঁচাতে চেঁচাতে যাচ্ছে হুটহাট। ওরা ফের নড়েচড়ে বসছে। আবার কথা কইছে। আমি তাকিয়ে আছি। ভোর হতে দেরি আছে। ভোর এলে আমি ঘুমোতে যাব। আমার একেকটি রাত এমন অদ্ভুতুড়ে যায়।
আমি লোকদের দেখি, আবার গল্পে মেতেছে।
এবার ওরা কেমন জড়ানো গলায় হাসছে। হয়তো এবার ওদের ঘুমিয়ে পড়ার ভয় পাচ্ছে। একজন আইল্যান্ডে পা তুলে দিল মনে হলো। একজন উঠে দাঁড়াল এবং একটা রোড ডিভাইডারের সঙ্গে হেলান দিল সামান্য সময়। বাকি দু’জন তেমনি বসে রয়েছে আইল্যান্ডে মিশে। ডিভাইডারে হেলান দিয়ে দাঁড়ানো লোকটা আকাশের দিকে তাকাল। তাকিয়েই রইল। তারপর হুট করে বলা নেই কওয়া নেই প্রায় চেঁচিয়ে এবং টেনে টেনে কাব্যিক ঢঙে বলে উঠল- ‘রাত পোহাবার কত দেরী পাঞ্জেরী!’
লোকটা স্কুলে পড়েছে এই কবিতা। লাইনটা ওর মাথায় গেঁথে ছিল। তা ছাড়া এটি বেশ বিখ্যাত একটি লাইন। নানা উপমায় ব্যবহার হয়েছে, নানা স্থানে। এই যেমন এখন হলো। লোকটি, মানে পুলিশটি তেমনি দাঁড়িয়ে আছে। আকাশের দিকে মুখ উঁচু করে। ক্ষুধার্ত, ক্লান্ত ও ঘুমে কাতর। ওর ক্ষয়াটে সবুজ ইউনিফর্মের নিচ দিয়ে ঘাম গড়াচ্ছে, আমি নিশ্চিত। বাতাস আপাতত বন্ধ। মধ্যরাতে ওঠা ঝড়ের এখন কোনো লক্ষণ আর নেই।
লোকটা দাঁড়িয়ে থাকে। অন্য দুটি পুলিশ ওর দিকে চেয়ে থাকে কিংবা ওর দিকে মুখ করে বসে থাকে। আমার কেমন ঘুম ঘুম পায়। আমি বারান্দা ছেড়ে উঠব উঠব ভাবি। ভেতরে নরম বিছানা অপেক্ষায় আছে। আমার বালিশ, কোলবালিশ আর আম্মার হাতে তৈরি কাঁথা- গত মাসে বাড়ি থেকে পাঠিয়েছে। ওটা জড়িয়ে শুয়ে পড়ব। এবার ঘুম হবে। ভোর রাতের শেষ মুহূর্তে আমার ঘুম আসে। আমি উঠি উঠি করি। ডিভাইডারে ঠেস দিয়ে দাঁড়ানো পুলিশটিও নড়েচড়ে ওঠে। কেমন যেন টলতে থাকে। আবছা অন্ধকারে বুঝি না। লোকটা কেমন ঢুলুঢুলু পায়ে অন্য দু’জনের দিকে এগোতে চায়। চায় কী?
কিছু বুঝে উঠতে চেয়েছি, নাকি ঘুমোতে যেতে চেয়েছি ঘরে, মনে নেই। একটা ট্রাক ছুটে আসে আকাশ বিদীর্ণ করে ভেঁপু বাজাতে বাজাতে। টলতে থাকা লোকটা মনে হয় স্বেচ্ছায় ছুটে যায় ওই আওয়াজের দিকে! নাকি ট্রাকটাই?
ভীষণ জোরে শব্দ!
ভোরের নিস্তব্ধতা খানখান করে মানুষের হাড়গোড় নাকি পুরো মাথাটাই ভেঙে পড়ার শব্দ!
কে জানে! নাকি আর্তনাদ? কারা করে? বাকি দুই পুলিশ? নাকি আমি? অথচ আমি তো ঘুমোতে যাচ্ছিলাম! ভোরের নরম অন্ধকারে আমার নিদ্রাহীনতার অভিশাপ শেষ হয়। অথচ আমি কেন এখনও দাঁড়িয়ে আছি? এই বারান্দায়? অন্ধকারে ঝুঁকে পড়ে আমি ওই দূরে আইল্যান্ডের কাছে মাত্র ঘটে যাওয়া মৃত্যুর আদ্যোপান্ত বুঝতে চাইছি! নাকি রাতের চিরচিরে হাওয়ার ভেতরে দ্রুত পলাতক ট্রাকটির পিছে দৌড়ে যাওয়া কাউকে দেখছি! কে ছুটে গেছে? আর কেই বা বসে আছে উবু হয়ে- বিস্মিত, হতবুদ্ধি! অথবা যে শুয়ে আছে রাস্তায়, শেষ রাতে, কিছুক্ষণ আগেই যে কবিতা বলেছিল! এই অন্ধকারে! এই ভোরের আগে!
ওই তিনজন রাতের পুলিশের ইউনিফর্মের ক্ষয়াটে সবুজ রঙ এই শেষ রাতের গভীরতম অন্ধকারে এত দূর থেকে আমি আর ঠিকঠাক দেখতে পাইনে।