কালা চাঁদপুরের গলির ভিতর এরকম বাসা থাকার কথা নয়; কিন্তু আছে। ২০-৩০ বছরে ঢাকা শহরের ধনী মানুষেরা মনে হয় গরিব হয়ে গেছে, বাড়ির বদলে ফ্ল্যাটে বা অ্যাপার্টমেন্টে থাকছে। কিন্তু কালাচাঁদপুর যা কিনা সদ্য গ্রাম থেকে শহর হতে শুরু করেছে, ইতস্তত ক’রে সবে উঠতে শুরু করেছে একটা-দুটা সাত-আট তলা অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিং, সেখানে আস্ত একটা তিনতলা বাড়িই আছে। ভেতরে না গেলে আন্দাজও করা যাবে না তিনতলা বাড়িটায় ওপরে ওঠার লিফটও আছে।
দু’-দুটো মার্সেইডিস গাড়ি ছিল কয়েক বছর আগে। তারপর হঠাৎ মরে গেলেন চৌধুরী আশফাক হোসেন। গাড়ি দুটো বিক্রি করে দিলেন মিসেস চৌধুরী। পাঁচ-ছ’বছর আগের কথা।
বাড়িটার নাম ‘আশ্রয়’। উল্টো দিকের সরকারি প্রাইমারি স্কুলটা দু’দিন যাবৎ বন্ধ। বৃষ্টিতে এলাকাটা অনেকখানি ডুবে গেছে। আজো সারাদিন অঝোর বৃষ্টি হয়ে এখন একটু ধরা। পানিতে ছপ ছপ শব্দ তুলে কেউ কেউ যাতায়াত করছে। আশ্রয়-এর তিন তলাটা অন্ধকার। সাইফুল এখনো ফেরেনি। বাড়ির মালিক নুসরাৎজাহান চৌধুরী একটু আগে দারোয়ানকে ইন্টারকমে জিজ্ঞেস ক’রে নিশ্চিত হয়েছেন। সাড়ে দশটা বেজে গেছে। এগারোটায় নিয়ম ক’রে ঘুমাতে যান তিনি। এর মধ্যে সাইফুলের চলে আসা উচিত।
সাইফুল খুব দূরে তা’ নয়। বড় রাস্তাটা এখান থেকে এক কিলোমিটারের মতো। সে বসে আছে পিজারিয়ায়। খাওয়া শেষ। ইতালিতে টাকা কামিয়ে ফেরত আসা এক যুবক দোকানটি চালায়। তার পিৎজা ও পাস্তা সুস্বাদু। শ্রাবণ মাসের ঘোর বৃষ্টির তোপে রাস্তাঘাট ফাঁকা হয়ে গেছে, অধিকাংশ দোকানের শাটার সাতটার মধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে, রাস্তায় বাস কম। দুর্যোগের মধ্যেও পিজারিয়া তার আলোঝলমল অস্তিত্ব জাহির ক’রে চলেছে।
দূর থেকে পিজারিয়ার সাইনবোর্ড চোখে পড়তেই সাইফুলের পেটে ক্ষুধা জেগে উঠলো। তার প্ল্যান ছিল বাসায় ফিরে রাইস কুকারে খিচুড়ি বসিয়ে দেয়া। দু’বছর যাবৎ সে জীবনটাকে সরল করার নানা চেষ্টা করছে। তার একটি হলো প্রতি রাতেই ডিম ভাজা দিয়ে খিচুড়ি খাওয়া। এটা না একঘেয়ে, না ক্লান্তিকর। পৃথিবীর সব মানুষের উচিত খাওয়াদাওয়ার পেছনে যথসম্ভব কম সময় ব্যয় করা। সরকারের উচিত বাড়ি বাড়ি রান্নার ব্যবস্থা তুলে দিয়ে সরকারি খাদ্যালয়ের ব্যবস্থা করা। একেক দিন একেক মেন্যু হবে। রবিবার মুরগি সব্জি ডাল; সোমবার ডিম-আলুর ঝোল সব্জি ডাল; মঙ্গলবার মাছের ঝোল সব্জি ডাল ইত্যাদি। সব্জি আর ডাল প্রতিদিন থাকবে। রাতের বেলা দুই আইটেম: ভুনা খিচুড়ি আর ডিম ভাজা।
ট্যাক্সি থামিয়ে ভাড়া চুকিয়ে পিজারিয়ায় ঢুকতে ঢুকতে বৃষ্টিতে মাথাটা ভিজে গেল। এই শ্রাবণের ভরা বৃষ্টির রাতেও পিজারিয়া মানুষের ভিড়ে সরগরম। সাইফুল একা থাকার মানুষ। কিন্তু মানুষের ভিড়, হট্টগোল আর আলো তার পছন্দ। এ সবে মনে হয়, পৃথিবীটা মরে যায় নি। কাচের দেয়াল ভেদ ক’রে রাস্তা দেখা যায় এ রকম একটা টেবিলে বসতে বসতেই সদ্য ওভেন থেকে বের করা পিৎসার আধগলা চিজ-এ ডুবে থাকা ভাপানো ক্যাপসিকাম আর মোটা ক’রে কাটা পেঁয়াজের সম্মিলিত গন্ধ ফুড়ূত ক’রে নাকে ঢুকে গেল। এ গন্ধেই সে মেন্যু ঠিক ক’রে ফেললো। কাল রবিবার, তার অফ ডে। আজ একসেপশনাল নাইট। এ রকম রাতে রুটিনের ব্যত্যয় ঘটানো যায়।
পিৎজার পর কাপুচিনো নিল সাইফুল। একটা মাইক্রোবাস থেকে নেমে ঢুকলো এক দঙ্গল তরুণ-তরুণী। আবার খানিক পর দরজা ঠেলে ঢুকলেন রেইনকোট পরা দীর্ঘদেহী জাহাঙ্গীর সাদাত। বিশিষ্ট শল্য চিকিৎসক। সম্ভবত হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফেরার পথে হঠাৎই নেমে পড়েছেন। জনশ্রুতি, তার দিনকার রোজগার দুই লাখ টাকার বেশি। মধ্যবিত্তের এই এক স্বভাব। রাস্তায় দাঁড়িয়ে চার তলার দিকে তাকিয়ে থাকা। জাহাঙ্গীর সাদাতের দৈনিক আয় কত, এটা নিয়ে পত্রিকায় রিপোর্টও হয়েছিল।
দোতলায় টেবিল নিয়ে খাচ্ছিল প্রিয়াংকা। খাওয়া শেষে নিচে নেমে আসতেই তার চোখে পড়লো সাইফুল ইসলাম বসে আছে এক কোণে। সে প্রায় উড়ে সাইফুলের টেবিলে এসে পড়লো।
‘আপনি? একা বসে আছেন? খেয়েছেন?’
উত্তরে একটু হাসলো সাইফুল। শিল্পকলা একাডেমিতে মাস তিনেক আগে প্রিয়াংকা তার জীবনের প্রথম সোলো পেইন্টিং এগজিবিশন করেছে। একটা লম্বা রিভিউ লিখেছিল সাইফুল। সেই থেকে শ্যামাঙ্গিনী বালিকাটি তার বিশেষ ভক্ত। মাঝে মধ্যে ফোন ক’রে খবর নেয়।
প্রিয়াংকা দীর্ঘাঙ্গিনী। শাড়িতে বেশ মানায়। সে শ্যামলা; উজ্জ্বল শ্যামলা বলা যাবে না। চোখগুলো বড়, হাসলে দু’গালে হালকা টোল পড়ে। শ্যামলা মেয়েদের চেহারা ভাল হওয়া দরকার। কিন্তু প্রিয়াংকার ক্ষেত্রে এই নিয়ম রক্ষা হয় নি। শেষ বিচারে সে সুদর্শনা নয়। তবু চলে যায়। একটা আলগা মায়া মায়া ভাব আছে। সে শুদ্ধ ইরেজিতে নিচুস্বরে কথা বলতে পারে; আদবকায়দা, হাই-হ্যালো ঠিক্ঠাক্ জানে। বিভিন্ন দূতাবাসের অনুষ্ঠানের ইনভাইটেশান কার্ডগুলো তার ঠিকানায় সময়মতো পৌঁছে যায়।
আর্জেন্টিনার সদ্য প্রতিষ্ঠিত দূতাবাসে তার একটি পেইন্টিং ঝোলানো হয়েছে ভিজটরস রুমে। ছবির নাম ‘মা ও শিশু’। বড় একটি বৃত্ত দিয়ে মা এবং ছোট একটি বৃত্ত দিয়ে শিশু বোঝানো হয়েছে। প্রিয়াংকার মতে, এক একটি মানুষ এক একটি বৃত্ত। এই পৃথিবীটা বৃত্তের শহর। পৃথিবী নিজেও গোলগাল। সূর্য গোল, চন্দ্র গোল, তাদের ঘূর্ণনের পথও গোলাকৃতি। আকাশের এই বৃত্তময়তা সে মাটির মানুষকে বৃত্তের শেপ দিয়ে উপস্থাপন করেছে। সাইফুল ইসলাম লিখেছিল, ‘প্রতীকায়ন নবীন শিল্পী প্রিয়াংকা মহলানবীশের প্রিয় কৌশল। তার চিত্রকলা কল্পনার সহযোগে ঋদ্ধ। তার এ প্রদর্শনী অত্যন্ত প্রতিশ্রুতিময়।’
মোবাইল ফোনের হোয়াটস্অ্যাপে মেসেজ আসার শব্দ হলো। রাত সাড়ে দশটা। এতো রাতে কে মেসেজ পাঠাবে?
কানাডার নম্বর।
‘সাড়ে দশটা বেজে গেছে। বাসায় ফিরে যাওয়া উচিত। আম্মা এগারোটার মধ্যে ঘুমিয়ে পড়েন।’
লতা’র মেসেজ!
লতার এ নম্বরটা সাইফুলের জানা নেই। কিন্তু লতা ঠিকই সাইফুলের নম্বর সংগ্রহ ক’রে রেখেছে।
একটা কৌতুকের আভা খেলে গেল সাইফুলের মুখাবয়বে। সে লিখলো, ‘আজ রাতে বাসায় ফেরার কোনো আকর্ষণ বোধ হচ্ছে না।’
‘আম্মাকে জানিয়ে দিলেই সমস্যা চুকে যায়।’
সাইফুল লিখলো, ‘তুমি ফোন ক’রে বলে দাও না।’
‘দয়া ক’রে আম্মাকে এখুনি জানাও যে রাতে ফিরছো না। তিনি উদ্বেগে ভুগছেন। তাঁর বয়স ৭৮। ব্লাডপ্রেশার বাড়ানো সমীচীন হবে না।’
সাইফুল লিখলো, ‘আমি ফোন করলে তিনি দশটা প্রশ্ন করবেন, সব প্রশ্নের জবাব দেয়া সম্ভব না। আর আমি মিথ্যাও ভাল বলতে পারি না।’
‘তুমি ভাল ক’রেই বোঝো আমার পক্ষে তোমাকে নিয়ে কিছু বলা সম্ভব না।’
সাইফুল লিখলো, ‘এ কথা ঠিক। আম্মা বুঝে যাবেন তোমার কাছে আমার নতুন নম্বরটাও আছে। এবং তুমি যোগাযোগও করো।’
হোয়াটস্অ্যাপ চুপ হয়ে গেল। আর কোনো মেসেজ এলো না।
সাইফুল উঠে দাঁড়ালো :’প্রিয়াংকা আমি এখন বাড়ি ফিরবো। এগারোটা প্রায় বাজে।’
‘অনেক রাত হয়ে গেল। আমার তো সেই উত্তরা যেতে হবে। কী ক’রে যে যাবো!’
সাইফুল বললো, ‘আমার সঙ্গে আসতে পারো। বাসা কাছেই।’
প্রিয়াংকার চোখ মুখ উজ্জল হয়ে উঠলো :’ভাবি বাসায় নেই?’
ঘাড় নাড়লো সাইফুল।
‘চলুন তাহলে।’
তিনতলায় উঠে মিসেস চৌধুরীকে ফোন করলো সাইফুল :’আম্মা, ফিরতে দেরি হয়ে গেল। সরি।’
‘ঠিক আছে। মন্টুুকে বলছি খাবার নিয়ে যাবে।’
‘একটা সমস্যা হয়েছে, আম্মা।’
‘বল।’
‘আমার পরিচিত একটি মেয়ে বৃষ্টিতে আটকা পড়েছিল রেস্টুরেন্টে। ওকে নিয়ে এসেছি। ওর বাসা উত্তরা। এতো রাতে যাওয়ার কোনো উপায় ছিল না। দোতলায় গেস্ট রুমে থাকার ব্যবস্থা করবো?’
‘মন্টুকে পাঠিয়ে দিচ্ছি।’
‘আম্মা, আপনি যদি ওর মাকে একটা ফোন ক’রে দেন তো তিনি নিশ্চিন্ত হবেন।’
‘এই মেয়ে কি তোমার ঘনিষ্ঠ?’
‘জি না। সামান্যই পরিচিত। আর্টিস্ট। ছবি আঁকে। রেস্টুরেন্টে বসে ছিলাম, হঠাৎ দেখা। অনেক রাত। রাস্তায় পানি আর পানি। বাস-ট্যাক্সি গায়েব হয়ে গেছে। নেহায়েতই মানবিক সাহায্য।’
২.
সকাল ছ’টার মধ্যে না-উঠলে আটটার মধ্যে অফিসে পৌঁছানো যায় না। কিন্তু আজ শনিবার। ঘুম ভেঙে গেলেও বিছানায় লেপ্টে ছিল লতা। আজ গ্রোসারি করার দিন। মেয়েটাকে সুইমিং পুলে নিয়ে যেতে হবে লাঞ্চের পর; বিকেলে সিটি সেন্টারে। সেখানেই উইনডোশপিংয়ের পর কোনো রেস্টুরেন্টে ডিনার সেরে নেয়া হবে। পরিপাটি ছক। হঠাৎ ক’রে তারিখটা মনে পড়লো। বাইশে জুলাই। আট বছর আগে এ দিনে তারা কানাডার নাগরিক হিসাবে পাসপোর্ট পেয়েছিল। ওই দিনই রাতে ডিনারের পর সে সাইফুলকে বলেছিল, ‘আমি তোমার সঙ্গে আর থাকবো না।’
আট বছর পার হয়ে গেছে।
সুবর্ণলতা তখন চার মাসের গর্ভবতী।
সাইফুল অফিসে যায়-আসে। শুরু থেকেই অফিস পাঁচটায় শেষ হলে একটুও দেরি না-করে সাইফুল সোজা বাড়ি ফিরে আসে। এর মধ্যেই ছাত্রজীবনের বান্ধবী আইভির সঙ্গে দেখা হয়ে যায়। আইভি কানাডা এসেছে অনেক আগে। আসার কিছু দিন পরই বিবাহ বিচ্ছেদ। পরে কানাডার এক তরুণ ছেলের সঙ্গে দু’বছর লিভ টুগেদার। তারপর ছাড়াছাড়ি, চার বছর যাবৎ একাকী জীবন।
ভ্যাঙ্কুভারে সেটলড্ হতে ওদের খুব সাহায্য করলো আইভি। তারপর এক সন্ধ্যায় সাইফুলকে অফিস থেকে তুলে নিয়ে তিউনেসিয়ান রেস্টুরেন্ট লা সল আ মজেতে গেল আইভি। শাকশুকা’র পর কুস্কুস্ খেয়ে কফি খেতে নিজের ফ্ল্যাটে। জীবনে দ্বিতীয় নারীর আস্বাদ নিয়ে বাসায় ফিরলো সাইফুল ইসলাম রাত ন’টায়। বহুদিন পর পরিতৃপ্ত শরীর নিয়ে আইভি গাঢ় নিদ্রায় ঢলে পড়লো। তারপর যা হওয়ার তাই হলো। গোপনে সাক্ষাৎ ও শারীরিক মিলন সাপ্তাহিক রুটিনে পরিণত হলো।
এর মধ্যেই একদিন ঘর ভ্যাকুয়াম করতে করতে সুবর্ণলতা টের পেল, তার গর্ভধারণ হয়েছে। কাকতালীয়ভাবে সেদিনই ডাকে সে অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটারটা পেল। আইভিরই পরামর্শে সে রিয়েল এস্টেট কোম্পানি অ্যান্ড্রু হ্যাসম্যান অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস-এ অ্যাকাউন্ট্যান্ট পদে দরখাস্ত করেছিল। ইন্টারভিউ দিয়েছিল দু’বার, প্রথমবার ফোনে, দ্বিতীয়বার সামনাসামনি। অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটারটা ব্যাগে পুরে সে সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে পড়েছিল :হাসপাতালে গিয়েছিল প্রেগন্যান্সি টেস্টের জন্য। পজিটিভ। সাইফুলকে জানানোর কোনো তাগাদা বোধ করে নি সে।
পাসপোর্ট পাওয়ার দিনটা ছিল বহুকাঙ্ক্ষিত। কানাডার পাসপোর্ট হাতে পেয়ে অন্তর্গত তিক্ততা কিছুক্ষণের চাপা পড়েছিল। প্রবল আত্মবিশ্বাস যুক্ত হয়েছিল তার মনে। সাইফুলের সঙ্গে বসে একটা কফিশপে কাপুচিনো খেয়েছিল সুবর্ণলতা।
সুবর্ণলতা ঠিক করেছিল, সে কোনো নাটক করবে না। সে কেবল বলেছিল, ‘আমি তোমার সঙ্গে আর থাকবো না।’
‘মানে!
‘আমি চলে যাচ্ছি। ফ্ল্যাট নিয়েছি। বাচ্চা হলে হাসপাতাল থেকে খবর দেবো। মোবাইল নম্বর বদল করলে জানিয়ে রেখো।’
‘এসব কী বলছো! কী হয়েছে? কেন?’
‘গত মাসে টরন্টো থেকে ঘুরে আসার পরের শুক্রবার সন্ধ্যায় যখন আইভির বাসায় ঢুকলে তখন আমি রাস্তার উল্টো পাশে গাড়ি পার্ক ক’রে বসে ছিলাম। ঘণ্টাখানেক পরে যখন বের হলে তখনও আমি সেখানেই। আগেই সন্দেহ করেছিলাম। সেদিন নিশ্চিত হয়েছি। তুমি সরল মানুষ, তাই গোপন বিষয় গোপন রাখতে পারো নি।’ ম্লান হাসলো সুবর্ণলতা।
সুবর্ণলতা চলে গেল।
‘ভুল করছো’ ‘ভুল হচ্ছে’- দুর্বল গলায় এসব বলা ছাড়া আর কিছু করতে পারে নি সাইফুল। লতাকে আটকাবে, এরকম নৈতিক শক্তি সংগ্রহ ক’রে উঠতে পারলো না।
ট্যাক্সি এলে লতা বললো, ‘আমার শরীরটা ভাল যাচ্ছে না, স্যুটকেস দুটো তুলে দাও।’ মন্ত্রাহতের মতো দুটো বড় স্যুটকেস আর ব্যাগগুলো ট্যাক্সির বুটে তুলে দিয়েছিল সাইফুল ইসলাম। চীনা ভাষার মুভির মতো ঠিক কী ঘটছে তা যেন স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল না।
লতা সাইফুলের ফোন আর ধরে নি। তবে যথাসময়ে কন্যাপ্রসবের খবরটা দিয়েছিল। হাসপাতালে ছুটে গিয়েছিল সাইফুল। নিরুত্তাপ গলায় লতা বলেছিল, ‘ওর নাম রেখেছি রিক্তা। তোমার মতো চেহারা হয়েছে।’
সন্ধ্যা ছ’টায় ভিজিটিং আওয়ার শেষ হওয়ার সংকেত বেজে উঠলো দেয়ালে লাগানো স্পিকারে। লতা বললো, ‘তোমাকে এবার যেতে হবে। বারবার আসার দরকার নেই। আমি একাই রিক্তার যত্ন নিতে পারবো।’
একটু থেমে বললো, ‘আজকের দিনটা খুব আনন্দের হওয়ার কথা ছিল। আমার ভাগ্যে নেই।’
রিক্তাকে একা মানুষ করতে গিয়ে সুবর্ণলতাকে অনেক কষ্ট স্বীকার করতে হয়েছে। চাকুরি ছেড়ে দেয়ার সুযোগ ছিল না। বেবিসিটারের বেতন জোগাতে তাকে শনিবারেও কাজ করতে হয়েছে দু’বছর।
সে ডিভোর্সের নোটিশ পাঠাতে চেয়েছিল। ওর মা দেন নি :’যথেষ্ট করেছ তুমি। আর ঝামেলা বাড়িয়ো না।’
কলকাতার বেথুন কলেজে পড়েছিলেন মিসেস চৌধুরী। গ্র্যাজুয়েশনের পর জে পি মর্গানে তিন বছর কাজ করেছিলেন মাদ্রাজে। তিরিশ বছর জার্মানিতে থাকার সময় প্রায় কুড়ি বছর হাই স্কুলে ইংরেজি সাহিত্য পড়িয়েছেন। তাঁর কথার ওপর কথা চলে না।
রাত আসে একই সঙ্গে নৈঃশব্দ্য আর একাকিত্ব নিয়ে। নির্জনতা পছন্দ করে যে মানুষ, সন্ধ্যার পর থেকে সেও কেবল আশ্রয় খোঁজে তা নয়, কারো সান্নিধ্যের জন্য কাঙাল হয়ে ওঠে। এ সময়টা ভয়ংকর। মানবজীবনের অর্থহীনতা প্রকট হয়ে চিন্তার মধ্যে ঢুকে যায়। নানা প্ররোচনা দেয়। এক মুঠি ঘুমের বড়ি গলার ভেতর পাচার করে দিয়ে কেউ কেউ পৃথিবীর সঙ্গে লেনদেন চুকিয়ে ফেলতে চায়। সুবর্ণলতা ক্লান্তি বোধ করে। গভীর ক্লান্তি তাকে কখনো কখনো আচ্ছন্ন করে। ঢাকায় তখন সকাল। সে আম্মাকে ফোন করে। মৃদু অথচ দৃঢ় কণ্ঠস্বরে মিসেস চৌধুরী নানা কথার ফাঁকে নিজের কোনো একটা সমস্যার কথা তুলে আনেন। ফোন রাখার পর সে সমস্যার সম্ভাব্য সমাধান ভাবতে ভাবতে সুবর্ণলতা ঘুমে তলিয়ে যায়।
লতা চলে যাওয়ার বছরখানেক পর একরাতে সাইফুলের মনে হলো, কানাডায় থাকার কোনো মানে হয় না। চাকুরিতে ইস্তফা দিয়ে একদিন সন্ধ্যায় ক্যাথে প্যাসিফিকের ফ্লাইটে চড়ে বসলো সে, হংকং হয়ে ঢাকা ফেরার পথে। ‘অন্য আলো’ পত্রিকাটা সবে প্রকাশ হতে শুরু করেছে। ফিচার এডিটর হিসেবে জয়েন করলো সাইফুল।
ইতিমধ্যে সে মিসেস চৌধুরীর ফোন পেয়ে দেখা করতে গেছে। মিসেস চৌধুরী তাকে দলিল ক’রে ‘আশ্রয়’ লিখে দিয়েছেন। তাকে সে বাসাতেই থাকতে বলেছেন। কাঁঠালবাগনের গলি থেকে কালাচাঁদপুরের এই বস্তিবেষ্টিত ক্ষুদ্র প্রাসাদে আসতে সাইফুল ইসলামের আড়াই মাস লেগে গেল।
৩.
শনিবার সকালটা, অন্তত এগারোটা পর্যন্ত সুবর্ণলতা খুব উপভোগ করে। একেবারে দায়িত্ববিহীন একটা সময়। না থাকে কাজ, না থাকে তাড়া, না বাজে টেলিফোন। দেরি ক’রে ওঠা, চায়ের পরিবর্তে জ্যামাইকান কফি খাওয়া, ডাকবাক্সে রেখে যাওয়া অপ্রয়োজনীয় বিজ্ঞাপনগুলো পড়া, অনেক দিন যাবৎ পড়ে থাকা কাজগুলোর কথা ধীরে সুস্থে স্মরণ করা- এই সব শনিবার সকালের অবকাশটা জুড়ে থাকে।
নয়টা বেজে গেছে। ঢাকায় আম্মাকে ফোন করা দরকার। তা না হলে হয় তো সহসা ঘুমিয়ে পড়বেন। ফোনে নানা কথার মধ্যে মিসেস চৌধুরী জানালেন, তার ঘুমোতে দেরি হতে পারে, কারণ সাইফুল এখনো ফেরে নি।
মেজাজ খারাপ হলো লতার। যেটা করার নয় সেই কাজটা ক’রে বসলো। হোয়াটস্অ্যাপ-এ মেসেজ পাঠালো সাইফুলকে বাড়ি ফেরার তাগিদ দিয়ে। আম্মা যে কেন সাইফুলকে বাড়িটা লিখে দিলেন, এ নিয়ে লতার কৌতূহলের শেষ নেই। তার ওপর এখন সাইফুল সে বাসারই তিন তলার স্থায়ী বাসিন্দা। খুবই নাটকীয় এবং বিরক্তিকর ব্যাপার।
সাইফুল কি ফিরলো এর মধ্যে?
আবার ফোন করলো লতা :’আম্মা, ঘুমোতে যান নি?’
‘না। প্রিয়াংকার সাথে গল্প করছি।’
‘প্রিয়াংকা! কে প্রিয়াংকা?’
‘সাইফুলের পরিচিত। উত্তরায় মা’র সাথেই থাকে। এ রকম বৃষ্টি-বাদলায় কী ক’রে যাবে অত দূর এতো রাতে? এখানেই থাকবে রাতটা।’
‘আম্মা, বাসায় কী হচ্ছে এসব?’
রাগে গা জ্বলে গেল সুবর্ণলতার।
‘বাসায় কী হচ্ছে এসব?’
‘কী হচ্ছে?’- লতার ফোন পেয়ে সাইফুল হতবাক হলো।
‘আমি কিচ্ছু বুঝি না। তুমি ওই মেয়েটাকে এখুনি ওর বাসায় পাঠানোর ব্যবস্থা করবে।’
‘সে করা যাবে। রাত মাত্র সাড়ে এগারোটা, যদিও বৃষ্টি পড়ছে কষে। উত্তরা পাঠানো কঠিন কিন্তু অসম্ভব নয়।’ সাইফুল বললো নিরুত্তাপ কণ্ঠে।
‘চলে যেতে বলবো?’
‘এক্ষুনি। রাইট নাউ।’
‘তুমি একটু আম্মাকে বলে দিলে ভাল হয়।’
‘ঝামেলা তুমি বাধিয়েছ, তুমি মিটাও। রাত-বিরেতে যাকে-তাকে বাসায় আনছো। তোমার অধঃপতনে আমি শক্ড্, ট্রুলি শক্ড্। গো এন্ড গেট রিড অব হার রাইট অ্যাওয়ে।’
‘আচ্ছা দেখছি কী করা যায়। এতো উত্তেজনা ঠিক না। উত্তেজনা হলে ডিসিশানে ভুল হয়ে যায়।’
ফোন ক’রে একটা অ্যাম্বুলেন্স ডাকলো সাইফুল। অ্যাম্বুলেন্স এলে তিনতলা থেকে দোতলায় নামলো।
বসার ঘরের দরোজায় সাইফুলকে দেখে অবাক হলেন মিসেস চৌধুরী। এ বাসায় ওঠার পর থেকে সাইফুল কোনো দিন আসে নি। ঈদের দিনেও না। প্রশ্নবোধক চোখে তাকালেও বিস্ময়টা গোপন করলেন।
‘আম্মা, একটা কথা ছিল।’
‘বলো।’
‘প্রিয়াংকা, আগে একটা অ্যাম্বুলেন্সের খোঁজ করেছিলাম। এতক্ষণে এসেছে। তুমি চাইলে আমি নামিয়ে দিতে আসতে পারি। রাস্তা খালি, ১৫-২০ মিনিটে পৌঁছে যাবো হয়তো। এতক্ষণ ঝুম বৃষ্টি হচ্ছিল, বৃষ্টিটাও থেমে গেছে।’
ফোন বেজে উঠলো।
‘আম্মা, মেয়েটা আছে, না বিদায় হয়েছে?’ সুবর্ণলতার ফোন। মিসেস চৌধুরী এবার খুবই বিস্মিত হলেন। চকিস্ফতে একবার প্রিয়াংকার দিকে একবার সাইফুলের দিকে তাকালেন। তারপর খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বললেন, ‘এক্ষুুণি তো বলতে পারছি না মা। খোঁজ নিয়ে জানাচ্ছি। তুই ঠিক আছিস তো মা?’
মেয়েকে তুমি ক’রে বলেন তিনি; আজ বহু দিন বাদে তুই ক’রে বললেন।
ফোনের লাইন কেটে কাঁদতে বসলো সুবর্ণলতা। শেষ পর্যন্ত সে হেরে গেছে। সবার সামনে হেরে গেছে।