ভালোবাসা কারে কয়

এই তো সেই বাড়িটা যেখানে সমরেশ মজুমদারের তীর্থভূমির কয়েকজন রাত্রি কাটিয়েছিলেন। এখানে এখন আর এক দল। বিভিন্ন জায়গার, বিভিন্ন বয়সী। ওদের দলের ভেতর আবির সবচাইতে কমবয়সী। সেই এমন একটা কথা বলে। বলে প্রায় আপন মনে- আরে আরে এ যে দেখছি সমরেশ মজুমদারের তীর্থভূমির সেই বাড়িটা। সকলে তাকায় আবিরের দিকে। ওদের ভেতর আর কেউ তীর্থভূমি বইটা পড়েনি। গল্পটা আবিরের ভীষণ পছন্দের একটি গল্প। ও ভুলে যায়নি। আর এই পরিবেশে এসে গল্পটা যেন সমস্ত সৌন্দর্য ও সত্য নিয়ে প্রাণ পায়।

সাহানা আরেফিন ভালোমতো শালটা টেনে শরীর ঢাকেন। তিনি দেশে একটি স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা। বয়স তার বায়ান্ন বছর। তিনি বলেন- এমন একটা বাড়িতে আমরা আটকে পড়ব কে ভেবেছিল। তিনি চারপাশে তাকান। মাথার শালটা নেই। কালো চুল চোখে পড়ে। সাদা নেই। সেগুলো রঙের কারণে কি-না কেউ বুঝতে পারে না। বলেন তিনি- এই শীতে আর তুষারে এমন একটা বাড়িতে …

ঠিক তাই। পাঁচজন মানুষের ছোটখাটো একটা দল দার্জিলিংয়ের একটা পাহাড়ে আটকে পড়লেন। পাঁচজনাই একটা জিপে নির্দিষ্ট জায়গায় পৌঁছাতে চেয়েছিলেন। ওরা পাঁচজন দার্জিলিং দেখতে এসেছেন। শিলিগুড়ির ‘নিরুপমা’ হোটেলের লাউঞ্জে সে কথা জেনেছিলেন তারা। তারপর ঠিক করেন একসঙ্গে দার্জিলিং যাবেন। তারপর যে যার মতো। জিপের ড্রাইভার বললেন- ধস নামছে। এখন আর আমি গাড়ি চালাতে পারব না। অসম্ভব ঘটনা। ওরা ভীত। বলে কী পল্টু নামের এই ড্রাইভার? গাড়িতে তুলবার সময় ওর কি এমন হবে মনে ছিল না? ওরা না হয় বাইরের মানুষ। এখানকার আবহাওয়ার সবটা জানে না। কিন্তু যে দীর্ঘদিন এখানে বাস করছে সেও কি আবহাওয়ার কথা কিছুই বুঝতে পারেনি? ওদের একটু আশ্বস্ত করে ড্রাইভার বলেছিল- একটা বাড়ি আছে। এদিক দিয়ে একটু অন্যপথে গেলে একটা ছোটখাটো বাড়িতে রাত কাটানো যেতে পারে। বাড়িটা প্রায় সবসময় তালা দেওয়াই থাকে। আপনারা যদি বলেন- আমি আজ রাতের মতো আপনাদের ওখানে পৌঁছে দিতে পারি।

তালা দেওয়া বাড়িতে? প্রশ্ন করেছিল সেই দল।

ভাগ্য ভালো হলে গার্ডকে পেয়ে যাবেন। আর ভাগ্য খারাপ হলে সকলে মিলে তালা ভাঙতে হবে। গার্ডটা কখনও থাকে কখনও থাকে না। পরে আপনারা মালিককে যা বলবার বলবেন। এখন আমি নিচেও নামতে পারব না উপরেও যেতে পারব না। কেবল পাশের রাস্তা দিয়ে সেই বাড়িটাতে নিয়ে যেতে পারি। এমন কিছু বলেই ড্রাইভার কারও কোনো কথার অপেক্ষা না করে জিপটাকে পাশের রাস্তায় তুলে দিয়েছিল।

কেমন করে নিয়ে যাবে তুমি ও পল্টু মহারাজ? কেমন করে যাব সকলে একটা তালা দেওয়া বাড়িতে? মিস্টার ত্রিবেদী, যার বয়স বোঝা যায় না তিনি বলেন।

যেমন করে হোক নিয়ে যাব। তবে কেমন করে সেটা পরে শুনবেন। কেমন করে? এমন ঘটনা আগেও দু’একবার ঘটেছে কি-না। ওই বাড়িটাই শেষ পর্যন্ত এমন বিপদে পড়া যাত্রীর আশ্রয়ের জায়গা হয়েছে। ঈশ্বর মহারাজ কখন যে কী করেন।

যখন আমরা জিপ ভাড়া করি তুমি তো বলনি এমন হতে পারে। মিস্টার ত্রিবেদী বোধহয় একটু রেগে গেছেন- আমি জানতাম না। এখানকার আবহাওয়ার কি ঠিক আছে? এখন ড্রাইভ করে উপর দিকে যাওয়ায় বিপদ হতে পারে। আর নিচের দিকে যাওয়া মানে গাধামি। দেখছেন না কী ভীষণ তুফান চারদিকে। পল্টু গাড়ি ঘোরাতে ঘোরাতে জবাব দিয়েছিল।

ওরা ঠিক বুঝতে পারছে না ড্রাইভার কি ইচ্ছে করে এমন একটা কথা বলছে। প্রবল বৃষ্টি চারপাশে। ঝরঝর মরমর শব্দ। শীত তো ছিলই। এখন মনে হয় শীত শরীরের হাড়ের ভেতর চলে যাবে। ওরা কোনো মতে শরীর ঢেকে জড়োসড়ো হয়ে বসেছে।

ওরা বুঝতে পারছে না কী বলবে। জায়গাটা কার্শিয়াং থেকে আরও একটু উপরে। এমন হবে ওরা ভাবেনি। ওরা শীতেই দার্জিলিং দেখতে চায়। মিস্টার ও মিসেস রহমাতুল্লাহ। একজন ষাট, একজন আটান্ন। মিস্টার ত্রিবেদী। বয়স বোঝা যায় না। মিস সাহানা আরেফিন বায়ান্ন-টায়ান্নর একজন। আর আবির করিম চব্বিশ বা পঁচিশ বছরের তরুণ। ওরা সকলে মিলে জিপটা যখন ভাড়া নেয় বুঝতে পারেনি এমন হবে। ওদের আলাপ হয়েছিল হোটেলে। পরে ওরা ঠিক করে একটা জিপে সকলে মিলে দার্জিলিং যাবে। শিলিগুড়ির সেই হোটেলটাতে থাকলেই হতো। এমন অবেলায় রওনা দেওয়াটাই ভুল হয়েছে। আবির করিমের উৎসাহ। পঁচিশ বছরের একটা তরুণের কথায় ওরা কি হিতাহিত জ্ঞান হারিয়েছিল?

এর মধ্যে ড্রাইভ করা ঠিক নয়। বারবার একই কথা বলতে শুরু করেছিল ড্রাইভার। তারপর একটু গম্ভীর হয়ে বলেছিল- আমার ওপর একটু আস্থা রাখতে হবে, উপায় যখন নেই।

তুমি তো একটা সাংঘাতিক লোক। কোনখানে নিয়ে তুলতে চাও আমাদের? উপায়হীনদের ভবনদী পার করানোর ঈশ্বর নাকি তুমি? মিস্টার ত্রিদেবী বলেন ভারি গলায়।

আমি নিজেও জানি না সেখানে আপনারা আজ রাতে থাকতে পারবেন কি পারবেন না। ওখানে থাকতে গেলে আগে থেকে রিজার্ভ করতে হয়। তালা ভাঙবেন, থাকবেন দরকার হলে। তারপর জবাবহিহি করবেন। তবে গার্ডের থাকার কথা। দেখা যাক কী হয়। ও মাঝে মাঝে নিজের বাড়িতে চলে যায়।

তোমার কথা শুনব না। এমন কিছু বলার অবস্থা সত্যিই নয়। মিস্টার ত্রিবেদী চুপ করেন। কাজেই পল্টুর হাতে ভাগ্য তুলে দিয়ে খাঁচার মুরগির মতো ওরা অপেক্ষা করেছিলেন সেই বাড়িটার।

ভাগ্য ভালো। গার্ড ছিল। তবে ওখানে আর এক যুগল আগে থেকেই ছিল। ওরা পাঁচজন সেখানে যখন উপস্থিত সেই যুগল নিজের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে গার্ডকে বলে- আমাদের ঘরে কেউ থাকতে পারবে না। আমরা আগে থেকে রিজার্ভ করে এসেছি। গার্ড বাধ্য হয় অন্য ঘরে ওদের বসাতে। মনে হয় মিস্টার ত্রিবেদী খুব কেউকেটা একজন। গার্ডকে বাইরে ডেকে নিয়ে কী বলতেই সে রাজি হয়। যে ঘরটায় ওরা বসেছে সেটা একটা লিভিংরুম। বলে কেবল- হুজুর আপনি সব সামলাবেন।

সকলে ঢুকে পড়ে বসার বা লিভিংরুমে। ঘরটা বেশ বড়। সেখানে ঘর গরম করবার একটা চুলো আছে। সেই দম্পতি, যারা ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করেছে তারা এতক্ষণ এখানে বসে শরীর গরম করছিল। তারা ওদের সাড়া পেয়েই নিজেদের ঘরে ঢুকে শক্ত হাতে ঘরের ছিটকিনি লাগিয়েছে। ওরা পাঁচজন সেখানে বসে। মিস্টার ত্রিবেদী একটা সিঙ্গেল সোফায়। তিনি হাতের দস্তানা খুলে হাত মেলে ধরেন সামনে। বেশ আরাম লাগছে তার। চারপাশে তুফান। বরফ। ঝড়। তিনি বলেন- এই ঘরেই বোধহয় আমাদের রাত কাটাতে হবে। মনে হয় আর কোনো শোবার ঘর নেই। আবির এবার বাড়িটা দেখবে বলে বাইরে গেছে। ঘরটায় মোমবাতির আলো মোমবাতিদানিতে। বলেন তিনি- এই যে গার্ড, সারারাত যেন চুলো জ্বলে তেমন কাঠকয়লা আছে তো? গার্ড কিছু কাঠকয়লা এনে চুলোটার আঁচ বাড়িয়ে দেয়। আবির করিম একবার অন্ধকারে বাড়িটা দেখে আসে। বাথরুম ও রান্নাঘর দেখে। যদি চা করা যায় তাহলে বেশ হবে। কিন্তু চা বা চিনি নেই। একটা কফির কৌটার তলায় কফি পড়ে আছে। সেটা থেকে পাঁচ কাপ কফি বানিয়ে পাঁচজন পান করতে পারে। বলে আবির- যারা এখানে আগে থেকে আছেন তারা কি না খেয়ে আছেন?

ওরা সঙ্গে খাবার এনেছিলেন। কাল সকালেই চলে যাবেন। আমার কাজ ছিল ওদের কেবল কফি বানিয়ে দেওয়া। আর আমার বাজার শেষ। খালি কয়েকটা ডিম আছে। পাওয়ার কাট। কাজেই মোমবাতিই সম্বল।

পারলে কফি করে আনো। গার্ড মাথা নেড়ে জানায় সে কফি করবে। – পাওয়ার কাট। মোমবাতির আলো জ্বলছে! ভারি রোমান্টিক ব্যাপার। বলে আবির। সকলে বেশ কঠিন চোখে আবিরের দিকে তাকায়। বলেন মিস্টার রহমাতুল্লাহ- তুমি এখন এর ভেতরে রোমান্টিকতা দেখছ? আবির উত্তর দেয় না। গার্ড একটা মোমবাতি নিয়ে চলে যায়। দুটো শোবার ঘর। একটা ঘরে গার্ড থাকে। ভেতরে একটা ছোট বাচ্চার আওয়াজ পেয়েছে আবির। মনে হয় গার্ডের বাচ্চা। আর একটা ঘরে দুই হানিমুন কাপল মোমবাতি আর অন্ধকারে চাঁদতারামধু কিছু না পেয়ে বোধকরি এবার ঘুমিয়ে গেছে। একটা লিভিং রুম। রান্নাঘর আর তার পাশে একটা ছোট ভাঁড়ার ঘর। বলে আবির- বাড়িটা কার?

শেখর বাবুর। তিনি বছরে দু-একবার আসেন। এমনিতে পড়েই থাকে হুজুর।

পল্টু বাড়িটাতে কি আগে এসেছে? প্রশ্ন করেন মিসেস রাহমাতুল্লাহ। গার্ড উত্তর দেয়-

কয়েকবার। আমার বউ আর ও একই গ্রামের মেয়ে হুজুর।

আবির বাড়িটা, মানুষজন, বাড়ির মালিকের খোঁজ নিয়ে ফিরে এসেছে। বলেন মিস্টার আর মিসেস রহমাতুল্লাহ জিপের লাগেজের একটা ব্যাগে বিস্কুট-কলা আছে। কিন্তু জিপের কাছে কারও যাওয়ার ইচ্ছা নেই। ওটা ত্রিপল ঢেকে চুপচাপ পড়ে আছে। চারপাশে বরফ। পড়ছে, জমছে। কাল কি ওরা সেই পথ ধরে যেতে পারবে? পল্টু বলে পারব। কাল সকালে সূর্য উঠবে। দার্জিলিং খুব বেশি দূরে নেই।

কাল সকালে কী হবে সেটা সকালের হাতে রেখে দেওয়াই ভালো। এখন রাতটা কাটানো যাক। ঘড়ি দেখে জানে রাত মাত্র দশটা। সকাল হতে অনেক দেরি। আলো নেই বই পড়বার মতো। হাতব্যাগে একটা গল্পের বই আছে, সাহানা আরেফিন সেটা পড়তে পারবে না। ত্রিবেদীও নয়। মিস্টার ও মিসেস রহমাতুল্লাহর ব্যাগে নানা ওষুধ। বই নেই। আবির করিমের ক্যামেরা। লেখার কাগজ। বই সঙ্গে হাতে নেই তবে ব্যাগে আছে। ও বসে। হাত গরম করে। – কিছু পেলেন রাত কাটানোর মতো?

কী পাব? এখানে পাওয়ার মতো কিছু আছে? সাহানা আরেফিন জানান। ঘণ্টা খানেক সবাই বসে থাকে প্রায় চুপচাপ। এর ওর সঙ্গে আলাপ, নাম জানা, সে তো হোটেলেই হয়েছে। কয়েকটা কম্বল উদ্ধার করা হয় রান্নার পাশের ঘরটা থেকে। অন্ধকার। ময়লা না পরিস্কার বোঝা যায় না, তাইতেই রক্ষা। পায়ের পাতা ঢাকার মতো ছোট কম্বল। মেঝেতে একটা চটের কার্পেট বিছানো। শেখরবাবু কেন একটা সুন্দর দামি কার্পেট লাগাননি সেটা ওরা ভাবতে থাকে। জানা গেল শেখর বাবু একজন সংসারহীন সন্ন্যাসী জাতীয় মানুষ। এখানে আসেন নাকি ধ্যান করতে। কলকাতায় সমাজসেবা, এটা সেটা করেন। কেন গৃহী নন সেটা গার্ড কী করে বলবে। ধ্যানের জন্য বড় বাড়ির দরকার কী? গুহা হলেও চলে। তবে তিনি গুহাবাসী নন। এখানে আসেন, ধ্যান করেন, ঈশ্বর নিয়ে ভাবনা করেন তারপর চলে যান।

চলুন আমরা একটা করে গল্প করি। জীবনের গল্প। প্রেমের গল্প। আবির করিম দলটাকে চাঙ্গা করতে এমন একটা প্রস্তাব করে। সকলে প্রথমে একটু গম্ভীর হয়ে থাকলে পরে হাসে। বলেন ত্রিবেদী- আপনিই আগে শুরু করুন। আপনার বয়স কম। নিশ্চয় অনেক প্রেমের গল্প আপনার জানা।

তা তো আছেই। তবে আমি অনুরোধ করব মিস্টার ও মিসেস রহমাতুল্লাহকে, ওরা আগে বলুক। কে বলবেন? মিস্টার না মিসেস?

আমরা আগে শুরু করব? কারণ কী?

তেমন কোনো কারণ নেই। তবে আপনাদের যুগলকে দেখে মনে হয় আপনারা প্রেমের গল্প জানেন।

তুমি বল। মিসেস রহমাতুল্লাহ স্বামীকে বলেন। সকলে পায়ের কম্বল, চুলোর আঁচ উসকে ভালো হয়ে বসে। গার্ডের বাড়িতে যে কটা ডিম ছিল তা শেষ। ওর বউ ডিম ভেজে দিয়েছে। বলেছে গার্ড- আর কিছু নেই। কাল বাজার। তারপর খাওয়া। পল্টুর দেখা নেই। বোধকরি গার্ডের ঘরে ঢুকেছে।

প্রেম একটা শক্তিশালী ব্যাপার। এত শক্তি রাখে পৃথিবীটাকেই বদলে দিতে পারে। ধরুন হিটলারের ঘৃণা যদি প্রেম হতো তাহলে কী হতো? সমস্ত পৃথিবীর চেহারা বদলে যেত না? বেশ একটু ভূমিকা শুরু করেন তিনি। ওরা বসে আছে গল্পের অপেক্ষায়। এই যে আমি আর মিমি দীর্ঘদিন প্রেম করেছি। ওর বাবা-মা রাজি নন, আমার বাবা-মাও নয়। কারণ মিমিদের পদমর্যাদা বংশমর্যাদা আমাদের চেয়ে উঁচুতে। আমার বাবা লোকজনের ফরমাশ মতো কাঠের জিনিস বানান। ভাগ্যক্রমে আমি পড়াশোনায় ভালো। আমার বাবা-মায়ের আপত্তি এত বড়ঘরের মেয়ে তাদের সংসারে রবীন্দ্রনাথের সেই গানের মতো বেমানান হবে- এই মনিহার আমায় নাহি সাজে। বিয়ে করব আমি মাথা ব্যথা তাদের। আর ওর মা-বাবা বিয়াই-বেয়ানকে জাতে তুলতে পারবেন না সেটা তাদের মাথাব্যথা। বড় বড় পার্টিতে একমাত্র মেয়ের শ্বশুর-শাশুড়ি আসতে পারবেন না, বিয়ের কার্ডে কোনো ভালো লোকের নাম লেখা যাবে না, এইসব ভাবনায় একেবারেই অনড় তারা। তিনি একটু চুপ করেন। মিসেস রহমাতুল্লাহ বা মিমি একটু হাসিমুখে স্বামীকে দেখছেন। বয়সিনী মহিলার কেমন আদুরে নাম। বোঝা যায় এককালে তিনি দেখতে ভালো ছিলেন। যখন প্রেমের গল্প শুরু হয় ওর মুখে মোমের আলোর মতো এক ধরনের আলো তাকে নতুন এক ফাউন্ডেশন ক্রিম-ঘষা মুখের মতো লাবণ্যময়ী করে তুলছে। তারপর কী হলো? সাহানা আরেফিনের গলা। মনে হয় তার গলার স্বরটাও বদলে গেছে। এ গলা ছাত্রশাসন করবার গলা নয়। যখন প্রেমের গল্প, গলা এমন করে নতুন হয়ে যায়। মিসেস রহমাতুল্লাহ এবার আপনি বলুন।

না, ওই বলুক। ও খুব ভালো গল্প বলতে পারে।

এরপর কী করা যায়? আমি বিদেশে যাবার একটা স্কলারশিপ পেয়ে গেলাম। ও তখন কেবল এমএ পাস করেছে। বললাম, তুমিও একটা স্কলারশিপ সংগ্রহ কর মিমি। আমরা বিদেশে বিয়েটা সেরে ফেলব।

ও সেটা পারেনি। যখন ফিরে এসেছি ও চাকরি করছে চট্টগ্রামে। আমার বাবা মারা গেছেন করাত কলে পড়ে। আমি একটা ভালো চাকরি করছি। ছুতোরের ছেলের গায়ের গন্ধটা তখন বিদেশি সাবানে, আফটার শেভে, আর আমার নামের শেষের কান্টাবের কারণে অনেকটা জাতে উঠেছে। কাজেই বিয়ে হলো।

গল্পটায় তেমন সাসপেন্স নেই, একেবারে নতুন লেখকের প্রেমের গল্পের মতো। দেন দে লিভ হ্যাপিলি এভার আফটার, ব্যস, গল্প শেষ। বলে আবির করিম। মিস্টার রহমাতুল্লাহ বলেন- নট কোয়ায়েট। একটা পা বের করেন। তার একটা পা নেই। সেখানে নকল পা। বলেন- কাটা পড়েছে। মারা যাইনি। ওই এখন আমাকে দেখাশোনা করে। প্রেম না থাকলে এসব মানত কেউ? এক বছর হাসপাতালে। তারপর বাড়িতে ফিরে আসি।

কেউ কি আর মানত বলছেন? তা মানত। কত দাম্পত্যজীবন দেখেছি একজন আর একজনকে মেনে নেয়। সেখানে প্রেম আছে কি নেই, কে জানে। বলেন ত্রিবেদী। কেউ বিছানায় পড়ে আছে দীর্ঘদিন, কারও শরীর অবশ, কারও মাথাটা আগের মতো কাজ করে না, কেউ নেশাভাঙে বিবশ, তারপরও একজন আর একজনকে মেনে নেয়। এখন বলুন আপনি বলতে চান এটাই আপনাদের প্রেমের শ্রেষ্ঠ ব্যাপার? যখন আপনি পা হারালেন, ধারণা করছি চাকরিও হারালেন, ও আপনাকে দেখছে এবং ভালোবাসছে?

রহমাতুল্লাহ হাসছেন। তার পা দুটো আবার কম্বলের নিচে চাপা পড়েছে। একটা আসল আর একটা নকল পা। বলেন- এটা একটা বড় ঘটনা। কিন্তু সে ঘটনাকে আমরা প্রেমের সর্বশ্রেষ্ঠ ঘটনা বলে মনে করি না। আমরা মনে করি তিন বছরে আমরা দু’জনে দু’জনকে যতগুলো চিঠি লিখেছি, সেটাই আমাদের জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ ফসল। প্রতি সপ্তাহে একটা। ও একটা আমি একটা। অপূর্ব সেসব লেখা। ভাবতে পারিনি কোনোদিন এমন লেখা আমরা লিখতে পারব- প্রেমে, বেদনায়, আনন্দে, দুঃখে, বিষাদে, একাকীত্বে, সন্তাপে, শোকে, শ্নোকে, বর্ষণে, শ্রাবণে, শীতে আর রোদে, গানে আর তানে, গদ্যে আর পদ্যে, লিরিকে আর মহাকাব্যে, সেসব তুলনাহীন।

হাততালি পড়ে।

বুঝলাম। বলেন সাহানা আরেফিন। – কেবল সেসব মনে করে যিনি এমন একটা বড় বাক্য অবলীলাক্রমে বলে ফেলতে পারেন তার আর প্রেমিকার সেসব চিঠি যে কতটা মনোরম, হৃদয়গ্রাহী, ভাষার কারুকার্যে অসামান্য তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। চিঠির কথা বলতেই আপনাদের দু’জনের মুখ কেমন উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল, মোমবাতির অল্প আলোতেও সেসব বোঝা গেছে। এমন সব চিঠি। বই করে ছাপান না কেন?

কী যে বলেন। ওসব আমাদের বিবাহিত জীবনের বন্ধ্যাজমির ফসল। আমাদের কোনো সন্তান নেই। আমরা দু’জন কোনো কোনো দিন বারবার ওগুলো পড়ি। ওরটা আমি, আমারটা ও, না হলে ভাসাইভার্সা। আরও বেশি ভালোবাসি দু’জন দু’জনকে তখন। ওই চিঠিগুলোর কাছে আমরা কৃতজ্ঞ।

মিস্টার আর মিসেস রহমাতুল্লাহ সোফায় আরও কাছাকাছি আসেন। মিসেস রহমাতুল্লাহর মাথা স্বামীর কাঁধে। তার দুই চোখে হাসি নয় কোমল শিশির টলটল। মিস্টার রাহমাতুল্লাহর একটি হাত স্ত্রীর শরীর একটু আদর করে।

ত্রিবেদী তার গল্পটা বড় করে বলতে পারেন না। বোঝা যায় একজনকে ভালোবেসেছিলেন গভীর করে। তাকে পাননি। বিয়ে করেছেন। তিন জন সন্তান। পড়াশোনা করছে দু’জন, একজন চাকরি শুরু করেছে। এখন সেইসব প্রেমট্রেম বোধকরি মনে করেন না। বড় সরকারি চাকরি করেন। আগামী বছর রিটায়ার করবেন। এখানেই কোথাও থাকবেন। তার ও স্ত্রীর এমন ইচ্ছা। একটা বাড়ি দেখতে এসেছেন। আসল বাড়ি জলপাইগুড়িতে। শেষজীবনের দিনগুলো কাটাবেন বলে। বলেন- ওকে আর মনে করি না। বলেই হাসেন।

একেবারেই মনে করেন না? আবির করিম প্রশ্ন করেন।

একেকদিন মনে হয়। বলুন তো কখন?

কখন? যখন বৃষ্টি পড়ে, ফুলবাগান দেখেন, না হলে কোনো চমৎকার নিসর্গে ভাবেন জীবনের এতকিছুর ভেতরে কেন একটা মুখ বারবার ভেসে ওঠে, যার কোনো অর্থ করতে পারেন না, একটা অপূর্ব বেদনা, যা পান করতে দুঃখ ও আনন্দ। যখন নিঃসঙ্গ। এবং যখন অপ্রিয় সঙ্গ। আবির বলে- নট কোয়ায়েট ইয়ংম্যান। তিনি ভাবছেন। ভাবছেন। অনেকক্ষণ কথা বলেন না। বলেন সাহানা – তাহলে কখন?

আমাদের পাশের বাড়িতে যে মেয়েটা এসেছে কয়েক বছর হলো ইঞ্জিনিয়ার স্বামীর ঘর করতে ওকে দেখলে। একেবারে মায়ের মুখটা বসানো কি-না। লীলার গানের গলাটাও মায়ের মতো। ওর মা আর নেই। মায়াকে আমি লীলাবতী বলে ডাকতাম। মায়া অঙ্কে খুব ভালো ছিল। বলতাম- তুমি আমার লীলাবতী।

মেয়েটার নাম কী?

দূর্বা।

এই বলেই ত্রিবেদী চোখ বন্ধ করেছেন। দীর্ঘ প্রেমের গল্প তিনি করতে পারেন না। মোমবাতি আর কতক্ষণ জ্বলবে কে জানে। গার্ড বলেছে আর মোমবাতি নেই। আলোটা ছোট হয়ে আসছে। রাত গভীর। সকাল হতে এখনও অনেক দেরি।

এরপর যখন ত্রিবেদী আবার এই পৃথিবীতে ফিরে আসেন। আবির করিমের দিকে তাকিয়ে বলেন- ইয়ংম্যান, তোমার কাছে একটা রক্তমাংসের প্রেমের গল্প আশা করছি। আমাদের মতো নিরামিষ গল্প নয়। কখন যে সম্বোধন তুমি হয়ে গেছে বুঝতে পারেন না।

আবির করিম মুখ নিচু করে। আলোটা কমে আসছে। দেয়ালে ছবির মতো ওদের ছায়া। বলেন আবির- আমার গল্পটা একতরফা প্রেমের। রক্তমাংসের কারবার নেই।

দূর, এমন গল্প তুমি করবে? রহমাতুল্লাহ বলেন।

তাই তো করতে হবে। আপনার মতো চিঠি লেখালেখির পর্বও নেই। একেবারে ছবির দিকে তাকিয়ে ভালোবাসার মতো ঘটনা।

নায়িকা কি কোনো দেশি-বিদেশি ছবির নায়িকা। কোনো গ্লামারাস অভিনেত্রী? কোনো অপূর্ব শরীর আর মুখ?

না। একেবারেই মাটির পৃথিবীর কঠিন নারী।

কঠিন নারী?

বলতেই হয়। চারশ’জন ছাত্রকে সামলাতে পারার মতো কঠিন।

কোনো স্কুলের শিক্ষিকা?

ঠিক তাই। আমি যে স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করি তার প্রধান শিক্ষিকা। পুরুষ যেখানে ছাত্র সামলাতে হিমশিম খায় সেখানে তিনি কী চমৎকারভাবে সবকিছু সামলান। কঠিন ব্যক্তিত্ব।

কত বয়স তার?

কত কে জানে। তবে আমি আমার তেরো বছর বয়স থেকে তাকেই ভালোবাসি। কারণ জিজ্ঞাসা করবেন না, আমি কারণ জানি না।

ও। এমন হতে পারে। হিরো ওয়ার্শিপের মতো কোনো ব্যাপার। তোমার ঘটনা শুনে মনে হলো হিরোইন ওয়ার্শিপের মতো কোনো ব্যাপার তোমার। ত্রিবেদী হেসে বলেন।

সাহানা আরেফিন দেয়ালের দিকে তাকিয়ে আছেন। অন্ধকারে দেয়ালের ছায়াগুলো দেখতে প্যাস্টেলে আঁকা ছবির মতো।

কোনো আনন্দ পাওয়া গেল না তোমার গল্পে। আমরা বুড়োরা যেমন গল্প করতে পেরেছি তার কাছাকাছিও নয় তোমার গল্প। এবার একটা সত্যিকারের গল্প বল। ওসব ওয়ার্শিপ নিয়ে তো আর জীবন চলবে না। কত বয়স তোমার?

আমার বয়স পঁচিশ।

একেবারে হোপলেস একটা গল্প। মনে মনে আর একটা গল্প ঠিক কর। ত্রিবেদী উঠে জানালা দিয়ে বাইরে তাকান। মনে হয় তুষার পড়ছে না। এখনও সকাল হতে বাকি আছে। ওরা দু’জন মানে মিস্টার ও মিসেস রহমাতুল্লাহ বেড়ালের মতো না হলে বসন্তের পাখির মতো কাঁধে মাথা রেখে বোধকরি ঘুমিয়ে আছে। না ঘুমাননি তারা। বলেন মিসেস রহমাতুল্লাহ- সারাজীবন তো এমন একজন নারীর চেহারা ভেবে জীবন কাটাতে পারবে না। বল এমন কেউ যাকে এখন তোমার ভালো লাগছে। যাকে তুমি বুকের ভেতরে পেতে চাও।

তেমন কেউ এখনও জীবনে আসেনি। আপনাদের ফোন নম্বর আছে আমার নোটবুকে। এলে জানাব, ঠিক আছে?

মিসেস রহমাতুল্লাহ আবার চোখ বন্ধ করেন।

সাহানা আরেফিন চোখ বন্ধ করে সোফায় মাথা রেখে ঘুমিয়ে কি?

আবির করিম বাইরে আসে। বাথরুমে যেতে হবে। গার্ডের ঘরটা পার হলে বাথরুম। দু’জন ছায়ামূর্তি দাঁড়িয়ে আছে। ওরা কারা? একজন তো পল্টু। সেই হতচ্ছাড়া ড্রাইভার। আর ওর সঙ্গে ওই নারীমূর্তি কি ড্রাইভারের বউ? তাই তো মনে হয়। ছিপছিপে শ্যামলা একটা মেয়ে ডিমভাজি দিতে এসেছিল ঘোমটা টেনে। ওরা কথা বলছে খুব কাছাকাছি দাঁড়িয়ে। বেশ একটু অন্তরঙ্গভাবে। ওদের ভাষা বোঝে না আবির করিম। আবিরকে দেখে ওরা ঘরের ভেতর চলে যায়। -ও এই। গাঁয়ের মেয়েকে দেখতে আসে মনে হলে? মানুষকে বাজে আবহাওয়ার ভয় দেখিয়ে? বলেছিল- বেশ কয়েকবার ওই বাড়িতে যেতে হয়েছে। বাড়িটা আমার চেনা। আর ওই গার্ড? সেকি ঘুমিয়ে? বউ কী করছে না করছে সেদিকে কোনো খেয়াল নেই? মরুক। ও নিয়ে আমার কী? আবির চুপচাপ চলে যায় বাথরুমের দিকে। বলে- তোমার প্রেমের গল্পটাই সবচেয়ে জমকালো। কিন্তু কেউ তোমাকে ডাকবে না সেসব শুনতে।

গার্ডের বউ আর পল্টু খুব কাছাকাছি দাঁড়িয়ে ফিসফিস করে কী সব বলছে সেটা কি প্রেম না আর কিছু। তবে দাঁড়ানোটা সন্দেহজনক। মরুক। যা ইচ্ছে হোক। ব্লাডার খালি করে আবির ফিরে আসে।

ঘরের ভেতর সকলের অনুরোধে সাহানা আরেফিন গল্প শুরু করেছেন। হেসে বলেন প্রেম? সময় কোথায়? ভাইবোনদের মানুষ করেছি। তারপর যখন নিজের দিকে তাকালাম দেখি বিয়ের বয়স আর নেই।

আপনি দেখতে তো এখনও বেশ। বলেন রহমাতুল্লাহ। এখনও কাউকে পেতে পারেন যদি ইচ্ছে করেন।

ঠিক বলেছেন। বিয়ের কি কোনো বয়স থাকে। বিদেশে তো বুড়োবুড়ির হোমেও বিয়ে হয়। এখানেও সে রকম ঘটনা ঘটছে। সেদিন আমার এক ষাট বছরের বন্ধু তার ছেলেবেলার বান্ধবীকে বিয়ে করলেন প্রথমবারের মতো। আমি বলছি না আপনি ষাট। কত বয়স আপনার? ত্রিবেদী চশমার কাচ মুছে প্রশ্ন করেন।

মেয়েদের বয়স জিজ্ঞেস করতে নেই, জানেন না?

আপনার বয়স পঞ্চাশেরও কম হবে। বলেন মিসেস রাহমাতুল্লাহ।

হবে ওই রকমই কিছু। এখন বিয়ে? আপনাদের কি মাথা খারাপ? জেনেশুনে একজন বসকে জীবনে ডেকে আনব? শাসন করবেন আমাকে বাচ্চা মেয়ের মতো।

বস কেন? বন্ধুও তো হতে পারে?

আমার বন্ধুর দরকার নেই। তা ছাড়া স্বামী মানেই বস, না হলে অসহায় বালক। – আমার মোজা খুঁজে পাচ্ছি না, না হলে আমার শার্টের ইস্ত্রি নেই কেন। আর বসরা যে কী করে তা আপনারা জানেন। চুপচাপ কথা শুনছে আবির করিম। সে এবার মেঝেতে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ে তার সঙ্গের ব্যাগের ওপর মাথা রেখে। চোখ বন্ধ। সকাল হতে বেশি দেরি নেই। সকলেই এবার বসে বসে একটু একটু ঝিমাতে শুরু করেছে।

সকালের আলো ফুটে গেছে। এখন যাওয়া যাবে। বরফ নেই। সকলের আগে সাহানা আরেফিন ঘর থেকে বাইরে এসেছেন। পেছনে আবির করিম। সাহানা ওর দিকে তাকান। বলেন- তোমাকে চিনতে পেরেছি। আমার স্কুল থেকেই তো তুমি স্কুল ফাইনাল পাস করেছ, না? আবির মাথা নাড়ায়। বলেন তিনি- গল্পটা নিশ্চয় বানিয়ে বলেছ? আবির করিম বলে- না। বানিয়ে বলব কেন?

জানতাম আমাকে তুমি ভয় পাও।

তা পাই। বলেই সে অন্যদিকে তাকায়। বলে সে মুখ ঘুরিয়ে- ভয় আছে বলে আর কোনো অনুভূতি কাজ করবে না এমন কথা কে আপনাকে বলেছে।

সাহানা আরেফিন এবার আবহাওয়া জরিপ করেন। আবির করিম বলে- একদিন যখন আপনার কেউ খোঁজ নেবে না, যাদের জন্য এতকিছু করেছেন তারা আপনাকে ভুলে যাবে, তখন কী হবে?

কী হবে? সে শুনে তোমার লাভ?

তখন না হয় আপনার জীবনে একটু জায়গা করে নেব।

না, আমার কোনো পুরুষ নার্সের দরকার নেই। বলেন কঠিন গলায়।

পাগল। ছেলেটা পাগল। তিনি বলেন আরও তেমনিভাবে- তুমি কি জানতে একটু বিশ্রাম নিতে আমি দার্জিলিং এসেছি। আবির মাথা নাড়ে। ওরা সব আসছে। সাহানা আরেফিন প্রথমে গিয়ে জিপে বসেন। আবির করিম ওদের অপেক্ষা করে। ও বসবে ড্রাইভারের পাশের সিটটায়। জিপটা ছাড়বে। পল্টুর হাতে একটা খাবারের প্যাকেট তুলে দেয় ড্রাইভারের ছিপছিপে বউ। বোধকরি লুকিয়ে রাখা দুটো একটা মম। ওদের ভাষায় কী বলে কে জানে। পল্টু মাথা নাড়ে আর একটু হাসে। মোটা বখশিশ পেয়ে আজ রাতে গার্ড কতটা তরল পানীয় পান করবে, নেশা করবে, কে বলতে পারে। বোধহয় আজ আর ও উঠবে না। মেয়েটা দাঁড়িয়ে আছে। জিপ ছেড়ে দেয়। পল্টু বিষণ্ণ। আর বউটার চোখে বোধকরি জলটল কিছু হবে। এইটুকু পথ কি কাল রাতে যাওয়া যেত না? কী জানি কী ছিল এই হারামজাদা ড্রাইভার পল্টুর মনে। আর পল্টু তো মাঝে মাঝে একাও আসতে পারে। পারে না? পারে না, কারণ ড্রাইভারটা নেশাভাঙ করলে বউ পেটায়। কাজেই অজুহাত করে আসা।

ওরা খানিক পরেই দার্জিলিংয়ে পৌঁছে যাবে। তখন যে যার মতো, নিজেদের বেছে নেওয়া হোটেলে। তখন যদি রাস্তায় একজনের আর একজনের সঙ্গে দেখা হয়? কে বলতে পারে সে কথা। কে বলতে পারে তখন সাহানা আরেফিন কী বলবেন আবিরকে।

আর পল্টু হয়তো অপেক্ষায় থাকবে আবার আর কোনো যাত্রীকে বাজে আবহাওয়ার ভয় দেখিয়ে এই বাড়িতে নিয়ে আসার।

এই তো সেই বাড়িটা যেখানে সমরেশ মজুমদারের তীর্থভূমির কয়েকজন রাত্রি কাটিয়েছিলেন। এখানে এখন আর এক দল। বিভিন্ন জায়গার, বিভিন্ন বয়সী। ওদের দলের ভেতর আবির সবচাইতে কমবয়সী। সেই এমন একটা কথা বলে। বলে প্রায় আপন মনে- আরে আরে এ যে দেখছি সমরেশ মজুমদারের তীর্থভূমির সেই বাড়িটা। সকলে তাকায় আবিরের দিকে। ওদের ভেতর আর কেউ তীর্থভূমি বইটা পড়েনি। গল্পটা আবিরের ভীষণ পছন্দের একটি গল্প। ও ভুলে যায়নি। আর এই পরিবেশে এসে গল্পটা যেন সমস্ত সৌন্দর্য ও সত্য নিয়ে প্রাণ পায়।

সাহানা আরেফিন ভালোমতো শালটা টেনে শরীর ঢাকেন। তিনি দেশে একটি স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা। বয়স তার বায়ান্ন বছর। তিনি বলেন- এমন একটা বাড়িতে আমরা আটকে পড়ব কে ভেবেছিল। তিনি চারপাশে তাকান। মাথার শালটা নেই। কালো চুল চোখে পড়ে। সাদা নেই। সেগুলো রঙের কারণে কি-না কেউ বুঝতে পারে না। বলেন তিনি- এই শীতে আর তুষারে এমন একটা বাড়িতে …

ঠিক তাই। পাঁচজন মানুষের ছোটখাটো একটা দল দার্জিলিংয়ের একটা পাহাড়ে আটকে পড়লেন। পাঁচজনাই একটা জিপে নির্দিষ্ট জায়গায় পৌঁছাতে চেয়েছিলেন। ওরা পাঁচজন দার্জিলিং দেখতে এসেছেন। শিলিগুড়ির ‘নিরুপমা’ হোটেলের লাউঞ্জে সে কথা জেনেছিলেন তারা। তারপর ঠিক করেন একসঙ্গে দার্জিলিং যাবেন। তারপর যে যার মতো। জিপের ড্রাইভার বললেন- ধস নামছে। এখন আর আমি গাড়ি চালাতে পারব না। অসম্ভব ঘটনা। ওরা ভীত। বলে কী পল্টু নামের এই ড্রাইভার? গাড়িতে তুলবার সময় ওর কি এমন হবে মনে ছিল না? ওরা না হয় বাইরের মানুষ। এখানকার আবহাওয়ার সবটা জানে না। কিন্তু যে দীর্ঘদিন এখানে বাস করছে সেও কি আবহাওয়ার কথা কিছুই বুঝতে পারেনি? ওদের একটু আশ্বস্ত করে ড্রাইভার বলেছিল- একটা বাড়ি আছে। এদিক দিয়ে একটু অন্যপথে গেলে একটা ছোটখাটো বাড়িতে রাত কাটানো যেতে পারে। বাড়িটা প্রায় সবসময় তালা দেওয়াই থাকে। আপনারা যদি বলেন- আমি আজ রাতের মতো আপনাদের ওখানে পৌঁছে দিতে পারি।

তালা দেওয়া বাড়িতে? প্রশ্ন করেছিল সেই দল।

ভাগ্য ভালো হলে গার্ডকে পেয়ে যাবেন। আর ভাগ্য খারাপ হলে সকলে মিলে তালা ভাঙতে হবে। গার্ডটা কখনও থাকে কখনও থাকে না। পরে আপনারা মালিককে যা বলবার বলবেন। এখন আমি নিচেও নামতে পারব না উপরেও যেতে পারব না। কেবল পাশের রাস্তা দিয়ে সেই বাড়িটাতে নিয়ে যেতে পারি। এমন কিছু বলেই ড্রাইভার কারও কোনো কথার অপেক্ষা না করে জিপটাকে পাশের রাস্তায় তুলে দিয়েছিল।

কেমন করে নিয়ে যাবে তুমি ও পল্টু মহারাজ? কেমন করে যাব সকলে একটা তালা দেওয়া বাড়িতে? মিস্টার ত্রিবেদী, যার বয়স বোঝা যায় না তিনি বলেন।

যেমন করে হোক নিয়ে যাব। তবে কেমন করে সেটা পরে শুনবেন। কেমন করে? এমন ঘটনা আগেও দু’একবার ঘটেছে কি-না। ওই বাড়িটাই শেষ পর্যন্ত এমন বিপদে পড়া যাত্রীর আশ্রয়ের জায়গা হয়েছে। ঈশ্বর মহারাজ কখন যে কী করেন।

যখন আমরা জিপ ভাড়া করি তুমি তো বলনি এমন হতে পারে। মিস্টার ত্রিবেদী বোধহয় একটু রেগে গেছেন- আমি জানতাম না। এখানকার আবহাওয়ার কি ঠিক আছে? এখন ড্রাইভ করে উপর দিকে যাওয়ায় বিপদ হতে পারে। আর নিচের দিকে যাওয়া মানে গাধামি। দেখছেন না কী ভীষণ তুফান চারদিকে। পল্টু গাড়ি ঘোরাতে ঘোরাতে জবাব দিয়েছিল।

ওরা ঠিক বুঝতে পারছে না ড্রাইভার কি ইচ্ছে করে এমন একটা কথা বলছে। প্রবল বৃষ্টি চারপাশে। ঝরঝর মরমর শব্দ। শীত তো ছিলই। এখন মনে হয় শীত শরীরের হাড়ের ভেতর চলে যাবে। ওরা কোনো মতে শরীর ঢেকে জড়োসড়ো হয়ে বসেছে।

ওরা বুঝতে পারছে না কী বলবে। জায়গাটা কার্শিয়াং থেকে আরও একটু উপরে। এমন হবে ওরা ভাবেনি। ওরা শীতেই দার্জিলিং দেখতে চায়। মিস্টার ও মিসেস রহমাতুল্লাহ। একজন ষাট, একজন আটান্ন। মিস্টার ত্রিবেদী। বয়স বোঝা যায় না। মিস সাহানা আরেফিন বায়ান্ন-টায়ান্নর একজন। আর আবির করিম চব্বিশ বা পঁচিশ বছরের তরুণ। ওরা সকলে মিলে জিপটা যখন ভাড়া নেয় বুঝতে পারেনি এমন হবে। ওদের আলাপ হয়েছিল হোটেলে। পরে ওরা ঠিক করে একটা জিপে সকলে মিলে দার্জিলিং যাবে। শিলিগুড়ির সেই হোটেলটাতে থাকলেই হতো। এমন অবেলায় রওনা দেওয়াটাই ভুল হয়েছে। আবির করিমের উৎসাহ। পঁচিশ বছরের একটা তরুণের কথায় ওরা কি হিতাহিত জ্ঞান হারিয়েছিল?

এর মধ্যে ড্রাইভ করা ঠিক নয়। বারবার একই কথা বলতে শুরু করেছিল ড্রাইভার। তারপর একটু গম্ভীর হয়ে বলেছিল- আমার ওপর একটু আস্থা রাখতে হবে, উপায় যখন নেই।

তুমি তো একটা সাংঘাতিক লোক। কোনখানে নিয়ে তুলতে চাও আমাদের? উপায়হীনদের ভবনদী পার করানোর ঈশ্বর নাকি তুমি? মিস্টার ত্রিদেবী বলেন ভারি গলায়।

আমি নিজেও জানি না সেখানে আপনারা আজ রাতে থাকতে পারবেন কি পারবেন না। ওখানে থাকতে গেলে আগে থেকে রিজার্ভ করতে হয়। তালা ভাঙবেন, থাকবেন দরকার হলে। তারপর জবাবহিহি করবেন। তবে গার্ডের থাকার কথা। দেখা যাক কী হয়। ও মাঝে মাঝে নিজের বাড়িতে চলে যায়।

তোমার কথা শুনব না। এমন কিছু বলার অবস্থা সত্যিই নয়। মিস্টার ত্রিবেদী চুপ করেন। কাজেই পল্টুর হাতে ভাগ্য তুলে দিয়ে খাঁচার মুরগির মতো ওরা অপেক্ষা করেছিলেন সেই বাড়িটার।

ভাগ্য ভালো। গার্ড ছিল। তবে ওখানে আর এক যুগল আগে থেকেই ছিল। ওরা পাঁচজন সেখানে যখন উপস্থিত সেই যুগল নিজের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে গার্ডকে বলে- আমাদের ঘরে কেউ থাকতে পারবে না। আমরা আগে থেকে রিজার্ভ করে এসেছি। গার্ড বাধ্য হয় অন্য ঘরে ওদের বসাতে। মনে হয় মিস্টার ত্রিবেদী খুব কেউকেটা একজন। গার্ডকে বাইরে ডেকে নিয়ে কী বলতেই সে রাজি হয়। যে ঘরটায় ওরা বসেছে সেটা একটা লিভিংরুম। বলে কেবল- হুজুর আপনি সব সামলাবেন।

সকলে ঢুকে পড়ে বসার বা লিভিংরুমে। ঘরটা বেশ বড়। সেখানে ঘর গরম করবার একটা চুলো আছে। সেই দম্পতি, যারা ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করেছে তারা এতক্ষণ এখানে বসে শরীর গরম করছিল। তারা ওদের সাড়া পেয়েই নিজেদের ঘরে ঢুকে শক্ত হাতে ঘরের ছিটকিনি লাগিয়েছে। ওরা পাঁচজন সেখানে বসে। মিস্টার ত্রিবেদী একটা সিঙ্গেল সোফায়। তিনি হাতের দস্তানা খুলে হাত মেলে ধরেন সামনে। বেশ আরাম লাগছে তার। চারপাশে তুফান। বরফ। ঝড়। তিনি বলেন- এই ঘরেই বোধহয় আমাদের রাত কাটাতে হবে। মনে হয় আর কোনো শোবার ঘর নেই। আবির এবার বাড়িটা দেখবে বলে বাইরে গেছে। ঘরটায় মোমবাতির আলো মোমবাতিদানিতে। বলেন তিনি- এই যে গার্ড, সারারাত যেন চুলো জ্বলে তেমন কাঠকয়লা আছে তো? গার্ড কিছু কাঠকয়লা এনে চুলোটার আঁচ বাড়িয়ে দেয়। আবির করিম একবার অন্ধকারে বাড়িটা দেখে আসে। বাথরুম ও রান্নাঘর দেখে। যদি চা করা যায় তাহলে বেশ হবে। কিন্তু চা বা চিনি নেই। একটা কফির কৌটার তলায় কফি পড়ে আছে। সেটা থেকে পাঁচ কাপ কফি বানিয়ে পাঁচজন পান করতে পারে। বলে আবির- যারা এখানে আগে থেকে আছেন তারা কি না খেয়ে আছেন?

ওরা সঙ্গে খাবার এনেছিলেন। কাল সকালেই চলে যাবেন। আমার কাজ ছিল ওদের কেবল কফি বানিয়ে দেওয়া। আর আমার বাজার শেষ। খালি কয়েকটা ডিম আছে। পাওয়ার কাট। কাজেই মোমবাতিই সম্বল।

পারলে কফি করে আনো। গার্ড মাথা নেড়ে জানায় সে কফি করবে। – পাওয়ার কাট। মোমবাতির আলো জ্বলছে! ভারি রোমান্টিক ব্যাপার। বলে আবির। সকলে বেশ কঠিন চোখে আবিরের দিকে তাকায়। বলেন মিস্টার রহমাতুল্লাহ- তুমি এখন এর ভেতরে রোমান্টিকতা দেখছ? আবির উত্তর দেয় না। গার্ড একটা মোমবাতি নিয়ে চলে যায়। দুটো শোবার ঘর। একটা ঘরে গার্ড থাকে। ভেতরে একটা ছোট বাচ্চার আওয়াজ পেয়েছে আবির। মনে হয় গার্ডের বাচ্চা। আর একটা ঘরে দুই হানিমুন কাপল মোমবাতি আর অন্ধকারে চাঁদতারামধু কিছু না পেয়ে বোধকরি এবার ঘুমিয়ে গেছে। একটা লিভিং রুম। রান্নাঘর আর তার পাশে একটা ছোট ভাঁড়ার ঘর। বলে আবির- বাড়িটা কার?

শেখর বাবুর। তিনি বছরে দু-একবার আসেন। এমনিতে পড়েই থাকে হুজুর।

পল্টু বাড়িটাতে কি আগে এসেছে? প্রশ্ন করেন মিসেস রাহমাতুল্লাহ। গার্ড উত্তর দেয়-

কয়েকবার। আমার বউ আর ও একই গ্রামের মেয়ে হুজুর।

আবির বাড়িটা, মানুষজন, বাড়ির মালিকের খোঁজ নিয়ে ফিরে এসেছে। বলেন মিস্টার আর মিসেস রহমাতুল্লাহ জিপের লাগেজের একটা ব্যাগে বিস্কুট-কলা আছে। কিন্তু জিপের কাছে কারও যাওয়ার ইচ্ছা নেই। ওটা ত্রিপল ঢেকে চুপচাপ পড়ে আছে। চারপাশে বরফ। পড়ছে, জমছে। কাল কি ওরা সেই পথ ধরে যেতে পারবে? পল্টু বলে পারব। কাল সকালে সূর্য উঠবে। দার্জিলিং খুব বেশি দূরে নেই।

কাল সকালে কী হবে সেটা সকালের হাতে রেখে দেওয়াই ভালো। এখন রাতটা কাটানো যাক। ঘড়ি দেখে জানে রাত মাত্র দশটা। সকাল হতে অনেক দেরি। আলো নেই বই পড়বার মতো। হাতব্যাগে একটা গল্পের বই আছে, সাহানা আরেফিন সেটা পড়তে পারবে না। ত্রিবেদীও নয়। মিস্টার ও মিসেস রহমাতুল্লাহর ব্যাগে নানা ওষুধ। বই নেই। আবির করিমের ক্যামেরা। লেখার কাগজ। বই সঙ্গে হাতে নেই তবে ব্যাগে আছে। ও বসে। হাত গরম করে। – কিছু পেলেন রাত কাটানোর মতো?

কী পাব? এখানে পাওয়ার মতো কিছু আছে? সাহানা আরেফিন জানান। ঘণ্টা খানেক সবাই বসে থাকে প্রায় চুপচাপ। এর ওর সঙ্গে আলাপ, নাম জানা, সে তো হোটেলেই হয়েছে। কয়েকটা কম্বল উদ্ধার করা হয় রান্নার পাশের ঘরটা থেকে। অন্ধকার। ময়লা না পরিস্কার বোঝা যায় না, তাইতেই রক্ষা। পায়ের পাতা ঢাকার মতো ছোট কম্বল। মেঝেতে একটা চটের কার্পেট বিছানো। শেখরবাবু কেন একটা সুন্দর দামি কার্পেট লাগাননি সেটা ওরা ভাবতে থাকে। জানা গেল শেখর বাবু একজন সংসারহীন সন্ন্যাসী জাতীয় মানুষ। এখানে আসেন নাকি ধ্যান করতে। কলকাতায় সমাজসেবা, এটা সেটা করেন। কেন গৃহী নন সেটা গার্ড কী করে বলবে। ধ্যানের জন্য বড় বাড়ির দরকার কী? গুহা হলেও চলে। তবে তিনি গুহাবাসী নন। এখানে আসেন, ধ্যান করেন, ঈশ্বর নিয়ে ভাবনা করেন তারপর চলে যান।

চলুন আমরা একটা করে গল্প করি। জীবনের গল্প। প্রেমের গল্প। আবির করিম দলটাকে চাঙ্গা করতে এমন একটা প্রস্তাব করে। সকলে প্রথমে একটু গম্ভীর হয়ে থাকলে পরে হাসে। বলেন ত্রিবেদী- আপনিই আগে শুরু করুন। আপনার বয়স কম। নিশ্চয় অনেক প্রেমের গল্প আপনার জানা।

তা তো আছেই। তবে আমি অনুরোধ করব মিস্টার ও মিসেস রহমাতুল্লাহকে, ওরা আগে বলুক। কে বলবেন? মিস্টার না মিসেস?

আমরা আগে শুরু করব? কারণ কী?

তেমন কোনো কারণ নেই। তবে আপনাদের যুগলকে দেখে মনে হয় আপনারা প্রেমের গল্প জানেন।

তুমি বল। মিসেস রহমাতুল্লাহ স্বামীকে বলেন। সকলে পায়ের কম্বল, চুলোর আঁচ উসকে ভালো হয়ে বসে। গার্ডের বাড়িতে যে কটা ডিম ছিল তা শেষ। ওর বউ ডিম ভেজে দিয়েছে। বলেছে গার্ড- আর কিছু নেই। কাল বাজার। তারপর খাওয়া। পল্টুর দেখা নেই। বোধকরি গার্ডের ঘরে ঢুকেছে।

প্রেম একটা শক্তিশালী ব্যাপার। এত শক্তি রাখে পৃথিবীটাকেই বদলে দিতে পারে। ধরুন হিটলারের ঘৃণা যদি প্রেম হতো তাহলে কী হতো? সমস্ত পৃথিবীর চেহারা বদলে যেত না? বেশ একটু ভূমিকা শুরু করেন তিনি। ওরা বসে আছে গল্পের অপেক্ষায়। এই যে আমি আর মিমি দীর্ঘদিন প্রেম করেছি। ওর বাবা-মা রাজি নন, আমার বাবা-মাও নয়। কারণ মিমিদের পদমর্যাদা বংশমর্যাদা আমাদের চেয়ে উঁচুতে। আমার বাবা লোকজনের ফরমাশ মতো কাঠের জিনিস বানান। ভাগ্যক্রমে আমি পড়াশোনায় ভালো। আমার বাবা-মায়ের আপত্তি এত বড়ঘরের মেয়ে তাদের সংসারে রবীন্দ্রনাথের সেই গানের মতো বেমানান হবে- এই মনিহার আমায় নাহি সাজে। বিয়ে করব আমি মাথা ব্যথা তাদের। আর ওর মা-বাবা বিয়াই-বেয়ানকে জাতে তুলতে পারবেন না সেটা তাদের মাথাব্যথা। বড় বড় পার্টিতে একমাত্র মেয়ের শ্বশুর-শাশুড়ি আসতে পারবেন না, বিয়ের কার্ডে কোনো ভালো লোকের নাম লেখা যাবে না, এইসব ভাবনায় একেবারেই অনড় তারা। তিনি একটু চুপ করেন। মিসেস রহমাতুল্লাহ বা মিমি একটু হাসিমুখে স্বামীকে দেখছেন। বয়সিনী মহিলার কেমন আদুরে নাম। বোঝা যায় এককালে তিনি দেখতে ভালো ছিলেন। যখন প্রেমের গল্প শুরু হয় ওর মুখে মোমের আলোর মতো এক ধরনের আলো তাকে নতুন এক ফাউন্ডেশন ক্রিম-ঘষা মুখের মতো লাবণ্যময়ী করে তুলছে। তারপর কী হলো? সাহানা আরেফিনের গলা। মনে হয় তার গলার স্বরটাও বদলে গেছে। এ গলা ছাত্রশাসন করবার গলা নয়। যখন প্রেমের গল্প, গলা এমন করে নতুন হয়ে যায়। মিসেস রহমাতুল্লাহ এবার আপনি বলুন।

না, ওই বলুক। ও খুব ভালো গল্প বলতে পারে।

এরপর কী করা যায়? আমি বিদেশে যাবার একটা স্কলারশিপ পেয়ে গেলাম। ও তখন কেবল এমএ পাস করেছে। বললাম, তুমিও একটা স্কলারশিপ সংগ্রহ কর মিমি। আমরা বিদেশে বিয়েটা সেরে ফেলব।

ও সেটা পারেনি। যখন ফিরে এসেছি ও চাকরি করছে চট্টগ্রামে। আমার বাবা মারা গেছেন করাত কলে পড়ে। আমি একটা ভালো চাকরি করছি। ছুতোরের ছেলের গায়ের গন্ধটা তখন বিদেশি সাবানে, আফটার শেভে, আর আমার নামের শেষের কান্টাবের কারণে অনেকটা জাতে উঠেছে। কাজেই বিয়ে হলো।

গল্পটায় তেমন সাসপেন্স নেই, একেবারে নতুন লেখকের প্রেমের গল্পের মতো। দেন দে লিভ হ্যাপিলি এভার আফটার, ব্যস, গল্প শেষ। বলে আবির করিম। মিস্টার রহমাতুল্লাহ বলেন- নট কোয়ায়েট। একটা পা বের করেন। তার একটা পা নেই। সেখানে নকল পা। বলেন- কাটা পড়েছে। মারা যাইনি। ওই এখন আমাকে দেখাশোনা করে। প্রেম না থাকলে এসব মানত কেউ? এক বছর হাসপাতালে। তারপর বাড়িতে ফিরে আসি।

কেউ কি আর মানত বলছেন? তা মানত। কত দাম্পত্যজীবন দেখেছি একজন আর একজনকে মেনে নেয়। সেখানে প্রেম আছে কি নেই, কে জানে। বলেন ত্রিবেদী। কেউ বিছানায় পড়ে আছে দীর্ঘদিন, কারও শরীর অবশ, কারও মাথাটা আগের মতো কাজ করে না, কেউ নেশাভাঙে বিবশ, তারপরও একজন আর একজনকে মেনে নেয়। এখন বলুন আপনি বলতে চান এটাই আপনাদের প্রেমের শ্রেষ্ঠ ব্যাপার? যখন আপনি পা হারালেন, ধারণা করছি চাকরিও হারালেন, ও আপনাকে দেখছে এবং ভালোবাসছে?

রহমাতুল্লাহ হাসছেন। তার পা দুটো আবার কম্বলের নিচে চাপা পড়েছে। একটা আসল আর একটা নকল পা। বলেন- এটা একটা বড় ঘটনা। কিন্তু সে ঘটনাকে আমরা প্রেমের সর্বশ্রেষ্ঠ ঘটনা বলে মনে করি না। আমরা মনে করি তিন বছরে আমরা দু’জনে দু’জনকে যতগুলো চিঠি লিখেছি, সেটাই আমাদের জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ ফসল। প্রতি সপ্তাহে একটা। ও একটা আমি একটা। অপূর্ব সেসব লেখা। ভাবতে পারিনি কোনোদিন এমন লেখা আমরা লিখতে পারব- প্রেমে, বেদনায়, আনন্দে, দুঃখে, বিষাদে, একাকীত্বে, সন্তাপে, শোকে, শ্নোকে, বর্ষণে, শ্রাবণে, শীতে আর রোদে, গানে আর তানে, গদ্যে আর পদ্যে, লিরিকে আর মহাকাব্যে, সেসব তুলনাহীন।

হাততালি পড়ে।

বুঝলাম। বলেন সাহানা আরেফিন। – কেবল সেসব মনে করে যিনি এমন একটা বড় বাক্য অবলীলাক্রমে বলে ফেলতে পারেন তার আর প্রেমিকার সেসব চিঠি যে কতটা মনোরম, হৃদয়গ্রাহী, ভাষার কারুকার্যে অসামান্য তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। চিঠির কথা বলতেই আপনাদের দু’জনের মুখ কেমন উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল, মোমবাতির অল্প আলোতেও সেসব বোঝা গেছে। এমন সব চিঠি। বই করে ছাপান না কেন?

কী যে বলেন। ওসব আমাদের বিবাহিত জীবনের বন্ধ্যাজমির ফসল। আমাদের কোনো সন্তান নেই। আমরা দু’জন কোনো কোনো দিন বারবার ওগুলো পড়ি। ওরটা আমি, আমারটা ও, না হলে ভাসাইভার্সা। আরও বেশি ভালোবাসি দু’জন দু’জনকে তখন। ওই চিঠিগুলোর কাছে আমরা কৃতজ্ঞ।

মিস্টার আর মিসেস রহমাতুল্লাহ সোফায় আরও কাছাকাছি আসেন। মিসেস রহমাতুল্লাহর মাথা স্বামীর কাঁধে। তার দুই চোখে হাসি নয় কোমল শিশির টলটল। মিস্টার রাহমাতুল্লাহর একটি হাত স্ত্রীর শরীর একটু আদর করে।

ত্রিবেদী তার গল্পটা বড় করে বলতে পারেন না। বোঝা যায় একজনকে ভালোবেসেছিলেন গভীর করে। তাকে পাননি। বিয়ে করেছেন। তিন জন সন্তান। পড়াশোনা করছে দু’জন, একজন চাকরি শুরু করেছে। এখন সেইসব প্রেমট্রেম বোধকরি মনে করেন না। বড় সরকারি চাকরি করেন। আগামী বছর রিটায়ার করবেন। এখানেই কোথাও থাকবেন। তার ও স্ত্রীর এমন ইচ্ছা। একটা বাড়ি দেখতে এসেছেন। আসল বাড়ি জলপাইগুড়িতে। শেষজীবনের দিনগুলো কাটাবেন বলে। বলেন- ওকে আর মনে করি না। বলেই হাসেন।

একেবারেই মনে করেন না? আবির করিম প্রশ্ন করেন।

একেকদিন মনে হয়। বলুন তো কখন?

কখন? যখন বৃষ্টি পড়ে, ফুলবাগান দেখেন, না হলে কোনো চমৎকার নিসর্গে ভাবেন জীবনের এতকিছুর ভেতরে কেন একটা মুখ বারবার ভেসে ওঠে, যার কোনো অর্থ করতে পারেন না, একটা অপূর্ব বেদনা, যা পান করতে দুঃখ ও আনন্দ। যখন নিঃসঙ্গ। এবং যখন অপ্রিয় সঙ্গ। আবির বলে- নট কোয়ায়েট ইয়ংম্যান। তিনি ভাবছেন। ভাবছেন। অনেকক্ষণ কথা বলেন না। বলেন সাহানা – তাহলে কখন?

আমাদের পাশের বাড়িতে যে মেয়েটা এসেছে কয়েক বছর হলো ইঞ্জিনিয়ার স্বামীর ঘর করতে ওকে দেখলে। একেবারে মায়ের মুখটা বসানো কি-না। লীলার গানের গলাটাও মায়ের মতো। ওর মা আর নেই। মায়াকে আমি লীলাবতী বলে ডাকতাম। মায়া অঙ্কে খুব ভালো ছিল। বলতাম- তুমি আমার লীলাবতী।

মেয়েটার নাম কী?

দূর্বা।

এই বলেই ত্রিবেদী চোখ বন্ধ করেছেন। দীর্ঘ প্রেমের গল্প তিনি করতে পারেন না। মোমবাতি আর কতক্ষণ জ্বলবে কে জানে। গার্ড বলেছে আর মোমবাতি নেই। আলোটা ছোট হয়ে আসছে। রাত গভীর। সকাল হতে এখনও অনেক দেরি।

এরপর যখন ত্রিবেদী আবার এই পৃথিবীতে ফিরে আসেন। আবির করিমের দিকে তাকিয়ে বলেন- ইয়ংম্যান, তোমার কাছে একটা রক্তমাংসের প্রেমের গল্প আশা করছি। আমাদের মতো নিরামিষ গল্প নয়। কখন যে সম্বোধন তুমি হয়ে গেছে বুঝতে পারেন না।

আবির করিম মুখ নিচু করে। আলোটা কমে আসছে। দেয়ালে ছবির মতো ওদের ছায়া। বলেন আবির- আমার গল্পটা একতরফা প্রেমের। রক্তমাংসের কারবার নেই।

দূর, এমন গল্প তুমি করবে? রহমাতুল্লাহ বলেন।

তাই তো করতে হবে। আপনার মতো চিঠি লেখালেখির পর্বও নেই। একেবারে ছবির দিকে তাকিয়ে ভালোবাসার মতো ঘটনা।

নায়িকা কি কোনো দেশি-বিদেশি ছবির নায়িকা। কোনো গ্লামারাস অভিনেত্রী? কোনো অপূর্ব শরীর আর মুখ?

না। একেবারেই মাটির পৃথিবীর কঠিন নারী।

কঠিন নারী?

বলতেই হয়। চারশ’জন ছাত্রকে সামলাতে পারার মতো কঠিন।

কোনো স্কুলের শিক্ষিকা?

ঠিক তাই। আমি যে স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করি তার প্রধান শিক্ষিকা। পুরুষ যেখানে ছাত্র সামলাতে হিমশিম খায় সেখানে তিনি কী চমৎকারভাবে সবকিছু সামলান। কঠিন ব্যক্তিত্ব।

কত বয়স তার?

কত কে জানে। তবে আমি আমার তেরো বছর বয়স থেকে তাকেই ভালোবাসি। কারণ জিজ্ঞাসা করবেন না, আমি কারণ জানি না।

ও। এমন হতে পারে। হিরো ওয়ার্শিপের মতো কোনো ব্যাপার। তোমার ঘটনা শুনে মনে হলো হিরোইন ওয়ার্শিপের মতো কোনো ব্যাপার তোমার। ত্রিবেদী হেসে বলেন।

সাহানা আরেফিন দেয়ালের দিকে তাকিয়ে আছেন। অন্ধকারে দেয়ালের ছায়াগুলো দেখতে প্যাস্টেলে আঁকা ছবির মতো।

কোনো আনন্দ পাওয়া গেল না তোমার গল্পে। আমরা বুড়োরা যেমন গল্প করতে পেরেছি তার কাছাকাছিও নয় তোমার গল্প। এবার একটা সত্যিকারের গল্প বল। ওসব ওয়ার্শিপ নিয়ে তো আর জীবন চলবে না। কত বয়স তোমার?

আমার বয়স পঁচিশ।

একেবারে হোপলেস একটা গল্প। মনে মনে আর একটা গল্প ঠিক কর। ত্রিবেদী উঠে জানালা দিয়ে বাইরে তাকান। মনে হয় তুষার পড়ছে না। এখনও সকাল হতে বাকি আছে। ওরা দু’জন মানে মিস্টার ও মিসেস রহমাতুল্লাহ বেড়ালের মতো না হলে বসন্তের পাখির মতো কাঁধে মাথা রেখে বোধকরি ঘুমিয়ে আছে। না ঘুমাননি তারা। বলেন মিসেস রহমাতুল্লাহ- সারাজীবন তো এমন একজন নারীর চেহারা ভেবে জীবন কাটাতে পারবে না। বল এমন কেউ যাকে এখন তোমার ভালো লাগছে। যাকে তুমি বুকের ভেতরে পেতে চাও।

তেমন কেউ এখনও জীবনে আসেনি। আপনাদের ফোন নম্বর আছে আমার নোটবুকে। এলে জানাব, ঠিক আছে?

মিসেস রহমাতুল্লাহ আবার চোখ বন্ধ করেন।

সাহানা আরেফিন চোখ বন্ধ করে সোফায় মাথা রেখে ঘুমিয়ে কি?

আবির করিম বাইরে আসে। বাথরুমে যেতে হবে। গার্ডের ঘরটা পার হলে বাথরুম। দু’জন ছায়ামূর্তি দাঁড়িয়ে আছে। ওরা কারা? একজন তো পল্টু। সেই হতচ্ছাড়া ড্রাইভার। আর ওর সঙ্গে ওই নারীমূর্তি কি ড্রাইভারের বউ? তাই তো মনে হয়। ছিপছিপে শ্যামলা একটা মেয়ে ডিমভাজি দিতে এসেছিল ঘোমটা টেনে। ওরা কথা বলছে খুব কাছাকাছি দাঁড়িয়ে। বেশ একটু অন্তরঙ্গভাবে। ওদের ভাষা বোঝে না আবির করিম। আবিরকে দেখে ওরা ঘরের ভেতর চলে যায়। -ও এই। গাঁয়ের মেয়েকে দেখতে আসে মনে হলে? মানুষকে বাজে আবহাওয়ার ভয় দেখিয়ে? বলেছিল- বেশ কয়েকবার ওই বাড়িতে যেতে হয়েছে। বাড়িটা আমার চেনা। আর ওই গার্ড? সেকি ঘুমিয়ে? বউ কী করছে না করছে সেদিকে কোনো খেয়াল নেই? মরুক। ও নিয়ে আমার কী? আবির চুপচাপ চলে যায় বাথরুমের দিকে। বলে- তোমার প্রেমের গল্পটাই সবচেয়ে জমকালো। কিন্তু কেউ তোমাকে ডাকবে না সেসব শুনতে।

গার্ডের বউ আর পল্টু খুব কাছাকাছি দাঁড়িয়ে ফিসফিস করে কী সব বলছে সেটা কি প্রেম না আর কিছু। তবে দাঁড়ানোটা সন্দেহজনক। মরুক। যা ইচ্ছে হোক। ব্লাডার খালি করে আবির ফিরে আসে।

ঘরের ভেতর সকলের অনুরোধে সাহানা আরেফিন গল্প শুরু করেছেন। হেসে বলেন প্রেম? সময় কোথায়? ভাইবোনদের মানুষ করেছি। তারপর যখন নিজের দিকে তাকালাম দেখি বিয়ের বয়স আর নেই।

আপনি দেখতে তো এখনও বেশ। বলেন রহমাতুল্লাহ। এখনও কাউকে পেতে পারেন যদি ইচ্ছে করেন।

ঠিক বলেছেন। বিয়ের কি কোনো বয়স থাকে। বিদেশে তো বুড়োবুড়ির হোমেও বিয়ে হয়। এখানেও সে রকম ঘটনা ঘটছে। সেদিন আমার এক ষাট বছরের বন্ধু তার ছেলেবেলার বান্ধবীকে বিয়ে করলেন প্রথমবারের মতো। আমি বলছি না আপনি ষাট। কত বয়স আপনার? ত্রিবেদী চশমার কাচ মুছে প্রশ্ন করেন।

মেয়েদের বয়স জিজ্ঞেস করতে নেই, জানেন না?

আপনার বয়স পঞ্চাশেরও কম হবে। বলেন মিসেস রাহমাতুল্লাহ।

হবে ওই রকমই কিছু। এখন বিয়ে? আপনাদের কি মাথা খারাপ? জেনেশুনে একজন বসকে জীবনে ডেকে আনব? শাসন করবেন আমাকে বাচ্চা মেয়ের মতো।

বস কেন? বন্ধুও তো হতে পারে?

আমার বন্ধুর দরকার নেই। তা ছাড়া স্বামী মানেই বস, না হলে অসহায় বালক। – আমার মোজা খুঁজে পাচ্ছি না, না হলে আমার শার্টের ইস্ত্রি নেই কেন। আর বসরা যে কী করে তা আপনারা জানেন। চুপচাপ কথা শুনছে আবির করিম। সে এবার মেঝেতে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ে তার সঙ্গের ব্যাগের ওপর মাথা রেখে। চোখ বন্ধ। সকাল হতে বেশি দেরি নেই। সকলেই এবার বসে বসে একটু একটু ঝিমাতে শুরু করেছে।

সকালের আলো ফুটে গেছে। এখন যাওয়া যাবে। বরফ নেই। সকলের আগে সাহানা আরেফিন ঘর থেকে বাইরে এসেছেন। পেছনে আবির করিম। সাহানা ওর দিকে তাকান। বলেন- তোমাকে চিনতে পেরেছি। আমার স্কুল থেকেই তো তুমি স্কুল ফাইনাল পাস করেছ, না? আবির মাথা নাড়ায়। বলেন তিনি- গল্পটা নিশ্চয় বানিয়ে বলেছ? আবির করিম বলে- না। বানিয়ে বলব কেন?

জানতাম আমাকে তুমি ভয় পাও।

তা পাই। বলেই সে অন্যদিকে তাকায়। বলে সে মুখ ঘুরিয়ে- ভয় আছে বলে আর কোনো অনুভূতি কাজ করবে না এমন কথা কে আপনাকে বলেছে।

সাহানা আরেফিন এবার আবহাওয়া জরিপ করেন। আবির করিম বলে- একদিন যখন আপনার কেউ খোঁজ নেবে না, যাদের জন্য এতকিছু করেছেন তারা আপনাকে ভুলে যাবে, তখন কী হবে?

কী হবে? সে শুনে তোমার লাভ?

তখন না হয় আপনার জীবনে একটু জায়গা করে নেব।

না, আমার কোনো পুরুষ নার্সের দরকার নেই। বলেন কঠিন গলায়।

পাগল। ছেলেটা পাগল। তিনি বলেন আরও তেমনিভাবে- তুমি কি জানতে একটু বিশ্রাম নিতে আমি দার্জিলিং এসেছি। আবির মাথা নাড়ে। ওরা সব আসছে। সাহানা আরেফিন প্রথমে গিয়ে জিপে বসেন। আবির করিম ওদের অপেক্ষা করে। ও বসবে ড্রাইভারের পাশের সিটটায়। জিপটা ছাড়বে। পল্টুর হাতে একটা খাবারের প্যাকেট তুলে দেয় ড্রাইভারের ছিপছিপে বউ। বোধকরি লুকিয়ে রাখা দুটো একটা মম। ওদের ভাষায় কী বলে কে জানে। পল্টু মাথা নাড়ে আর একটু হাসে। মোটা বখশিশ পেয়ে আজ রাতে গার্ড কতটা তরল পানীয় পান করবে, নেশা করবে, কে বলতে পারে। বোধহয় আজ আর ও উঠবে না। মেয়েটা দাঁড়িয়ে আছে। জিপ ছেড়ে দেয়। পল্টু বিষণ্ণ। আর বউটার চোখে বোধকরি জলটল কিছু হবে। এইটুকু পথ কি কাল রাতে যাওয়া যেত না? কী জানি কী ছিল এই হারামজাদা ড্রাইভার পল্টুর মনে। আর পল্টু তো মাঝে মাঝে একাও আসতে পারে। পারে না? পারে না, কারণ ড্রাইভারটা নেশাভাঙ করলে বউ পেটায়। কাজেই অজুহাত করে আসা।

ওরা খানিক পরেই দার্জিলিংয়ে পৌঁছে যাবে। তখন যে যার মতো, নিজেদের বেছে নেওয়া হোটেলে। তখন যদি রাস্তায় একজনের আর একজনের সঙ্গে দেখা হয়? কে বলতে পারে সে কথা। কে বলতে পারে তখন সাহানা আরেফিন কী বলবেন আবিরকে।

আর পল্টু হয়তো অপেক্ষায় থাকবে আবার আর কোনো যাত্রীকে বাজে আবহাওয়ার ভয় দেখিয়ে এই বাড়িতে নিয়ে আসার।

এই তো সেই বাড়িটা যেখানে সমরেশ মজুমদারের তীর্থভূমির কয়েকজন রাত্রি কাটিয়েছিলেন। এখানে এখন আর এক দল। বিভিন্ন জায়গার, বিভিন্ন বয়সী। ওদের দলের ভেতর আবির সবচাইতে কমবয়সী। সেই এমন একটা কথা বলে। বলে প্রায় আপন মনে- আরে আরে এ যে দেখছি সমরেশ মজুমদারের তীর্থভূমির সেই বাড়িটা। সকলে তাকায় আবিরের দিকে। ওদের ভেতর আর কেউ তীর্থভূমি বইটা পড়েনি। গল্পটা আবিরের ভীষণ পছন্দের একটি গল্প। ও ভুলে যায়নি। আর এই পরিবেশে এসে গল্পটা যেন সমস্ত সৌন্দর্য ও সত্য নিয়ে প্রাণ পায়।

সাহানা আরেফিন ভালোমতো শালটা টেনে শরীর ঢাকেন। তিনি দেশে একটি স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা। বয়স তার বায়ান্ন বছর। তিনি বলেন- এমন একটা বাড়িতে আমরা আটকে পড়ব কে ভেবেছিল। তিনি চারপাশে তাকান। মাথার শালটা নেই। কালো চুল চোখে পড়ে। সাদা নেই। সেগুলো রঙের কারণে কি-না কেউ বুঝতে পারে না। বলেন তিনি- এই শীতে আর তুষারে এমন একটা বাড়িতে …

ঠিক তাই। পাঁচজন মানুষের ছোটখাটো একটা দল দার্জিলিংয়ের একটা পাহাড়ে আটকে পড়লেন। পাঁচজনাই একটা জিপে নির্দিষ্ট জায়গায় পৌঁছাতে চেয়েছিলেন। ওরা পাঁচজন দার্জিলিং দেখতে এসেছেন। শিলিগুড়ির ‘নিরুপমা’ হোটেলের লাউঞ্জে সে কথা জেনেছিলেন তারা। তারপর ঠিক করেন একসঙ্গে দার্জিলিং যাবেন। তারপর যে যার মতো। জিপের ড্রাইভার বললেন- ধস নামছে। এখন আর আমি গাড়ি চালাতে পারব না। অসম্ভব ঘটনা। ওরা ভীত। বলে কী পল্টু নামের এই ড্রাইভার? গাড়িতে তুলবার সময় ওর কি এমন হবে মনে ছিল না? ওরা না হয় বাইরের মানুষ। এখানকার আবহাওয়ার সবটা জানে না। কিন্তু যে দীর্ঘদিন এখানে বাস করছে সেও কি আবহাওয়ার কথা কিছুই বুঝতে পারেনি? ওদের একটু আশ্বস্ত করে ড্রাইভার বলেছিল- একটা বাড়ি আছে। এদিক দিয়ে একটু অন্যপথে গেলে একটা ছোটখাটো বাড়িতে রাত কাটানো যেতে পারে। বাড়িটা প্রায় সবসময় তালা দেওয়াই থাকে। আপনারা যদি বলেন- আমি আজ রাতের মতো আপনাদের ওখানে পৌঁছে দিতে পারি।

তালা দেওয়া বাড়িতে? প্রশ্ন করেছিল সেই দল।

ভাগ্য ভালো হলে গার্ডকে পেয়ে যাবেন। আর ভাগ্য খারাপ হলে সকলে মিলে তালা ভাঙতে হবে। গার্ডটা কখনও থাকে কখনও থাকে না। পরে আপনারা মালিককে যা বলবার বলবেন। এখন আমি নিচেও নামতে পারব না উপরেও যেতে পারব না। কেবল পাশের রাস্তা দিয়ে সেই বাড়িটাতে নিয়ে যেতে পারি। এমন কিছু বলেই ড্রাইভার কারও কোনো কথার অপেক্ষা না করে জিপটাকে পাশের রাস্তায় তুলে দিয়েছিল।

কেমন করে নিয়ে যাবে তুমি ও পল্টু মহারাজ? কেমন করে যাব সকলে একটা তালা দেওয়া বাড়িতে? মিস্টার ত্রিবেদী, যার বয়স বোঝা যায় না তিনি বলেন।

যেমন করে হোক নিয়ে যাব। তবে কেমন করে সেটা পরে শুনবেন। কেমন করে? এমন ঘটনা আগেও দু’একবার ঘটেছে কি-না। ওই বাড়িটাই শেষ পর্যন্ত এমন বিপদে পড়া যাত্রীর আশ্রয়ের জায়গা হয়েছে। ঈশ্বর মহারাজ কখন যে কী করেন।

যখন আমরা জিপ ভাড়া করি তুমি তো বলনি এমন হতে পারে। মিস্টার ত্রিবেদী বোধহয় একটু রেগে গেছেন- আমি জানতাম না। এখানকার আবহাওয়ার কি ঠিক আছে? এখন ড্রাইভ করে উপর দিকে যাওয়ায় বিপদ হতে পারে। আর নিচের দিকে যাওয়া মানে গাধামি। দেখছেন না কী ভীষণ তুফান চারদিকে। পল্টু গাড়ি ঘোরাতে ঘোরাতে জবাব দিয়েছিল।

ওরা ঠিক বুঝতে পারছে না ড্রাইভার কি ইচ্ছে করে এমন একটা কথা বলছে। প্রবল বৃষ্টি চারপাশে। ঝরঝর মরমর শব্দ। শীত তো ছিলই। এখন মনে হয় শীত শরীরের হাড়ের ভেতর চলে যাবে। ওরা কোনো মতে শরীর ঢেকে জড়োসড়ো হয়ে বসেছে।

ওরা বুঝতে পারছে না কী বলবে। জায়গাটা কার্শিয়াং থেকে আরও একটু উপরে। এমন হবে ওরা ভাবেনি। ওরা শীতেই দার্জিলিং দেখতে চায়। মিস্টার ও মিসেস রহমাতুল্লাহ। একজন ষাট, একজন আটান্ন। মিস্টার ত্রিবেদী। বয়স বোঝা যায় না। মিস সাহানা আরেফিন বায়ান্ন-টায়ান্নর একজন। আর আবির করিম চব্বিশ বা পঁচিশ বছরের তরুণ। ওরা সকলে মিলে জিপটা যখন ভাড়া নেয় বুঝতে পারেনি এমন হবে। ওদের আলাপ হয়েছিল হোটেলে। পরে ওরা ঠিক করে একটা জিপে সকলে মিলে দার্জিলিং যাবে। শিলিগুড়ির সেই হোটেলটাতে থাকলেই হতো। এমন অবেলায় রওনা দেওয়াটাই ভুল হয়েছে। আবির করিমের উৎসাহ। পঁচিশ বছরের একটা তরুণের কথায় ওরা কি হিতাহিত জ্ঞান হারিয়েছিল?

এর মধ্যে ড্রাইভ করা ঠিক নয়। বারবার একই কথা বলতে শুরু করেছিল ড্রাইভার। তারপর একটু গম্ভীর হয়ে বলেছিল- আমার ওপর একটু আস্থা রাখতে হবে, উপায় যখন নেই।

তুমি তো একটা সাংঘাতিক লোক। কোনখানে নিয়ে তুলতে চাও আমাদের? উপায়হীনদের ভবনদী পার করানোর ঈশ্বর নাকি তুমি? মিস্টার ত্রিদেবী বলেন ভারি গলায়।

আমি নিজেও জানি না সেখানে আপনারা আজ রাতে থাকতে পারবেন কি পারবেন না। ওখানে থাকতে গেলে আগে থেকে রিজার্ভ করতে হয়। তালা ভাঙবেন, থাকবেন দরকার হলে। তারপর জবাবহিহি করবেন। তবে গার্ডের থাকার কথা। দেখা যাক কী হয়। ও মাঝে মাঝে নিজের বাড়িতে চলে যায়।

তোমার কথা শুনব না। এমন কিছু বলার অবস্থা সত্যিই নয়। মিস্টার ত্রিবেদী চুপ করেন। কাজেই পল্টুর হাতে ভাগ্য তুলে দিয়ে খাঁচার মুরগির মতো ওরা অপেক্ষা করেছিলেন সেই বাড়িটার।

ভাগ্য ভালো। গার্ড ছিল। তবে ওখানে আর এক যুগল আগে থেকেই ছিল। ওরা পাঁচজন সেখানে যখন উপস্থিত সেই যুগল নিজের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে গার্ডকে বলে- আমাদের ঘরে কেউ থাকতে পারবে না। আমরা আগে থেকে রিজার্ভ করে এসেছি। গার্ড বাধ্য হয় অন্য ঘরে ওদের বসাতে। মনে হয় মিস্টার ত্রিবেদী খুব কেউকেটা একজন। গার্ডকে বাইরে ডেকে নিয়ে কী বলতেই সে রাজি হয়। যে ঘরটায় ওরা বসেছে সেটা একটা লিভিংরুম। বলে কেবল- হুজুর আপনি সব সামলাবেন।

সকলে ঢুকে পড়ে বসার বা লিভিংরুমে। ঘরটা বেশ বড়। সেখানে ঘর গরম করবার একটা চুলো আছে। সেই দম্পতি, যারা ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করেছে তারা এতক্ষণ এখানে বসে শরীর গরম করছিল। তারা ওদের সাড়া পেয়েই নিজেদের ঘরে ঢুকে শক্ত হাতে ঘরের ছিটকিনি লাগিয়েছে। ওরা পাঁচজন সেখানে বসে। মিস্টার ত্রিবেদী একটা সিঙ্গেল সোফায়। তিনি হাতের দস্তানা খুলে হাত মেলে ধরেন সামনে। বেশ আরাম লাগছে তার। চারপাশে তুফান। বরফ। ঝড়। তিনি বলেন- এই ঘরেই বোধহয় আমাদের রাত কাটাতে হবে। মনে হয় আর কোনো শোবার ঘর নেই। আবির এবার বাড়িটা দেখবে বলে বাইরে গেছে। ঘরটায় মোমবাতির আলো মোমবাতিদানিতে। বলেন তিনি- এই যে গার্ড, সারারাত যেন চুলো জ্বলে তেমন কাঠকয়লা আছে তো? গার্ড কিছু কাঠকয়লা এনে চুলোটার আঁচ বাড়িয়ে দেয়। আবির করিম একবার অন্ধকারে বাড়িটা দেখে আসে। বাথরুম ও রান্নাঘর দেখে। যদি চা করা যায় তাহলে বেশ হবে। কিন্তু চা বা চিনি নেই। একটা কফির কৌটার তলায় কফি পড়ে আছে। সেটা থেকে পাঁচ কাপ কফি বানিয়ে পাঁচজন পান করতে পারে। বলে আবির- যারা এখানে আগে থেকে আছেন তারা কি না খেয়ে আছেন?

ওরা সঙ্গে খাবার এনেছিলেন। কাল সকালেই চলে যাবেন। আমার কাজ ছিল ওদের কেবল কফি বানিয়ে দেওয়া। আর আমার বাজার শেষ। খালি কয়েকটা ডিম আছে। পাওয়ার কাট। কাজেই মোমবাতিই সম্বল।

পারলে কফি করে আনো। গার্ড মাথা নেড়ে জানায় সে কফি করবে। – পাওয়ার কাট। মোমবাতির আলো জ্বলছে! ভারি রোমান্টিক ব্যাপার। বলে আবির। সকলে বেশ কঠিন চোখে আবিরের দিকে তাকায়। বলেন মিস্টার রহমাতুল্লাহ- তুমি এখন এর ভেতরে রোমান্টিকতা দেখছ? আবির উত্তর দেয় না। গার্ড একটা মোমবাতি নিয়ে চলে যায়। দুটো শোবার ঘর। একটা ঘরে গার্ড থাকে। ভেতরে একটা ছোট বাচ্চার আওয়াজ পেয়েছে আবির। মনে হয় গার্ডের বাচ্চা। আর একটা ঘরে দুই হানিমুন কাপল মোমবাতি আর অন্ধকারে চাঁদতারামধু কিছু না পেয়ে বোধকরি এবার ঘুমিয়ে গেছে। একটা লিভিং রুম। রান্নাঘর আর তার পাশে একটা ছোট ভাঁড়ার ঘর। বলে আবির- বাড়িটা কার?

শেখর বাবুর। তিনি বছরে দু-একবার আসেন। এমনিতে পড়েই থাকে হুজুর।

পল্টু বাড়িটাতে কি আগে এসেছে? প্রশ্ন করেন মিসেস রাহমাতুল্লাহ। গার্ড উত্তর দেয়-

কয়েকবার। আমার বউ আর ও একই গ্রামের মেয়ে হুজুর।

আবির বাড়িটা, মানুষজন, বাড়ির মালিকের খোঁজ নিয়ে ফিরে এসেছে। বলেন মিস্টার আর মিসেস রহমাতুল্লাহ জিপের লাগেজের একটা ব্যাগে বিস্কুট-কলা আছে। কিন্তু জিপের কাছে কারও যাওয়ার ইচ্ছা নেই। ওটা ত্রিপল ঢেকে চুপচাপ পড়ে আছে। চারপাশে বরফ। পড়ছে, জমছে। কাল কি ওরা সেই পথ ধরে যেতে পারবে? পল্টু বলে পারব। কাল সকালে সূর্য উঠবে। দার্জিলিং খুব বেশি দূরে নেই।

কাল সকালে কী হবে সেটা সকালের হাতে রেখে দেওয়াই ভালো। এখন রাতটা কাটানো যাক। ঘড়ি দেখে জানে রাত মাত্র দশটা। সকাল হতে অনেক দেরি। আলো নেই বই পড়বার মতো। হাতব্যাগে একটা গল্পের বই আছে, সাহানা আরেফিন সেটা পড়তে পারবে না। ত্রিবেদীও নয়। মিস্টার ও মিসেস রহমাতুল্লাহর ব্যাগে নানা ওষুধ। বই নেই। আবির করিমের ক্যামেরা। লেখার কাগজ। বই সঙ্গে হাতে নেই তবে ব্যাগে আছে। ও বসে। হাত গরম করে। – কিছু পেলেন রাত কাটানোর মতো?

কী পাব? এখানে পাওয়ার মতো কিছু আছে? সাহানা আরেফিন জানান। ঘণ্টা খানেক সবাই বসে থাকে প্রায় চুপচাপ। এর ওর সঙ্গে আলাপ, নাম জানা, সে তো হোটেলেই হয়েছে। কয়েকটা কম্বল উদ্ধার করা হয় রান্নার পাশের ঘরটা থেকে। অন্ধকার। ময়লা না পরিস্কার বোঝা যায় না, তাইতেই রক্ষা। পায়ের পাতা ঢাকার মতো ছোট কম্বল। মেঝেতে একটা চটের কার্পেট বিছানো। শেখরবাবু কেন একটা সুন্দর দামি কার্পেট লাগাননি সেটা ওরা ভাবতে থাকে। জানা গেল শেখর বাবু একজন সংসারহীন সন্ন্যাসী জাতীয় মানুষ। এখানে আসেন নাকি ধ্যান করতে। কলকাতায় সমাজসেবা, এটা সেটা করেন। কেন গৃহী নন সেটা গার্ড কী করে বলবে। ধ্যানের জন্য বড় বাড়ির দরকার কী? গুহা হলেও চলে। তবে তিনি গুহাবাসী নন। এখানে আসেন, ধ্যান করেন, ঈশ্বর নিয়ে ভাবনা করেন তারপর চলে যান।

চলুন আমরা একটা করে গল্প করি। জীবনের গল্প। প্রেমের গল্প। আবির করিম দলটাকে চাঙ্গা করতে এমন একটা প্রস্তাব করে। সকলে প্রথমে একটু গম্ভীর হয়ে থাকলে পরে হাসে। বলেন ত্রিবেদী- আপনিই আগে শুরু করুন। আপনার বয়স কম। নিশ্চয় অনেক প্রেমের গল্প আপনার জানা।

তা তো আছেই। তবে আমি অনুরোধ করব মিস্টার ও মিসেস রহমাতুল্লাহকে, ওরা আগে বলুক। কে বলবেন? মিস্টার না মিসেস?

আমরা আগে শুরু করব? কারণ কী?

তেমন কোনো কারণ নেই। তবে আপনাদের যুগলকে দেখে মনে হয় আপনারা প্রেমের গল্প জানেন।

তুমি বল। মিসেস রহমাতুল্লাহ স্বামীকে বলেন। সকলে পায়ের কম্বল, চুলোর আঁচ উসকে ভালো হয়ে বসে। গার্ডের বাড়িতে যে কটা ডিম ছিল তা শেষ। ওর বউ ডিম ভেজে দিয়েছে। বলেছে গার্ড- আর কিছু নেই। কাল বাজার। তারপর খাওয়া। পল্টুর দেখা নেই। বোধকরি গার্ডের ঘরে ঢুকেছে।

প্রেম একটা শক্তিশালী ব্যাপার। এত শক্তি রাখে পৃথিবীটাকেই বদলে দিতে পারে। ধরুন হিটলারের ঘৃণা যদি প্রেম হতো তাহলে কী হতো? সমস্ত পৃথিবীর চেহারা বদলে যেত না? বেশ একটু ভূমিকা শুরু করেন তিনি। ওরা বসে আছে গল্পের অপেক্ষায়। এই যে আমি আর মিমি দীর্ঘদিন প্রেম করেছি। ওর বাবা-মা রাজি নন, আমার বাবা-মাও নয়। কারণ মিমিদের পদমর্যাদা বংশমর্যাদা আমাদের চেয়ে উঁচুতে। আমার বাবা লোকজনের ফরমাশ মতো কাঠের জিনিস বানান। ভাগ্যক্রমে আমি পড়াশোনায় ভালো। আমার বাবা-মায়ের আপত্তি এত বড়ঘরের মেয়ে তাদের সংসারে রবীন্দ্রনাথের সেই গানের মতো বেমানান হবে- এই মনিহার আমায় নাহি সাজে। বিয়ে করব আমি মাথা ব্যথা তাদের। আর ওর মা-বাবা বিয়াই-বেয়ানকে জাতে তুলতে পারবেন না সেটা তাদের মাথাব্যথা। বড় বড় পার্টিতে একমাত্র মেয়ের শ্বশুর-শাশুড়ি আসতে পারবেন না, বিয়ের কার্ডে কোনো ভালো লোকের নাম লেখা যাবে না, এইসব ভাবনায় একেবারেই অনড় তারা। তিনি একটু চুপ করেন। মিসেস রহমাতুল্লাহ বা মিমি একটু হাসিমুখে স্বামীকে দেখছেন। বয়সিনী মহিলার কেমন আদুরে নাম। বোঝা যায় এককালে তিনি দেখতে ভালো ছিলেন। যখন প্রেমের গল্প শুরু হয় ওর মুখে মোমের আলোর মতো এক ধরনের আলো তাকে নতুন এক ফাউন্ডেশন ক্রিম-ঘষা মুখের মতো লাবণ্যময়ী করে তুলছে। তারপর কী হলো? সাহানা আরেফিনের গলা। মনে হয় তার গলার স্বরটাও বদলে গেছে। এ গলা ছাত্রশাসন করবার গলা নয়। যখন প্রেমের গল্প, গলা এমন করে নতুন হয়ে যায়। মিসেস রহমাতুল্লাহ এবার আপনি বলুন।

না, ওই বলুক। ও খুব ভালো গল্প বলতে পারে।

এরপর কী করা যায়? আমি বিদেশে যাবার একটা স্কলারশিপ পেয়ে গেলাম। ও তখন কেবল এমএ পাস করেছে। বললাম, তুমিও একটা স্কলারশিপ সংগ্রহ কর মিমি। আমরা বিদেশে বিয়েটা সেরে ফেলব।

ও সেটা পারেনি। যখন ফিরে এসেছি ও চাকরি করছে চট্টগ্রামে। আমার বাবা মারা গেছেন করাত কলে পড়ে। আমি একটা ভালো চাকরি করছি। ছুতোরের ছেলের গায়ের গন্ধটা তখন বিদেশি সাবানে, আফটার শেভে, আর আমার নামের শেষের কান্টাবের কারণে অনেকটা জাতে উঠেছে। কাজেই বিয়ে হলো।

গল্পটায় তেমন সাসপেন্স নেই, একেবারে নতুন লেখকের প্রেমের গল্পের মতো। দেন দে লিভ হ্যাপিলি এভার আফটার, ব্যস, গল্প শেষ। বলে আবির করিম। মিস্টার রহমাতুল্লাহ বলেন- নট কোয়ায়েট। একটা পা বের করেন। তার একটা পা নেই। সেখানে নকল পা। বলেন- কাটা পড়েছে। মারা যাইনি। ওই এখন আমাকে দেখাশোনা করে। প্রেম না থাকলে এসব মানত কেউ? এক বছর হাসপাতালে। তারপর বাড়িতে ফিরে আসি।

কেউ কি আর মানত বলছেন? তা মানত। কত দাম্পত্যজীবন দেখেছি একজন আর একজনকে মেনে নেয়। সেখানে প্রেম আছে কি নেই, কে জানে। বলেন ত্রিবেদী। কেউ বিছানায় পড়ে আছে দীর্ঘদিন, কারও শরীর অবশ, কারও মাথাটা আগের মতো কাজ করে না, কেউ নেশাভাঙে বিবশ, তারপরও একজন আর একজনকে মেনে নেয়। এখন বলুন আপনি বলতে চান এটাই আপনাদের প্রেমের শ্রেষ্ঠ ব্যাপার? যখন আপনি পা হারালেন, ধারণা করছি চাকরিও হারালেন, ও আপনাকে দেখছে এবং ভালোবাসছে?

রহমাতুল্লাহ হাসছেন। তার পা দুটো আবার কম্বলের নিচে চাপা পড়েছে। একটা আসল আর একটা নকল পা। বলেন- এটা একটা বড় ঘটনা। কিন্তু সে ঘটনাকে আমরা প্রেমের সর্বশ্রেষ্ঠ ঘটনা বলে মনে করি না। আমরা মনে করি তিন বছরে আমরা দু’জনে দু’জনকে যতগুলো চিঠি লিখেছি, সেটাই আমাদের জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ ফসল। প্রতি সপ্তাহে একটা। ও একটা আমি একটা। অপূর্ব সেসব লেখা। ভাবতে পারিনি কোনোদিন এমন লেখা আমরা লিখতে পারব- প্রেমে, বেদনায়, আনন্দে, দুঃখে, বিষাদে, একাকীত্বে, সন্তাপে, শোকে, শ্নোকে, বর্ষণে, শ্রাবণে, শীতে আর রোদে, গানে আর তানে, গদ্যে আর পদ্যে, লিরিকে আর মহাকাব্যে, সেসব তুলনাহীন।

হাততালি পড়ে।

বুঝলাম। বলেন সাহানা আরেফিন। – কেবল সেসব মনে করে যিনি এমন একটা বড় বাক্য অবলীলাক্রমে বলে ফেলতে পারেন তার আর প্রেমিকার সেসব চিঠি যে কতটা মনোরম, হৃদয়গ্রাহী, ভাষার কারুকার্যে অসামান্য তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। চিঠির কথা বলতেই আপনাদের দু’জনের মুখ কেমন উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল, মোমবাতির অল্প আলোতেও সেসব বোঝা গেছে। এমন সব চিঠি। বই করে ছাপান না কেন?

কী যে বলেন। ওসব আমাদের বিবাহিত জীবনের বন্ধ্যাজমির ফসল। আমাদের কোনো সন্তান নেই। আমরা দু’জন কোনো কোনো দিন বারবার ওগুলো পড়ি। ওরটা আমি, আমারটা ও, না হলে ভাসাইভার্সা। আরও বেশি ভালোবাসি দু’জন দু’জনকে তখন। ওই চিঠিগুলোর কাছে আমরা কৃতজ্ঞ।

মিস্টার আর মিসেস রহমাতুল্লাহ সোফায় আরও কাছাকাছি আসেন। মিসেস রহমাতুল্লাহর মাথা স্বামীর কাঁধে। তার দুই চোখে হাসি নয় কোমল শিশির টলটল। মিস্টার রাহমাতুল্লাহর একটি হাত স্ত্রীর শরীর একটু আদর করে।

ত্রিবেদী তার গল্পটা বড় করে বলতে পারেন না। বোঝা যায় একজনকে ভালোবেসেছিলেন গভীর করে। তাকে পাননি। বিয়ে করেছেন। তিন জন সন্তান। পড়াশোনা করছে দু’জন, একজন চাকরি শুরু করেছে। এখন সেইসব প্রেমট্রেম বোধকরি মনে করেন না। বড় সরকারি চাকরি করেন। আগামী বছর রিটায়ার করবেন। এখানেই কোথাও থাকবেন। তার ও স্ত্রীর এমন ইচ্ছা। একটা বাড়ি দেখতে এসেছেন। আসল বাড়ি জলপাইগুড়িতে। শেষজীবনের দিনগুলো কাটাবেন বলে। বলেন- ওকে আর মনে করি না। বলেই হাসেন।

একেবারেই মনে করেন না? আবির করিম প্রশ্ন করেন।

একেকদিন মনে হয়। বলুন তো কখন?

কখন? যখন বৃষ্টি পড়ে, ফুলবাগান দেখেন, না হলে কোনো চমৎকার নিসর্গে ভাবেন জীবনের এতকিছুর ভেতরে কেন একটা মুখ বারবার ভেসে ওঠে, যার কোনো অর্থ করতে পারেন না, একটা অপূর্ব বেদনা, যা পান করতে দুঃখ ও আনন্দ। যখন নিঃসঙ্গ। এবং যখন অপ্রিয় সঙ্গ। আবির বলে- নট কোয়ায়েট ইয়ংম্যান। তিনি ভাবছেন। ভাবছেন। অনেকক্ষণ কথা বলেন না। বলেন সাহানা – তাহলে কখন?

আমাদের পাশের বাড়িতে যে মেয়েটা এসেছে কয়েক বছর হলো ইঞ্জিনিয়ার স্বামীর ঘর করতে ওকে দেখলে। একেবারে মায়ের মুখটা বসানো কি-না। লীলার গানের গলাটাও মায়ের মতো। ওর মা আর নেই। মায়াকে আমি লীলাবতী বলে ডাকতাম। মায়া অঙ্কে খুব ভালো ছিল। বলতাম- তুমি আমার লীলাবতী।

মেয়েটার নাম কী?

দূর্বা।

এই বলেই ত্রিবেদী চোখ বন্ধ করেছেন। দীর্ঘ প্রেমের গল্প তিনি করতে পারেন না। মোমবাতি আর কতক্ষণ জ্বলবে কে জানে। গার্ড বলেছে আর মোমবাতি নেই। আলোটা ছোট হয়ে আসছে। রাত গভীর। সকাল হতে এখনও অনেক দেরি।

এরপর যখন ত্রিবেদী আবার এই পৃথিবীতে ফিরে আসেন। আবির করিমের দিকে তাকিয়ে বলেন- ইয়ংম্যান, তোমার কাছে একটা রক্তমাংসের প্রেমের গল্প আশা করছি। আমাদের মতো নিরামিষ গল্প নয়। কখন যে সম্বোধন তুমি হয়ে গেছে বুঝতে পারেন না।

আবির করিম মুখ নিচু করে। আলোটা কমে আসছে। দেয়ালে ছবির মতো ওদের ছায়া। বলেন আবির- আমার গল্পটা একতরফা প্রেমের। রক্তমাংসের কারবার নেই।

দূর, এমন গল্প তুমি করবে? রহমাতুল্লাহ বলেন।

তাই তো করতে হবে। আপনার মতো চিঠি লেখালেখির পর্বও নেই। একেবারে ছবির দিকে তাকিয়ে ভালোবাসার মতো ঘটনা।

নায়িকা কি কোনো দেশি-বিদেশি ছবির নায়িকা। কোনো গ্লামারাস অভিনেত্রী? কোনো অপূর্ব শরীর আর মুখ?

না। একেবারেই মাটির পৃথিবীর কঠিন নারী।

কঠিন নারী?

বলতেই হয়। চারশ’জন ছাত্রকে সামলাতে পারার মতো কঠিন।

কোনো স্কুলের শিক্ষিকা?

ঠিক তাই। আমি যে স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করি তার প্রধান শিক্ষিকা। পুরুষ যেখানে ছাত্র সামলাতে হিমশিম খায় সেখানে তিনি কী চমৎকারভাবে সবকিছু সামলান। কঠিন ব্যক্তিত্ব।

কত বয়স তার?

কত কে জানে। তবে আমি আমার তেরো বছর বয়স থেকে তাকেই ভালোবাসি। কারণ জিজ্ঞাসা করবেন না, আমি কারণ জানি না।

ও। এমন হতে পারে। হিরো ওয়ার্শিপের মতো কোনো ব্যাপার। তোমার ঘটনা শুনে মনে হলো হিরোইন ওয়ার্শিপের মতো কোনো ব্যাপার তোমার। ত্রিবেদী হেসে বলেন।

সাহানা আরেফিন দেয়ালের দিকে তাকিয়ে আছেন। অন্ধকারে দেয়ালের ছায়াগুলো দেখতে প্যাস্টেলে আঁকা ছবির মতো।

কোনো আনন্দ পাওয়া গেল না তোমার গল্পে। আমরা বুড়োরা যেমন গল্প করতে পেরেছি তার কাছাকাছিও নয় তোমার গল্প। এবার একটা সত্যিকারের গল্প বল। ওসব ওয়ার্শিপ নিয়ে তো আর জীবন চলবে না। কত বয়স তোমার?

আমার বয়স পঁচিশ।

একেবারে হোপলেস একটা গল্প। মনে মনে আর একটা গল্প ঠিক কর। ত্রিবেদী উঠে জানালা দিয়ে বাইরে তাকান। মনে হয় তুষার পড়ছে না। এখনও সকাল হতে বাকি আছে। ওরা দু’জন মানে মিস্টার ও মিসেস রহমাতুল্লাহ বেড়ালের মতো না হলে বসন্তের পাখির মতো কাঁধে মাথা রেখে বোধকরি ঘুমিয়ে আছে। না ঘুমাননি তারা। বলেন মিসেস রহমাতুল্লাহ- সারাজীবন তো এমন একজন নারীর চেহারা ভেবে জীবন কাটাতে পারবে না। বল এমন কেউ যাকে এখন তোমার ভালো লাগছে। যাকে তুমি বুকের ভেতরে পেতে চাও।

তেমন কেউ এখনও জীবনে আসেনি। আপনাদের ফোন নম্বর আছে আমার নোটবুকে। এলে জানাব, ঠিক আছে?

মিসেস রহমাতুল্লাহ আবার চোখ বন্ধ করেন।

সাহানা আরেফিন চোখ বন্ধ করে সোফায় মাথা রেখে ঘুমিয়ে কি?

আবির করিম বাইরে আসে। বাথরুমে যেতে হবে। গার্ডের ঘরটা পার হলে বাথরুম। দু’জন ছায়ামূর্তি দাঁড়িয়ে আছে। ওরা কারা? একজন তো পল্টু। সেই হতচ্ছাড়া ড্রাইভার। আর ওর সঙ্গে ওই নারীমূর্তি কি ড্রাইভারের বউ? তাই তো মনে হয়। ছিপছিপে শ্যামলা একটা মেয়ে ডিমভাজি দিতে এসেছিল ঘোমটা টেনে। ওরা কথা বলছে খুব কাছাকাছি দাঁড়িয়ে। বেশ একটু অন্তরঙ্গভাবে। ওদের ভাষা বোঝে না আবির করিম। আবিরকে দেখে ওরা ঘরের ভেতর চলে যায়। -ও এই। গাঁয়ের মেয়েকে দেখতে আসে মনে হলে? মানুষকে বাজে আবহাওয়ার ভয় দেখিয়ে? বলেছিল- বেশ কয়েকবার ওই বাড়িতে যেতে হয়েছে। বাড়িটা আমার চেনা। আর ওই গার্ড? সেকি ঘুমিয়ে? বউ কী করছে না করছে সেদিকে কোনো খেয়াল নেই? মরুক। ও নিয়ে আমার কী? আবির চুপচাপ চলে যায় বাথরুমের দিকে। বলে- তোমার প্রেমের গল্পটাই সবচেয়ে জমকালো। কিন্তু কেউ তোমাকে ডাকবে না সেসব শুনতে।

গার্ডের বউ আর পল্টু খুব কাছাকাছি দাঁড়িয়ে ফিসফিস করে কী সব বলছে সেটা কি প্রেম না আর কিছু। তবে দাঁড়ানোটা সন্দেহজনক। মরুক। যা ইচ্ছে হোক। ব্লাডার খালি করে আবির ফিরে আসে।

ঘরের ভেতর সকলের অনুরোধে সাহানা আরেফিন গল্প শুরু করেছেন। হেসে বলেন প্রেম? সময় কোথায়? ভাইবোনদের মানুষ করেছি। তারপর যখন নিজের দিকে তাকালাম দেখি বিয়ের বয়স আর নেই।

আপনি দেখতে তো এখনও বেশ। বলেন রহমাতুল্লাহ। এখনও কাউকে পেতে পারেন যদি ইচ্ছে করেন।

ঠিক বলেছেন। বিয়ের কি কোনো বয়স থাকে। বিদেশে তো বুড়োবুড়ির হোমেও বিয়ে হয়। এখানেও সে রকম ঘটনা ঘটছে। সেদিন আমার এক ষাট বছরের বন্ধু তার ছেলেবেলার বান্ধবীকে বিয়ে করলেন প্রথমবারের মতো। আমি বলছি না আপনি ষাট। কত বয়স আপনার? ত্রিবেদী চশমার কাচ মুছে প্রশ্ন করেন।

মেয়েদের বয়স জিজ্ঞেস করতে নেই, জানেন না?

আপনার বয়স পঞ্চাশেরও কম হবে। বলেন মিসেস রাহমাতুল্লাহ।

হবে ওই রকমই কিছু। এখন বিয়ে? আপনাদের কি মাথা খারাপ? জেনেশুনে একজন বসকে জীবনে ডেকে আনব? শাসন করবেন আমাকে বাচ্চা মেয়ের মতো।

বস কেন? বন্ধুও তো হতে পারে?

আমার বন্ধুর দরকার নেই। তা ছাড়া স্বামী মানেই বস, না হলে অসহায় বালক। – আমার মোজা খুঁজে পাচ্ছি না, না হলে আমার শার্টের ইস্ত্রি নেই কেন। আর বসরা যে কী করে তা আপনারা জানেন। চুপচাপ কথা শুনছে আবির করিম। সে এবার মেঝেতে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ে তার সঙ্গের ব্যাগের ওপর মাথা রেখে। চোখ বন্ধ। সকাল হতে বেশি দেরি নেই। সকলেই এবার বসে বসে একটু একটু ঝিমাতে শুরু করেছে।

সকালের আলো ফুটে গেছে। এখন যাওয়া যাবে। বরফ নেই। সকলের আগে সাহানা আরেফিন ঘর থেকে বাইরে এসেছেন। পেছনে আবির করিম। সাহানা ওর দিকে তাকান। বলেন- তোমাকে চিনতে পেরেছি। আমার স্কুল থেকেই তো তুমি স্কুল ফাইনাল পাস করেছ, না? আবির মাথা নাড়ায়। বলেন তিনি- গল্পটা নিশ্চয় বানিয়ে বলেছ? আবির করিম বলে- না। বানিয়ে বলব কেন?

জানতাম আমাকে তুমি ভয় পাও।

তা পাই। বলেই সে অন্যদিকে তাকায়। বলে সে মুখ ঘুরিয়ে- ভয় আছে বলে আর কোনো অনুভূতি কাজ করবে না এমন কথা কে আপনাকে বলেছে।

সাহানা আরেফিন এবার আবহাওয়া জরিপ করেন। আবির করিম বলে- একদিন যখন আপনার কেউ খোঁজ নেবে না, যাদের জন্য এতকিছু করেছেন তারা আপনাকে ভুলে যাবে, তখন কী হবে?

কী হবে? সে শুনে তোমার লাভ?

তখন না হয় আপনার জীবনে একটু জায়গা করে নেব।

না, আমার কোনো পুরুষ নার্সের দরকার নেই। বলেন কঠিন গলায়।

পাগল। ছেলেটা পাগল। তিনি বলেন আরও তেমনিভাবে- তুমি কি জানতে একটু বিশ্রাম নিতে আমি দার্জিলিং এসেছি। আবির মাথা নাড়ে। ওরা সব আসছে। সাহানা আরেফিন প্রথমে গিয়ে জিপে বসেন। আবির করিম ওদের অপেক্ষা করে। ও বসবে ড্রাইভারের পাশের সিটটায়। জিপটা ছাড়বে। পল্টুর হাতে একটা খাবারের প্যাকেট তুলে দেয় ড্রাইভারের ছিপছিপে বউ। বোধকরি লুকিয়ে রাখা দুটো একটা মম। ওদের ভাষায় কী বলে কে জানে। পল্টু মাথা নাড়ে আর একটু হাসে। মোটা বখশিশ পেয়ে আজ রাতে গার্ড কতটা তরল পানীয় পান করবে, নেশা করবে, কে বলতে পারে। বোধহয় আজ আর ও উঠবে না। মেয়েটা দাঁড়িয়ে আছে। জিপ ছেড়ে দেয়। পল্টু বিষণ্ণ। আর বউটার চোখে বোধকরি জলটল কিছু হবে। এইটুকু পথ কি কাল রাতে যাওয়া যেত না? কী জানি কী ছিল এই হারামজাদা ড্রাইভার পল্টুর মনে। আর পল্টু তো মাঝে মাঝে একাও আসতে পারে। পারে না? পারে না, কারণ ড্রাইভারটা নেশাভাঙ করলে বউ পেটায়। কাজেই অজুহাত করে আসা।

ওরা খানিক পরেই দার্জিলিংয়ে পৌঁছে যাবে। তখন যে যার মতো, নিজেদের বেছে নেওয়া হোটেলে। তখন যদি রাস্তায় একজনের আর একজনের সঙ্গে দেখা হয়? কে বলতে পারে সে কথা। কে বলতে পারে তখন সাহানা আরেফিন কী বলবেন আবিরকে।

আর পল্টু হয়তো অপেক্ষায় থাকবে আবার আর কোনো যাত্রীকে বাজে আবহাওয়ার ভয় দেখিয়ে এই বাড়িতে নিয়ে আসার।

এই তো সেই বাড়িটা যেখানে সমরেশ মজুমদারের তীর্থভূমির কয়েকজন রাত্রি কাটিয়েছিলেন। এখানে এখন আর এক দল। বিভিন্ন জায়গার, বিভিন্ন বয়সী। ওদের দলের ভেতর আবির সবচাইতে কমবয়সী। সেই এমন একটা কথা বলে। বলে প্রায় আপন মনে- আরে আরে এ যে দেখছি সমরেশ মজুমদারের তীর্থভূমির সেই বাড়িটা। সকলে তাকায় আবিরের দিকে। ওদের ভেতর আর কেউ তীর্থভূমি বইটা পড়েনি। গল্পটা আবিরের ভীষণ পছন্দের একটি গল্প। ও ভুলে যায়নি। আর এই পরিবেশে এসে গল্পটা যেন সমস্ত সৌন্দর্য ও সত্য নিয়ে প্রাণ পায়।

সাহানা আরেফিন ভালোমতো শালটা টেনে শরীর ঢাকেন। তিনি দেশে একটি স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা। বয়স তার বায়ান্ন বছর। তিনি বলেন- এমন একটা বাড়িতে আমরা আটকে পড়ব কে ভেবেছিল। তিনি চারপাশে তাকান। মাথার শালটা নেই। কালো চুল চোখে পড়ে। সাদা নেই। সেগুলো রঙের কারণে কি-না কেউ বুঝতে পারে না। বলেন তিনি- এই শীতে আর তুষারে এমন একটা বাড়িতে …

ঠিক তাই। পাঁচজন মানুষের ছোটখাটো একটা দল দার্জিলিংয়ের একটা পাহাড়ে আটকে পড়লেন। পাঁচজনাই একটা জিপে নির্দিষ্ট জায়গায় পৌঁছাতে চেয়েছিলেন। ওরা পাঁচজন দার্জিলিং দেখতে এসেছেন। শিলিগুড়ির ‘নিরুপমা’ হোটেলের লাউঞ্জে সে কথা জেনেছিলেন তারা। তারপর ঠিক করেন একসঙ্গে দার্জিলিং যাবেন। তারপর যে যার মতো। জিপের ড্রাইভার বললেন- ধস নামছে। এখন আর আমি গাড়ি চালাতে পারব না। অসম্ভব ঘটনা। ওরা ভীত। বলে কী পল্টু নামের এই ড্রাইভার? গাড়িতে তুলবার সময় ওর কি এমন হবে মনে ছিল না? ওরা না হয় বাইরের মানুষ। এখানকার আবহাওয়ার সবটা জানে না। কিন্তু যে দীর্ঘদিন এখানে বাস করছে সেও কি আবহাওয়ার কথা কিছুই বুঝতে পারেনি? ওদের একটু আশ্বস্ত করে ড্রাইভার বলেছিল- একটা বাড়ি আছে। এদিক দিয়ে একটু অন্যপথে গেলে একটা ছোটখাটো বাড়িতে রাত কাটানো যেতে পারে। বাড়িটা প্রায় সবসময় তালা দেওয়াই থাকে। আপনারা যদি বলেন- আমি আজ রাতের মতো আপনাদের ওখানে পৌঁছে দিতে পারি।

তালা দেওয়া বাড়িতে? প্রশ্ন করেছিল সেই দল।

ভাগ্য ভালো হলে গার্ডকে পেয়ে যাবেন। আর ভাগ্য খারাপ হলে সকলে মিলে তালা ভাঙতে হবে। গার্ডটা কখনও থাকে কখনও থাকে না। পরে আপনারা মালিককে যা বলবার বলবেন। এখন আমি নিচেও নামতে পারব না উপরেও যেতে পারব না। কেবল পাশের রাস্তা দিয়ে সেই বাড়িটাতে নিয়ে যেতে পারি। এমন কিছু বলেই ড্রাইভার কারও কোনো কথার অপেক্ষা না করে জিপটাকে পাশের রাস্তায় তুলে দিয়েছিল।

কেমন করে নিয়ে যাবে তুমি ও পল্টু মহারাজ? কেমন করে যাব সকলে একটা তালা দেওয়া বাড়িতে? মিস্টার ত্রিবেদী, যার বয়স বোঝা যায় না তিনি বলেন।

যেমন করে হোক নিয়ে যাব। তবে কেমন করে সেটা পরে শুনবেন। কেমন করে? এমন ঘটনা আগেও দু’একবার ঘটেছে কি-না। ওই বাড়িটাই শেষ পর্যন্ত এমন বিপদে পড়া যাত্রীর আশ্রয়ের জায়গা হয়েছে। ঈশ্বর মহারাজ কখন যে কী করেন।

যখন আমরা জিপ ভাড়া করি তুমি তো বলনি এমন হতে পারে। মিস্টার ত্রিবেদী বোধহয় একটু রেগে গেছেন- আমি জানতাম না। এখানকার আবহাওয়ার কি ঠিক আছে? এখন ড্রাইভ করে উপর দিকে যাওয়ায় বিপদ হতে পারে। আর নিচের দিকে যাওয়া মানে গাধামি। দেখছেন না কী ভীষণ তুফান চারদিকে। পল্টু গাড়ি ঘোরাতে ঘোরাতে জবাব দিয়েছিল।

ওরা ঠিক বুঝতে পারছে না ড্রাইভার কি ইচ্ছে করে এমন একটা কথা বলছে। প্রবল বৃষ্টি চারপাশে। ঝরঝর মরমর শব্দ। শীত তো ছিলই। এখন মনে হয় শীত শরীরের হাড়ের ভেতর চলে যাবে। ওরা কোনো মতে শরীর ঢেকে জড়োসড়ো হয়ে বসেছে।

ওরা বুঝতে পারছে না কী বলবে। জায়গাটা কার্শিয়াং থেকে আরও একটু উপরে। এমন হবে ওরা ভাবেনি। ওরা শীতেই দার্জিলিং দেখতে চায়। মিস্টার ও মিসেস রহমাতুল্লাহ। একজন ষাট, একজন আটান্ন। মিস্টার ত্রিবেদী। বয়স বোঝা যায় না। মিস সাহানা আরেফিন বায়ান্ন-টায়ান্নর একজন। আর আবির করিম চব্বিশ বা পঁচিশ বছরের তরুণ। ওরা সকলে মিলে জিপটা যখন ভাড়া নেয় বুঝতে পারেনি এমন হবে। ওদের আলাপ হয়েছিল হোটেলে। পরে ওরা ঠিক করে একটা জিপে সকলে মিলে দার্জিলিং যাবে। শিলিগুড়ির সেই হোটেলটাতে থাকলেই হতো। এমন অবেলায় রওনা দেওয়াটাই ভুল হয়েছে। আবির করিমের উৎসাহ। পঁচিশ বছরের একটা তরুণের কথায় ওরা কি হিতাহিত জ্ঞান হারিয়েছিল?

এর মধ্যে ড্রাইভ করা ঠিক নয়। বারবার একই কথা বলতে শুরু করেছিল ড্রাইভার। তারপর একটু গম্ভীর হয়ে বলেছিল- আমার ওপর একটু আস্থা রাখতে হবে, উপায় যখন নেই।

তুমি তো একটা সাংঘাতিক লোক। কোনখানে নিয়ে তুলতে চাও আমাদের? উপায়হীনদের ভবনদী পার করানোর ঈশ্বর নাকি তুমি? মিস্টার ত্রিদেবী বলেন ভারি গলায়।

আমি নিজেও জানি না সেখানে আপনারা আজ রাতে থাকতে পারবেন কি পারবেন না। ওখানে থাকতে গেলে আগে থেকে রিজার্ভ করতে হয়। তালা ভাঙবেন, থাকবেন দরকার হলে। তারপর জবাবহিহি করবেন। তবে গার্ডের থাকার কথা। দেখা যাক কী হয়। ও মাঝে মাঝে নিজের বাড়িতে চলে যায়।

তোমার কথা শুনব না। এমন কিছু বলার অবস্থা সত্যিই নয়। মিস্টার ত্রিবেদী চুপ করেন। কাজেই পল্টুর হাতে ভাগ্য তুলে দিয়ে খাঁচার মুরগির মতো ওরা অপেক্ষা করেছিলেন সেই বাড়িটার।

ভাগ্য ভালো। গার্ড ছিল। তবে ওখানে আর এক যুগল আগে থেকেই ছিল। ওরা পাঁচজন সেখানে যখন উপস্থিত সেই যুগল নিজের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে গার্ডকে বলে- আমাদের ঘরে কেউ থাকতে পারবে না। আমরা আগে থেকে রিজার্ভ করে এসেছি। গার্ড বাধ্য হয় অন্য ঘরে ওদের বসাতে। মনে হয় মিস্টার ত্রিবেদী খুব কেউকেটা একজন। গার্ডকে বাইরে ডেকে নিয়ে কী বলতেই সে রাজি হয়। যে ঘরটায় ওরা বসেছে সেটা একটা লিভিংরুম। বলে কেবল- হুজুর আপনি সব সামলাবেন।

সকলে ঢুকে পড়ে বসার বা লিভিংরুমে। ঘরটা বেশ বড়। সেখানে ঘর গরম করবার একটা চুলো আছে। সেই দম্পতি, যারা ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করেছে তারা এতক্ষণ এখানে বসে শরীর গরম করছিল। তারা ওদের সাড়া পেয়েই নিজেদের ঘরে ঢুকে শক্ত হাতে ঘরের ছিটকিনি লাগিয়েছে। ওরা পাঁচজন সেখানে বসে। মিস্টার ত্রিবেদী একটা সিঙ্গেল সোফায়। তিনি হাতের দস্তানা খুলে হাত মেলে ধরেন সামনে। বেশ আরাম লাগছে তার। চারপাশে তুফান। বরফ। ঝড়। তিনি বলেন- এই ঘরেই বোধহয় আমাদের রাত কাটাতে হবে। মনে হয় আর কোনো শোবার ঘর নেই। আবির এবার বাড়িটা দেখবে বলে বাইরে গেছে। ঘরটায় মোমবাতির আলো মোমবাতিদানিতে। বলেন তিনি- এই যে গার্ড, সারারাত যেন চুলো জ্বলে তেমন কাঠকয়লা আছে তো? গার্ড কিছু কাঠকয়লা এনে চুলোটার আঁচ বাড়িয়ে দেয়। আবির করিম একবার অন্ধকারে বাড়িটা দেখে আসে। বাথরুম ও রান্নাঘর দেখে। যদি চা করা যায় তাহলে বেশ হবে। কিন্তু চা বা চিনি নেই। একটা কফির কৌটার তলায় কফি পড়ে আছে। সেটা থেকে পাঁচ কাপ কফি বানিয়ে পাঁচজন পান করতে পারে। বলে আবির- যারা এখানে আগে থেকে আছেন তারা কি না খেয়ে আছেন?

ওরা সঙ্গে খাবার এনেছিলেন। কাল সকালেই চলে যাবেন। আমার কাজ ছিল ওদের কেবল কফি বানিয়ে দেওয়া। আর আমার বাজার শেষ। খালি কয়েকটা ডিম আছে। পাওয়ার কাট। কাজেই মোমবাতিই সম্বল।

পারলে কফি করে আনো। গার্ড মাথা নেড়ে জানায় সে কফি করবে। – পাওয়ার কাট। মোমবাতির আলো জ্বলছে! ভারি রোমান্টিক ব্যাপার। বলে আবির। সকলে বেশ কঠিন চোখে আবিরের দিকে তাকায়। বলেন মিস্টার রহমাতুল্লাহ- তুমি এখন এর ভেতরে রোমান্টিকতা দেখছ? আবির উত্তর দেয় না। গার্ড একটা মোমবাতি নিয়ে চলে যায়। দুটো শোবার ঘর। একটা ঘরে গার্ড থাকে। ভেতরে একটা ছোট বাচ্চার আওয়াজ পেয়েছে আবির। মনে হয় গার্ডের বাচ্চা। আর একটা ঘরে দুই হানিমুন কাপল মোমবাতি আর অন্ধকারে চাঁদতারামধু কিছু না পেয়ে বোধকরি এবার ঘুমিয়ে গেছে। একটা লিভিং রুম। রান্নাঘর আর তার পাশে একটা ছোট ভাঁড়ার ঘর। বলে আবির- বাড়িটা কার?

শেখর বাবুর। তিনি বছরে দু-একবার আসেন। এমনিতে পড়েই থাকে হুজুর।

পল্টু বাড়িটাতে কি আগে এসেছে? প্রশ্ন করেন মিসেস রাহমাতুল্লাহ। গার্ড উত্তর দেয়-

কয়েকবার। আমার বউ আর ও একই গ্রামের মেয়ে হুজুর।

আবির বাড়িটা, মানুষজন, বাড়ির মালিকের খোঁজ নিয়ে ফিরে এসেছে। বলেন মিস্টার আর মিসেস রহমাতুল্লাহ জিপের লাগেজের একটা ব্যাগে বিস্কুট-কলা আছে। কিন্তু জিপের কাছে কারও যাওয়ার ইচ্ছা নেই। ওটা ত্রিপল ঢেকে চুপচাপ পড়ে আছে। চারপাশে বরফ। পড়ছে, জমছে। কাল কি ওরা সেই পথ ধরে যেতে পারবে? পল্টু বলে পারব। কাল সকালে সূর্য উঠবে। দার্জিলিং খুব বেশি দূরে নেই।

কাল সকালে কী হবে সেটা সকালের হাতে রেখে দেওয়াই ভালো। এখন রাতটা কাটানো যাক। ঘড়ি দেখে জানে রাত মাত্র দশটা। সকাল হতে অনেক দেরি। আলো নেই বই পড়বার মতো। হাতব্যাগে একটা গল্পের বই আছে, সাহানা আরেফিন সেটা পড়তে পারবে না। ত্রিবেদীও নয়। মিস্টার ও মিসেস রহমাতুল্লাহর ব্যাগে নানা ওষুধ। বই নেই। আবির করিমের ক্যামেরা। লেখার কাগজ। বই সঙ্গে হাতে নেই তবে ব্যাগে আছে। ও বসে। হাত গরম করে। – কিছু পেলেন রাত কাটানোর মতো?

কী পাব? এখানে পাওয়ার মতো কিছু আছে? সাহানা আরেফিন জানান। ঘণ্টা খানেক সবাই বসে থাকে প্রায় চুপচাপ। এর ওর সঙ্গে আলাপ, নাম জানা, সে তো হোটেলেই হয়েছে। কয়েকটা কম্বল উদ্ধার করা হয় রান্নার পাশের ঘরটা থেকে। অন্ধকার। ময়লা না পরিস্কার বোঝা যায় না, তাইতেই রক্ষা। পায়ের পাতা ঢাকার মতো ছোট কম্বল। মেঝেতে একটা চটের কার্পেট বিছানো। শেখরবাবু কেন একটা সুন্দর দামি কার্পেট লাগাননি সেটা ওরা ভাবতে থাকে। জানা গেল শেখর বাবু একজন সংসারহীন সন্ন্যাসী জাতীয় মানুষ। এখানে আসেন নাকি ধ্যান করতে। কলকাতায় সমাজসেবা, এটা সেটা করেন। কেন গৃহী নন সেটা গার্ড কী করে বলবে। ধ্যানের জন্য বড় বাড়ির দরকার কী? গুহা হলেও চলে। তবে তিনি গুহাবাসী নন। এখানে আসেন, ধ্যান করেন, ঈশ্বর নিয়ে ভাবনা করেন তারপর চলে যান।

চলুন আমরা একটা করে গল্প করি। জীবনের গল্প। প্রেমের গল্প। আবির করিম দলটাকে চাঙ্গা করতে এমন একটা প্রস্তাব করে। সকলে প্রথমে একটু গম্ভীর হয়ে থাকলে পরে হাসে। বলেন ত্রিবেদী- আপনিই আগে শুরু করুন। আপনার বয়স কম। নিশ্চয় অনেক প্রেমের গল্প আপনার জানা।

তা তো আছেই। তবে আমি অনুরোধ করব মিস্টার ও মিসেস রহমাতুল্লাহকে, ওরা আগে বলুক। কে বলবেন? মিস্টার না মিসেস?

আমরা আগে শুরু করব? কারণ কী?

তেমন কোনো কারণ নেই। তবে আপনাদের যুগলকে দেখে মনে হয় আপনারা প্রেমের গল্প জানেন।

তুমি বল। মিসেস রহমাতুল্লাহ স্বামীকে বলেন। সকলে পায়ের কম্বল, চুলোর আঁচ উসকে ভালো হয়ে বসে। গার্ডের বাড়িতে যে কটা ডিম ছিল তা শেষ। ওর বউ ডিম ভেজে দিয়েছে। বলেছে গার্ড- আর কিছু নেই। কাল বাজার। তারপর খাওয়া। পল্টুর দেখা নেই। বোধকরি গার্ডের ঘরে ঢুকেছে।

প্রেম একটা শক্তিশালী ব্যাপার। এত শক্তি রাখে পৃথিবীটাকেই বদলে দিতে পারে। ধরুন হিটলারের ঘৃণা যদি প্রেম হতো তাহলে কী হতো? সমস্ত পৃথিবীর চেহারা বদলে যেত না? বেশ একটু ভূমিকা শুরু করেন তিনি। ওরা বসে আছে গল্পের অপেক্ষায়। এই যে আমি আর মিমি দীর্ঘদিন প্রেম করেছি। ওর বাবা-মা রাজি নন, আমার বাবা-মাও নয়। কারণ মিমিদের পদমর্যাদা বংশমর্যাদা আমাদের চেয়ে উঁচুতে। আমার বাবা লোকজনের ফরমাশ মতো কাঠের জিনিস বানান। ভাগ্যক্রমে আমি পড়াশোনায় ভালো। আমার বাবা-মায়ের আপত্তি এত বড়ঘরের মেয়ে তাদের সংসারে রবীন্দ্রনাথের সেই গানের মতো বেমানান হবে- এই মনিহার আমায় নাহি সাজে। বিয়ে করব আমি মাথা ব্যথা তাদের। আর ওর মা-বাবা বিয়াই-বেয়ানকে জাতে তুলতে পারবেন না সেটা তাদের মাথাব্যথা। বড় বড় পার্টিতে একমাত্র মেয়ের শ্বশুর-শাশুড়ি আসতে পারবেন না, বিয়ের কার্ডে কোনো ভালো লোকের নাম লেখা যাবে না, এইসব ভাবনায় একেবারেই অনড় তারা। তিনি একটু চুপ করেন। মিসেস রহমাতুল্লাহ বা মিমি একটু হাসিমুখে স্বামীকে দেখছেন। বয়সিনী মহিলার কেমন আদুরে নাম। বোঝা যায় এককালে তিনি দেখতে ভালো ছিলেন। যখন প্রেমের গল্প শুরু হয় ওর মুখে মোমের আলোর মতো এক ধরনের আলো তাকে নতুন এক ফাউন্ডেশন ক্রিম-ঘষা মুখের মতো লাবণ্যময়ী করে তুলছে। তারপর কী হলো? সাহানা আরেফিনের গলা। মনে হয় তার গলার স্বরটাও বদলে গেছে। এ গলা ছাত্রশাসন করবার গলা নয়। যখন প্রেমের গল্প, গলা এমন করে নতুন হয়ে যায়। মিসেস রহমাতুল্লাহ এবার আপনি বলুন।

না, ওই বলুক। ও খুব ভালো গল্প বলতে পারে।

এরপর কী করা যায়? আমি বিদেশে যাবার একটা স্কলারশিপ পেয়ে গেলাম। ও তখন কেবল এমএ পাস করেছে। বললাম, তুমিও একটা স্কলারশিপ সংগ্রহ কর মিমি। আমরা বিদেশে বিয়েটা সেরে ফেলব।

ও সেটা পারেনি। যখন ফিরে এসেছি ও চাকরি করছে চট্টগ্রামে। আমার বাবা মারা গেছেন করাত কলে পড়ে। আমি একটা ভালো চাকরি করছি। ছুতোরের ছেলের গায়ের গন্ধটা তখন বিদেশি সাবানে, আফটার শেভে, আর আমার নামের শেষের কান্টাবের কারণে অনেকটা জাতে উঠেছে। কাজেই বিয়ে হলো।

গল্পটায় তেমন সাসপেন্স নেই, একেবারে নতুন লেখকের প্রেমের গল্পের মতো। দেন দে লিভ হ্যাপিলি এভার আফটার, ব্যস, গল্প শেষ। বলে আবির করিম। মিস্টার রহমাতুল্লাহ বলেন- নট কোয়ায়েট। একটা পা বের করেন। তার একটা পা নেই। সেখানে নকল পা। বলেন- কাটা পড়েছে। মারা যাইনি। ওই এখন আমাকে দেখাশোনা করে। প্রেম না থাকলে এসব মানত কেউ? এক বছর হাসপাতালে। তারপর বাড়িতে ফিরে আসি।

কেউ কি আর মানত বলছেন? তা মানত। কত দাম্পত্যজীবন দেখেছি একজন আর একজনকে মেনে নেয়। সেখানে প্রেম আছে কি নেই, কে জানে। বলেন ত্রিবেদী। কেউ বিছানায় পড়ে আছে দীর্ঘদিন, কারও শরীর অবশ, কারও মাথাটা আগের মতো কাজ করে না, কেউ নেশাভাঙে বিবশ, তারপরও একজন আর একজনকে মেনে নেয়। এখন বলুন আপনি বলতে চান এটাই আপনাদের প্রেমের শ্রেষ্ঠ ব্যাপার? যখন আপনি পা হারালেন, ধারণা করছি চাকরিও হারালেন, ও আপনাকে দেখছে এবং ভালোবাসছে?

রহমাতুল্লাহ হাসছেন। তার পা দুটো আবার কম্বলের নিচে চাপা পড়েছে। একটা আসল আর একটা নকল পা। বলেন- এটা একটা বড় ঘটনা। কিন্তু সে ঘটনাকে আমরা প্রেমের সর্বশ্রেষ্ঠ ঘটনা বলে মনে করি না। আমরা মনে করি তিন বছরে আমরা দু’জনে দু’জনকে যতগুলো চিঠি লিখেছি, সেটাই আমাদের জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ ফসল। প্রতি সপ্তাহে একটা। ও একটা আমি একটা। অপূর্ব সেসব লেখা। ভাবতে পারিনি কোনোদিন এমন লেখা আমরা লিখতে পারব- প্রেমে, বেদনায়, আনন্দে, দুঃখে, বিষাদে, একাকীত্বে, সন্তাপে, শোকে, শ্নোকে, বর্ষণে, শ্রাবণে, শীতে আর রোদে, গানে আর তানে, গদ্যে আর পদ্যে, লিরিকে আর মহাকাব্যে, সেসব তুলনাহীন।

হাততালি পড়ে।

বুঝলাম। বলেন সাহানা আরেফিন। – কেবল সেসব মনে করে যিনি এমন একটা বড় বাক্য অবলীলাক্রমে বলে ফেলতে পারেন তার আর প্রেমিকার সেসব চিঠি যে কতটা মনোরম, হৃদয়গ্রাহী, ভাষার কারুকার্যে অসামান্য তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। চিঠির কথা বলতেই আপনাদের দু’জনের মুখ কেমন উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল, মোমবাতির অল্প আলোতেও সেসব বোঝা গেছে। এমন সব চিঠি। বই করে ছাপান না কেন?

কী যে বলেন। ওসব আমাদের বিবাহিত জীবনের বন্ধ্যাজমির ফসল। আমাদের কোনো সন্তান নেই। আমরা দু’জন কোনো কোনো দিন বারবার ওগুলো পড়ি। ওরটা আমি, আমারটা ও, না হলে ভাসাইভার্সা। আরও বেশি ভালোবাসি দু’জন দু’জনকে তখন। ওই চিঠিগুলোর কাছে আমরা কৃতজ্ঞ।

মিস্টার আর মিসেস রহমাতুল্লাহ সোফায় আরও কাছাকাছি আসেন। মিসেস রহমাতুল্লাহর মাথা স্বামীর কাঁধে। তার দুই চোখে হাসি নয় কোমল শিশির টলটল। মিস্টার রাহমাতুল্লাহর একটি হাত স্ত্রীর শরীর একটু আদর করে।

ত্রিবেদী তার গল্পটা বড় করে বলতে পারেন না। বোঝা যায় একজনকে ভালোবেসেছিলেন গভীর করে। তাকে পাননি। বিয়ে করেছেন। তিন জন সন্তান। পড়াশোনা করছে দু’জন, একজন চাকরি শুরু করেছে। এখন সেইসব প্রেমট্রেম বোধকরি মনে করেন না। বড় সরকারি চাকরি করেন। আগামী বছর রিটায়ার করবেন। এখানেই কোথাও থাকবেন। তার ও স্ত্রীর এমন ইচ্ছা। একটা বাড়ি দেখতে এসেছেন। আসল বাড়ি জলপাইগুড়িতে। শেষজীবনের দিনগুলো কাটাবেন বলে। বলেন- ওকে আর মনে করি না। বলেই হাসেন।

একেবারেই মনে করেন না? আবির করিম প্রশ্ন করেন।

একেকদিন মনে হয়। বলুন তো কখন?

কখন? যখন বৃষ্টি পড়ে, ফুলবাগান দেখেন, না হলে কোনো চমৎকার নিসর্গে ভাবেন জীবনের এতকিছুর ভেতরে কেন একটা মুখ বারবার ভেসে ওঠে, যার কোনো অর্থ করতে পারেন না, একটা অপূর্ব বেদনা, যা পান করতে দুঃখ ও আনন্দ। যখন নিঃসঙ্গ। এবং যখন অপ্রিয় সঙ্গ। আবির বলে- নট কোয়ায়েট ইয়ংম্যান। তিনি ভাবছেন। ভাবছেন। অনেকক্ষণ কথা বলেন না। বলেন সাহানা – তাহলে কখন?

আমাদের পাশের বাড়িতে যে মেয়েটা এসেছে কয়েক বছর হলো ইঞ্জিনিয়ার স্বামীর ঘর করতে ওকে দেখলে। একেবারে মায়ের মুখটা বসানো কি-না। লীলার গানের গলাটাও মায়ের মতো। ওর মা আর নেই। মায়াকে আমি লীলাবতী বলে ডাকতাম। মায়া অঙ্কে খুব ভালো ছিল। বলতাম- তুমি আমার লীলাবতী।

মেয়েটার নাম কী?

দূর্বা।

এই বলেই ত্রিবেদী চোখ বন্ধ করেছেন। দীর্ঘ প্রেমের গল্প তিনি করতে পারেন না। মোমবাতি আর কতক্ষণ জ্বলবে কে জানে। গার্ড বলেছে আর মোমবাতি নেই। আলোটা ছোট হয়ে আসছে। রাত গভীর। সকাল হতে এখনও অনেক দেরি।

এরপর যখন ত্রিবেদী আবার এই পৃথিবীতে ফিরে আসেন। আবির করিমের দিকে তাকিয়ে বলেন- ইয়ংম্যান, তোমার কাছে একটা রক্তমাংসের প্রেমের গল্প আশা করছি। আমাদের মতো নিরামিষ গল্প নয়। কখন যে সম্বোধন তুমি হয়ে গেছে বুঝতে পারেন না।

আবির করিম মুখ নিচু করে। আলোটা কমে আসছে। দেয়ালে ছবির মতো ওদের ছায়া। বলেন আবির- আমার গল্পটা একতরফা প্রেমের। রক্তমাংসের কারবার নেই।

দূর, এমন গল্প তুমি করবে? রহমাতুল্লাহ বলেন।

তাই তো করতে হবে। আপনার মতো চিঠি লেখালেখির পর্বও নেই। একেবারে ছবির দিকে তাকিয়ে ভালোবাসার মতো ঘটনা।

নায়িকা কি কোনো দেশি-বিদেশি ছবির নায়িকা। কোনো গ্লামারাস অভিনেত্রী? কোনো অপূর্ব শরীর আর মুখ?

না। একেবারেই মাটির পৃথিবীর কঠিন নারী।

কঠিন নারী?

বলতেই হয়। চারশ’জন ছাত্রকে সামলাতে পারার মতো কঠিন।

কোনো স্কুলের শিক্ষিকা?

ঠিক তাই। আমি যে স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করি তার প্রধান শিক্ষিকা। পুরুষ যেখানে ছাত্র সামলাতে হিমশিম খায় সেখানে তিনি কী চমৎকারভাবে সবকিছু সামলান। কঠিন ব্যক্তিত্ব।

কত বয়স তার?

কত কে জানে। তবে আমি আমার তেরো বছর বয়স থেকে তাকেই ভালোবাসি। কারণ জিজ্ঞাসা করবেন না, আমি কারণ জানি না।

ও। এমন হতে পারে। হিরো ওয়ার্শিপের মতো কোনো ব্যাপার। তোমার ঘটনা শুনে মনে হলো হিরোইন ওয়ার্শিপের মতো কোনো ব্যাপার তোমার। ত্রিবেদী হেসে বলেন।

সাহানা আরেফিন দেয়ালের দিকে তাকিয়ে আছেন। অন্ধকারে দেয়ালের ছায়াগুলো দেখতে প্যাস্টেলে আঁকা ছবির মতো।

কোনো আনন্দ পাওয়া গেল না তোমার গল্পে। আমরা বুড়োরা যেমন গল্প করতে পেরেছি তার কাছাকাছিও নয় তোমার গল্প। এবার একটা সত্যিকারের গল্প বল। ওসব ওয়ার্শিপ নিয়ে তো আর জীবন চলবে না। কত বয়স তোমার?

আমার বয়স পঁচিশ।

একেবারে হোপলেস একটা গল্প। মনে মনে আর একটা গল্প ঠিক কর। ত্রিবেদী উঠে জানালা দিয়ে বাইরে তাকান। মনে হয় তুষার পড়ছে না। এখনও সকাল হতে বাকি আছে। ওরা দু’জন মানে মিস্টার ও মিসেস রহমাতুল্লাহ বেড়ালের মতো না হলে বসন্তের পাখির মতো কাঁধে মাথা রেখে বোধকরি ঘুমিয়ে আছে। না ঘুমাননি তারা। বলেন মিসেস রহমাতুল্লাহ- সারাজীবন তো এমন একজন নারীর চেহারা ভেবে জীবন কাটাতে পারবে না। বল এমন কেউ যাকে এখন তোমার ভালো লাগছে। যাকে তুমি বুকের ভেতরে পেতে চাও।

তেমন কেউ এখনও জীবনে আসেনি। আপনাদের ফোন নম্বর আছে আমার নোটবুকে। এলে জানাব, ঠিক আছে?

মিসেস রহমাতুল্লাহ আবার চোখ বন্ধ করেন।

সাহানা আরেফিন চোখ বন্ধ করে সোফায় মাথা রেখে ঘুমিয়ে কি?

আবির করিম বাইরে আসে। বাথরুমে যেতে হবে। গার্ডের ঘরটা পার হলে বাথরুম। দু’জন ছায়ামূর্তি দাঁড়িয়ে আছে। ওরা কারা? একজন তো পল্টু। সেই হতচ্ছাড়া ড্রাইভার। আর ওর সঙ্গে ওই নারীমূর্তি কি ড্রাইভারের বউ? তাই তো মনে হয়। ছিপছিপে শ্যামলা একটা মেয়ে ডিমভাজি দিতে এসেছিল ঘোমটা টেনে। ওরা কথা বলছে খুব কাছাকাছি দাঁড়িয়ে। বেশ একটু অন্তরঙ্গভাবে। ওদের ভাষা বোঝে না আবির করিম। আবিরকে দেখে ওরা ঘরের ভেতর চলে যায়। -ও এই। গাঁয়ের মেয়েকে দেখতে আসে মনে হলে? মানুষকে বাজে আবহাওয়ার ভয় দেখিয়ে? বলেছিল- বেশ কয়েকবার ওই বাড়িতে যেতে হয়েছে। বাড়িটা আমার চেনা। আর ওই গার্ড? সেকি ঘুমিয়ে? বউ কী করছে না করছে সেদিকে কোনো খেয়াল নেই? মরুক। ও নিয়ে আমার কী? আবির চুপচাপ চলে যায় বাথরুমের দিকে। বলে- তোমার প্রেমের গল্পটাই সবচেয়ে জমকালো। কিন্তু কেউ তোমাকে ডাকবে না সেসব শুনতে।

গার্ডের বউ আর পল্টু খুব কাছাকাছি দাঁড়িয়ে ফিসফিস করে কী সব বলছে সেটা কি প্রেম না আর কিছু। তবে দাঁড়ানোটা সন্দেহজনক। মরুক। যা ইচ্ছে হোক। ব্লাডার খালি করে আবির ফিরে আসে।

ঘরের ভেতর সকলের অনুরোধে সাহানা আরেফিন গল্প শুরু করেছেন। হেসে বলেন প্রেম? সময় কোথায়? ভাইবোনদের মানুষ করেছি। তারপর যখন নিজের দিকে তাকালাম দেখি বিয়ের বয়স আর নেই।

আপনি দেখতে তো এখনও বেশ। বলেন রহমাতুল্লাহ। এখনও কাউকে পেতে পারেন যদি ইচ্ছে করেন।

ঠিক বলেছেন। বিয়ের কি কোনো বয়স থাকে। বিদেশে তো বুড়োবুড়ির হোমেও বিয়ে হয়। এখানেও সে রকম ঘটনা ঘটছে। সেদিন আমার এক ষাট বছরের বন্ধু তার ছেলেবেলার বান্ধবীকে বিয়ে করলেন প্রথমবারের মতো। আমি বলছি না আপনি ষাট। কত বয়স আপনার? ত্রিবেদী চশমার কাচ মুছে প্রশ্ন করেন।

মেয়েদের বয়স জিজ্ঞেস করতে নেই, জানেন না?

আপনার বয়স পঞ্চাশেরও কম হবে। বলেন মিসেস রাহমাতুল্লাহ।

হবে ওই রকমই কিছু। এখন বিয়ে? আপনাদের কি মাথা খারাপ? জেনেশুনে একজন বসকে জীবনে ডেকে আনব? শাসন করবেন আমাকে বাচ্চা মেয়ের মতো।

বস কেন? বন্ধুও তো হতে পারে?

আমার বন্ধুর দরকার নেই। তা ছাড়া স্বামী মানেই বস, না হলে অসহায় বালক। – আমার মোজা খুঁজে পাচ্ছি না, না হলে আমার শার্টের ইস্ত্রি নেই কেন। আর বসরা যে কী করে তা আপনারা জানেন। চুপচাপ কথা শুনছে আবির করিম। সে এবার মেঝেতে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ে তার সঙ্গের ব্যাগের ওপর মাথা রেখে। চোখ বন্ধ। সকাল হতে বেশি দেরি নেই। সকলেই এবার বসে বসে একটু একটু ঝিমাতে শুরু করেছে।

সকালের আলো ফুটে গেছে। এখন যাওয়া যাবে। বরফ নেই। সকলের আগে সাহানা আরেফিন ঘর থেকে বাইরে এসেছেন। পেছনে আবির করিম। সাহানা ওর দিকে তাকান। বলেন- তোমাকে চিনতে পেরেছি। আমার স্কুল থেকেই তো তুমি স্কুল ফাইনাল পাস করেছ, না? আবির মাথা নাড়ায়। বলেন তিনি- গল্পটা নিশ্চয় বানিয়ে বলেছ? আবির করিম বলে- না। বানিয়ে বলব কেন?

জানতাম আমাকে তুমি ভয় পাও।

তা পাই। বলেই সে অন্যদিকে তাকায়। বলে সে মুখ ঘুরিয়ে- ভয় আছে বলে আর কোনো অনুভূতি কাজ করবে না এমন কথা কে আপনাকে বলেছে।

সাহানা আরেফিন এবার আবহাওয়া জরিপ করেন। আবির করিম বলে- একদিন যখন আপনার কেউ খোঁজ নেবে না, যাদের জন্য এতকিছু করেছেন তারা আপনাকে ভুলে যাবে, তখন কী হবে?

কী হবে? সে শুনে তোমার লাভ?

তখন না হয় আপনার জীবনে একটু জায়গা করে নেব।

না, আমার কোনো পুরুষ নার্সের দরকার নেই। বলেন কঠিন গলায়।

পাগল। ছেলেটা পাগল। তিনি বলেন আরও তেমনিভাবে- তুমি কি জানতে একটু বিশ্রাম নিতে আমি দার্জিলিং এসেছি। আবির মাথা নাড়ে। ওরা সব আসছে। সাহানা আরেফিন প্রথমে গিয়ে জিপে বসেন। আবির করিম ওদের অপেক্ষা করে। ও বসবে ড্রাইভারের পাশের সিটটায়। জিপটা ছাড়বে। পল্টুর হাতে একটা খাবারের প্যাকেট তুলে দেয় ড্রাইভারের ছিপছিপে বউ। বোধকরি লুকিয়ে রাখা দুটো একটা মম। ওদের ভাষায় কী বলে কে জানে। পল্টু মাথা নাড়ে আর একটু হাসে। মোটা বখশিশ পেয়ে আজ রাতে গার্ড কতটা তরল পানীয় পান করবে, নেশা করবে, কে বলতে পারে। বোধহয় আজ আর ও উঠবে না। মেয়েটা দাঁড়িয়ে আছে। জিপ ছেড়ে দেয়। পল্টু বিষণ্ণ। আর বউটার চোখে বোধকরি জলটল কিছু হবে। এইটুকু পথ কি কাল রাতে যাওয়া যেত না? কী জানি কী ছিল এই হারামজাদা ড্রাইভার পল্টুর মনে। আর পল্টু তো মাঝে মাঝে একাও আসতে পারে। পারে না? পারে না, কারণ ড্রাইভারটা নেশাভাঙ করলে বউ পেটায়। কাজেই অজুহাত করে আসা।

ওরা খানিক পরেই দার্জিলিংয়ে পৌঁছে যাবে। তখন যে যার মতো, নিজেদের বেছে নেওয়া হোটেলে। তখন যদি রাস্তায় একজনের আর একজনের সঙ্গে দেখা হয়? কে বলতে পারে সে কথা। কে বলতে পারে তখন সাহানা আরেফিন কী বলবেন আবিরকে।

আর পল্টু হয়তো অপেক্ষায় থাকবে আবার আর কোনো যাত্রীকে বাজে আবহাওয়ার ভয় দেখিয়ে এই বাড়িতে নিয়ে আসার।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত