অন্য সবকিছুর একটা না একটা ব্যবস্থা হয়ে গেলেও গোল বেধে গেল স্টম্ফটিকটি নিয়ে। লোহার একটি ফ্রেমের ওপর সেটি বসানো। ফ্রেমটিতে খোদাই করা লেখায় বোঝা যায়, প্রায় দুইশ’ বছর পুরনো ওই স্টম্ফটিক। হতে পারে ফ্রেমটি পরে বানানো, লেখাটিও পরে লেখা। কিন্তু স্টম্ফটিকটি নিয়ে যে বর্ণনা, তাতে পাথরখণ্ডটির সময় স্পষ্ট। কালো ফ্রেমে স্টম্ফটিকটি নিয়ে ইংরেজি লেখাটির অনুবাদ মোটামুটি এ রকম :মহামান্য ছোটলাটের পদস্পর্শের সময় তার সম্মানে নৈশভোজে পানীয়র সঙ্গে পরিবেশনের জন্য জেলায় প্রথমবারের মতো ছোট বরফকলে বানানো বরফ টুকরোর প্রতিরূপ হিসেবে সম্মানিত নাগরিকদের জন্য মাননীয় জেলা প্রশাসকের উপহার। নিচে জেলা প্রশাসকের নাম :জি গ্রাহাম।
বাড়িটি ভাঙার আগে জিনিসপত্র যখন একে একে বিক্রি হচ্ছে, কিংবা কেউ কেউ ছোটখাটো কোনো জিনিস ‘এটা আমি নেব’ বলে নিয়ে যাচ্ছে, তখন আব্দুস সাত্তারের ম্যানেজার আমিনুল ইসলাম স্টম্ফটিকটি দাবি করে বসেন।
ম্যানেজারের কথার সঙ্গে চোখের ভাষায় আব্দুস সাত্তার বুঝতে পারেন, আমিনুল যেটা নিতে চাচ্ছে সেটা অমূল্য কিছু। প্রথমে হাতে নিয়ে জিনিসটিকে তার অবশ্য তেমন গুরুত্বপূর্ণ কিছু মনে হয়নি। শুধুই একটা সাদা পাথর। কিন্তু লেখা পড়ে বুঝতে পারেন, এই একটা জিনিস তাকে দুইশ’ বছরের খানদানি মানুষে পরিণত করবে।
খানদান যে তার এখনও একটু কম, এমন না। গত ২০ বছরে তার হাতে অর্থ এসেছে, বিত্ত এসেছে। অর্থবিত্তের সঙ্গে এসেছে ক্ষমতা, আর তার সঙ্গে মানুষের সম্মান। এক সময় তিনি নিজে আমিনুল ইসলামের মতো ম্যানেজার ছিলেন। এখন তার নিজেরই এ রকম ম্যানেজার কয়েক ডজন। আমিনুল তার প্রিয় ম্যানেজারদের একজন, যেমন তিনি নিজে ছিলেন ওয়াজিউদ্দিনের।
‘তুমি এটা চাও ক্যান?’ স্টম্ফটিকটা ঘুরিয়ে দেখতে দেখতে আব্দুস সাত্তার জানতে চান।
আমিনুল ‘লাগবে না’ বলে প্রসঙ্গটা এড়িয়ে যেতে চান। যে কারণে তিনি এটা চান, সেটা তার মালিককে বলা যাবে না। আব্দুস সাত্তারের যেমন রাতে সুন্দরী নারীদের প্রয়োজন, তেমনি তার প্রয়োজন রঙিন পানি। সে কারণেই ব্রিটিশ আমলের ডিসি গ্রাহাম সাহেবের নামাঙ্কিত ওই স্টম্ফটিকটি তিনি নেবেন বলে ভেবে রেখেছিলেন। তারও মনে হয়েছিল, পানীয়র সঙ্গে যুক্ত এই একটা জিনিস তার ইজ্জত-সম্মান অনেক বাড়িয়ে দেবে।
শেষ পর্যন্ত ঠিক হলো, থেকে যাওয়া রূপার জিনিসগুলোর মতো স্টম্ফটিকটিও আব্দুস সাত্তারের বাড়িতে যাবে। প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য বাড়ি তার অনেক। যে বাড়িতে স্ত্রী থাকেন, শুধু ছেলেমেয়েরা মাঝেমধ্যে দেশের বাইরে থেকে এলে যে বাড়িতে উৎসবের বন্যা বয়ে যায়, বাকি সময় আব্দুস সাত্তারের স্ত্রী মিনারা বেগম নিশ্চল চলাফেরা করেন, সেই বাড়ির ড্রয়িংরুমে জায়গা করে নিল ওই সাদা স্থায়ী বরফ টুকরো।
আর সেদিন বড় মসজিদে জুমার নামাজের পর সবাইকে মিষ্টিমুখ করিয়ে বাড়ি ভাঙার কাজ শুরু করে দিয়ে নিজের বাসায় ফিরেও কানের মধ্যে বাড়ি ভাঙার আওয়াজ শুনতে থাকেন আব্দুস সাত্তার। এই আওয়াজ তার খুবই প্রিয়। ভেঙে ভেঙেই যে তার উত্থান; আজকের অবস্থান।
তার জীবনে ভাঙাভাঙির শুরু মিলিটারিরা ক্ষমতায় আসার পর। তখন তিনি ওয়াজিউদ্দিনের কোম্পানির সাইট ম্যানেজার। একদিন এক অফিসার ডেকে পাঠালেন তাকে। চারদিকে তখন দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযানের খবর। আজ এই সাবেক মন্ত্রী গ্রেফতার তো পরদিন বিরোধী দলের সাবেক কোনো এমপি। রাজনীতিকরা অনেকেই তখন দেশছাড়া। ওয়াজিউদ্দিনের নির্দেশে একজনকে নিজে সীমান্ত পার করিয়ে দিয়ে এসেছেন আব্দুস সাত্তার। তাকে যে এ জন্যই ডাকা হয়েছে এবং এর পর রিমান্ডে নিয়ে পশ্চাদ্দেশ দিয়ে ডিম ঢোকানো হবে, সে বিষয়ে তিনি নিশ্চিত। তার পরও না যেয়ে উপায় নেই।
যা থাকে কপালে হবে ভেবে পরদিন সকালে তিনি ওই অফিসারের দপ্তরে হাজির হলেন। সালাম দিয়ে তার টেবিলের সামনে দাঁড়ানোর পর ভাবছিলেন, এই না তিনি তাকে বেঁধে ফেলতে বলেন। কিন্তু তাকে অবাক করে দিয়ে অফিসার বললেন, ‘আপনাকে একটা বিশেষ কাজে ডেকেছি।’
‘জি স্যার।’
‘আপনি জানেন, আমরা অবৈধ সব স্থাপনা ভেঙে ফেলছি।’
‘জি স্যার।’
‘এগুলো আপনাকে ভাংতে হবে।’
‘স্যার, আমাদের কোম্পানি আছে।’
‘কোম্পানি আছে জানি। কিন্তু অত ফর্মালিটির সময় নেই। লোকজন ঠিক করেন, শনিবার থেকে কাজ শুরু।’
আব্দুস সাত্তার বুঝতে পারেন, লক্ষ্মী এসে তার পায়ে ধরা দিয়েছে। জীবনে সুযোগ বারবার আসে না। এই একবার আসা সুযোগেই জীবনটাকে বদলে ফেলতে হবে।
পরদিন ওয়াজিউদ্দিনের অফিসে গিয়ে তিনি চাকরিটা ছেড়ে দেন। সব শুনে ওয়াজিউদ্দিন বুঝতে পারেন, তার বাবার জীবনে পাকিস্তান আমলে যে ঘটনা ঘটেছিল, সেটাই এখন আব্দুস সাত্তারের জীবনে ঘটতে চলেছে। পার্থক্য একটাই, ওই আমলে বিশাল জমি-জিরেত থেকে ব্যবসায় এসেছিলেন ওয়াজিউদ্দিনের পিতা ওয়াহিদউদ্দিন; আর আব্দুস সাত্তার শুরু করতে পারছেন শূন্য থেকে। নিজের ব্যবসার একটু ক্ষতি হবে বুঝলেও আব্দুস সাত্তারের উত্থানের সম্ভাবনায় ওয়াজিউদ্দিন খুশিই হন। নতুন দেশ নতুন একটা শ্রেণির জন্য সম্ভাবনা খুলে দিচ্ছে। এটাও তিনি বুঝতে পারছেন, নতুন অফিসারদের সঙ্গে পুরনোদের লেনদেনে পোষাবে না। তাই তারা নতুনদের বেছে নিচ্ছে। তবে, তাকে কিছু ভাংতে হচ্ছে না বলে মনে মনে খুশিও থাকেন।
ওঠার আগে ওয়াজিউদ্দিনকে কদমবুসি করেন আব্দুস সাত্তার। সেখান থেকে বের হয়ে পথে নেমে নতুন এক জীবন শুরু হয় তার। শনিবার শুরু হয় ভাঙাভাঙির কাজ।
অন্যদের জন্য ভাঙাভাঙির শনি আর আব্দুস সাত্তারের জন্য লক্ষ্মী অবশ্য খুব বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। কিন্তু এর মধ্যেই নিজেকে অনেকটা গুছিয়ে নিয়েছেন আব্দুস সাত্তার। যারা কাজ করান তাদের সঙ্গে সখ্যও গড়ে উঠেছে তার। ভাঙাভাঙির বিপরীতে এখন তার নির্মাণের অনেক কাজ। এত এত কাজ যে, আজ শুরু হওয়া হীরা কনডোমিনিয়াম, যার নাম তিনি তার দাদি হীরামতির নামে দিয়েছেন, সেই কাজকে অনেক ছোটই বলতে হয়। প্রজেক্ট ছোট হলেও বড় মুনাফার আশা করছেন আব্দুস সাত্তার। এখানে জমির জন্য টাকা বিবেচনায় তেমন কোনো বিনিয়োগই করতে হয়নি বলা যায়। তবে, ঝঞ্ঝাট পোহাতে হয়েছে অনেক।
ঝঞ্ঝাট পুরোটা মিটে গেছে কি-না বুঝতে তিনি ম্যানেজার আমিনুল ইসলামকে ডেকে পাঠান। গলাটা একটু নামিয়ে বলেন, ‘লাহিড়ী বাবুদের খবর কী?’
‘স্যার, তারা সীমান্ত পার হয়ে গেছে।’
‘আলহামদুলিল্লাহ।’
আব্দুস সাত্তার এমনভাবে আলহামদুলিল্লাহ বলেন, যেন তিনি আমিনুলের কাছেই প্রথম খবরটা পেলেন। যেন গোপন খবর নেওয়ার জন্য আমিনুল ইসলামই তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সোর্স। তার চাল সব সময় এ রকমই থাকে। সবাই ভাবে, তিনিই আব্দুস সাত্তারের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মানুষ। এ বিষয়টা তিনি রাজনীতিতে এসে শিখেছেন। রাজনীতিতে নামার তার যে খুব ইচ্ছে ছিল, এমন না। কিন্তু পরিস্থিতি তাকে রাজনীতিতে টেনে এনেছে।
ভাঙাভাঙি পর্ব শেষে তখন তিনি সরকারি নানা প্রতিষ্ঠান নির্মাণের কাজ করছেন। নানা জায়গায় সম্পর্কের কারণে একের পর এক কাজে ফুলে-ফেঁপে উঠছেন তিনি। কিন্তু মধুচন্দ্রিমা বেশি দিন স্থায়ী হলো না। কন্ট্রাক্টরিতে যখন প্রতিদ্বন্দ্বীর সংখ্যা বাড়তে থাকল, তখন শুধু টাকা-পয়সা দিয়েই কাজ পাওয়া যাচ্ছিল না। বিশেষ করে দরপত্র জমা দিতেই হুজ্জোত পোহাতে হচ্ছিল অনেক। এ জন্য যেমন টাকা-পয়সা খরচের বিষয় ছিল, তেমনি ছিল কাজ করার সময় নতুন গজিয়ে ওঠা মাস্তানদের ম্যানেজ করা। প্রথমদিকে দলকে টাকা দিয়ে ম্যানেজ করতে হচ্ছিল সব। পাশাপাশি দলের নানা সভা-সমাবেশের জন্য চাঁদার বিষয় তো ছিলই। আব্দুস সাত্তারের এক সময় মনে হতে লাগল, দল যেহেতু এক রকম তার টাকাতেই চলছে, আবার কাজ-কর্মেও টাকা দিতে হচ্ছে; তাহলে দল পরিচালনায় তিনি কেন থাকবেন না!
আব্দুস সাত্তার জানতেন, সরাসরি রাজনীতিতে ঢুকে পড়া তার জন্য এত সহজ হবে না। জেলার নেতারা তাকে দলে নিয়ে খাল কেটে কুমির আনবেন কেন! তিনি তাই একদিকে কেন্দ্রে টাকা ঢালতে শুরু করলেন, অন্যদিকে শহরের ক্যাডার নেতা আলাউদ্দিনের পেছনেও খরচ করতে লাগলেন দেদার। ফল হাতেনাতে। নির্বাচনের আগে যখন দলে যোগদানের হিড়িক, তখন সুযোগ বুঝে একদিন তিনিও ভাড়া করা কয়েকশ’ কর্মী বাহিনী নিয়ে নাম লিখিয়ে ফেললেন দলে।
এর পরও অবশ্য তার জন্য কিছুই নিজ থেকে এসে ধরা দেয়নি। দল যেহেতু অনেক পুরনো, তাই নেতৃত্বে জায়গা পাওয়া সহজ নয়। তিনি তাই ভিন্ন পথ ধরলেন। আবারও কেন্দ্রে টাকা ঢেলে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে মনোনয়ন নিলেন শহর চেয়ারম্যান পদে। দলের মার্কার সঙ্গে টাকা আর মাস্তানদের দাপটে তার নির্বাচিত হতে কোনো বেগই পেতে হলো না। সেই থেকে তিনি জেলার সবচেয়ে বড় ব্যবসায়ী পরিচয়ের পাশাপাশি শহরের চেয়ারম্যান। তার এ উত্থানে অবশ্য আলাউদ্দিনকে ছেঁটে ফেলতে হয়েছে। এ নিয়ে মাঝেমধ্যে মনটা খুব আনচান করে। আহারে! ছেলেটা কেন যে তাকে চ্যালেঞ্জ জানাতে গেল! তাকে গায়েব করে ফেলা ছাড়া আব্দুস সাত্তারের সামনে আর কোনো পথ খোলা ছিল না। তারপরও আলাউদ্দিনের জন্য তার মনটা সময় সময় কেঁদে ওঠে। নিজেকে অপরাধী মনে হয়। পরমুহূর্তেই আবার গা-ঝাড়া দিয়ে ওঠেন। রাজনীতি, ক্ষমতা, ব্যবসায় ভাবালুতার কোনো জায়গা নেই। এখানে টিকে থাকাই সবচেয়ে বড় কথা। টিকে থাকার জন্য আলাউদ্দিনের জায়গায় তিনি নিয়ে এসেছেন আলাউদ্দিনেরই চাচাতো ভাই মইনউদ্দিনকে।
মইনউদ্দিন তার যোগ্যতা আবার দেখিয়েছে। এখন আমিনুল ইসলাম বের হয়ে যাওয়ার পর মইনউদ্দিনকে ডেকে পাঠান তিনি।
‘লিডার…’ প্রায় ঝড়ের বেগেই ঢোকেন মইনউদ্দিন।
‘বসো, বসো।’
‘জি লিডার।’
‘লাহিড়ী বাবুদের কারও ওপর হাত ওঠাতে হয়নি তো?’
‘ওই রকম কিছু না’- মইনউদ্দিন তার কণ্ঠে একটু রহস্য ধরে রাখেন।
আব্দুস সাত্তার এ রহস্যকে উপভোগই করেন। কারণ কীভাবে কী ঘটেছে তার পুরোটাই তিনি খবর রেখেছেন। মইনউদ্দিনকে তিনি পাঠিয়েছিলেন কফিনে শেষ পেরেকটা মারার জন্য। সেখানে কী ঘটেছে তার সবটা জানিয়েছেন মইনউদ্দিনের ডানহাত হিসেবে পরিচিত কফিল। এর আগের কাজটা করে দিয়েছেন সুবীর বাবু। তার নিজেকেও জড়াতে হয়েছিল অনেকটা।
আব্দুস সাত্তার চাইছিলেন জমির জন্য বিনিয়োগ করতে হবে না, এমন কিছু প্রকল্পে যেতে। এমন জায়গা খুঁজছিলেন যেখানে অ্যাপার্টমেন্ট করলে জমির মালিককে মোট ফ্ল্যাটের অর্ধেক বা জমির কোনো দাম দিতে হবে না। দিলেও বড়জোর একটা ফ্ল্যাট কিংবা অল্প কিছু টাকা। ভূমি অফিসের সবচেয়ে বয়সী দালাল সুবীর বাবুকে এ জন্য অগ্রিম টাকা দিয়ে নামিয়ে দেন তিনি। কয়েক দিনের মধ্যেই পাকা খবর নিয়ে হাজির সুবীর বাবু।
‘স্যার, লাহিড়ী হাউস চেনেন?’
‘বিষ্ণুপুর রোডে?’
‘স্যার, ঠিক। লাহিড়ী হাউসের অর্ধেক মালিক ইন্ডিয়ায়। এখানে যারা আছে তাদের সঙ্গে বনিবনা নেই।’
‘ইন্ডিয়ায় যারা তাদের ঠিকানা আছে?’
‘আছে স্যার। তবে ওরা পশ্চিমবঙ্গে থাকে না। ইউপিতে থাকে।’
সুবীর বাবুর কথায় আব্দুস সাত্তার মুহূর্তেই কর্মপরিকল্পনা ঠিক করে ফেলেন। সব ঠিকঠাক হওয়ার পর এক রাতে কাগজপত্র নিয়ে লাহিড়ী হাউসে উপস্থিত হন সুবীর বাবু। যাদব লাহিড়ীকে সব খুলে বলেন তিনি। বাড়ির অর্ধেক অংশের জন্য আব্দুস সাত্তার যে সামান্য টাকা দিতে চাচ্ছেন, তাতেই রাজি হয়ে যেতে বলেন। এর আগে ব্যবসা হারানো, এমনকি বাজারের দোকানটাও হারানো যাদব লাহিড়ী জানতে চান- সুবীর বাবু, কেন এসবে জড়িয়েছেন?
‘জলে নেমে কুমিরের সঙ্গে লড়াই করা যায় না, দাদা।’
যাদব লাহিড়ী একবার ভাবেন, তিনি এক ইঞ্চি মাটিও ছাড়বেন না। আবার গত কয়েক বছরে আব্দুস সাত্তারের যে উত্থান, তাতে তিনি না যাওয়ার সাহসও পান না।
‘চলে যাব সুবীর! এখানে যে অর্থবিত্তে খুব ভালো আছি, এমন না। ওইখানেও হয়তো ভালো থাকব না। কিন্তু দেশ ছেড়ে যেতে কষ্ট হয়।’
যাদব বাবুর কথায় সুবীর বাবুরও কান্না পায়। কিন্তু লোভে আর ভয়ে পরদিন সকালে আব্দুস সাত্তারকে জানান, ‘লাহিড়ীরা চলে যাবে।’
‘যে টাকা দেব, তাতেই রাজি?’
‘জি স্যার।’
আব্দুস সাত্তারের নিজেরই একটু বিস্ময় লাগে। মনে মনে তিনি ভাবেন, নিজ থেকেই তিনি টাকাটা না হয় বাড়িয়ে দেবেন।
কিন্তু রাতে সুবীর বাবু লাহিড়ীদের সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের কথা জানালে তার মাথায় রক্ত উঠে যায়। নিজেই গাড়ি চালিয়ে চলে যান বিষ্ণুপুর রোডের লাহিড়ী হাউসে। তার হাঁকডাকে যাদব লাহিড়ী বেরিয়ে আসেন। আব্দুস সাত্তারকে একদম পাত্তা না দিয়ে বলেন, ‘আমরা যাব না।’
‘অর্ধেক জমির মালিক অলরেডি আমি।’
‘সেটা আপনার কারসাজি।’
‘সাজি যাই হোক, জমির মালিক আমি। এখানে কনডোমিনিয়াম উঠবে।’
‘অর্ধেকে উঠান।’
‘না, আমার পুরোটাই চাই।’
‘হবে না।’
‘মালাউনের বাচ্চা, তুই তো শ্মশানে এক পা দিয়েই রেখেছিস। নিজের কথা না ভাবলেও চলবে। তোর নাতি-নাতনিদের কথা ভাব।’
পরদিন সুবীর বাবু জানান, লাহিড়ীরা বাড়ি ছাড়তে রাজি হয়েছে।
কয়েক দিনের মধ্যে সবকিছু ঠিকঠাক হয়ে যাওয়ার পরও লাহিড়ীরা বাড়ি ছাড়ার আগের রাতে মইনউদ্দিনকে একবার সেখানে পাঠিয়েছিলেন যদি যাদব লাহিড়ী আবার উল্টোসিধে কোনো সিদ্ধান্ত নিয়ে বসেন! মইনউদ্দিনকে সেখানে যেতে বলার সময় আব্দুস সাত্তারের সামনে ছিলেন সুবীর বাবু। ক্যাডার জাতীয় লোকজন সেখানে গেলে লাহিড়ী বাড়ির মানুষ অযথা ভয় পেতে পারে ভেবে আব্দুস সাত্তারকে নিরুৎসাহিত করার চেষ্টা করেন তিনি।
‘আর দরকার নেই স্যার।’
‘কোনটা দরকার নেই?’
‘ওই যে লাহিড়ী হাউসে আর কাউকে পাঠানো।’
‘শোনো সুবীর, মুসলমানের ইমান এক, জবানও এক। মালাউনদের জবানের কোনো ঠিক নেই।’
নিজের ভেতরটা দুমড়ে-মুচড়ে গেলেও মুখে হাসি রেখে সুবীর বাবু বলেন, আমি তো আমার কথা রেখেছি। আপনার কাজ করে দিয়েছি।
সুবীর বাবুর কথাটা আব্দুস সাত্তারের কাছে যেন কেমন ঠেকে! তিনি বলেন, তুমি তো আমাদের লোক।
‘তা ঠিক।’
আজ কাজ শুরুর সময় সুবীর বাবুকে খোঁজ করেছিলেন আব্দুস সাত্তার। প্রথম মিষ্টিটা তার মুখেই দিতে চেয়েছিলেন। কে একজন তখন বলল, সুবীর বাবুও লাহিড়ীদের সঙ্গে চলে গেছেন।
বিষয়টার সত্যাসত্য জানতে এই বিকেলে আরেকবার ম্যানেজার আমিনুলকে ডেকে পাঠান তিনি। লাহিড়ীদের চলে যাওয়ার খবর নিশ্চিত করে আমিনুল বলেন, ‘লাহিড়ী হাউসে যে কেয়ারটেকার রমজান, সে কয়েক পুরুষ ধরে ওইখানে কাজ করে।’
‘হুম।’
‘সে ওইখানেই থাকতে চায়। মানে হঠাৎ কোথায় গিয়ে কী কাজ করবে! আমাদের তো লোক লাগবেই।’
আব্দুস সাত্তারকে একটু ভাবতে হয়। সুই অনেক সময় ফাল হয়ে বের হয়। তার পরও কী মনে করে তিনি রমজানকে কেয়ারটেকার হিসেবে রেখে দিতে বলেন।
বিষয়টা আমিনুলের জন্য খুবই সুখকর। কারণ রমজানের সঙ্গে তার খায়-খাতির অনেক দিনের। গ্লাসের আড্ডায় একাধিকবার দেখা হয়েছে। দুই বছর ধরে তাদের খানাপিনার মধ্যেই উঠতে লাগল হীরা কনডোমিনিয়াম। আমিনুল এ প্রজেক্টের ম্যানেজার হয়ে নিজেকে ভাগ্যবান মনে করেন। অন্য কয়েকটা প্রজেক্টে খুন-খারাবির মতো ঘটনা ঘটে গেছে। তুলনায় এটা একেবারেই নিষ্পাপ একটা প্রজেক্ট।
ফ্ল্যাটগুলোর চাবি হস্তান্তরের দিন বড় আয়োজন করা হলো। এখানকার ফ্ল্যাট মালিকরা এখন শহরের সবচেয়ে দামি ফ্ল্যাটের মালিক। সবাই গত কয়েক বছরে ফুলে-ফেঁপে ওঠা মানুষ। তাদের পাশাপাশি গণ্যমান্য অনেকে এলেন। আব্দুস সাত্তার সাহেবের দলের লোকেরা তো আছেই; প্রশাসন, পুলিশের লোকজনও এসেছেন কয়েকজন। ব্যাপক আয়োজনের এই দিনটাতে আমিনুল ইসলাম তার ছেলেমেয়েদেরও নিয়ে এসেছেন। নির্মাণ কাজ চলার সময়ও তারা অনেকবার এসেছে। আজ আসার আগে মেয়েটা বলেছিল, ‘মা, যাবে না?’
হীরা কনডোমিনিয়ামে এসে বাচ্চাদের অবশ্য আর মায়ের কথা তেমন একটা মনে থাকে না। তারা লিফট ছাড়াই এক ফ্লোর থেকে অন্য ফ্লোরে উঠছে, ঘুরছে। কারও বাসা যে এমন সুন্দর হতে পারে, সেটা তাদের কল্পনারও বাইরে।
যাবার সময় হয়ে এলে আমিনুল বুঝতে পারেন, আসার সময় মেয়েটি কেন মায়ের কথা বলেছিল। এতদিন বাবাকে এই বাড়ি বানানোর পেছনে থাকতে দেখে মেয়েটি ভেবেছিল, তারাও এখানে থাকবে। যাবার সময় তাড়া দিলে সে জানতে চায়, ‘এটা আমাদের বাড়ি না, বাবা?’
‘না, মা।’
মেয়েটি কিছু বুঝতে পারে কিংবা পারে না। হাত দিয়ে চোখের জল মুছতে মুছতে সে বাবা আর ভাইয়ের সঙ্গে বেরিয়ে আসে। বোনকে কাঁদতে দেখে ভাইটিও ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে। আর তাদের কান্না দেখে আকাশের দিকে তাকিয়ে হাঁটতে থাকেন আমিনুল। বাচ্চাদের রেখে তাকে আবার আব্দুস সাত্তারের কাছে ফিরতে হবে।
আব্দুস সাত্তার তখন ফ্ল্যাট মালিকদের সঙ্গে রসিকতা করতে করতে কোনো একটা কাজে রমজানকে ডাকেন। কয়েক দফা উটকো মাস্তান ঠেকিয়ে দিয়ে ম্যানেজার হওয়ার আশ্বাস পেয়েছেন রমজান। আজই তার ঘোষণা হওয়ার কথা। হয়তো আমিনুল ফিরে এলে আব্দুস সাত্তার সেটা জানিয়ে দেবেন। এ রকম ভাবতে ভাবতেই আব্দুস সাত্তারের ডাকে সাড়া দেওয়ার আগে আমিনুল আর তার বাচ্চাদের চলে যাওয়া দেখে লাহিড়ীদের কথা মনে পড়ে হবু ম্যানেজার রমজানের। সেদিন লাহিড়ীর দুই নাতিও এভাবে কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল। আর আকাশের দিকে তাকিয়ে তাদের পাশে হাঁটছিলেন যাদব লাহিড়ী। সেদিন তখনও সূর্য ওঠেনি, আর আজ সূর্যাস্তকাল।