বগি নম্বর ৮৩০৫

বেঁচে থাকা মানে দুর্ভোগ পোহানো। টিকে থাকা মানে ওই দুর্ভোগের কোনো তাৎপর্য বুঝতে পারা।

– নিট্শে

ট্রেন এক রহস্যময় বাহন। কত চড়েছে সাজু! তবু এর রহস্যের তল পায়নি। রহস্যময় আসলে ট্রেন নয়। লোহালক্কড়ের মধ্যে কী এমন রহস্য? সেই শতাব্দীকাল প্রাচীন ইঞ্জিন কলুর বলদের মতো বগিগুলোকে টানে, আঠারো শতকের নিগ্রো ক্রীতদাসদের মতো বগির চাকাগুলো গড়িয়ে গড়িয়ে চলে, চলতে চলতে দেশ-দেশান্তরে ছোটে, এই তো। এর মধ্যে রহস্য কোথায়? রহস্য আসলে মানুষ। ট্রেনে কত কিসিমের মানুষ যে ওঠে! ধনী, গরিব, ব্যবসায়ী, চাকুরে মৌলবি, ফেরিওয়ালা, কানা-খোঁড়া, ফকির … বিচিত্র রকমের মানুষ। ট্রেন ছাড়ার আগে মুখে সাদা দাড়ি, মাথায় টুপি আর গায়ে জোববাঅলা এক ফকির জানালার পাশে দাঁড়াল। এক টাকা নয়, দুই টাকা নয়, শুরু করল পাঁচ টাকা চেয়ে : ‘দেন বাবা, পাঁচটা টাকা দেন। পাঁচ টাকার অসিলায় কবরে পঞ্চাশ হাজার বছরের আজাব মাফ হবে, জান্নাতে পাবেন পঞ্চাশ হাজার হুর ও গেলমান। দশ টাকা দিলে কবরে এক লক্ষ্য বছরের আজাব মাফ হবে, জান্নাতে মিলবে এক লক্ষ হুর ও গেলমান। বিশ টাকা দিলে তার ডবল। চলিস্নশ টাকা দিলে ডবলের ডবল। দেন বাবা, দেন।’

চোখেমুখে বিরক্তি নিয়ে সাজু বলল, ‘মাফ করেন।’

ফকির বলল, ‘আপনি মুসলমান না?’

সাজুর মেজাজটা এবার টং করে উঠল। সে মুসলমান, না হিন্দু, না বৌদ্ধ, না খ্রিষ্টান, তাতে ফকিরের কী? ফকিরের মতলবটা বুঝতে দেরি হলো না তার। অর্থাৎ তোমাকে এতক্ষণ ধর্মের কথা শোনালাম, তুমি কিনা কোনো গুরুত্বই দিলে না! মেজাজের লাগামটা সে ধরে রাখল। ফকিরের সঙ্গে মেজাজ দেখিয়ে কী লাভ? হাসিমুখে বলল, ‘আমি মানুষ। আপনি?’

বুঝেছি, তুই মুসলমানের পোলা না। তোর ভিক্ষা লাগবো না।

হাঁটা ধরল ফকির। দীর্ঘ হুইসেল বাজিয়ে ট্রেনও ছেড়ে দিলো। সাজুর মেজাজের লাগামটা ফসকে গেল। ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে, নইলে ফকিরের বেটা ফকিরকে আচ্ছামতো দুটো কথা শুনিয়ে দিত। বেশি বাড়াবাড়ি করলে পাঞ্জাবির কলারটা টেনে দিতেও ছাড়ত না।

সাজু ফিরছে ফেনী থেকে। মহানগর এক্সপ্রেসে। সঙ্গে স্ত্রী-কন্যা। তাদের সিট পড়েছে ডানদিকে, তার বাঁদিকে। ফিরছে আসলে সাজেক থেকে। বৃহস্পতিবার ঢাকা থেকে মহানগর প্রভাতীতে ফেনী গিয়েছিল। রাতটা ছিল শালির বাসায়। শুক্রবার মহিপাল থেকে প্রথমে খাগড়াছড়ি, তারপর দিঘিনালা। দিঘিনালা থেকে চাঁদের গাড়িতে করে সাজেক। মেঘকাব্য রিসোর্টে ছিল দু-রাত। রোববার রাতে শালির বাসায় থেকে সোমবার আবার ঢাকার উদ্দেশে যাত্রা।

বৃহস্পতিবার দুপুরে ফেনী পৌঁছার পর মেজাজ বিগড়ে দিয়েছিল চোর, আজ ফেনী ছাড়ার সময় বিগড়ে দিলো ফকির। বৃহস্পতিবার ট্রেনে ভিড় ছিল খুব। ঈদ গেছে দশদিন আগে। ভেবেছিল এত ভিড় হবে না, অথচ হলো কিনা অকল্পনীয় ভিড়। নামার সময় প্যান্টের পকেটে ছিল শখের স্যামসাং জে সেভেন অ্যান্ড্রয়েড মোবাইল ফোন, আর হাতে ছিল ট্রলি ব্যাগ। কোন ফাঁকে মোবাইলটা চুরি হয়ে গেল টের পেল না। পেল নামার পর। ততক্ষণে ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে। মেজাজটা বিগড়ে গেল ভীষণ। বিগড়াবে না? মাত্র ছ-মাস আগে ফোনটা কিনেছে। একেবারে নতুন। কোথাও একটা দাগ পর্যন্ত পড়েনি। প্রায় দশ মিনিট পর, পস্ন্যাটফরম ছেড়ে যখন রিকশায় উঠল, মনে পড়ে গেল গীতার বাণী : তোমার কী হারিয়েছে যে তুমি কাঁদছ? তুমি কী নিয়ে এসেছিলে যা তুমি হারিয়েছ? সঙ্গে সঙ্গে মেজাজটা হয়ে গেল শীতল।

শালি বা ভায়রার কাছ থেকে টাকা ধার করে ফেনী শহর থেকে একটা ফোন কিনতে পারত। কেনেনি। কারণ ফোন ছাড়াই ভ্রমণটা শেষ করতে চেয়েছে। ফোন মানেই ডিস্টার্ব। কল আর কল, ফেসবুকে চ্যাট আর চ্যাট। ভাইবার, হোয়াটসঅ্যাপ তো আছেই। সায়িকার ফোন আছে। শাওমি কোম্পানির দামি অ্যানড্রয়েড। ওটা দিয়ে ছবি তোলার কাজ সেরেছে। ফোন ছাড়া গত কদিন ভালোই ছিল।

ফকিরের কথায় মেজাজ এতটাই বিগড়ে গেল যে, ভায়রা বা শালার নম্বরে ফোন করার ইচ্ছে হলো। ওই ফকিরের বেটাকে ধরে আচ্ছামতো তারা ঝেড়ে দিক। শালা ভ- কোথাকার! সঙ্গে থাকলে ঠিকই ফোন দিত। সায়িকার ফোন থেকে দিতে পারে। দিলো না। মনকে সান্তবনা দিলো, যাক, আদনা ফকিরের ওপর রাগ করে কী লাভ?

ট্রেন চলছে। ভিড় বেশি নেই আজ। কেউ দাঁড়িয়ে নেই। গোটা বগির দু-একটা সিট ফাঁকাও থাকতে পারে। পনেরো মিনিটে পৌঁছে গেল গুণবতী স্টেশন। এই স্টেশনে থামার কথা নয়, অথচ থামল। হয়তো লাইন ক্লিয়ার পায়নি। খানিক পর চট্টগ্রামগামী একটা ট্রেন ক্রস করার পর আবার চলতে শুরু করল। সাজুর চোখ স্থির হলো বগির শেষমাথায় দরজার ওপর, যেখানটায় লেখা ৮৩০৫। যতবারই সে ট্রেনে চড়েছে ততবারই খেয়াল করছে সব বগির ওই জায়গাটায় একটা নম্বর লেখা থাকে। ওটা কি বগি-নম্বর? তার টিকিটে তো লেখা : কোচ নং-গ। তাহলে ওটা কিসের নম্বর? হয়তো স্থায়ী কোচ নম্বর। পৃথিবীতে কত কিছু যে অজানা! জানার আসলে শেষ নেই। জ্ঞান এক মহাসমুদ্র, যার কোনো কিনারা নেই। মোবাইল থাকলে গুগলে সার্চ দিয়ে জেনে নিতে পারত।

ট্রেন কুমিল্লা স্টেশনে পৌঁছল সোয়া পাঁচটায়। ফেনী থেকে পাক্কা সোয়া তিন ঘণ্টা লাগিয়ে দিলো। বিস্তর যাত্রী উঠল। দু-একজন বসতে পারলেও বাকিরা দাঁড়িয়ে রইল। আখাউড়া থেকে উঠল দ্বিগুণ। মানুষের পিঠে মানুষ। তিলঠাঁই নেই। সাজুর বিরক্তি লাগে। ট্রেনে আজকাল এত ভিড় হয়! ছ-মাস আগে সোনার বাংলা এক্সপ্রেসে চট্টগ্রাম গিয়েছিল। তখন এত ভিড় দেখেনি। অবশ্য তখন গিয়েছিল এসি কেবিনে। এসি কেবিনে তো নয়ই, এসি বগিতেও অতিরিক্ত কোনো যাত্রী ওঠে না। উঠলেও পুলিশ অন্য বগিতে সরিয়ে দেয়। সেদিন হয়তো অন্য বগিগুলোতে ভিড় ছিল। এসি কেবিনে ছিল বলে ভিড় তার চোখে পড়েনি। তার ভুল হয়েছে নন-এসি শোভন চেয়ারের টিকিট কেটে। উচিত ছিল কেবিন নেওয়া। টাকা একটু বেশি হলেও নিরুপদ্রব ভ্রমণ। নেয়নি সায়িকার কারণে। কেবিন ভালো লাগে না তার। বাদামঅলা, ঝালমুড়িআলা, শসাঅলা, আমড়াঅলা ওঠে না। ট্রেন ভ্রমণ মানেই এটা-সেটা খাওয়া। না খেলে ভ্রমণ কিসের? তাই তার শোভন চেয়ারই পছন্দ।

সাজুর সিগারেটের তেষ্টা পেল খুব। তেষ্টা মেটানোর জন্য দরজার সামনে বা বাথরুমে যেতে হবে। যে ভিড়, যাওয়ার কোনো উপায় নেই। সর্বশেষ ট্রেন কুমিল্লা স্টেশনে ঢোকার আগে দরজায় দাঁড়িয়ে টেনেছিল একটা। প্রস্রাবের বেগও পেয়েছে খুব। ঝিম মেরে বসে থাকা ছাড়া উপায় নেই। ভিড় ঠেলে বাথরুমে যাওয়া-আসার চেয়ে ঝিম মেরে বসে থাকাটা কম কষ্টের।

নরসিংদী স্টেশনে কিছু যাত্রী নামলেও উঠল তার দ্বিগুণ। সাজু জানত এমনটাই ঘটবে। নরসিংদীর মানুষ বাসে কম চড়ে। ঢাকা যাতায়াতে ট্রেনেই তাদের সুবিধা। বিমানবন্দর স্টেশন না পৌঁছা পর্যন্ত এই ভিড় আর কমবে না। ভিড়ের কারণে সায়িকা ও মিশুকে সে দেখতে পাচ্ছে না। কুমিল্লা স্টেশনের পর থেকেই তাদের আর দেখতে পায়নি। ভাগ্যিস ট্রেন কুমিল্লা স্টেশনে ঢোকার আগে মেয়েটা বাথরুম সেরে এসেছে। নইলে কী বিপত্তিতে যে পড়তে হতো!

রাত পৌনে নটায় বিমানবন্দর স্টেশনে থামল ট্রেন। ফাঁকা হয়ে গেল পুরো বগি, খালি হয়ে গেল অনেক সিট। সায়িকা ও মিশুর সঙ্গে কথা বলে বাথরুমে গেল সাজু। প্রস্রাব করে বেরিয়ে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে সিগারেট ধরিয়ে সুখটান দিলো। মাথার ভেতরে ঝিঁঝি করতে লাগল। দীর্ঘক্ষণ পর সিগারেট খেলে মাথায় এমনি করে।

সিগারেটটা শেষ করে সিটে ফিরল। সায়িকা জানতে চাইল, তেজগাঁও স্টেশন পৌঁছতে আর কতক্ষণ লাগবে? সাজু বলল, বড়জোর পনেরো মিনিট। জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল সায়িকা। মিশুও। সাজুর পেটটা হঠাৎ মোচড় দিয়ে উঠল। আবার বাথরুমে যেতে হবে। চেষ্টা করল ঠেকিয়ে রাখার। কিন্তু পেটের ভেতর যে-আন্দোলন, তাতে বেশিক্ষণ ঠেকিয়ে রাখা যাবে বলে মনে হলো না। তাদের বাসা মোহাম্মদপুরে। নামতে হবে তেজগাঁও স্টেশনে। সিএনজিচালিত অটোরিকশায় চড়ে বাসায় পৌঁছতে আরো অন্তত এক ঘণ্টা। জ্যামে পড়লে তো কথা নেই, দেড় ঘণ্টাও লেগে যেতে পারে। তারচেয়ে বরং ট্রেনেই কাজটা সেরে ফেলা ভালো।

সায়িকা ও মিশু তখনো বাইরে তাকিয়ে। সাজু উঠল। সে যখন বাথরুমে ঢুকে দরজার লোহার পাতটা ঘুরিয়ে লকটা লাগিয়ে দিলো, পেছনের বগি থেকে তখন এক বুড়ো এসে দরজার সামনে দাঁড়াল। একটা বিড়ি ধরাল বুড়ো। বিড়ি টানতে টানতে অনেকটা আনমনে বাথরুমের দরজার বাইরে লকের লোহার পাতটা ঘুরিয়ে খাঁজে ঢুকিয়ে দিলো। তারপর দরজায় হেলান দিয়ে আয়েশে বিড়ি টানতে লাগল। দু-মিনিটের মধ্যে ঝটপট বিড়িটা শেষ করে গলার কফ-থুথু ঝেড়ে নিজের বগিতে ফিরে গেল।

তেজগাঁও স্টেশনের কাছাকাছি পৌঁছল ট্রেন। বাঁয়ে তাকিয়ে স্বামীকে দেখতে না পেয়ে সায়িকা ভাবল দরজার সামনে বুঝি সিগারেট খেতে গেছে। সে অপেক্ষা করতে লাগল। কয়েক মিনিট পর তেজগাঁও স্টেশনে ঢুকল ট্রেন। অস্থির হয়ে উঠল সায়িকা। কোথায় গেল সাজু! বগির এ-মাথা ও-মাথায় চক্কর দিলো একবার। কোনো সিটে নেই। দুই মাথার চার দরজায় খুঁজল। তাও নেই। কোথায় গেল তবে? পরিচিত কারো দেখা পেয়ে কি অন্য বগিতে গেল? গেলেও এতক্ষণে তো ফিরে আসার কথা। পেছনের বগিতে গিয়ে খুঁজে দেখার কথা ভাবল। কিন্তু ট্রেন ততক্ষণে পস্ন্যাটফর্মে থেমে গেছে। অসহায়ের মতো কেঁদে উঠল সায়িকা। মিশু বলল, ‘আম্মু, চলো আমরা নেমে পড়ি। আববুর কাছে তো মোবাইল নেই। যেখানেই থাকুক, আববু নিশ্চয়ই নেমে পড়বে। আমাদের খুঁজে না পেলে অন্য কারো নম্বর থেকে নিশ্চয়ই তোমার নম্বরে ফোন দেবে।’

ব্যাগ আর মেয়েকে নিয়ে নেমে পড়ল সায়িকা। পস্ন্যাটফর্মে তেমন লোকজন নেই। ট্রেন থেকে যারা নেমেছে তারা গন্তব্যে ছুটছে। আছে কয়েকটা কুকুর, কয়েকজন ভবঘুরে আর একজন টিকিট চেকার। এক হাতে মেয়েকে এবং অন্য হাতে ব্যাগটা ধরে দাঁড়িয়ে থাকে সায়িকা। ডানে-বাঁয়ে তাকায়। সাজু নিশ্চয়ই নামবে। নেমেই তাদের খুঁজবে। আসুক, আচ্ছামতো একটা বকা না দিয়ে ছাড়বে না। এটা কোন ধরনের দায়িত্বজ্ঞানহীনতা?

কিন্তু না, সাজু এলো না। দীর্ঘ হুইসেল বাজিয়ে ছেড়ে দিলো ট্রেন। আবারো কেঁদে উঠল সায়িকা। মিশুও কাঁদতে শুরু করল এবার। ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে মোবাইলটা বের করে হাতে নিল সায়িকা। নিশ্চয়ই সাজু ফোন দেবে। প্রায় পাঁচ মিনিট কেটে গেল, অথচ কোনো ফোন এলো না। সায়িকার মাথায় নানা দুশ্চিন্তা ঘুরপাক খেতে লাগল। কী হলো সাজুর? সে কি সিগারেট খেতে দরজায় গিয়েছিল? খাওয়ার সময় ট্রেন থেকে পড়ে গেল না তো? কেউ ধাক্কা মেরে ফেলে দিলো না তো? নাকি ট্রেনে সিগারেট খাওয়ার অপরাধে পুলিশ গ্রেফতার করল? না না, তা হবে কেন? দরজায়, বাথরুমে কত যাত্রীই তো সিগারেট খায়। নাকি কেউ অপহরণ করল? ইদানীং তো অপহরণের ঘটনা অহরহ ঘটছে। বিনা ওয়ারেন্টে পুলিশ ধরে নিয়ে যাচ্ছে, ডিবি পরিচয়ে সন্ত্রাসীরা ধরে নিয়ে যাচ্ছে। নাকি কোনো ছিনতাইকারীর কবলে পড়ল?

কী করে সায়িকা? পস্ন্যাটফর্মে তো বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকা যাবে না। ঢাকা শহরের পস্ন্যাটফর্ম মানে চোর-বাটপার আর ছিনতাইকারীদের আখড়া। এখন নেই, আসতে কতক্ষণ? অগত্যা ট্রলিব্যাগটা টানতে টানতে সে বেরিয়ে বাইরের রাস্তায় দাঁড়াল। মিনিট দশেক দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করল। রাত সোয়া নয়টা। ট্রেন থেকে নেমেছে আধা ঘণ্টা হয়ে গেছে। আর কতক্ষণ অপেক্ষা করবে? মিশু বলল, ‘কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবে মা? দাঁড়িয়ে থেকে তো লাভ নেই। আমাদের খুঁজে না পেয়ে আববু নিশ্চয়ই বাসায় চলে যাবে।’

মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে আবার কেঁদে উঠল সায়িকা। মেয়েকে জড়িয়ে ধরল বুকে। তারপর একটা অটোরিকশা ঠিক করে রওনা হয়ে গেল বাসার উদ্দেশে।

সায়িকা চলে যাক। মিশুও যাক। কারণ তারা এই গল্পের চরিত্র নয়। গল্পের চরিত্র সাজিদ হোসেন সাজু, যে এখন কমলাপুর স্টেশনে থেমে থাকা ৮৩০৫ নম্বর বগির বাথরুমে বন্দি। বের হওয়ার জন্য সারাটা পথ সে বাথরুমের দরজা টানাটানি করেছে, দুহাতে ধাক্কা দিয়েছে, জোরে জোরে শব্দ করেছে, গলা ফাটিয়ে চিৎকার করেছে, অথচ কেউ শুনতে পায়নি। ট্রেন তেজগাঁও স্টেশনে থামার পর সে ভেবেছিল কেউ না কেউ তার ডাক শুনতে পাবে, অথচ পায়নি। কী করে পাবে? বাথরুমটা তো বগির ডানপাশের দরজার কাছে। পস্ন্যাটফর্ম বাঁয়ের দরজায় বলে যাত্রীদের কেউ তো ডানের দরজা দিয়ে নামেনি। তবু সে আশায় থেকেছে, নিশ্চয়ই কেউ না কেউ প্রাকৃতিক ডাকে বাথরুমে আসবে। কমলাপুর পৌঁছে গেল ট্রেন, অথচ কেউ গেল না।

কমলাপুর স্টেশনে ট্রেন থামার পর সে আবার চিৎকার শুরু করল, আবার দরজা ধাক্কাতে লাগল, অথচ কেউ শুনতে পেল না। অবশ্য শুনতে পাওয়ার কথাও নয়। বাথরুমটা যেন আস্ত একটা কবর। গোটা বাথরুমে মোটে দুটি ফুটো। একটা ওপরে ছোট্ট ভেন্টিলেটরের, দ্বিতীয়টা নিচে কমোডের। ভেন্টিলেটরের ওপর এক টুকরো কাচ। সাধারণত খোলা থাকে, অথচ এখন বন্ধ। বিপদ এলে এভাবেই বুঝি চারদিক থেকে আসে। কাচটা সরিয়ে মাথাটা গলিয়ে চিৎকার করলে কেউ না কেউ শুনতে পেত। কিন্তু কোথাও দাঁড়িয়ে বা কিছু একটা ধরে মাথাটা যে ওই পর্যন্ত নেবে, তার কোনো উপায় নেই। বাথরুমে বেসিনও নেই। থাকলে বেসিনে ভর দিয়ে ওঠা যেত।

প্রায় আধা ঘণ্টা পর খটখট আওয়াজ শুনতে পেল সাজু। কেউ যেন হাতুড়ি দিয়ে লোহা পেটাচ্ছে। বগি থেকে বগি আলাদা করার সময় যেরকম শব্দ হয় ঠিক সেরকম। সাজু আবার চিৎকার করল, আবার দরজা ধাক্কাতে লাগল। দরজাটা এমনই শক্ত, ধাক্কালেও সহজে শব্দ হয় না। জোরসে লাথি মারল কয়েকবার। না, বাইরে কারো কোনো সাড়াশব্দ পেল না। সে লাথি মারতে থাকে। মারতে মারতে পায়ে ব্যথা ধরে যায়, চিৎকার করতে করতে গলাটা শুকিয়ে যায়। চিৎকার করার মতো বা লাথি মারার মতো যখন আর শক্তি রইল না, তখন সে কমোডের পাশে অপরিসর জায়গাটুকুতে বসে পড়ল। মাথায় হাত দিয়ে কাঁদতে লাগল। মনে পড়ে গেল ছুটির ঘণ্টা সিনেমার কথা। প্রায় দশ বছর আগে দেখা। ঈদের ছুটি ঘোষণার দিন স্কুলের বাথরুমে সবার অজান্তে তালা বন্ধ হয়ে আটকে পড়ে বারো বছর বয়সী এক ছাত্র। সেই বন্ধ বাথরুমে দীর্ঘ দশদিন অমানবিক কষ্ট সহ্য করার পর নিষ্পাপ শিশুটি ঢলে পড়ে মৃত্যুর কোলে। তার দশাও কি সেই ছাত্রের মতো হবে? হৃদকম্প দ্বিগুণ বেড়ে গেল তার। পাল্লা দিয়ে ঝরতে লাগল ঘাম।

হঠাৎ বগিটা নড়ে উঠল। পেছনের দিকে চলল খানিক। তারপর আবার থামল। সাজু ভাবল, ট্রেন নিশ্চয়ই আবার চট্টগ্রামের উদ্দেশে যাত্রা করবে, তাই ইঞ্জিন ঘুরিয়ে বগির সামনে লাগানো হয়েছে। সে স্বস্তি পেল। খানিক পরেই যাত্রীরা উঠতে শুরু করবে। নিশ্চয়ই কেউ না কেউ বাথরুমে আসবে। না এলেও বাথরুমের সামনে তো অন্তত দাঁড়াবে। তখন নিশ্চয়ই কেউ না কেউ তার ডাক শুনতে পাবে।

বগিটা এবার সামনের দিকে চলতে শুরু করল। সাজু ভাবল, ট্রেন কি চট্টগ্রামের উদ্দেশে ছেড়ে দিলো? কিন্তু কই, বাইরে তো যাত্রীদের সাড়াশব্দ পাওয়া যাচ্ছে না! বগিতে নিশ্চয়ই যাত্রীরা আছে। বাথরুমের দরজার কোথাও কোনো ফাঁক নেই বলে তাদের কথাবার্তা শোনা যাচ্ছে না।

কয়েক মিনিট চলার পর বগিটা আবার থামল। এবার চলতে শুরু করল পেছনের দিকে। এবার ভীত হয়ে পড়ল সাজু। তবে কি ট্রেন চট্টগ্রাম যাচ্ছে না! শরীরে তার কাঁপুনি ধরে গেল। পরক্ষণে মনে হলো, ট্রেন হয়তো পস্ন্যাটফর্ম পরিবর্তন করছে। তিন নম্বর থেকে চার নম্বরে যাচ্ছে, কিংবা চার নম্বর থেকে পাঁচ নম্বরে। কিন্তু এমন তো হওয়ার কথা নয়। ট্রেন তো যে-পস্ন্যাটফর্মে থামে সেই পস্ন্যাটফর্ম থেকেই ছাড়ে। কে জানে, হয়তো কোনো সমস্যা হয়েছে, তাই পস্ন্যাটফর্ম পরিবর্তন করতে হচ্ছে। সাজু অপেক্ষা করতে লাগল। তার ভাবনাতেও এলো না ৮৩০৫ নম্বর বগিসহ অতিব্যবহারে জীর্ণ আরো দুটি বগিকে যে মেরামতের জন্য পস্ন্যাটফর্মের পূর্ব দিকের অব্যবহৃত লাইনে সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে।

ধীরে ধীরে চলতে চলতে বগিটা থামল। অপেক্ষা করতে লাগল সাজু। খানিক পর নিশ্চয়ই যাত্রীরা উঠতে শুরু করবে। বড়জোর এক ঘণ্টার মধ্যে ট্রেন চট্টগ্রামের উদ্দেশে যাত্রা করবে। মুক্তির আর বেশি দেরি নেই। সে ঘড়ি দেখল। গাঢ় অন্ধকারে ঘড়ির কাঁটাগুলো জ্বলজ্বল করছে। বড় শখের ঘড়ি। টাইটান কোম্পানির। পাঁচ হাজার টাকায় কিনেছিল বছর দেড়েক আগে। সময় এখন দশটা বেজে তেত্রিশ মিনিট।

সাজু অপেক্ষা করতে থাকে। এক ঘণ্টা কেটে গেল, কারো সাড়াশব্দ পেল না। দুই ঘণ্টা কেটে গেল, ট্রেন ছাড়ল না। তিন ঘণ্টা কেটে গেল, তবু ছাড়ল না। সাজু ভাবল, তবে কি এই ট্রেন ভোরে ছাড়বে? ঘড়িতে তখন রাত একটা বেজে পঞ্চাশ মিনিট। ঢাকা থেকে তূর্ণা এক্সপ্রেস তো রাত সাড়ে এগারোটায় ছাড়ে। তারপর তার জানামতে রাতে আর চট্টগ্রামগামী কোনো ট্রেন নেই। সকাল পৌনে আটটায় ছাড়ে মহানগর প্রভাতী। সে ভাবল, নিশ্চয়ই এ-ট্রেনটাই মহানগর প্রভাতী হয়ে চট্টগ্রাম যাবে। তবে কি ভোর পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে? চিৎকার করতে করতে, দরজায় ধাক্কা ও লাথি মারতে মারতে এবং খিদায় সে নিদারুণ ক্লান্ত। প্যাকেটে থাকা বারোটি সিগারেটের একটি ধরাল। সকালের আগে মুক্তির কোনো আশা নেই। আশায় থেকে জেগে থাকার কোনো মানে নেই। ঘুমিয়ে নেওয়াটাই উত্তম। কমোডের পাশে ছোট্ট জায়গাটা ততক্ষণে শুকিয়ে গেছে। সেখানে বসে পড়ল সে। হেলান দিলো। সিগারেটটা শেষ করে কমোডের ফুটোয় গোড়ালিটা ফেলে দিয়ে চোখ বুজল।

কিন্তু বাথরুমে কি কেউ ঘুমাতে পারে? তাও কিনা ট্রেনের বাথরুমে? ঘুম কি সহজে আসে? না, ঘুম আসে না কিছুতেই। একবার চোখ বন্ধ করে তো আবার খোলে। গভীর অন্ধকারে সে নিজেকেও ঠাওর করতে পারে না। যেন সে একটা কবরে শুয়ে। কবরে কোনো ফুটো থাকে না, এখানে আছে, কবরে নিশ্বাস নেওয়া যায় না, এখানে নেওয়া যাচ্ছে – পার্থক্য শুধু এটুকু। নানা দুশ্চিন্তা তার মাথায় ঘুরপাক খেতে থাকে। মনের আয়নায় সায়িকার মুখটা ভেসে ওঠে। সায়িকা নিশ্চয়ই কেঁদে কেঁদে বুক ভাসাচ্ছে। এই শহরে তার কোনো নিকটাত্মীয় নেই। সাজুরও নেই। দূরাত্মীয় যারা আছে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ নেই। এই বিপদে সায়িকা কার সাহায্য চাইবে? চাইতে পারে সাজুর বন্ধু-বান্ধবদের, কিংবা অফিসের কলিগদের। যাদের নম্বর সায়িকার মোবাইল সেটে সেভ করা আছে, এতক্ষণে নিশ্চয়ই সে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে। তার কোনো বন্ধু হয়তো সায়িকাকে নিয়ে থানায় গিয়ে পুলিশে খবর দিয়েছে। পুলিশ এতক্ষণে হয়তো সাজুকে খুঁজতে শুরু করেছে; কিন্তু মনে হয় না ঘটনাটা পুলিশ আমলে নিয়েছে। নড়ত, সাজু যদি বিখ্যাত কোনো ব্যক্তি হতো। সে সাধারণ এক ব্যাংক কর্মকর্তা, তার জন্য কি পুলিশ এত রাতে এতটা তৎপর হবে?

মিশুর কথা মনে করে সাজুর কান্না পেল। মেয়েটাকে সে বড্ড ভালোবাসে। পড়ালেখার জন্য সায়িকা কত বকাবকি করে, কত মারধর করে, সাজু কিচ্ছুটি বলে না। মেয়েকে কখনো রাগ দেখাতে পারে না। কখনো দেখালে মন খারাপ করে যখন কাঁদে, মুখের দিকে তাকিয়ে তখন তার মৃত বাবার কথা মনে পড়ে যায়। কান্নারত মেয়ের মুখে ভেসে ওঠে মৃত বাবার মুখ। বাবার জন্য সাজুর বুকটা তখন হু-হু করে ওঠে। তখন তারও কান্না পায়। সাজু ভাবে, এই যে মানবহৃদয়ের গোপন গভীর অনুভূতি, এই অনুভূতির কথা কাউকে বলা যায় না, কাউকে বোঝানো যায় না।

নানা চিন্তা ও দুশ্চিন্তার স্রোতে ঘুরপাক খেতে খেতে সাজুর চোখে ঘুম নামল। রাত সাড়ে তিনটার দিকে কিসের শব্দে ঘুমটা ভেঙে গেল। সে চিৎকার করল, ‘বাইরে কেউ আছেন?’ কারো সাড়া পেল না। সে আবার চোখ বুজল। আবার ঘুমিয়ে পড়ল। স্বপ্নে দেখা দিলো মিশু। দেখতে রকেটের মতো একটা বাহনে চড়ে বসেছে মিশু। সঙ্গে সাজুও। একটা টাওয়ার বেয়ে রকেটটা ওপরের দিকে উঠতে থাকে সর্বোচ্চ গতিতে। উঠতে উঠতে দূর আকাশে বিশাল একটা পস্ন্যাটফর্মে পৌঁছে। মিশু রকেটটা থামাতে চায়। কিন্তু পারে না। ব্রেক ফেইল করেছে। রকেটটা বিশাল একটা টাওয়ারের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে টাওয়ারটা ভেঙেচুরে গুঁড়িয়ে হাওয়ায় মিশে যায়। সাজু দাঁড়িয়ে থাকে পস্ন্যাটফর্মে। মিশুর রক্ত-মাংস-অস্থি গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে হাওয়ায় মিশে যায়। মেয়ের শোকে সে কাঁদতে শুরু করে। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদে। পেছনে দেখতে পায় সায়িকাকে। সায়িকা নির্বাক। শোকে পাথর হয়ে গেছে। কাঁদতে কাঁদতে সাজুর ঘুম ভেঙে গেল। টের পেল, চোখের জলে ভিজে গেছে তার গাল, গলা আর বুক। সে উঠে দাঁড়াল। ভেন্টিলেটরের কাচ ভেদ করে খানিকটা আলো ভেতরে ঢুকেছে। তার মানে ভোর হয়েছে। কান্না থামাতে পারে না সাজু। মেয়েটাকে দেখতে ইচ্ছে করে খুব। কোলে নিয়ে আদর করতে ইচ্ছে করে। জোর করে সাজু কান্না থামাল। চোখ মুছে চিৎকার করল, ‘বাইরে কেউ আছেন? কেউ শুনতে পাচ্ছেন? কেউ কি আছেন? আমি বাথরুমে আটকা পড়েছি। আমাকে উদ্ধার করুন পিস্নজ। কেউ আছেন? কেউ কি শুনতে পাচ্ছেন? ও ভাই …!’

না, কারো সাড়াশব্দ পেল না। খিদার জ্বালাটা উসকে উঠল। কলটা ছেড়ে দিয়ে পেট ভরে পানি খেল, চোখেমুখে পানি দিলো। জুতা জোড়া খুলে এক পাশে সরিয়ে রাখল। ঘড়ি দেখল। সাতটা বাজে। নিজেকে এই বলে সান্তবনা দিলো, আর মাত্র বড়জোর আধা ঘণ্টা। তারপর যাত্রীরা উঠতে শুরু করবে। মুক্তির আর দেরি নেই।আটটা বেজে যায়, যাত্রীরা ওঠে না। দশটা বেজে যায়, ট্রেন ছাড়ে না। দুপুর বারোটা বেজে যায়, বগিটা একটুও নড়ে না। তবে কি ট্রেনটা মহানগর গোধূলি হয়ে চট্টগ্রাম যাবে? হতে পারে। পৌনে তিনটায় ঢাকা থেকে যাত্রা করে মহানগর গোধূলি। সাজু অপেক্ষা করতে থাকে।

আড়াইটা বেজে যায়, কোনো যাত্রী ওঠে না। তিনটা বেজে যায়, ট্রেনটা ছাড়ে না। তবে কি রাত এগারোটায় তূর্ণা হয়ে যাবে ট্রেনটা? হতে পারে। সাজু অপেক্ষা করতে থাকে। ক্ষুধার কথা ভুলে যায়। এখন আর ক্ষুধা নেই। একটা নির্দিষ্ট সময়ে শরীর খাবার চায়। খাবার না পেলে সে বিদ্রোহ করে। ক্লান্ত হয়। তবু খাবার না পেলে সে নিজের শক্তির ওপর নির্ভর করে। টিকে থাকে দুদিন, তিনদিন, পাঁচদিন, এমনকি এক সপ্তাহ। তারপরও খাবার না পেলে সে আত্মা থেকে নিজেকে বিযুক্ত করে নেয়।

সাজু ঘড়ি দেখল। রাত আটটা বেজে তেত্রিশ মিনিট। বাইরে কারো গলার আওয়াজ শুনতে পেয়ে হাঁক দিলো, ‘বাইরে কেউ আছেন? হ্যালো ভাই, শুনতে পাচ্ছেন? আমি আটকা পড়েছি।’

না, কারো সাড়া নেই।

প্রায় দশ মিনিট পর, পনেরো মিনিটও হতে পারে, স্টেশনের এক যুবতী বেশ্যা, ভদ্রজনেরা যাকে বলে যৌনকর্মী, ডানের দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকল। পেছনে যুবক খদ্দের। যুবতীর নাম হতে পারে জুলেখা, চামেলি, বীথি, নার্গিস, ফুলি, চম্পা, জবা। বেশ্যাদের নাম এমনই হয়ে থাকে। প্রকৃত নাম গোপন করে তারা একটা ছদ্মনাম নেয়। ধরা যাক যুবতীর নাম জবা। আর যুবক খদ্দেরের নাম হতে পারে খায়ের, জাকের, মালেক, দুলাল, ছলিম, কলিম, কামাল, জামাল। ঢাকা শহরে শ্রমজীবীদের নাম এমনই হয়ে থাকে। যুবক নিশ্চয়ই শ্রমজীবী। নইলে লুঙ্গি পরে রাতের বেলায় জবার সঙ্গী হতো না। ধরা যাক যুবকের নাম জামাল।

দরজার পাশে ছোট্ট জায়গাটুকুতে শুয়ে পড়ল জবা। তার সালোয়ারের ফিতেটি ত্রস্ত হাতে খুলতে শুরু করল জামাল। এক টানে সালোয়ারটা খুলে এক পাশে সরিয়ে রাখল। ট্যালকম পাউডারের গন্ধ ঝাপটা দিলো তার নাকে। জামালের হাতদুটো চলে গেল জবার নরম বুকে। দু-হাতে বস্নাউজের হুকগুলো খুলতে শুরু করল। খুলে দুই স্তনের ফাঁকে মুখটা ডুবিয়ে দিলো।

হঠাৎ কান খাড়া করল জবা। যেন দূরাগত কোনো শব্দ ভেসে আসছে তার কানে। সেদিকে জামালের খেয়াল নেই। তার সর্বাঙ্গে আদিম উল্লাস। জবা বলল, ‘এই ব্যাডা, কিছু শুনতে পাচ্ছিস?’

জামাল নিরুত্তর।

জবাবে আবার বলল, ‘একটু দাঁড়া, আমারে একটু উঠবার দে।’

জামাল তার কথার পাত্তা দিলো না। তার নাঙলটি জবার সুড়ঙ্গে প্রবিষ্ট করার জন্য সে তাড়াহুড়ো করতে লাগল।

আরে দাঁড়া না ব্যাডা!

জবার হাতদুটো দুহাতে ঠেসে ধরল জামাল।

জবা বলল, ‘শুনতে পাচ্ছিস না কিছু? বাথরুমের ভিতরে কে যেন কানতে আছে। শুনতে পাচ্ছিস?’

জামাল তবু পাত্তা দিলো না। কারণ বেশ্যাদের ছলনা তার জানা। নানা অছিলায় ফসকে যেতে চায়। ফিসফিস করে বলল, ‘তোর চাতুরীতে কাজ হইবে না মাগি। চুপ কইরা হুইয়া থাক।’

জবা চুপ করে থাকে। খাড়া করে রাখে দুই কান।

জামাল যখন তার নাঙলটি জবার সুড়ঙ্গে প্রবিষ্ট করল, জবা হঠাৎ ‘খাড়াইতে কইছি না খানকির বেটা’ বলে দুহাতে জোরসে তাকে ধাক্কা মারল। জামাল ছিটকে পড়ল বগির নিচে, শক্ত পাথরের ওপর, অথবা ইস্পাতের লাইনের ওপর। আর্তনাদ করে উঠল সে। আদিম মানবের মতো উলঙ্গ জবা ত্রস্ত হাতে বাথরুমের লকটা ঘুরিয়ে দরজায় ঠেলা মারল। খুলে গেল দরজাটা।

ল্যাম্পপোস্টের আলো জবার মুখের ওপর। সালোয়ারটা পড়ে আছে একপাশে। হাতদুটো জোর করে উচ্চৈঃস্বরে কেঁদে উঠে জবার পায়ে লুটিয়ে পড়ল সাজু। দুই ফোঁটা অশ্রম্ন গড়িয়ে পড়ল জবার পায়ের মেহেদি-রাঙানো পাতায়। হাঁ মুখে খোলা বাথরুমটার দিকে তাকিয়ে থাকে জবা। আর বাইরে দরজার ডান্ডা ধরে জামাল তাকিয়ে থাকে লুটিয়ে পড়া সাজুর দিকে।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত