নুরুর মার বয়স কত হবে? পঁয়ত্রিশ-চল্লিশ কিংবা তার বেশি বা কমও হতে পারে। অন্তত চোখের অনুমান দিয়ে মাথা হতে পা পর্যন্ত পরিমাপ করে বছর-মাসের যোগফল ঘোষণা করে বয়স সাব্যস্ত করা আমার পক্ষে বেশ কঠিন ছিল। তাছাড়া তেমন কঠিন নিরীক্ষাশক্তি আমার কোনোকালেই ছিল না বলে জানি।
আমার বাবা খুব সামান্য চাকুরি করতেন বলে সরকারি কোয়ার্টারের হলুদ একটা ভবনের চারতলার কোনো এক পাশে অন্যের সাবলেট হিসেবে তিনি আমাদের নিয়ে থাকতেন। মা যেদিন থেকে বিছানায় শুয়ে অসহায় চোখে যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছিলেন সেদিন থেকে আমার একাকি বিষণ্ন দিনগুলো শুরু হয়। অথচ ক্যালেন্ডারের পাতায় সে ক্লান্তিময় দিনগুলো গোনার চেয়ে আমি মুগ্ধ হয়ে তার ছবির দিকেই তাকিয়ে থাকতাম। যেমনই আমাদের ঘরে নুরুর মাকে প্রথমদিন দেখে তাকিয়ে ছিলাম । তার পূর্বের জীবনবৃত্তান্ত আমাদের জানা ছিল না। কিংবা কীভাবে সে আমাদের ঘরে প্রবেশের সুযোগ পেল তেমন কৌতূহল আমার মধ্যে মোটেই ছিল না। তারপরও সে এলো যখন একখণ্ড মেঘের ছায়া যেন আকাশ কাঁপিয়ে দারুণভাবে এলো।
আমাদের এক কক্ষের জীবনে ততদিনে অভ্যস্ত হয়ে গেছে নুরুর মা। একদিন দাঁড়িয়ে দেখলাম থপথপ করে ঘরে ঢুকে মায়ের মাথায় জলপট্টি বেঁধে দিল সে—কিছু বুঝে বা না বুঝে অথবা বাবার কাছ হতে নির্দেশিত হয়ে। আমি তখন মায়ের কাছাকাছি জানালার লোহার শিক ধরে আপাত শূন্যতার ঘোরে। যতখানি উচ্চতায় উঠলে নিজেকে মানুষের চেয়ে অন্য কোনো উড়ন্ত জীবের কাছাকাছি নিয়ে যাওয়া যায় বা তেমনভাবে কল্পনা করা যায় সেরকম একটা চেষ্টাই ছিল আমার খেলার অংশবিশেষ। আমি বোধহয় নুরুর মাকে নিয়েই ভাবছিলাম; যে কিনা মেঘ, মেঘের কালো অথবা সেখানে আড়াল হওয়া প্রকাণ্ড কোনো বাজপাখির উড়ন্ত ছায়া হয়ে আমার মন দখল করে আছে। আগেই বলে নিচ্ছি এ গল্প কিন্তু আমি কিংবা আমাদের নয়।
আমার মা নাজমা নাহার দীর্ঘদিনের রোগশয্যায় ক্লান্ত। ঠিক কী অসুখে তিনি বিছানায় রয়েছেন আমার কোমল প্রাণে তার কোনো অস্তিত্ব ছিল না। এদিকে একটা ঘোষিত কয়েদঘরের মধ্যে মায়ের সঙ্গী হয়ে সকাল থেকে রাত অবধি কাটাতে হতো বলে আমার চারপাশের পৃথিবী দারুণভাবে হাঁপিয়ে উঠেছিল। কারণ, সকাল হলেই জানতাম কখন সন্ধ্যা আসবে। আর এভাবে দুপুর, বিকাল, সন্ধ্যাসহ সবকিছুই দেখতে হতো চারতলার জানালা হতে। আমাদের শৈশবের সে সময়টায় সম্ভবত এটাই ছিল সর্বোচ্চ কোনো আবাসের ঠিকানা যেখান থেকে তাকিয়ে পৃথিবীর ব্যস্ততা দেখা যেতো আর দেখা যেতো নিচের পিঁপড়ার মতো মানুষজনের বিরামহীন আনাগোনা। এভাবে ওপর থেকে তাকিয়ে নিচের অজানা দেশ ভ্রমণ করাই আমার খেলার অংশ হয়ে উঠল দিনের পর দিন।
ফিরে আসি নুরুর মার কাছে। মায়ের মাথায় জলপট্টি বেঁধে দিয়ে সারা বিকাল ক্লান্তিহীন শুশ্রূষার কারণে সেদিন সন্ধ্যার সময়ে মা অনেক দিন পর একটু চোখ মেলে চাইলেন। খানিকক্ষণ তাকিয়ে তিনি এই পৃথিবী দেখলেন আর এই দৃশ্য দেখে আমি যেন আমার পুরো জগৎটা দেখলাম। কারণ, বাবাসহ আমাদের তিনজনের পরিবার ছিল আমার সমস্ত পৃথিবী। বাবা যদি সূর্য হয়ে থাকে, ছিমছাম সে পৃথিবীর কক্ষপথ ছিল মাকে নিয়ে। এর মধ্যে নুরুর মা চলে এল এক অচেনা গ্রহ হয়ে। এসব ভাবনার মধ্যেই পা টিপে টিপে খাট থেকে নেমে আমি আমার নির্ধারিত নির্বাসিত এক কক্ষের জীবন থেকে বেরিয়ে পড়ি সামনের অপরিসর বারান্দায়।
রান্নাঘরের কলতলার কাছে আরেকদিন পিঁড়ি টেনে বসে ছিল নুরুর মা। বাবা তখনও ফেরেননি। বয়সজনিত ভীরুতায় কাঠের সবুজ ভারী দরজার আড়াল থেকে দেখলাম মানুষটিকে। কাছে যেতে সাহস হলো না। মুখটা বিশাল। তোষা পাটের মতো রুক্ষ চুলগুলো লালচে কোঁকড়ানো। একটা লালরঙা চুলের ফিতায় খোঁপাবদ্ধ চুলগুলো মাথার ওপরের দিকে কেমন অবিন্যস্ত। পরনের জংলি ছাপার শাড়িটাও লাল। তবে হাঁটুর কাছাকাছি কাপড় উঠিয়ে পা ছড়িয়ে বসায় ভেতরের নীল পেটিকোট বেরিয়ে আছে। অনেকক্ষণ পর খেয়াল করলাম হাতে-কানে কোথাও অলংকার না থাকলেও নাকে একটা নীল নাকফুল আর রূপার নোলক।
চুলায় আগুন নেই। আমাকে আশ্চর্য করে দিয়ে বিড়িটা সে ধরালো দেশলাই দিয়ে। তারপর ঠোঁটের এক কোণে বিড়িটা রেখে দাঁত দিয়ে চেপে ধরে চুলায় আগুন জ্বালিয়ে গনগনে সে আগুনের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলো সেদিনের নুরুর মা। একটা অখণ্ড অচল পাহাড় যেন—কোত্থেকে চলে এল আমাদের চারতলার এ ঘরে। নিঃশব্দে জ্বাল চলতে থাকে আর টগবগ করে ফুটতে থাকে হাঁড়ির ভাত। পা ছড়িয়ে রাখা ঝাঁঝালো চেহারার মানুষটা একদেহ রুক্ষতা নিয়ে সেখানে বসেই থাকে—বসে থেকে বিড়ির ধোঁয়া ছেড়ে ফ্যানসা ভাতের ধোঁয়াময় এক অন্য পৃথিবীতে হারিয়ে যেতে থাকে ক্রমশ। তার সে পৃথিবী আরও অচেনা হতে হতে কিংবা অচেনা সে গ্রহটি ভিন্ন কক্ষপথে হারিয়ে যেতে যেতে একসময় আমাদের কাছে অপার রহস্য রেখে চলে যায় নুরুর মা।
দুই
স্কুলের বার্ষিক পরীক্ষা শেষে শীতের লম্বা ছুটি চলছিল একমাস ধরে। মায়ের কাছাকাছি দাঁড়িয়ে জানালার গরাদ ধরে মানুষ দেখাই আমার একমাত্র খেলা তখন। এমন সময়ে সকলেই বাইরের নতুন জগতের সাথে পরিচিত হয়। অথচ আমার কৈশোরের সরল চোখে আশ্চর্য হয়ে বসে আছে সেদিনের আলুথালু নুরুর মা। চারতলার জানালা থেকে তার আসার অপেক্ষায় হয়তো দাঁড়িয়ে থাকতাম আমি।
অন্য আর সব দিনের মতো রান্নাঘরে কারও অসতর্ক পায়ের আওয়াজে আমি সেদিকে এগিয়ে যাই। হ্যাঁ, নুরুর মা-ই। আমি অবশ্য তাকে ডাকতাম নুরুম্মা বলে। ওপর থেকে প্রায়ই দেখতাম কেউ একজন একটা নতুন রিকশা নিয়ে অপেক্ষা করছে নিচে রাস্তার ধারে। আর আমি বুঝতাম নুরুম্মা এসেছে।
আজও একটা উৎকট গন্ধ আসছে রান্নাঘরের ওদিক থেকে। বিড়ির লালচে আগুনের মতো তার চোখ দুটো যেন জ্বলছে আর নিভছে। নুরুম্মার সাথে আমার সহজাত দূরত্ব কমে এলেও চোখে ক্রোধের আগুন দেখে ফিরে আসি ঘরের দিকে। বাইরের জগতের সাথে ততদিনে আমার যোগসূত্র ঘটে গেছে হারুনের কারণে। হারুন নুরুম্মার ছেলে। আমার কথা বলার আর বাইরের দুনিয়ার সাথে পরিচয় ঘটিয়ে দেবার জন্য প্রকৃত একজন মানুষ। আর পুরো এ ঘটনার মাধ্যম হলো নুরুম্মা, যার কারণে আমার ছোট্ট দুনিয়া থেকে অজানা এক বৃহৎ দুনিয়ায় প্রবেশের সুযোগ ঘটেছিল একটু একটু করে।
আজ নুরুম্মাকে কেমন অস্বাভাবিক লাগছে। অন্যদিনের চেয়েও অপরিচিত এক হিংস্র ছায়া আপাদমস্তক রুক্ষতা নিয়ে ভীষণভাবে জেঁকে বসে আছে তার শরীরে। তবে তার গোলগাল চেহারায় রুক্ষতা থাকলে কী হবে, কথার মধ্যে যে মায়া ছিল তা তার সাথে কেউ কথা না বললে বুঝতে পারবে না। অনেকদিন থেকে দেখছি বিকালের এ সময়টাতে এসে সে খুব তৃপ্তি নিয়ে নুনগোলা ভাতের ফেন খেত। খাওয়ার অন্য কিছু ছিল না বলে ঠিক নয়, এটা ছিল তার প্রিয় অভ্যাসের মতো।
আমাকে দেখলে বলত, এট্টু ফ্যান খাইবাম?
আমি মাথা নেড়ে ‘না’ বলতাম।
সেও তখন মায়া করে বলত, যাও গুরো গিয়া। হারুন নিচত আছে।
আমি ঠিক এ কথাগুলো শোনার জন্যই অধীর হয়ে অপেক্ষা করতাম। কারণ, আমি জানি ওদিকে হারুন যথারীতি তার রঙিন রিকশা নিয়ে নিচে দাঁড়িয়ে। হারুন। আমার চেয়ে বয়সে কত বড় তা ঠিক জানি না, তবে বেশ বড়ই হবে। এদিকে মনে মনে আমি কখনও ভাবতাম, নিশ্চয়ই নুরু নামে তার আরেক ছেলে ছিল অন্য কোথাও। নইলে লোকে তাকে ওই নামে ডাকবে কেন? আমার বিকালের খেলার অংশটা শেষমেশ রিকশায় চড়া পর্যন্ত বর্ধিত হয়েছিল নুরুম্মার কারণেই। সেদিন থেকে সে অচেনা গ্রহটি আমার কাছে আরও প্রিয় হয়ে আমাদের নিজস্ব গ্রহের উপগ্রহ হয়ে উঠতে লাগল।
আমাদের দিনগুলো নুরুম্মা ও হারুনকে কেন্দ্র করে ভালোই কেটে যাচ্ছিল। এর মধ্যে কয়েক মাস কেটে গেছে। একদিন বিকালে বাইরের রোদটা দিনটাকে পুড়িয়ে দিয়ে একটু থিতু হয়েছে কেবল। ভাপওঠা রাস্তায় লোকজনের চলাচল ও কোলাহল দুটোই কম। দু একটি শালিক-চড়–ই-কাক শুধু এদিক ওদিক হাঁটছে। মা শুয়ে আছেন পর্দার আড়ালে। দুপুরে স্কুল থেকে ফিরে আমিও খেলছি প্রতিদিনের মতো।
আমি মায়ের বুকের ওঠানামা দেখছি মানানসই দূরত্ব থেকে। ওদিকে রক্তলাল চোখ ও আলুথালু চুলে নুরুম্মা বসে আছে রান্নাঘরের মেঝেতে। আমাকে দেখে ফেন খাওয়ার কথা বলল না আজ। আমি নুন দেয়া ফেন খাওয়ার চিন্তায় মগ্ন হয়ে তাকিয়ে থাকি তার দিকে কিছু শুনব বলে। নুরুম্মার সামনে মাটির মালসাতে ফেন। নাকে ঝুলানো নোলক থেকে টপটপ করে গড়িয়ে পড়ছে জল— ভালো করে খেয়াল করে দেখি সে মেঝের দিকে মাথা নিচু করে বসে কাঁদছে। গায়ে জড়ানো মোটা সুতি থানও কেমন এলোমেলো। তবে চারদিকের নানান অসঙ্গতির মাঝে তার অসংলগ্ন বসার ভঙ্গিতেও শরীরী দৃঢ়তা স্পষ্ট।
সিঁড়ির কাছ থেকে কয়েকজন আগন্তুকের দুপদাপ শব্দ আসছে পায়ের। তারপর হঠাৎ দরজায় ঠকঠক। আমি ভীত হয়ে সরে আসলাম। আবারও কড়া নাড়ার অস্থির শব্দ। নুরুম্মাই উঠে গেল টলতে টলতে। দরজার অপর প্রান্তে যারা দাঁড়িয়ে তাদের একজন এ ভবনের তিন তলায় থাকেন। বাবার চেনা লোকগুলো। লোকগুলোর সাথে নুরুম্মার ধ্বস্তাধ্বস্তিতে আমি আরও হতভম্ব হয়ে যাই। তারপর লোকগুলো চলে যেতেই দ্রুত কপাট বন্ধ করে দেয় নুরুম্মা। অনেকক্ষণ পরে আমার নজরে এলো একটা ধারালো দা। কাপড়ের কাছা দিয়ে পেঁচানো দাটি নুরুম্মা তখন আঁচলের আড়াল থেকে বের করে হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
ভেতর ও বাইরের সম্ভাব্য পরিস্থিতির অনুপুঙ্খ পাঠ বিশ্লেষণের চেষ্টা করি আমি। আমার বয়স কিংবা বিচারবোধ উদ্ভূত এ পরিস্থিতির সাথে কিছুতেই তাল মিলিয়ে উঠতে পারছিল না। তবে কিছু একটা গণ্ডগোল হয়েছে এবং তা যে অত্যন্ত মারাত্মক, তা নুরুম্মার থরথর করে কাঁপুনি থেকে আঁচ করতে পারছিলাম। আমার প্রতিদিনের খেলার জগৎ নুরুম্মা তার খেয়াল খুশিমতো এভাবে ভণ্ডুল করে দিতে পারে না। আমি হতবাক হয়ে পড়ে আছি তখনও। নুরুম্মা দা হাতে করে দরজার কাছাকাছি তখনও দাঁড়িয়ে। বাইরের দরজায় কড়ার গায়ে আগের চেয়েও আরও কঠিন ঘায়ের শব্দ এবার। আরও কঠিন স্বরে কেউ তখন ডাকছে।
গোলাপি…ওই গোলাপি…শিগগির বাইর হইয়া আয়। নইলে কপালে কিন্তু খারাবি আছে কইলাম।
ভেতরে দাঁড়িয়ে নুরুম্মা থরথর করে কাঁপছে। বাইরে অনবরত ধাক্কা, জোরে জোরে কড়া নাড়া, দুমদাম আওয়াজ শুধু। আবারও সেই একই কর্কশ কণ্ঠের হাঁক।
গোলাপি… তাড়াতাড়ি দরজা খোল।
তিন
শঙ্কিত পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়ে এমন একটি দিনেই প্রথম জানতে পারলাম নুরুম্মার নাম গোলাপজান। বাইরের আর ভেতরের পৃথিবী এক হবার পরেই আমি বুঝতে পারি আমার এ ছোট্ট গণ্ডির বাইরের বিশাল জগৎটা ভীষণ অন্যরকম। সেখানে কোথাও কোনো বড় তাণ্ডব হয়ে গেছে, লণ্ডভণ্ড হয়েছে কিছু। নইলে এমন হচ্ছে কেন সব? আজ গোলাপজানের চোখগুলো সুতি থানের লাল পাড়ের মতো রক্তিম হয়েইবা আছে কেন? কেন খুনরাঙা জবার লালচে রঙের ছোপ ছোপ দাগ তার কাপড়ের ফ্যাকাশে জমিনে?
অপরিচিত দুজন আগন্তুকের মধ্যে সম্ভবত একজন ছিল গোলাপজানের স্বামী। তারা হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে যেতে চেয়েছিল তাকে। কাপড়ের আড়াল থেকে দ্রুত দাটা বের করে আনে সে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই কয়েকটা কোপ বসিয়ে দেয় একজনের কাঁধে। রক্তবন্যায় ভেসে যাবার আগে লোকটা গোলাপজানের হাত ছেড়ে তিন লাফে সিঁড়ি দিয়ে পালিয়ে যেতে যেতে সেখানেই লুটিয়ে পড়ে। কিছু রক্ত গড়িয়ে পড়ে থাকে দরজার মুখটায়, কিছু হয়তো সিঁড়িঘরের মাঝে। কিন্তু, এ দৃশ্য দেখার সাথে সাথে পরবর্তী ঘটনাক্রমের সাক্ষী হবার জন্য আমাকে আরও কিছুদিন অপেক্ষা করে থাকতে হয়।
কয়েকটা দিন কেটে যায় নিরুপদ্রব। রুটিন মেনেই গোলাপজান আবার সাংসারিক টুকিটাকি কাজ সামলাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। প্রতিদিনের মতো বিকালের নরম আলো সাঁতরে ভারী দেহ নিয়ে থপথপ আওয়াজ তুলে এসে বসতো রান্নাঘরের উনুনের কাছে। তারপর চুলার গনগনে আঁচে সিদ্ধ হয়ে ভাতের চাল ফুটে উঠতো রোজ। এদিকে গোলাপজানের পরিবর্তিত মনোজগতে যে দ্বন্দ্ব তৈরি হতে শুরু করেছে তাও বেশ বুঝতে পারছিলাম আমি। তার ঠোঁটে গুঁজে রাখা বিড়ির আগুন চোখে-মুখেও দপদপ করে জ্বলে উঠতো উন্মত্ততার প্রতীক হয়ে। চারপাশের সবকিছু দেখে কী প্রচণ্ড ঘৃণা ফুটে উঠতো তার সমস্ত মুখমণ্ডল জুড়ে। তাই আগের মতো তার কাছে যেতে আমার ঠিক সাহস হতো না আর।
আপনাদের জানিয়ে রাখি, চারতলার বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালে চোখের নাগালের সাথে রেলিঙের উচ্চতাটা প্রায় সমান বলে আমাকে দু পায়ের পাতায় ভর দিয়ে দাঁড়াতে হতো। এভাবে ওপর থেকে নিচে তাকিয়ে দেখতাম আগের মতোই একটা রঙিন রিকশা রাস্তায় দাঁড়ানো। সেখানে হারুন নয়, যেন অন্য কেউ; একজন অচেনা মানুষের প্রতিকৃতি। আমার ভেতরে প্রশ্ন জাগে তবে কি হারুনসহ রিকশাটা ছিনতাই হয়ে গেছে? আমার রঙিন রিকশাওয়ালা—যে আমাকে বাইরের জগৎ দেখিয়েছে। নাকি শুধু একলা হারুন? যে কিনা পালিয়ে গেছে গোলাপজানের সাথে সেদিনের ঘটনার কারণে। রঙিন রিকশাওয়ালার এ পলায়নপর ঘটনা আমাকে আরও একা করে দেয়।
কয়েকদিন বাদে একদিনের এক বিষণ্ন মধ্যাহ্নে কয়েকজন পুলিশ এসে খোঁজ-খবর করে আমাদের কাছে। জিজ্ঞাসাবাদ শেষে তারা নিয়ে যায় গোলাপজানকে। আর গোলাপজান নয়, নুরুম্মা তখন আমাকে মায়াভরা দৃষ্টি নিয়ে সোহাগ করে ডাকছে, ‘খোকন, এট্টু ফ্যান খাইবাম’?
গোলাপজানকে নিয়ে শেষে অনেক কথাই ছড়িয়ে পড়ে আমাদের চারতলা কোয়ার্টারের ঘরে ঘরে। আমার মুখ দিয়ে কোনো কথা আসে না কিংবা সেসব রটনা বলতে ইচ্ছা করে না। সকলের মুখে মুখে নিঃশব্দ দুপুরের একাকী প্রহরগুলোতে নুরুম্মারা গোলাপজান হয়ে যায়। তারা ঘর ভেঙে অন্য পুরুষ নিয়ে দেশান্তরী হয়, কেউ বলে বেশ্যাও হয়ে যায়। আর গোলাপজানের গল্পটা এভাবে আমার মনের ভেতরে সযত্নে লুকিয়ে থাকে অনেকদিন পর্যন্ত। যার শেষ পরিণতি দেখে আপনারাও হয়তো তার নামের মাঝে হারিয়ে যাবেন একসময়। কিন্তু, আমার কোমল মনে ছায়াছবির মতো খেলা করে দুজন নীল পোশাকের পুলিশ গোলাপজানকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যায় হাত ধরাধরি করে। আগের মতোই তার পরনে ছিল শাদা থানের লাল পেড়ে মোটা কাপড়।
আমার দিকে তাকানো চোখ দুটো ছিল আশ্চর্য রকমের স্থির; তবে চকচক করছিল জেদে, ক্ষোভে নাকি কোনো মায়ার আগুনে? আমি সেদিন সে আগুনের ভাষা বুঝতে পারিনি। চোখে শুধু ভাসতে থাকে দুজন পুলিশ ও একজন গোলাপজান আমার দৃষ্টিসীমা থেকে হারিয়ে যায় একটু একটু করে। আর পড়ে থাকে শুধু তার বিদায়ের সময়ে কাপড়ের খোঁট দিয়ে মুছে নেয়া কয়েক ফোঁটা চোখের জল আর সেই ভরাট কণ্ঠস্বর, ‘খোকন, এট্টু ফ্যান খাইবাম’?