নিন্দাকথামৃত

ভণিতা

বিবিধ নিন্দাকথা অমৃত সমান

সামান্যা এ-লেখকে লেখে,পড়ে পুণ্যবান।

এক। কথারম্ভ

প্রিয় ভাইসব এবং আপারা,

জানেন নাকি, জগতে কয় প্রকার নিন্দা আছে? জানেন না তো?

জানতাম আমি সেটা!

আমি অতি পরিস্কাররকমে জানি যে, এই অতি উচ্চমার্গের বিষয়টা সম্পর্কে আমার মতন আর কেউ জানে না!

জগতে নিন্দা আছে দুই প্রকার! এক হচ্ছে, নিত্য নিন্দা! মানে কিনা নিত্যদিনের নিন্দা। সেই নিন্দা আমাদের সকলের সাথে, সকল সময়, কদমে কদমে চলে! কখনো আবার কিনা সে সামনে সামনে চলতে থাকে! কখনো কখনো আমাদের পেছন পেছন আসতে থাকে! এক্কেবারে সমস্তটা দিন আর সমস্তটা রাত আমাদের প্রতিটা জনের সাথে সে থাকেই থাকে! কখনো সে আমাদের ছেড়ে যায় না! এমনই দয়াঅলা বান্ধব সে আমাদের!

এই নিন্দা আমাদের রোজকার পাতের ডালভাতের মতন আপন! আর একেবারে যেনোতেনো, সাধারণ!

জানতেন এই জটিল কথাটা?

জানি জানি-এখনই বলবেন তো যে, জানেন আপনারা!

তা তো বলবেনই! আমারটা শুনে শুনে এখন এমন একটা ভাব দেখাবেন যে, এই মহাজ্ঞান মাথায় নিয়েই আপনারা পৃথিবী অভিযানে এসেছেন! আমি আপনাদের এই স্বভাবের তীব্র নিন্দা জানাই!

কথার মাঝে -কেনো যে- এমন বাগড়া দেন আপনারা! কথাটা শেষ করতে তো দিন! এতো কথা কেমন করে, কেনো বলেন? অতি নিন্দনীয় কিন্তু আপনাদের এই স্বভাব! আশ্চর্য!

যাক, এইবার দ্বিতীয়জাতের নিন্দার কথাটা সারি!

এই দ্বিতীয় জাতের নিন্দা কোনো এলেবেলে, ভুঁঁইফোঁড়, গরিবমিসকিন নিন্দা নয়! সে উত্তম! সে অভিজাত! সে আমজনতার চির আরাধ্য! বহু সাধনায় প্রাণপণে তাকে চাইলে কী, তার জন্য জীবনপাত করলে কী, সে ধরা দেয় শুধুমাত্র দু’এক জনের কাছে! মনুষ্য সভ্যতার এবং সভ্যতার আগের যুগের; কোটি কোটি লোক, যুগ যুগ ধরে, তাকে পাওয়ার সাধনা করে গেছে এবং যাচ্ছে! কিন্তু সে ধরা দিয়েছে কদাচিৎ! এমনই দামির দামি সেই নিন্দা!

এই নিন্দার হাতে আছে একরকমের কদমফুল! দুইএকজন বোকা লোক সেই কদমফুলেরে কিনা অন্য আরেকটা নামে ডাকে! বলে কী, অই কদমের নাম নাকি অমরতা! অইসব বোকারে আমি দুই চক্ষে দেখতে পারি না! নিন্দা দেই তাদের! অনেক নিন্দা!

আমি কিন্তু চিরকাল কদমেরে কদম বলেই ডাকি! কখনো অন্য কিছু বলতে যাই না! আপনারাও কিন্তু এই লাইন মাফিকই চলবেন! বুঝলেন?

ভাইসব, আপনারা কিন্তু আমারটা শুনে শুনেই শিখছেন! কাজেই আমি যেমতে চলতে বলি, সেইমতেই চলবেন! নাইলে নিন্দা দিয়া ধুইয়া দিমু কিন্তুক একেকজনেরে!

আচ্ছা যাক!

এই যে দ্বিতীয় জাতের নিন্দা বা অই যে কদমফুল! আহারে! সে যে কী জিনিস! কী যে সুগন্ধ তার! আর, কী যে শোভা! কিন্তু তাতে কী! হাতে নিতে চান তারে? আহা! আপনি চাইলেই তো আর হবে না! সেই কদমের যদি দয়া হয়, তবেই সে আমার আপনার হাতে এসে ধরা দেবে!

তবে এর ভেতরে কিন্তু একটা গূঢ়, গোপন, মারাত্মক কথা -খুব লুকানো আছে! যে কিনা এরে পেয়েছে, সেই শুধু অই গোপন কথাখানা জানে! আর জানি আমি!

সেই কথাখানা হলো এই :এই কদম্বপুষ্প না তোমার হাতে এসে ধরা দিয়েছে? জানবে,কদম্ব পুষ্প না, তোমার হাতে এসে ধরা দিয়েছে আদত সর্বনাশখানা! এই কদম ভয়ানক জঘন্য কদম!তার ডালে আর পাতায়- কাঁটার ওপরে কাঁটা! মহা খটখটা কাঁটা!

সেই কাঁটা তোমার আঙুলকে থেঁতলাভেতলা করবে! হাতের তালু ছন্নভন্ন করবে! রক্ত ঝরতে থাকবে রক্ত ঝরতে থাকবে- তোমার হাত থেকে। চোখ থেকে। আর তোমার আউলা পরান থেকে! কিন্তু তোমার নিস্তারের কোনো রাস্তা থাকবে না!

চান নাকি ভাইসব -সেই নামি নিন্দারে? আমি জীবনেও চাই না!

এই যে নিন্দাবিষয়ে এতো কথা আপনাদেরকে জানায়ে চলছি, সেটা কি আমার কোনো উপকারের জন্য? না! মোটেই তা নয়! আমি এইসব বলছি জনস্বার্থে! আপনাদের মঙ্গল সাধনের নিমিত্তে!

শাস্ত্রে তো এমন হিতোপদেশই দিয়ে যাচ্ছে যুগ-জীবন ভরে! শাস্ত্রে কী বলেছে? বলেছে যে, ওই পাড়ে যাওয়ার সময় তোমার জ্ঞানগম্যি কিছুই কিন্তু পরানের ডিব্বার ভেতরে সেঁটে নিয়ে চলে যেয়ো না! লোকের কাছে রেখে যেয়ো! লোকের কাজে লাগবে! আর তোমারও তাতে মহান বলে খ্যাতি হবে! আমি সেই সামান্য খ্যাতিরই বাঞ্ছা করি! বেশি কিছু না! এওখন আপনারা সেইটা দিলে দিবেন, না দিলে নাই! আমি পরোয়া করি না! পাওয়া-থোওয়ার ধার আমি আর ধারি না !

কিন্তু নিন্দা বিষয়ক এই যে মহাজ্ঞান আমি অর্জন করেছি, সেইটা বিশদ ব্যাখ্যাসহ- আপনাদের হাতে- দিয়ে আমি যাবোই! এই আমার পণ!

দুই। বিবিধ নিত্যনিন্দা অতি স্বাস্থ্যকর!

এই সংসারে নিন্দাই সার কথা। বাকি সকলই অসার।

ঘরে ঘরে নিত্যনিন্দা আছে বলেই সংসার সুস্থ আছে।

ঘরে ঘরে নিত্যনিন্দাভীতি আছে বলেই সংসারে এতো এতো অসুখ আছে!

সংসারের আশা-বাসনার লতাপাতা- এই যে চিরকাল এমন লকলকিয়ে চলছে,

কখনোই যে মরে কাঠ হয়ে যাচ্ছে না !

তার কী কারণ?

কারণ সেই নিত্যনিন্দা!

সে আছে বলেই সকল বাঞ্ছালতা এমন লকলকা-নিরবধি!

নিত্যনিন্দা আছে বলেই সংসারের সূর্য ডুবছে, আর রাত আসছে!

তারপর রাত শেষ হচ্ছে, আবার সূর্য দেখা দিচ্ছে!

নিত্যনিন্দাখানা আছে বলেই ঘরে ঘরে পুত্রবধূগণ এমন বিনা কারণে ধুমসো কলাগাছ হবার ফুরসত পাচ্ছে!

পাবে না কেনো ?

মনের ভেতরে তো কোনো প্রকার বিষব্যাধি জমানোর কোনো অবকাশ তারা পাচ্ছে না!

সেই সকল বিষ নিত্য হড়বড় করে করে বেরিয়ে আসছে!

অড়শিপড়শি, আত্মীয়, বান্ধব, ছেলেমেয়ের সহপাঠীর বাপ কিম্বা মা- সকলজনের কাছে সেই বিষসুধা ঢেলে দেয়া যাচ্ছে বলেই না -শরীর অমন নির্ভার স্টম্ফীতকায় হবার ভাগ্য পাচ্ছে!

আর বধূর অন্তরখানারে জয়ের গৌরবে ভরে দিচ্ছে!

নিত্যনিন্দা আছে বলেই শাশুড়ির জীবন অমন তেলে-জলে মাখোমাখো হয়ে আছে সংসারে!

সয় না তাদের-সহ্য হতে কিছুতেই চায় না তাদের- নিজ পুত্রের জীবনে অই পরকন্যার বসবাস!

অসহ সেই ব্যথাভারে কবেই মরে যেতে হতো তাদের-যদি নিত্যনিন্দার ঘন ছায়াখানা না থাকতো!

যদি নিত্যনিন্দার গুণে চোখে অশ্রু না এসে যেতো

তবে জীবনের বিকেলবেলাখানা কী জঘন্য গুমোট হতো!

নিত্যনিন্দা আছে বলেই বিটকেলে বসরে চোখের সামনে সয়ে নেয়া যায়

কোনো সমস্যা হয় না!

নিত্যনিন্দাগুণে সহকর্মীর পদোন্নতিখানারেও বরদাস্ত করা যায়!

দিন তেমন এবড়া-ছেবড়া লাগে না!

মেধাবী লেখকেরে- এই যে অমন এক -নিরুদ্ধার কোণঠাসা দমবন্ধ জীবনে রয়ে যেতে হয়

সে কার গুণে?

সংঘবদ্ধ নিত্যনিন্দার গুণে!

এই নিত্যনিন্দা আছে বলে

পাগলাজাতের সাহিত্য সম্পাদকের ঝাড়িরেও হজমের রাস্তা আছে!

নিত্যনিন্দা হে!

তুমি আছো তাই

লোকের পরানে নতুন বস্ত্র ক্রয় করিবার বাসনাখানা আছে!

নব নব মোবাইল ফোন লোকসকলের হাতে হাতে ঘুরে বেড়াবার সাধখানা আছে

হাওয়ায় হাওয়ায় উড়তে থাকার ঘুড্ডিসকলে আছে!

হে নিত্যনিন্দা, তুমি আছো বলে এই জগৎ আছে!

আর এই আমি আছি!

আর এ জগতে সুস্থতা আছে!

তিন। হে একা অনিত্যনিন্দা! তোমারে লভিয়া কী ফল!

অনিত্যনিন্দা একা একলা থাকে, এই কথা সর্বজনে জানে! কিন্তু সে যে জগতের কোনখানে থাকে, সেই কথা আজ পর্যন্ত কেউই সঠিকরকমে বলতে পারে নাই!

তার সন্ধানে সন্ধানে আমাদের আদি দুনিয়ার এক মেয়েরে ঝড়বাদলার রাতে রাতে যমুনার কিনারে কিনারে ঘুরে বেড়াতে দেখা গিয়েছিলো! এই পাগলা ছুটের কথা শাস্ত্রে পর্যন্ত বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করা আছে! কিন্তু সেই মেয়ে কি শেষ পর্যন্ত সেই অনিত্যনিন্দা ওরফে অমরতার ওরফে আসল প্রণয়ের সন্ধান পেয়েছিলো? সেই কথা শাস্ত্রে বলে না! সেই মেয়েও বিশদ ভেঙেচুরে কিছুই বলে যায় নাই!

বলার মধ্যে যা বলেছে,তা হলো এই :’কলঙ্কী বলিয়া ডাকে সব লোক/ তাহাতে নাহিক দুখ। তোমার লাগিয়া কলঙ্কের হার/ গলায় পরিতে সুখ।।’

তবে ভাইসব, জগতে এক বিষম অদ্ভুত বিত্তান্ত চিরকাল ধরে ঘটতে দেখা যায়! সেটা হলো এই যে, লোকে না নিত্যনিন্দা দিয়ে নিজেদের জীবন-মরণেরে ঘেরাও দিয়ে রাখে? তার সাথেই না ওঠ-বস করে?

করে তো! কিন্তু করলে কী!

সেই নিত্যনিন্দার কথা ভুলেও তাদের মনে থাকে না! নিত্যনিন্দার বেষ্টনে থেকে থেকে তারা কেবল সেই চির-অদেখা অনিত্যনিন্দার জন্য আফসোস করতে থাকে! মনে মনে গোপনে গোপনে তার জন্যই পুড়তে থাকে!

হাজারটা বাহুর ঘেরে নিজেরে ঠেলে দেওয়ার পরেও তার মনে হতে থাকে যে, হায় রে! সেই তারে কিছুতেই পাওয়া হলো না! সেই অনিত্যনিন্দার দংশনরে-কিছুতেই পাওয়া হলো না!

মনুষ্যস্বভাব এমন বিটকেলে কেনো!

চার! হায় হায় এ কী বিপত্তি!

দেখেন, দেখেন ভাইসকল ও বইনেরা!

আমি কী করছি?

আমি জনস্বার্থে এই যে উপকারীসব ব্যাখ্যা রচনা করে চলছি!

এমন জনদরদি আমার ওপর কী এক আসমানি গজব না জানি নেমে আসতাছে! আমার হাত জানি ক্যান আঁতকার উপরে অতি বেতালা বেতালা লাগতাছে! সবগুলা আঙুলই ক্যান জানি অবশ, অসাড় মরা গাছ মরা গাছ হয়ে যাচ্ছে-পলকে পলকে!

এইটা কী ব্যাপার! এটা কেমন গজব নেমে আসতে চাচ্ছে-আমার ওপর! কেনো রে? কেনো?

কেনো যে এমন হইতাছে, সেইটা কি আর আমার অজানা! কিচ্ছু অজানা নাই!

ভিতরে ভিতরে আমি ঠিকই বুঝতে পারতেছি-কেনো আঁতকার উপরে এমন বালামুসিবত আমার উপর নাজিল হইতে চাইতাছে!

চাইবে নয়া কেনো?

আমি ভুল করে একটা তথ্য দিতে ভুলে গেছিলাম যে! সেই ভুলের কারণে এখন এমন জ্বালাযাতনার ছোবলখানা পাইতে হইতাছে আমারে!

না না ভাইসব! আমি ইচ্ছা করে ভুলি নাই! ভুল করে হয়ে গেছে-এমন ভুলটা!

এই যে আমি এক্ষণ স্বীকার করছি! এই যে আমি সর্বসমক্ষে কবুল করছি যে, এই নিন্দাকথাজ্ঞান আমার নিজের অর্জন না রে বাবা! এইটা দৈবে দিছে আমারে! এই জ্ঞান দৈবপ্রদত্ত জ্ঞান!

সেই জ্ঞানেরে কিনা এতোক্ষণ ধরে আমি আমার নিজের ভিতরে জন্ম নেওয়া বস্তু বলে ঘোষণা দিয়া যাইতাছি! এইটা মিথ্যা এইটা পাপ! সেই মিথ্যার এই শাস্তি! আঙুল মরে যায় যায় দশায় পড়া-এই কারণে!

আসো বাবা দৈব! প্রসন্ন হও! আমার ভুলেরে ক্ষমা দেও! আমার আঙুলদের এইবেলা তাদের স্বাভাবিক জীবন ফেরত দাও! তোমার স্তব সম্পন্ন করে, তারপরই, আমি লোক সকলেরে,আবার নতুন করে, বিবিধ জাতের নিন্দার গুণ এবং অগুণ কথা জানানি দিতে যাবো বাবা!

পাঁচ। যেমতে এই নিন্দাকথার সন্ধান পাওয়া যায়

সত্যি বলছি, আমি কীভাবে এই নিন্দাকথার খোঁজ পেয়েছি- সেই গুহ্য কথাখানা আপনাদের বলে দেয়ার কিছুমাত্র ইচ্ছা আমার ছিলো না!

একেবারে ষোল আনা ইচ্ছা ছিলো যে, আমি ঝপ্পাত করে, সরাসরি নিন্দা কথামৃত শোনাবার কাজে ঝাঁপিয়ে পড়বো! এমন ভঙ্গি-ভণিতা করে মনুষ্য-সংসারে নিন্দার গুণ ও অগুণ বলা শুরু করবো যে, লোকে আমার কল্পনাশক্তির গহীনতা দেখে বাক্যহারা হয়ে যেতে বাধ্য হবে! আমার ভাবনাচিন্তার নবত্ব ও অভিনবত্ব নিয়ে তারিফ করতে করতে একেবারে কাহিল হয়ে যাবে দশজনে!

সত্যি বলছি, লেখা শুরু করার আগেই-এতো সবকিছু ভেবে ভেবে আমার আহদ্মাদের কোনো সীমাপরিসীমা থাকে নাই!

কিন্তু কী কপাল! দেখলেন তো, যেই না লেখা শুরু করতে গেছি, অমনি আমার দশ আঙুল আস্তে-বিস্তে কেমন অচল পাত্থর হয়ে যাচ্ছিলো তখন? আর কী হচ্ছিলো জানেন? আচমকাই আমার মাথার ভেতরে ঝনাৎকার দিয়ে উঠছিলো সেই হুমকিখানা! সেই যে সেই হুমকিখান! সেই যে সেই লোক, সেইদিন, পরিস্কার গলায় আমারে বলে গিয়েছিলো, ‘এই যে কথাগুলা তোমার কাছে থুইয়া যাইতাছি, এইগুলারে আমানত বইল্লা জানবা! এইগুলা দশজনেরে জানানোর হকদার খালি তুমি! এগো মালিকানা তোমার না! কথাগুলা বলার কাজ তুমি করবা, কিন্তু সেই কথারে নিয়া নিজের নাম ফাটানোর কোনো উজ্জুগ নিবা না! সেইটা নিছো, তয় জানবা তুমি মরছো! আমার হাত তেনে রেহাই পাইবা না!’

হায় হায় হায়! নাম ফাটানোর লোভ কী সাংঘাতিক জিনিস! সেই লোভে কিনা ঝটকা মেরে এসে আমারে আমার জানের মায়া ভুলায়ে দিচ্ছিলো! ধিক ধিক তোমারে, হে লোভ! তোমারে আমি তীব্র নিন্দা করি!

যাক, এইবার আসল কথায় আসি!

কথা হলো এই যে, যখনই আমি রাস্তায় চলাচলতি শুরু করি, তখনই কোনো না কোনো একটা অশৈলী কারবার আমার সাথে ঘটবেই ঘটবে! অই তো দেখা যায়- দেশের কোটি কোটি লোক- খোদার তিরিশটা দিন, রাস্তায় বের হচ্ছে। নিজ নিজ কর্ম করছে তারা যে যার মতন; তারপর নিজ নিজ বাড়িঘরেও যথাসময়ে ফেরত আসছে! কই, তাদের সাথে তো অশৈলী কারবার কোনোপ্রকার লেনদেন সারতে যায় না?

অশৈলী কারবারে খালি আমারেই দেখতে পায়! আমারেই শুধু? এখন, এইবার কী ঘটেছে- সেইটা শোনেন!

হয়েছে কী, কপাল্‌গুণে দিনকতক আগে আমার কিনা যেতে হয়েছিলো জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে! সকাল সকাল করে পৌঁছুবার বাঞ্ছা ছিলো বলে, সেইদিন, খুব ভোর ভোর করে বেরিয়ে গিয়েছিলাম! আমার ইচ্ছা ছিলো উত্তরা পেরিয়ে আশুলিয়ার খা খা হাওয়ার দিকে চেয়ে থেকে থেকেই পথ শেষ করে ফেলবো! কোনো যানজট আমার নাগালটাও পাবে না! কী উত্তম এক ভ্রমণই না হবে সেটা!

তবে চলতে চলতে আমি হঠাৎই খেয়াল করে দেখি যে, উত্তরা আশুলিয়াকে অতি নিকৃষ্ট চলাচল এলাকা বলে ঘোষণা দিয়ে আমার চালক তার নিজ পছন্দের পথ বেছে নিয়েছে! সে যাচ্ছে রোকেয়া সরণী ধরে। তার আপাতত গন্তব্য আমীনবাজার! তারপর যেতে যেতে তো জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় আসবেই!

রোকেয়া সরণী ধরে একটুখানি এগুবার পর হুড়ূম করে তাকে থেমে যেতে দেখি আমি! তারপর সে থেমেই থাকে থাকেই। এগোবার কোনো ফরমাশ আর পায় না! ডান, বাম এবং সামনের সকল রাস্তার সকল গাড়ি হুড়ুমধুড়ুম ছুটে যেতে থাকে। কিন্তু এই পথের জন্য কোনো হুকুম আসে না!

আল্লা! এইটা কী কারবার! পঁয়ত্রিশ মিনিট পার হয়ে গিয়ে চল্লিশ মিনিটও যায় যায়! এইটা কী! আর এদিকে দেখো সূর্যের তামশাখানা! এই তো আষাঢ় মাসের সকালবেলা! দেখো দেখো! আষাঢ় মাসের সুরুজেরে দেখো! তার কোনো লাজশরম হায়া-পরদা কিচ্ছু আছে কিনা? সেইসবের কিচ্ছু নাই তার!

আরে, তুই মেঘে ঢাকাঢুকি হয়ে না থাকিস, নাই! কিন্তু একটু নরমসরম তো থাকবি? তুই বরষাকালের সূর্য না? কোন মুখে তুই এমন দবদবা গনগনা হয়ে থাকিসরে বেশরম? ধিক তোরে!

থেমে থাকতে থাকতে থাকতে নিজেরে যখন মরা থকথকা পুয়ামাছ ছাড়া আর কিচ্ছু মনে হচ্ছিলো না, তেমন সময়ে দেখি কী-কে একজন জানি পা-হেঁচড়াতে হেঁচড়াতে এসে দাঁড়ায় গাড়ির দরোজা বরাবর!

যাহ! এখন, এই এমন সময়ে কিনা একজনের সাহায্য চাওয়ার মর্জি হলো! এমন সময়ে কি সাহায্য চাইতে আসতে হয়? ওরে মানুষের বিবেকবুদ্ধির স্বল্পতা! ধিক তোমারে!

‘এই যে ধরো গাট্টিখান! হুঁশ কইরা ধরো!’ সেই মানুষ গাড়ির জানালা দিয়ে তার শরীরের অর্ধেকখান ঢুকায়ে দিয়ে আমার কোলের ওপরে কী জানি একটা ছুড়ে দিতে দিতে বলে! ‘সংসারের অতি উপকারী কথা কয়খানা এই গাট্টিতে বান্ধা আছে! লোকেরে ভালারকমে জানান্তি দিয়া দেওনের কামখান করবা! নাইলে কইলাম খবর আছে!’ সেই লোকের চোখমুখ আমাকে হুঁশিয়ার করতে থাকে!

‘মানে কী!’ আমি তো তখন সেই লোকের কায়কারবার দেখে পুরা বেদিশা! কিন্তু সেই লোক আমারে কিছুমাত্র পাত্তাই দেয় না! সেই লোকেরে আবার বলতে শুনি আমি; ‘আমি আছি কিনা দুনিয়ার ভেজালে। বলতে গেলে, এক ফোঁটা টাইম নাইক্কা আমার। আর, আমার অতি মায়ার শইল! হেইর লেইগাই না এই গাট্টির দায়দেনা তোমারে দিতাছি! লোকের উবকারটা কইরা যুদি নিজের ভালাইখানও কইরা নিতে পারো!’ বলতে বলতে লোকটাকে পেছনে চলে যেতে দেখি আমি!

আরে-আরে! কী যাচ্ছেতাই ব্যাপার! এটা কার কী রে বাবা! আমি কেনো রাখবো? ধুর!

এই পোটলা নিয়ে আমি কী করবো!! দূর দূর! পোটলাটাকে ফেলে দেয়ার জন্য আমি দড়ামদুড়ুম হাতে কাচ নামাতে থাকি! কিন্তু তাজ্জবের কাণ্ডরে বাবা! সেই লোক যেনো উড়ে এসে আবার দরোজার সামনে দাঁড়ায়ে যায়!

‘ফালাইলে খবর আছে! যেমনে যা কইছি, সেইটা না করলে তো খবর আছেই, কইতাছি! হুকুমের বাইরে কিছু করলে কইলাম- কইলজা ছিঁড়া হাতে ধরাইয়া দিমু! মোনে থাকে য্যান কথা কয়খান!’ এমন গরজানি দিতে দিতে সেই লোক গাড়ির সাথে সাথে চলতে থাকে। চলতে চলতে একসময় সে কোনখানে জানি নাইও হয়ে যায়! কিন্তু সেই যে আমার পরান কাঁপাকাঁপি শুরু হয়, তার আর থামাথামি হয় না! কিছুতেই থামাথামি নাই!

শেষে মনে পড়ে, দেখি তো পোটলাটা খুলে বিশেষ কোনো উপকার হয় কিনা! এটা খুললে কি এই ডরুক হাত-পা-মাথা আর কলজের এমন বিরতিহীন কম্পন থামানো সম্ভব? মনে হতে থাকে যে, এর কারণেই যেহেতু এমন সর্বনাশা অবস্থাটা এসেছে, নিদানও তবে এইখানেই থাকতে পারে!

‘আমারে খোলোনের চেষ্টা নিয়া না!’ আমি পোটলার গলা একেবারে পরিস্কাররকমে শুনতে পাই! ‘আমি যা কইতাছি সেইটা মাথায় নেও! কামে লাগবো!’

ভাইসব! এই যে আমি এতোক্ষণ যেট্টুক নিন্দাবিত্তান্ত বলেছি, তার সবটাই সেই অচিন মানুষের দেয়া ছেঁড়া পাতিপাতি কাপড়ের গাট্টিটার বলা কথা! আমি কিছু বলি নাই! এইসকল কথার দায়দায়িত্বও আমার নাই! আমি এইখানে নিমিত্ত মাত্র!

তবে, একটা কথা কিছুতেই পরিস্কার হলো না!

লোকে শত শত কোটি টাকাসুদ্ধা – আপন জিনিস মনে করে- গাপ করে দিচ্ছে! তাদের কিছুতে কিছু হচ্ছে না! আর আমি কিনা তুচ্ছ কয়টা নিন্দাকথারে একেবারে আপনা মনে করে আত্মসাৎ করতে গেছি, তাতে এমন আসমানি-জমিনি বালাই আমার দিকে তেড়ে আসে?

এইটা কার কারণে ঘটছে?

কার কারণে আবার?

ঘটছে অই তেনা-কাপড়ের গাট্টির কারণে!

আমি কি এখন অই গাট্টিরে নিন্দা দিবো? নিত্য নিন্দা?

ধুত্তোর নিন্দা!

এরে যুদি আমি এক্ষণ আগুন দিয়া না-পোড়াইছি, তো কী কইলাম!

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত