পাত্রীর বিবাহের দিনক্ষণ ঘনিয়ে এসেছে। বারো পুকুর গ্রামে মাতব্বর হরমুজ আলীর একমাত্র কন্যা ফুলবানুর আজ বাদে দু’দিন পরে বিবাহের দিনক্ষণ ধার্য হয়েছে। শরতের রাতের আকাশে যেমনি ঝলমলে তারা জ্বলছে তেমনি মাতব্বরের বাড়িতে গেল সপ্তাহ ধরে বিয়ের ঝিকমিক বাতি জ্বলছে। আশেপাশের পাঁচ গ্রাম পর্যন্ত মাতব্বরের একমাত্র কন্যার বিবাহের খবর রটে গেছে।
বিয়ের গীত কাওয়ালি গাওয়ার জন্য শহর থেকে নামকরা শিল্পী আনা হয়েছে।গ্রামের কচিকাঁচা থেকে শুরু করে বুড়ো-বুড়ি সবাই বিয়ের আনন্দে মাতোয়ারা। শুধু বিয়ের কন্যা ফুলবানুর মনে কোনো আনন্দ নেই।বিয়ের লাজে লাজুক কন্যা ফুলবানুর বদনখানা টকটকে লাল হয়ে গেছে। ক্ষণে ক্ষণে অস্থির অস্থির ভাব। যেন শরতের আকাশে হুট করে চৈত্রের খাঁ খাঁ রোদ্র এসে মাঠঘাট পুড়ে চৌচির করে দিচ্ছে। ফুলবানুর কোমল হৃদয়খানি পুড়ে যেন একটু বাতাসের জন্য ছটফট করছে। সবাই বিয়ে নিয়ে এতই মাতোয়ারা যে ওদিকে ফুলবানুর মনের খবর নেবার কোনো কাকপক্ষীও আর অবশিষ্ট নেই।
আজ বাদে কাল গায়ে হলুদ। পরশু বিয়ে। এমনই সময় দিনের কোলাহল পেরিয়ে রাত্রির শুনশান নিরবতা প্রকৃতির বুকে নেমে আসলে ; ফুলবানু পরনের কাপড়খানা ভালো করে প্যাঁচিয়ে মাথায় ঘোমটা দিয়ে সকলের অলক্ষে অন্দরমহল থেকে বেরিয়ে পড়ে। এখন গভীর রাত। আকাশ ঝকমকে পরিষ্কার। কিছু জোনাকি পোকা ঝিঁ ঝিঁ করছে। কয়েকটা শিয়াল হাঁক ডাকছে। সবাই ঘুমে বিভোর। নিস্তব্ধ চারপাশ। যেন পুরো গ্রামটা অদ্ভুত মায়ার জালে বন্দি। ফুলবানু সুপারি, নারিকেলের ঘন লতাপাতা বেষ্টিত বাগানের গাছের ফাঁকে ফাঁকে একটু কাঁচুমাচু হয়ে টিপ টিপ পায়ে এগুচ্ছে। সুপারির বাগানের সামনেই একটি বড় পুকুর। লোকমুখে ভূতের পুকুর নামে পরিচিত। কথিত আছে এই পুকুরে ভাদ্র মাসে বারোজন নওজোয়ান ডুবে মরেছিল। সেই থেকে পুকুরের নামানুসারে গ্রামের নামটি বারো পুকুর গ্রাম।পারতপক্ষে রাত্রিবেলায় এই পুকুরের আশেপাশে কেউ আসার সাহস করে না।
ফুলবানু বাগানের ভিতর দিয়ে হাঁটছে। থমথমে পরিবেশ। তবুও তার মনে বিন্দুমাত্র ভয়ের চিহ্ন নেই। পুকুরের পাড়ে আসতেই শুনতে পেল কে যেন পিছু ডাকছে। ফুলবানু থমকে দাঁড়ায়। এই যে এদিকে, গাছের আড়াল হতে উমরের গলার আওয়াজ ভেসে ওঠে। ফুলবানু খানিক পেছনে ঘুরে উমরকে দেখতে পেয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। উমর দীর্ঘক্ষণ ধরে ফুলবানুর অপেক্ষায়, মনে হাজারো প্রশ্ন আর উৎকণ্ঠা নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। উমরের প্রতি ফুলবানুর শেষ আর্জি ছিল আজ রাতে যেকোনো উপায়ে তাদের সাক্ষাত করতেই হবে।
সেই ছোটবেলা থেকে ফুলবানুর দেখাশোনা তার সকল ছেলেমানুষি আবদার মিটানো এসবের দায়িত্বের ভার উমরের কাঁধেই অর্পিত ছিল। কোনোদিন তাদের এই সম্পর্কের দিকে কেউ আঙুল তুলে কিছু বলতে পারেনি।উমর ছোটকাল থেকেই হরমুজ আলীর পালিত সন্তান।তার আসল বাপ-মা কে তা সে জানে না। জানে শুধু সে এতিম। হরমুজ আলীর আশ্রিত সন্তান। মাতব্বরের ঘরে ফুলবানুর জম্ম হলে উমরের কপাল পুড়ে। সন্তানের সমতুল্য স্নেহ থেকে বঞ্চিত হয়ে সে হয়ে যায় তখন বাড়ির একপ্রকার কাজের ছেলে। সবকিছু দেখাশোনার ভার তখন তার উপর পড়ে। এ নিয়ে তার কোনো আক্ষেপ কখনো শোনা যায়নি। ফুলবানু উমরের খানিক কাছে আসে। উমর তা দেখে বিচলিত হয়ে পড়ে।
উমঃ কী বলবি বলে ফেল বানু। দেরি করিস না। লোকে দেখলে তোর অমঙ্গল হবে।
ফুলঃ কেউ দেখবে না। তুমি এত ভয় পাও কেন?
উমঃ বিয়ের কন্যা রাত্রিবেলা বাইরে। তাতে কি কোনো মঙ্গল বয়ে আনবে রে বানু?
ফুলঃ মঙ্গল না ছাই। তোমার মাথাখানি একটু উঁচু করবে? আমার দিকে তাকাবে দয়াকরে?
উমর খানিক মাথা উঁচু করে। তার সামনে যেন এক জ্যান্ত পরী দাঁড়িয়ে। উমরের চোখজোড়া যেন এক ভয়ংকর জাদুর মায়ায় আটকে পড়ল। জ্যোৎস্নালোকিত রাত। আকাশের চাঁদ যেন গাছের ফাঁকে ফাঁকে উঁকি মেরে ফুলবানুর কোমল মুখখানিতে এসে আছড়ে পড়ছে।চাঁদের আলোয় ফুলবানুর মুখখানি যেন জ্বলজ্বল করছে। এইরুপ বদনখানা দেখে উমর চমকে ওঠে। সেই ছোট থেকে ফুলবানুকে দেখে আসছে সে। কোনোদিন তো এইরুপ চাঁদের মতো মুখ ভেসে উঠেনি উমরের চোখে। আজ কেন ফুলবানুকে এত সুন্দর লাগছে? যেন পৃথিবীর সমস্ত সৌন্দর্য ঢেউ খেলছে ফুলবানুর চোখেমুখে।
ফুলঃ কী দেখছো অমন করে? উমরের খানিক ঘোর কাটলো। ইতঃস্তত হয়ে চোখজোড়া যেন তার মাটিতে নেমে গেল।
উমঃ যা কিছু বলার ছিল বলে ফেল বানু।আর দেরী করিস না।
ফুলঃ আমার হাতের উপর তোমার হাতদু’টি একটু রাখবে?
উমঃ এসব বলার জন্য কি তুই এখানে এসেছিস। আর পাগলামো করিস না।
ফুলবানুর এই রাঙা দুই হাতে কত মেহেদী পাতার রঙ লাগিয়ে দিছে।এই দুই হাতে জোড়া বেঁধে দু’জনে কত খেলা খেলেছে ; তবুও আজ একটি বার ফুলবানুর এই চেনা হাতদু’টো ধরার সাহস হয়নি উমরের। উমরের কাছ থেকে কোনো সদুত্তর না পেয়ে ফুলবানু খানিক জায়গা প্রস্থান করে পুকুরের ধারে আসে। তার মাথার ঘনকেশে খোঁপার বাঁধন মুক্ত করে, পা দু’টো পুকুরের পানিতে এলিয়ে দু’পায়ে ছমছম ধ্বনি তুলে। সেই ছমছম ধ্বনি উমরের বুকে এসে অদ্ভুত সুর তুলছে। যেন চাঁদনী পসরে সাক্ষাত এক জলপরী জলের কিনারায় এসে জলকেলিতে মত্ত হয়েছে।
ফুলঃ দেখো কী সুন্দর পুকুরের পানি! মন চায় এই চাঁদনী পসরে ভরা পুকুরে ডুব দিয়ে আসি। এই পুকুরে ডুব দিয়ে গোসল করবার আমার আজম্ম শখ। মানুষের কত শখ হয়। আমার কেন এমন অদ্ভুত শখ জাগে! তুমি একটু নামবে পানিতে?
উমঃ তোর মাথা খারাপ হয়েছে রে বানু। ভূত পেত্নী আছড় করছে।
জলদি পুকুরের কিনার থেকে ওঠে আয়।আর আবোলতাবোল বকিসনে। এই কথা শুনে ফুলবানু পুকুরের কিনারা থেকে পাদু’টো উপরে তুলে। ভেজা খালি পায়ে ফুলবানু উমরের কাছে আসে। মায়াবী নিষ্পাপ চাহনিতে আধো আধো স্বরে বলে, ” আমারে তোমার ভালো লাগে না বুঝি?” উমর তা শুনে নিশ্চুপ থাকে।
ফুলঃ একটা কথা কই? রাগ করবা না তো? এদিকে তাকিয়ে দেখো আমি নীল শাড়ি পরেছি, আমারে কি শাড়িতে বউ বউ লাগে?
উমঃ তোর রাজকপাল রে বানু। বিয়া অইব জমিদার ঘরে। তুই অনেক সুখী হইবি। বিয়ের কন্যা পরনে শাড়ি। উতালপাতাল মন। কেন তোরে বউ বউ লাগবে না? ফুলবানু তা শুনে মুগ্ধ হয়। শাড়ির আঁচলখানি আলতো করে হাতে প্যাঁচায়।
ফুলঃআমার কপালে একটু হাত রাখবা? এইটুকু আবদার রাখো? ফুলবানুর অনুনয় দেখে উমরের মনে সদয় হয়। তার ডান হাতখানা পেছনে ঘুরে ফুলবানুর কপালে রাখে। উমরের হাতের মৃদু ছোঁয়া কপালে স্পর্শ লাগতেই ফুলবানুর হৃদয়ে শীতল কম্পন তুলে শিহরণের ঢেউ ওঠে। ফুলবানুর কপাল বেয়ে তরতর করে যেন ঘাম ঝরছে।খানিক পর উমর কপাল থেকে হাত সরিয়ে ফেলে।
উমঃ তোর গায়ে জ্বর উঠেছেরে বানু।
ফুলঃ কীসের জ্বর? ওসব কিছু না। তা আমার মনের জ্বর। একটা কথা বলি? আমার বিয়ের পর শ্বশুরবাড়িতে তুমি কি আমার সাথে যাবা?
উমঃ না যাব না। তবে কর্তা হুকুম দিলে মাঝে মাঝে নাইয়র আনতে বেড়াতে যেতে পারি।
ফুলঃ তা না হয় নাইয়র আনতে গেলে। কিন্তু তোমারে দেখা ছাড়া আমি কেমনে থাকমু?
উমঃ থাকবি থাকবি। বিয়া হইলে স্বামীর আদর সোহাগে আমারে তখন ঠিকই ভুলবি।
ফুলবানুর শান্ত চোখজোড়ায় স্নিগ্ধ মায়াবী চাহনিতে মোমের মতো যেন তার কণ্ঠ ধ্বনি গলতে থাকে। শেষবারের মতো ফুলবানু কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, “বলো আমারে তুমি ভালা পাও ।আমায় পছন্দ করো।” উমর তা শুনে বিচলিত হয়ে পড়ে। মুখের উপর সোজা বলে দেয়, ” না, ভালা পাই না। পছন্দ করি না। বিয়ের কন্যা রাত্রিবেলা বাইরে তা দেখতে কি খুব ভালো দেখায়? ইহা নিতান্তই অমঙ্গলকর। আমি তা পছন্দ করি না।” এই কথা শুনিবা মাত্রই ফুলবানু শাড়ির আঁচলখানি মুখের ভিতর গুঁজে দিয়ে কান্নাভেজা চাহনিতে পশ্চিম দিকে মুখ ফিরিয়ে দ্রুত স্থান ত্যাগ করল। সেই দৃশ্য দেখে উমরের হৃদয়খানি যেন হুট করে ব্যথায় কুঁকড়ে উঠলো। কে জানি তার হৃদয়ে ছুরি নিক্ষেপ করে দ্রুত পলায়ন করল।কিছু বুঝে উঠবার আগেই উমরের হৃদয়খানি যেন রক্তাক্ত, ক্ষতবিক্ষত হয়ে থরথরে কাঁপতে লাগল। বাগানের যেই চেনা পথ দিয়ে এসেছিল, সেই পথের প্রান্তে যেন আস্তে আস্তে গাছের ছায়ার সাথে মিলিয়ে গেল ফুলবানু।
উমর সেই পথ ধারে শুধু নিষ্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। পরদিন দ্বিপ্রহরে বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হলে সারাবাড়ি বিয়ের আমেজে উৎসবমুখর হয়ে ওঠে।ফুলবানুর হলুদ সন্ধ্যা হয়। পরদিন বরপক্ষ আসলে ফুলবানুর রূপকথার মতো জীবনের এক অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটে। ফুলবানুর বিয়ে হয়।বরযাত্রী বউ নিয়ে যাওয়ার প্রাক্কালে ফুলবানু শেষবারের মতো তার বাপজানের কাঁধে মাথা রেখে কান্নাকাটি করে। এই কান্না দুঃখের কান্না। প্রিয়জন ছেড়ে চলে যাওয়ার কান্না।উপস্থিত জনতাও চোখের জলে বুক ভাসায়। সেই কান্নাভেজা পরিবেশ দূর থেকে আড় চোখে দেখলে, উমরের বুক শূন্য হাহাকারে ভেসে ওঠে।
আস্তে আস্তে বিয়ে বাড়িতে জনসাধারণের ভীড় কমে। ফুলবানুর প্রস্থান হয়। হরমুজ আলীর পুরো বাড়ি শূন্যতায় ছেয়ে যায়। সবাই যার যার ঘরে ফিরে।শুধু ফিরে না কিছু প্রিয় মুখ।ওই দূর পথে চেয়ে থাকে অপলক দৃষ্টিতে। কে যেন চলে যায় সবকিছু ফেলে।স্মৃতিরা গুমরে গুমরে কাঁদে, মায়ার বাঁধন যায় ছিঁড়ে। এ মায়া চোখের মায়া। যে মায়া বাঁধলো বাসা দুই নয়নে জনম জনম ভরে। ওই রাতে উমরের ঘুম হয়েছিল কি না তা জানি না।হয়তো তার মনের খবর নেবার অবশিষ্ট আর কেউ ছিল না। রাত্রির শেষভাগে ভোরের আবছা আলো ভেসে উঠার আগেই উমর সবার অলক্ষ্যে বারো পুকুর গ্রাম ত্যাগ করে। কেন গ্রাম ত্যাগ করলো তার কারণ কেউ কখনো জানতে পারেনি।
ভোরের সূর্য উঠলে চারপাশ থেকে উমরের নিখোঁজ হওয়ার সংবাদ আসতে থাকে।গ্রামবাসী বহু খোঁজাখুঁজি করেও উমরের কোনো হদিস পেলো না। সেই যে উমর গেল, কোথায় গেল কেউ জানে না। দিন যায়, মাস যায়,বছর ঘুরে আবার বছর আসে।ফুলবানু তার বাপের বাড়িতে বেড়াতে আসে তবুও উমর আর ফিরে না। বারো পুকুর গ্রামে দুই যুগ ধরে বয়ে বেড়ানো চোখের মায়ার অবসান ঘটে।
গল্পের বিষয়:
গল্প