আমি যে মেয়েটির প্রেমে পড়েছি, তার ভাই একজন সংসদ সদস্য। বোনকে অত্যধিক স্নেহ করেন। তার ভয়াবহ স্নেহের তুলনা হচ্ছে, কেউ যদি ভুলেও তার বোনের দিকে খারাপ চোখে তাকায়, চোখ তুলে মার্বেল খেলবেন। ভয়ে কেউ তার বোনের দিকে তাকায় না। আমি তাকিয়েছি, পরিণামে প্রেমে পড়ে গেছি।
ছাত্র ও যুব রাজনীতিতে হাত পাকিয়ে সর্বশেষ সংসদ নির্বাচনে তিনি আমাদের আসন থেকে এমপি হয়েছেন। তার নামে একাধিক মানিলন্ডারিং, অবৈধ দখল ও সন্ত্রাসী কার্যক্রমের মামলা থাকলেও নির্বাচনের আগে কারি কারি টাকা ঢেলে সব ক্লিন করেছেন। বর্তমানে বেশ পরিচ্ছন্ন মেজাজে চলাফেরা করেন। তার পরিচ্ছন্ন মেজাজের পেছনের অন্ধকার দিক অত্র এলাকার সবাই জানেন। নামে বেনামে এখনো তার ইশারায় সবকিছুই আগের চেয়ে রমরমা চলছে। সামনে থেকে প্রশাসনের সাহায্য পাচ্ছেন আর পেছনে তার সন্ত্রাসী বাহিনী তাকে এখনো ব্যাকআপ দিচ্ছেন। সন্ত্রাসী কার্যক্রম আর জবর দখল ছেড়ে দিলেও এখনো অন্যসব কালো ধান্দা চলছে তার, একথা এলাকার সবাই জানে।
এখন তার পিঠ পিছে কেউ বাজে কথা বললে গুম হয়ে যায়। গুম হওয়া ব্যক্তি সপ্তাহ খানেক পরে খোঁড়াতে খোঁড়াতে এলাকায় আসে। তারপর থেকে সে চুপ মেরে যায়। যারাই গুম হয়েছে, তারা আর কোনদিন জাবেদ পাটোয়ারী এমপি-র বিরুদ্ধে কিছু বলার সাহস ফিরে পায়নি। বুঝতেই পারছেন আমি যার প্রেমে পড়েছি, তার ভাই নিজেই মস্তবড় এক ডেঞ্জার। তবে তার ভাইয়ের এত ক্ষমতা বা টাকায় আমার কিছু যায় আসে না। আমার প্রেমে তিনি কোন বড় সমস্যা না। অন্তত আমি তা মনে করি না। তবুও আমার প্রেমটা হচ্ছে না। কারণ আমি যার প্রেমে পড়েছি, সেই মেয়েটি ছেলেদের নয় বরং মেয়েদের পছন্দ করে।
সোজা কথায় লেসবিয়ান।
আমি তার প্রেমে পড়েছি প্রায় ছয় মাস আগে। প্রথম যেদিন তাদের বাড়িতে গেলাম, সেদিনই। আমি এই বাড়িতে ঢুকেছি জাবেদ পাটোয়ারীর ছয় বছর বয়সী মেয়ে জায়রা কে টিউশন পড়াতে। প্রথম দিন পড়াচ্ছি, এর মধ্যে হুট করে এক মেয়ে রুমে ঢুকে খাটের উপর থেকে ওড়না নিয়ে আবার যেপথে এসেছিলো, সেই পথে বেড়িয়ে গেলো। তাকে দেখামাত্রই আমার দম বন্ধ গেলো। দম ফিরে আসলো সে চলে যাবার পরে। আমি বাম হাতের তালু চুলকাতে চুলকাতে বললাম, ‘এইমাত্র যে মেয়েটি এসেছিল, সে তোমার কী হয় জায়রা?’
জায়রা হোমওয়ার্ক রেখে বলল, ‘এটা তো আমার ফুপ্পি হয়।’
বাম হাতের তালু চুলকালে টাকা যায়। গেলে যাক টাকা, আমি হাত চুলকানো কন্টিনিউ রেখে আবার জিজ্ঞেস করলাম, ‘তোমার ফুপ্পির নাম কী?’ জায়রা মনোযোগ দিয়ে আমার হাত চুলকানো দেখতে দেখতে বলল, ‘ফুপ্পির নাম নুসরা।’ এ কেমন নাম নুসরা? আদরের মেয়েদের নামে বাবারা প্রতিষ্ঠানের নাম রাখে, যেমন “মীম জেনারেল স্টোর” তারপরে “নূপুর জুয়েলার্স” ইত্যাদি৷ নুসরা আবার কেমন নাম! মনে হয় যেনো জঙ্গি সংগঠন আল নুসরা ফ্রন্টের প্রধানের মেয়ে। উনিশ-বিশ হলেই অতর্কিত গুলি গ্রেনেড ছুড়ে মারবে। আমি বাম হাতটা এবার জিন্স প্যান্টের সাথে ঘষতে ঘষতে বললাম, ‘ফুপ্পির পুরো নাম কী জায়রা?’
ফুপ্পির ভাতিজি হাত ছেড়ে এবার আমার মুখের দিকে মনোযোগ দিয়ে উত্তর দিলো, ‘আমার ফুপ্পি তোমারও ফুপ্পি হয়?’
এখনকার বাচ্চাগুলোর সাহস কত। প্রথম দিনেই ‘তুমি’ বলে। আর আমরা টিচারকে ‘তুমি’ তো দূরে থাক, চোখে চোখ রেখেই কোন দিন কথা বলার সাহস পাই নাই। একবার স্যার পানি চাইছে, আনতে আনতে পানির গ্লাসে এক বাপ্পারাজ মশা উড়ে এসে সুইসাইড করে বসেছে। এটা কী আমার দোষ? মশার সলিলসমাধি যুক্ত পানি আনার অপরাধে স্যার দুই আঙুলের ফাঁকে কলম ঢুকিয়ে আঙুল মোচড়ে শাস্তি দিয়েছিলেন।
আমি ততক্ষণে বাম হাত কামড়াচ্ছি। হাত তখনো বেদম চুলকাচ্ছে। ঝেড়ে নেংটো করে টাকা পয়সা সব চলে যাবে কিছুদিনের মধ্যে মনে হচ্ছে। আমি দাঁত দিয়ে হাতের তালু কামড়ানো বন্ধ করে বললাম, ‘আমার ফুপ্পি লাগে নাতো। যেমন আমি তোমার ফুফা লাগি না, তেমনি সেও আমার কিছু হয় না। এবার বলো তোমার ফুপ্পির পুরো নামটা কী?’
তালু কামড়ানো বন্ধ করায় জায়রা যেনো একটু বিমর্ষ হলো। আমার চোখের দিকে তাকিয়ে জবাব দিলো, ‘ফুপ্পির পুরো নাম নুসরাত পাটোয়ারী।’
এই পাটোয়ারী পদবি কেন এমন সুন্দরী মেয়ের নামের সাথে থাকবে? পাটোয়ারী পদবিটার উপরেই আমার ঘেন্না ধরে গেছে। এর থেকে শুধু নুসরা-ই ভালো ছিলো। বুয়েটের ছাত্র আমি, ভালো একটা চাকরিও করছি। এই শালা জাবেদ পাটোয়ারী লোকজন দিয়ে জোর করে ধরে নিয়ে আসছে তার ছয় বছর বয়সী মেয়েকে পড়াতে। বুয়েটের ভাইয়া ছাড়া মেয়েকে সে পড়াবেই না। যত্তসব পাটোয়ারীসুধা পাবলিক৷ আমি তখনি ঠিক করে ফেলেছি বিয়ের কার্ডে নুসরাতের নামের সাথে পাটোয়ারী দিতে দিবো না। এটা হবে পাটোয়ারীদের বিরুদ্ধে আমার প্রথম বিপ্লব। বরং আমার নামের সাথে মিলিয়ে কার্ডে ছাপানো হবে “নুসরাত রহমান”, কী চমৎকার!
দুইদিনের মধ্যেই আমি নুসরাত সম্পর্কে অনেক কিছু জেনে নিয়েছি। এই যেমন, আমি যে রুমে বসে পড়াই, নুসরাত আর জায়রা সেই রুমে ঘুমায়। পশ্চিম পাশের দেয়ালে ঠেঁস দেয়া ওয়্যারড্রোবের উপরের দুইটা ড্রয়ার নুসরাত ব্যবহার করে। ড্রেসিং টেবিলে সাজানো শ্যানেলের পারফিউম নুসরাত ব্যবহার করে। খাটের উপরের বাম পাশের বালিশটায় নুসরাত ঘুমায়। আলমারির উপরে রাখা ছোট টেডিটা জায়রা ধরে ঘুমায় আর বড় টেডিটা নুসরাত।
আমার নুসরাতের টেডি হতে ইচ্ছা করে। আমার ইচ্ছা করে বাসা থেকে বালিশটা এনে নুসরাতের বালিশের ডান পাশে রাখতে। ওয়্যারড্রোবের ড্রয়ার খুলে নুসরাতের জিনিসপত্র ঘাটাঘাটি করতে। তৃতীয় দিন পড়ানো শেষে যাওয়ার সময় ড্রেসিং টেবিলের উপর থেকে সাহস করে নুসরাতের শ্যানেলের পারফিউম হাতের উল্টো পিঠে ফুস করে এক চাপ মেরে নিয়েছি। সারারাত হাত নাকের সামনে ধরে বসে থাকবো, নুসরাতের ঘ্রাণ নিবো। যাওয়ার সময় দেখি নুসরাত ড্রয়িং রুমে বসে আছে। পারফিউমের ঘ্রাণ ধরা পড়ে যাওয়ার ভয়ে হাত পকেটে ঢুকিয়ে ফেলেছি। নুসরাতের সাথে প্রথম কথা হয় টিউশনের দ্বিতীয় সপ্তাহে। রুমে ঢুকে ড্রেসিং টেবিলের উপর থেকে চাবি নিয়ে যাওয়ার সময় নুসরাত জিজ্ঞেস করলো, ‘ভালো আছেন?’
আমার বলতে ইচ্ছা হয়, অবশ্যই ভালো আছি নুসরাত। আজকে প্রথম তোমার গলা শুনছি। প্রথম তুমি আমাকে কিছু জিজ্ঞেস করেছো। আজকে পৃথিবীর সাত’শ কোটি মানুষের মধ্যে আমিই সবচেয়ে ভালো আছি। কিন্তু আমার গলা দিয়ে কোন আওয়াজ বের হয় না৷ আমি ঘাড় কাত করে চিঁ চিঁ করে বলি, ‘হ্যাঁ, আপনি?’ জবাব না দিয়ে নুসরাত হেসে চলে যায়। আমার চিঁ চিঁ স্বরের প্রশ্ন নুসরাত সম্ভবত শুনতে পায়নি। এরপর থেকে রুমে নিয়মিত নুসরাতের আনাগোনা আমাকে একজন দায়িত্বশীল শিক্ষকে পরিণত করে। একদিনও টিউশন মিস দেইনি। বরং প্রথম মাসে দুইটি ছুটির দিনে সদিচ্ছার সাথে জায়রাকে পড়াতে চলে গিয়েছি। জায়রার মা মুগ্ধ হয়ে আমার সামনেই জাবেদ পাটোয়ারীর কাছে আমার সুনাম করেছেন। জায়রার আম্মুকে বলতে ইচ্ছা করে, ‘ভাবী সুনামে আমার কিচ্ছু যায় আসে না, আমি তো আসি আপনার ননদকে দেখতে।’
প্রথম মাসে নুসরাতের সাথে টুকটাক গল্প হয়। একদিন মুভি সাজেশন ও আরেকদিন সৈয়দ মুজতবা আলীর রোমান্টিক উপন্যাস “শবনম” পড়তে দেই। নুসরাতের কথা বলতে বলতে মিষ্টি করে হাসার অভ্যেস। সে হাসি আমার কলিজায় লাগে। আমার মনের কইতর বাকবাকুম ডাকে। বই ফেরত দিতে এলে আমি নুসরাতকে জিজ্ঞেস করি, ‘উপন্যাসটা কেমন লাগলো নুসরাত?’ নুসরাত ঠোঁট বাঁকিয়ে জবাব দেয়, ‘কেমন আর লাগবে! সেই চিরায়ত নারী পুরুষের প্রেম।’ নুসরাতের জবাবে আমার কোন সন্দেহ হয় না। এই চিরায়ত নারী পুরুষের প্রেমই তো বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ প্রেমের উপন্যাস।
দ্বিতীয় মাসে এসে আরো বই লেনদেন ঘটে। নুসরাতের সাথে গল্প বাড়তে থাকে। নুসরাতের কথা শুনতে ভালো লাগে, কথা বলার সময় নুসরাতকে দেখতে ভালো লাগে। ছাত্রী পড়া না বুঝে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে, আমি তাকিয়ে থাকি ছাত্রীর ফুপ্পির দিকে। আগের মত আমি পড়াতে আসলে নুসরাত বেরিয়ে যায় না, বরং বেশ সময় নিয়ে বসে থাকে, আড্ডা দেয়। আমার ভয় করে কোনদিন না আবার জায়রার আম্মু জাবেদ পাটোয়ারীকে বলে দেয় আমাদের এত গালগল্পের কথা। এমনিতেই অধিকাংশ মানুষ যুবক গৃহশিক্ষকদের সন্দেহের চোখে দেখে।
জায়রার আম্মু উল্টো নাশতা নিয়ে এসে আমাদের সাথে টুকটাক গল্প করে যায়। জাবেদ পাটোয়ারীও দুই দিন এসে জায়রার পড়ার খবর নিয়ে গেছে। যুবক এক হোম টিউটরের সাথে যে তার বোন গল্পে মশগুল, তা যেনো সে কিছুই মনে করেনি। এই পরিবারটিকে আমার অত্যন্ত উদার মনে হয়। ডেঞ্জার জাবেদ পাটোয়ারীকে কিউট ভদ্রলোক মনে হয়। কিন্তু এসবের পিছনে যে রহস্য আছে আর তারা যে চায় নুসরাত পুরুষদের সাথে গল্প করুক, সেই ঘটনাতো আমি জানতাম না।
ঘটনা জানতে পেরেছি তৃতীয় মাসের শেষ সপ্তাহে এসে। পড়ানোর মধ্যেই চোখে পোকা ঢুকে যাওয়াতে ঘড়ি খুলে টেবিলে রেখে চোখে পানি দিয়ে এসেছিলাম। পড়ানো শেষে ঘড়ি না নিয়েই বের হয়ে গেছি। কিছুদূর যেয়ে হাত খালি লাগায় মনে পড়ল ঘড়ির কথা। ভাবলাম ঘড়ি নিয়ে আসি, সাথে নুসরাতকেও একটু দেখে আসি। তাকে একটু দেখা যেনো অস্পর্শী-বিমূর্ত সাধন। দরজা খোলাই ছিলো। কিছুটা ভিতরে ঢুকতেই শুনি জাবেদ পাটোয়ারীর রাগত্ব গলার স্বর, ‘শুনলাম ঐ মেয়েটা আবার এসেছে শহরে। সেই মেয়ের সাথে আবার মেলামেশা শুরু করেছ?’ ‘ও তো কোন ক্রিমিনাল না যে ওর সাথে দেখা করা যাবে না, কথা বলা যাবে না। বরং তোমাদের চিন্তা ভাবনা বদলাতে হবে। এখনো সেই আদিম যুগে পড়ে আছো তোমরা।’ জবাব দেয় নুসরাত।
ডয়িং রুম থেকে দরজা কিছুটা আড়ালে হওয়াতে আমি ভিতরের কাউকে দেখতে পাচ্ছি না। তবে কথপোকথন শুনে মনে হলো পারিবারিক লঙ্কাকান্ড চলছে এই বাড়িতে। কারণ নুসরাতের কথা শেষ হতে না হতেই জাবেদ পাটোয়ারী কিছু একটা আছাড় মেরে ভেঙ্গে ফেলেন। ভাঙ্গা সিরামিকের টুকরোগুলো আমার দিকেই এসেছে, বুঝলাম ফুলের টবের শোপিস ভেঙ্গেছেন। এর মধ্যে আমার ঘড়ি আনতে ভিতরে ঢুকা ঠিক হবে কি না ভাবতেই দোটানায় পড়ে গেলাম।
জাবেদ পাটোয়ারী আবার বললেন, ‘সমাজে আমার একটা ইজ্জত আছে। একটা মেয়ের সাথে আমার বোনকে বিয়ে দিবো, ভাবা যায় একথা! মানুষ আমার মুখে থু থু দিবে। লোকে জাবেদ পাটোয়ারীকে নিয়ে হাসাহাসি করবে।’
আমার মাথায় বাজ পড়ল জাভেদ পাটোয়ারীর কথা শুনে। দরজা দিয়ে বেরিয়ে এলোমেলো পায়ে হাঁটতে লাগলাম। আমার এত দিনের সাজানো বাগান এক নিমিষে খেয়ে নিলো ছাগল। পশুটা ছাগল হবে না, ছাগী হবে। ঐ ছাগীর কারণে একে একে আমার স্বপ্ন ভেঙ্গে যেতে দেখি আমি খোলা চোখেই। আমার আর নুসরাতের চোখের নিচের তিলটা ছুঁয়ে দেখা হবে না। চুল সরিয়ে ঘাড়ে সুড়সুড়ি দেয়া হবে না। নুসরাতের বালিশের পাশে আমার বালিশ থাকবে না, আমার আর নুসরাতের টেডি হওয়া হবে না। আমার সব শেষ হয়ে গেছে, আমি বরবাদ হয়ে গেছি।
মানসিক শক খেয়ে তখনো আমি ট্রমার মধ্যে আছি। এক সপ্তাহ কোথাও যাইনি, দিনরাত খাটে শুয়ে সিলিংয়ে তাকিয়ে থেকেছি। ক্ষুধা লাগলে অনলাইনে অর্ডার করেছি। অফিস থেকে সিক লিভ নিয়েছি। কোন আগাম নোটিশ ছাড়াই জায়রাকে পড়াতে যাইনি। যেয়ে কী হবে? আর কিছুই তো বাকী নেই। আমার পৃথিবী বদলে গেছে, একটা ছাগী সব ধ্বংস করে দিয়েছে। সিলিংয়ে তাকিয়ে যখন বন্ধ ফ্যানটা দেখছি আর ঘামছি, তখন আমার ফোন বাজছে। একবার, দুইবার, তিনবার ফোন বেজে চলেছে। আমার ফোন ধরতে ইচ্ছা করে না। সপ্তম বারে রবার্ট ব্রুস হারানো রাজ্য জয় করেছিলেন, আর আমি কলটা রিসভ করলাম। ওপাশ থেকে মেয়ে কণ্ঠ বললো, ‘কী স্যার? পড়াতে আসবেন না আর?’ নুসরাতের গলা শুনে আমার হৃদপিণ্ড ধড়ফড় করে উঠে। আমি শোয়া থেকে লাফিয়ে উঠি। সব মনে পড়তেই আবার শুয়ে পড়ি। শান্ত কণ্ঠে জবাব দেই, ‘এসে আর কী হবে?’
ওপাশ থেকে নুসরাত জিজ্ঞেস করে, ‘কী হবে মানে? আপনি জায়রাকে আর পড়াবেন না?’ আমি ডান কাত হয়ে কান আর বালিশের মাঝে ফোনটা স্যান্ডউইচের মত বানিয়ে হাত টান করে উত্তর দেই, ‘পড়ানোর ব্যাপারটা ছিলো একটা সাজানো বাগান। আমার বাগানের সব ফুল শুকিয়ে গেছে। বাগান হয়ে গেছে সাহারা মরুভূমি। আমার চোখের সমস্ত জল দিলেও সে বাগান আর সবুজ হবে না।’ আমার কথা শেষ হবার আগেই নুসরাত বললো, ‘কী আবোল তাবোল বকছেন? আপনার জ্বর টর আসেনি তো? যাকগে, পড়াতে না আসেন সেটা আপনার ব্যাপার, কিন্তু আপনার ঘড়িটা তো ফেলে গেছেন। ওটা নিয়ে যান এসে৷’ আমু কুঁজো হয়ে পাশবালিশটা টেনে দু পায়ের ফাঁকে ঢুকিয়ে লম্বা একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলি, ‘ওটা আর লাগবে না, ইচ্ছে হলে রেখে দিন, নইলে ফেলে দিন৷’
নুসরাত এবার একটু শক্ত স্বরে বলে, ‘বুঝলাম না হয় পড়াতে আসবেন না। আমাদের বাড়িতেও আসবেন না। তাই বলে ঘড়িটা নিবেন না আপনার? আপনি বরং বাইরে কোথাও আসুন, আমি এসে আপনাকে ঘড়িটা দিয়ে যাই।’
আমি পাশবালিশটা বুকে টেনে নিয়ে জবাব দেই, ‘যদি না আসি?’ নুসরাত রাগী গলায় শব্দ করে বলে, ‘ফাইজলামি করেন? কোথাও লুকিয়ে আছেন নাকি? শোনেন, যেখানেই থাকেন না কেনো, ভাইয়ার লোক পাঠিয়ে আপনাকে টেনে বের করাবো। আপনি চিনেন আমাকে?’ ভালো করেই চিনি। এমপি সাহেবের বোন, যেখানেই থাকি না কেনো খুঁজে বের করবে। এত ক্ষমতাধর ভাইয়ের চোখে চোখ রেখে তর্ক করে যে মেয়ে, সে যেকোন মূল্যেই হোক খুঁজে বের করবে। উল্টাপাল্টা করলে দলবল পাঠিয়ে উত্তম কেলানি দিতে পারে। তার থেকে বরং দেখা করে ঘড়িটা নিয়ে আসাই ভালো।
নুসরাত আমাকে ডেকেছে ধানমন্ডির একটা রুফটপ ক্যাফেতে। যথা সময়ে পৌঁছে দেখি নুসরাত আর একটা মেয়ে বসে আছে। চকোলেট রঙের জামা আর সাথে সেই রঙের আই শ্যাডো ও লিপস্টিক দেয়া নুসরাতকে দেখতে কী সুন্দর লাগছে! আমার চোখ আর সরে না নুসরাতের থেকে। তবুও সরাতে হয়, চোখ সরানোই নিয়ম। চোখ সরাতেই দেখি পাশের মেয়েটিকে। জিন্স আর টিশার্টের উপরে লেদার জ্যাকেট পরনে। মাথার চুল একপাশে ন্যাড়া করা, আরেক পাশে বড়। গায়ের রং দেখেই মনে হচ্ছে বিদেশি। আমার আর বুঝতে বাকী রইলো না এটাই সেই ছাগী, যে আমার চকোলেট কালারের বাগান খেয়ে ফেলেছে।
আমাকে দেখেই নুসরাত উঠে আসে। ছাদের একটা কোণে দাঁড়াই দুজনে। বাতাসে নুসরাতের চুল উড়ছে। কিছু চুল এসে মুখে পড়ছে। ইচ্ছে করে নুসরাতের অবাধ্য চুলগুলো সরিয়ে দেই, কিন্তু অধিকার তো নেই। নীরবতা ভেঙ্গে নুসরাত জিজ্ঞেস করে, ‘জায়রাকে পড়াতে আসছেন না কেনো?’ আমি ঠোঁটে কৃত্রিম হাসি এনে বলি, ‘ইচ্ছে করছে না আসলে। আপনার ভাই জোর করে ধরে এনেছিলেন। তাই বাধ্য হয়ে পড়াচ্ছিলাম। মনের বিরুদ্ধে কতদূর যাওয়া যায় বলেন?’ নুসরাত চোখ নামিয়ে ওর কামড়ে ধরে নীচের ঠোঁটটা ছেড়ে দিয়ে বললো, ‘মনের বিরুদ্ধে কতদূর যাওয়া যায়! আসলেই তো তাই। আমিও তো যেতে পারছি না। পরিবার আর সমাজের বিরুদ্ধে চলে গেছি মনের বিরুদ্ধে যেতে না পেরে। কিন্তু আপনি সত্যটা বলছেন না।
আপনার ব্যপারটা আমি জানি, আপনি কেনো আসছেন না। বলবো?’ আমার বেশ জানতে ইচ্ছে হলো নুসরাত কী ভাবছে আসলে আমার পড়াতে না যাওয়ার ব্যাপারটা। কারণ নুসরাতের মেয়েঘটিত ব্যাপারটা যে আমি জেনে গেছি, সেটা নুসরাতের জানার কথা না। আমিও চাই না নুসরাত কখনো জানুক আমি তার প্রেমে পড়ে গিয়েছিলাম। তার চোখের নীচের যে তিলটায় আমি তাকিয়ে আছি, একদিন তীব্র বাসনা ছিলো সেই তিলটি ছুঁয়ে দেখার। কিছু কথা অজানাই থাকুক। আমি নুসরাতকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘বলুন দেখি কেনো?’
নুসরাত তার ঠোঁটে এসে লেগে থাকা চুল সরিয়ে বললো, ‘আমাদের ঘরে ঢুকতেই একটা বড় আয়না দেয়ালে লাগানো আছে কখনো খেয়াল করেছেন? সেদিন আপনি আমার আর ভাইয়ার কথা শুনেছেন। মেয়েদের পেছনেও চোখ থাকে জানেন তো? আপনাকে আমার সামনের চোখই দেখেছে, দরজার কাছের আয়নাতে।’ আমি ধরা পড়ে গেছি ভেবে অপ্রস্তুত হই। তারপরেও সামান্য বেঁচে থাকা আত্মবিশ্বাস থেকে জবাব দেই, ‘এর সাথে আমার না পড়ানোর কী সম্পর্ক। ওটা তো আপনার ব্যক্তিগত ব্যাপার।’
নুসরাত আমার চোখে তাকিয়ে মৃদু হেসে উত্তর দেয়, ‘শ্যানেলের পারফিউমের ঘ্রাণ কিন্তু পৃথিবী জুড়ে বিখ্যাত। প্রথম দিন ভেবেছিলাম আমিই হয়ত মেখেছি। এরপরে ইচ্ছে করেই ঐ পারফিউমটা আর ব্যবহার করিনি। কিন্তু আপনি পড়ানো শেষে যাওয়ার সময় মাঝে মাঝেই ঘ্রাণ আমি পেয়েছি।’ আমি পুরোপুরি ধরা খেয়ে ভ্যাবাচেকা খেয়ে বোকার মত বলি, ‘এমনও তো হতে পারে আমার কৌতূহল ছিল পারফিউমটার প্রতি। ঘ্রাণ ভালো লেগেছিল, তাই অনুমতি না নিয়ে হাতে মেখে নিয়েছি।’ নুসরাত চোখ ছোট করে বললো, ‘আমাকে কী বোকা মনে হয় আপনার? সেক্সুয়াল প্রিফারেন্স যাই হোক, আমি একজন মেয়ে তো; তাই না? আপনি প্রথম মাসেই হাব ভাবে ধরা পড়ে গেছেন আমার কাছে। বাদ দেন তো এসব, চলুন আমার বান্ধবীর সাথে পরিচয় করিয়ে দেই।’
পরিচয়ের পরে কফি খেতে খেতে কথা চলছিল৷ ছাগীটার নাম শ্যারন ডি কক। নামের সাথে কক থাকলেও কক নিয়ে তার কোন ইন্টারেস্ট নেই। ইংরেজিতে তার কথা যা শুনলাম ও শুনে যতটুক বুঝলাম সে ভীষণ মোরগ বিদ্বেষী। তার যুক্তি হচ্ছে, মোরগ সারাদিন টই টই করে ঘুরে আর ইচ্ছা হলেই মুরগিকে জাতা দিয়ে ধরে। মুরগির সাধ আহ্লাদ নিয়ে মোরগের কোন ইন্টারেস্ট নাই। ওদিকে মুরগি খুবই প্রডাক্টিভ পার্সোনালিটি৷ ডিম দেয়, বাচ্চা দেয়, বাচ্চা পালন করে। তাই মোরগ ছাড়াও পৃথিবীতে মুরগির বেঁচে থাকা সম্ভব। আমার বলতে ইচ্ছা করে যে মোরগ ছাড়া বেঁচে থাকা তো সম্ভব মানলাম, তবে মোরগ জাতা না দিলে ডিম আসবে কোথেকে?
এ বিষয়ে তর্ক করার মত মন মানসিকতা আমার নেই তখন। আমার হৃদয়ে মস্ত এক ক্ষত। ঘড়িটা নিয়ে এখান থেকে কেটে পড়লেই বাঁচি। তাই মোরগ হয়েও মত চুপচাপ মোরগের বদনাম শুনলাম। তবে বেশিক্ষণ চেপে থাকতে পারলাম না, বেফাঁস মুখ জিজ্ঞেস করে ফেললো, ‘আপনাদের মধ্যে ছেলে কে?’ প্রশ্ন শুনে শ্যারন ডি কক হা হয়ে তাকিয়ে আছে। নুসরাত কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থেকে বললো, ‘আপনার কী দেখে মনে হয় না আমরা দুজনেই মেয়ে?’ আমতা আমতা করে বললাম, ‘না মানে মেয়েদের মধ্যেই ছেলে কে? আমি মনে হয় বুঝাতে পারছি না ব্যাপারটা। মানে মেয়ে মেয়ের মধ্যে ছেলে।’
প্রশ্নটা করে আমি নিজেই বোকা বনে গেছি। প্রশ্ন শুনে ওরা দুজনেই হেসে ফেলায় ব্যাপারটা হালকা হয়ে গেছে। আমিও হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। প্রায় তিন ঘন্টা আমাদের খোসগল্পে কেটে গেছে। আমার গত এক সপ্তাহের মন খারাপটাও কেটে গেছে ওদের সাথে গল্প করে। যে যেভাবে সুখী থাকতে চায়, থাকুক না। নুসরাত মোবাইল দেখে কপাল কুঁচকে আমাকে বললো, ‘ইশ! দেরী হয়ে গেছে। শ্যারনের ফ্লাইট আজকে রাতেই। ও লাগেজ নিয়েই এখানে এসেছে। আপনি কিছু মনে না করলে কষ্ট করে একটু এয়ারপোর্টে দিয়ে আসতে পারবেন? আমাদের বাসায় একটা পার্টি আছে, আমাকে থাকতে হবে। বুঝতেই পারছেন মেয়ে মানুষ, এয়ারপোর্ট পর্যন্ত একা যাওয়াটা সেইফ না।’
আমি চোখ বাঁকা করে রহস্যের হাসি দিয়ে বললাম, ‘নিয়ে যাবো, কোন ব্যাপারই না, কিন্তু আমাকে বাঁকা চোখে তাকাতে দেখে নুসরাত ব্যাপারটা ধরে ফেললো। চোখ গরম করে বললো, ‘ওকে ছেলে বলে আবার লেইম জোকস মারবেন না। এবার কিন্তু রেগে যাবো।’ আমি দাঁত বের করে বললাম, ‘আরে না জোকস না। ধরুন যাওয়ার পথে আমি যদি আপনার বান্ধবীকে পটিয়ে ফেলি, ব্যাপারটা কেমন হবে?’ নুসরাত ঠোঁট বাঁকিয়ে বললো, ‘ ছ্যাঁকা খেয়ে খুব তামাশা হচ্ছে না? কাল থেকে জায়রাকে পড়াতে আসবেন। ভাইয়া শুনলাম আপনাকে খুঁজছে। পেলে কিন্তু তখন আসল তামাশা দেখাবে।’
নুসরাতের কাছ থেকে বিদায় ও ঘড়ি দুটোই নিয়ে আমি আর শ্যারন ডি কক ট্যাক্সি নিয়ে এয়ারপোর্ট যাচ্ছি। বিদায় কালে দুজনকে জড়িয়ে ধরতে দেখে আমার গা জ্বলে যাচ্ছিলো। কোনদিন ভাবিনি সতীন নিয়ে একই ট্যাক্সিতে যাওয়া লাগবে। মানুষের পাশে বসে প্রেমিকা, আমার পাশে বসেছে প্রেমিকার প্রেমিকা। নুসরাত হলে রিক্সা নিতাম, শহরের ভিতরের অলিগলি দিয়ে এয়ারপোর্ট পর্যন্ত চলে যেতাম। ফ্লাইট মিস হতো, মুখে মিথ্যে আসফোস ঝুলিয়ে আবার একই পথে অলি গলি হয়ে মাঝরাতে ফিরে আসতাম। এই ডি কককে যত তাড়াতাড়ি এয়ারপোর্টে ফেলে আসা যায় ততই মঙ্গল। আমি ড্রাইভারকে তাড়া দেই দ্রুত চালাতে, কিছুতেই ফ্লাইট মিস করা চলবে না।
পরদিন থেকে জায়রাকে আবার নিয়মিত পড়ানো শুরু করলাম। অফিসেও যাওয়া শুরু করলাম। ব্যস্ত এমপি জাবেদ পাটোয়ারী এসে খোঁজ খবর নিয়ে গেছেন। অসুস্থতার বাহানায় পার পেয়ে গেছি। জায়রার আম্মু আর নুসরাত প্রায় দিনই এসে গল্প করে। আবার বই আর মুভি সাজেশন চলতে শুরু করলো। সম্পর্কটা এবার অনেকটা বন্ধুত্বের মতই। নুসরাতকে এবার কবিতার বই পড়তে দিয়েছি, জয় গোস্বামীর ‘পাগলী তোমার জন্য।’ বইয়ের নাম দেখে নুসরাত মিটিমিটি হাসছিলো। হয়ত ভাবছিলো আমার মাথা থেকে প্রেমের ভূত তখনো যায়নি।
পাঁচ মাসের মাথায় হঠাৎ-ই নুসরাত একদিন ফোন দিলো বাইরে দেখা করতে। অফিসে পেট ব্যথা বলে বেরিয়ে গেলাম। স্কুলে টিফিন আওয়ারে পেট ব্যথার নাটক করে অনেক বারই বাসায় গিয়ে পায়ের উপর পা ফেলে গোয়েন্দা গল্প পড়েছি। অফিসেও যে এই ছুতো কাজে দিবে ভাবতে পারিনি। নুসরাত আমাকে ডেকেছে শিশুপার্কে। প্রাপ্তবয়স্ক দু’জন ছেলে মেয়ের শিশুপার্রকে দেখা করার সমীকরণ আমার কিছুতেই মিলছে না। তবুও রিকশা নিয়ে শিশুপার্কের দিকে রওনা দিলাম। বিকেল থেকে মোটামুটি বড়রা উঠতে পারে এমন রাইডগুলোতে আমরা চড়ে বসলাম। সন্ধ্যার পরে উঠলাম মিনি ট্রেনে। ট্রেনটা পুরো শিশুপার্ক ঘুরিয়ে আনলো দুজনকে। ছোটবেলায় যখন এসেছিলাম, তখন পার্কের আয়তন আরো বড় ছিলো। ভিতরে বেশ বড় একটা লেক ছিলো। সেখানে সাদা রাজহাসেরা ঘুরে বেড়াতো। এখন সব কিছু পরিবর্তন হয়ে গেছে। সেই বিশাল পার্কটা ছোট হয়ে গেছে।
ট্রেন থামলেও আমরা নামলাম না। চুপ করে আড়ালে বসে রইলাম। শেষ ট্রিপ বলে এবার কম বাচ্চা ও অভিভাবকরা উঠেছে। ট্রেন চলতে শুরু করেছে। আমারা বড় দুটি বাচ্চা যে দ্বিতীয় বার টিকেট ছাড়া ভ্রমণ করতে গিয়ে ধরা পড়লাম না, এটা নিয়েই হাসতে হাসতে অর্ধেক পথ পেরিয়ে গেলো। বাতাসে নুসরাতের রেশমি চুল উড়ছে। কিছু চুল বরাবরের মত মুখে এসে পড়েছে। এবার আর সেই আদিম ইচ্ছাটা দমিয়ে রাখতে পারলাম না। অবাধ্য হাত গিয়ে সরিয়ে দিলো অবাধ্য চুলগুলোকে। নুসরাত অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলো। আমি চোখ ফিরিয়ে নিয়েছি। তবুও বুঝতে পারছিলাম ট্রেন থামা পর্যন্ত নুসরাত তাকিয়ে ছিলো। আমার আর তাকানোর সাহস হয়নি।
শিশুপার্কের গেট বন্ধ হবে, মাইকে এনাউন্স করছে। আমরা ট্রেন থেকে নেমে বেরিয়ে গেলাম। কিছুদূর হেঁটে গিয়ে বসলাম উদ্যানের একটা গাছের নীচে। ঝিরিঝিরি বাতাস বইছে তখনো, দূর থেকে ভেসে আসছে গানের সুর। আকাশ যেনো জোছনার মেলা বসিয়েছে। বেশ কিছুক্ষণ নীরবতার পরে নুসরাত বললো, ‘আপনাকে কেন শিশুপার্কে আসতে বলেছি জানেন?’ আমি নির্লিপ্ত উত্তর দিলাম, ‘জানি না, তবে দুপুর থেকে জানার জন্য মন উশখুশ করছে।’
-তাহলে জিজ্ঞেস করেননি কেনো?
-ভাবলাম আপনিই বলবেন। জিজ্ঞেস করলেই তো সব রহস্য শেষ।
-আপনি শিশুপার্কে আগেও এসেছেন?
-কতবার, ছোট বেলায় প্রতি বছরই আব্বু আম্মু নিয়ে আসতো।
-আমি কখনো শিশুপার্কে আসিনি। বড় হয়ে অনেক এমিউজমেন্ট পার্কে গেছি, কিন্তু কখনো শিশুপার্কে আসিনি। একজনের সাথে আসার কথা ছিলো, সেই অপেক্ষাতেই এতদিন ছিলাম।
-কার সাথে?
-ভাইয়ার সাথে। বাবা তো মারা গেছে আমি ছোট থাকতেই। মা দিনরাত জায়নামাজেই থাকে৷ স্কুলে আমার বান্ধবীরা গল্প করতো শিশুপার্কের। আমার খুব ইচ্ছা করতো। ভাইয়াকে বললেই বলতো সামনের মাসে। সেই সামনের মাস আর কখনো আসেনি।
-উনি তো সংসারের দায়িত্ব নিয়েছেন ছোট বেলায়, ব্যস্ত ছিলেন আপনাদের জন্যই। তাই হয়ত পারেননি।
-আমাদের জন্য ব্যস্ত থেকেও উনি জানতে পারেননি একটা ইচ্ছা আমি সেই ছোট বেলা থেকে পুষে রেখেছি। তার এই ব্যস্ততা তাহলে আমাদের জন্য হয় কী করে?
-এটা তো আবেগের কথা। সে নিজের পড়াশোনা, রাজনীতি, ব্যবসা, সংসার সব একসাথে চালিয়েছে অভিভাবকের স্থানে বসে। হয়ত ব্যস্ততার ফাঁদে পড়ে বুঝতেই পারেনি আপনার মনে এত অভিমান জমে গেছে।
-আমি ছেলেদের থেকে দূরে থাকি কেনো জানেন?
-এটাও জানার ইচ্ছে, চেপে রেখেছি।
-ছোট বেলা থেকেই ভাইয়া কড়া শাশনে রাখতেন। কোন ছেলেকে আমার আশেপাশে ভিড়তে দিতেন না। ঘরেও ভাইয়া ছাড়া কোন পুরুষ নেই। ভাইয়াকে জমের মত ভয় পেতাম। তাই ছোটবেলা থেকেই পুরুষ মানুষের প্রতি আমার ভয় জন্মে গেছে।
-সেদিন তো ভালোই তর্ক করলেন দেখলাম ভাইয়ের সাথে।
-দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে মানুষ সামনে আগাতে শিখে। শ্যারনের সাথে আমার পরিচয় নেটে।
ও আমাকে শিখিয়েছে পুরুষ ছাড়াও বাঁচা যায়। এর আগেও একবার এসেছিল। আমাদের বাসাতেই ছিলো। শ্যারনের আচরণে ভাবীর কাছে কিছুটা খটকা লাগলে তিনি ভাইয়াকে বলেন। ভাইয়ার ধমক খেয়ে আমি কাঁদতে কাঁদতে বলে দেই। তাই এবার শ্যারন হোটেলে উঠেছিলো। ভাইয়ার কড়া নজরদারির জন্য ওর সাথে দেখাও হয়নি খুব একটা।
-পুরুষভীতি কাটানোর চেষ্টা করেননি?
-বাঘের হিংস্রতা নিয়ে বই, টিভি, মিডিয়া থেকে এত কিছু শোনার পরেও বাঘের সামনে যাবেন?
-কথা ঠিক। ভয় ইজ রাইট। কিন্তু আমার সাথে যে বসে আছেন ভয় করছে না?
নুসরাত আর কোন উত্তর দেয়নি। চুপ করে দূরে তাকিয়ে ছিলো, সেদিক থেকে গানের আওয়াজ আসছে। ওর মুখের অভিব্যক্তি দেখে মনে হচ্ছিলো গান খুব এনজয় করছে। জোছনা এসে পড়েছে নুসরাতের পায়ে। আমি ঘাসের উপরে থাকা নুসরাতের পায়ে চেয়েছিলাম, কী সুন্দর! পরবর্তী এক মাস বেশ ঘুরাফিরা হয়েছে একসাথে। টিএসসির অপরাজিতা চা থেকে শুরু করে বিহারিপট্টির চাপ পর্যন্ত টেস্ট করা হয়ে গেছে। নিউমার্কেটের ফুটপাথ থেকে শুরু করে বিলাসবহুল শপিংমলে কেনাকাটা হয়ে গেছে। লোকাল বাসের ভিড় থেকে নুসরাতের ভাইয়ের ল্যান্ডক্রুজারে করে শহর ঘুরে দেখা হয়ে গেছে।
এই ছিলো নুসরাতের সাথে আমার গত ছয়মাসের টাইমলাইন। অফিসের ব্যস্ততা বেড়েছে, প্রমোশন হয়েছে। ট্রেনিংয়ের জন্য ক্যালিফোর্নিয়া পাঠাবে অফিস থেকে। জায়রার আম্মুকে বলে আসতে হবে ব্যাপারটা। নুসরাতের সাথেও দেখা করতে হবে। বাইরে মেঘ করেছে ভীষণ৷ আকাশ কালো হয়ে আছে। নুসরাতের গিফট করা সাদা শার্টের সাথে একটা নীল জিন্স পরে নিয়েছি। মাথায় কোন ভূত চাপলো কে জানে, রিকশা থামিয়ে খোপার গাজরা কিনে নিলাম। রিকশায় বসেই একবার ভাবলাম কী না কী মনে করে, ফেলে দেই। তারপরে ভাবলাম চলেই তো যাচ্ছি, ইচ্ছেটা তো বহুদিনের, দিয়েই দেখি।
জায়রার আম্মুর সাথে কথা শেষে নুসরাতের কথা জিজ্ঞেস করতেই বললেন ছাদে আছে। সিঁড়ি বেয়ে ছাদে উঠে গেলাম। নুসরাত ছাদের দক্ষিণ-পূর্ব কোণে দাঁড়িয়ে আছে। শাড়ি পরেছে। পেছন থেকে দেখতে ভালো লাগছে, সামনে এখনো দেখিনি। বাতাসে আজও ওর চুল উড়ছে। এই চুল সরানোর বাহানায় আবার কোনদিন মাইর খাই, ভয়ে আমি একহাতে গাজরা ধরে অন্যহাত পকেটে ঢুকিয়ে রাখলাম। কাছাকাছি যেয়ে দাঁড়াতেই সেই পরিচিত শ্যানেলের ঘ্রাণ। হঠাৎ আমাকে পাশে দেখে চমকে উঠে নুসরাত জিজ্ঞেস করলো, ‘আপনি এখন! এই সময়ে?’ দুপুর তখন বারোটা কী একটা হবে। আমি দূরে তাকিয়ে জবাব দিলাম, ‘চলে যাচ্ছি তো, তাই শেষবার দেখা করতে এলাম সবার সাথে।’
-চলে যাচ্ছি মানে? কোথায় চলে যাচ্ছেন?
-প্রমোশন হয়েছে, অফিস থেকে আমেরিকা পাঠাচ্ছে।
-ওহ তাই বলেন। আমি ভাবলাম জটিল রোগ হয়েছে, মরে টরে যাচ্ছেন। তা কতদিনের জন্য যাচ্ছেন?
কথা শুনে রাগ ধরে গেছে। চলে যাচ্ছি, কোথায় একটু ইমোশনাল হবে, তা না। হার্টলেস মেয়ে কোথাকার। ইচ্ছে করছে পশ্চিম দিকে ঘুরে গাজরা ছুড়ে মারি ক্যালিফোর্নিয়ায়। এই মেয়েকে গাজরা দিবে কোন শালা? মনের জেদ মনে চেপে, দূরে তাকিয়ে থাকা অবস্থাতেই গলার স্বর করুণ করে উত্তর দিলাম, ‘দুই বছরের জন্য যাচ্ছি। এরপরে বাড়তেও পারে সময়। এরপরে আর কখনো আপনাদের এখানে মনে হয়না আসা হবে। তাই বলা যায় শেষ দেখাই।’ এবারে নুসরাত আর কথার পিঠে উত্তর দেয়নি। চুপ হয়ে গেছে। চেহারার ভাবভঙ্গিও কিছুটা পরিবর্তন হয়ে গেছে। শাড়িতে প্রথম দেখছি নুসরাতকে। চমৎকার লাগছে। শুধু এই গাজরাটা খোপায় লাগানোই বাকী আছে। যদিও নুসরাতের চুল ছাড়া। আমি নুসরাতের দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘সুন্দর লাগছে শাড়িতে।’
-মাঝে মাঝে আসবেন না?
-দুই বছরের আগে আর আসবো না। ইচ্ছে আছে বাকী জীবন ওখানেই থেকে যাওয়ার৷
-আমাকে মনে পড়বে?
-গাজরাটা আপনার জন্য এনেছিলাম।
নুসরাত সেখানে দাঁড়িয়েই চুল খোপা করে নিয়েছে। আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আয়না ছাড়া আমি ফুল লাগাতে পারবো না, আপনি হেল্প করবেন?’ আমার তো বাকবাকুম। আমি খুবই আন্তরিক হেল্পের সাথে নুসরাতের খোপায় গাজরা পেঁচিয়ে দিলাম। বাতাসের বেগ কিছুটা বেড়েছে। আকাশ কিছুক্ষণ পর পর ডাকছে। যেকোন সময় বৃষ্টি হবে। নুসরাত আমার ঘুরে আমার মুখোমুখি হয়ে বললো, ‘আপনি সেদিন জিজ্ঞেস করেছিলেন না, আপনাকে ভয় পাই কী না?’
-আপনি তো উত্তর দেননি।
-আমি আপনাকে ভয় পাই না।
-কেন? আমাকে পুরুষ মনে হয় না?
-একমাত্র পুরুষ আপনি, যাকে আমার ভয় করে না। প্রথম যেদিন জায়রাকে পড়াচ্ছিলেন, আমি রুমে ঢুকেছিলাম, সেদিন থেকেই আপনাকে ভয় করে না। আপনি বোকা বোকা চোখে তাকিয়ে ছিলেন।
-প্রথম দেখেই প্রেমে পড়েছিলাম তো, তাই।
নুসরাত আরো কিছুটা কাছে এসে বললো, ‘আমি প্রথম দুই সুপ্তাহ পরীক্ষা করে দেখেছি। প্রতিদিন আপনি আসার ও যাওয়ার সময় এমন জায়গায় দাঁড়িয়েছি, যেখান থেকে আপনাকে দেখা যায়। আমি আপনাকে দেখে ভয় পাইনি। বরং আপনাকে দেখার অভ্যেস হয়ে গেছে। আপনার সাথে প্রথমদিন কথা বলেছি, আমি ভয় পাইনি। পরীক্ষা করতে প্রতিদিন আপনার সাথে কথা বলেছি। আমার অভ্যেস হয়ে গেছে আপনার সাথে কথা বলার। কথা না বললে ভালো লাগে না। এক সপ্তাহ আসেননি, আমার দম বন্ধ লেগেছে।
আপনার সাথে প্রথম বাড়ির বাইরে দেখা করেছি, আমি ভয় পাইনি। পরীক্ষা করতে এরপর আরেকদিন, এরপর আরো অনেকদিন, আমি ভয় পাইনি। আমি আপনার সঙ্গ অনুভব করি। আমি আপনাকে ভয় পাই না। চলে যাচ্ছেন যান, কিন্তু আমি কোনদিন আপনাকে ভয় পাবো না। কোন দিন না।’ কথাগুলো বলেই ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করলো নুসরাত। একই সাথে কেঁদে ফেললো আকাশ ঝুম ঝুম করে নেমে এলো বৃষ্টি। বৃষ্টির জল আর কান্নার জল মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে নুসরাতের গালে। আমি নুসরাতের চিবুক তুলে ওর চোখ বরাবর চোখ রেখে জয় গোস্বামীর সেই বই থেকে আবৃত্তি করলাম, “সন্ধেবেলা ঝগড়া হবে, হবে দুই বিছানা আলাদা হপ্তা হপ্তা কথা বন্ধ মধ্যরাতে আচমকা মিলন পাগলী, তোমার সঙ্গে ব্রক্ষ্মচারী জীবন কাটাবো পাগলী, তোমার সঙ্গে আদম ইভ কাটাবো জীবন।”
নুসরাত কান্না বাড়িয়ে জড়িয়ে ধরে আমাকে। আমার তো বাকবাকুম। সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে আমি কখনোই ছাড়িনি। নুসরাতকে জড়িয়ে ধরা অবস্থাতেই খেয়ে বসি চুমো। প্রথম অভিজ্ঞতায় কেঁপে উঠে সে। মনে হয় যেনো ঠোঁটে ঠোঁট রেখে প্রতি সেকেন্ডে কেটে গেছে শত সহস্র বছর। শত সহস্র বছর কাটতে কাটতে যখন আমরা আদম-হাওয়ার সময়ে চলে গেলাম, আর যখন আমরা ওষ্ঠ বন্ধন মুক্ত করলাম, ঠিক তখনি আবিষ্কার করলাম এমপি জাবেদ পাটোয়ারী ছাদে দাঁড়িয়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছেন।
গল্পের বিষয়:
গল্প