ধৈর্য্য

ধৈর্য্য
আমাদের ছোট ফুপির যখন বিয়ের অর্ধ যুগ পার হলো তখন তার স্বামী মারা গেলেন।ফুপির এক মেয়ের বয়স তখন তিন,আরেক সন্তান পেটে। পেটের সন্তানের বয়স তখন পাঁচ মাস। এই পেটের সন্তান নিয়ে ফুপা ফুপির মধ্যে প্রায়ই মজাদার ঝগড়া ঝাটি হতো। একেক দিন রাতে তাদের তিন বছরের মেয়ে মরিয়ম যখন ঘুমিয়ে যেতো তখন ফুপা বলতেন,’সালমা, এবার ইনশাআল্লা আমার ছেলে হবে।’
ফুপি তখন কপট রাগ দেখিয়ে বলতেন,’কেন, মেয়ে হলে বুঝি তোমার ঘাড়ে বোঝা চাপবে? ভবিষ্যৎ অন্ধকার হবে?’
ফুপা তখন হেসে বলেন,’মেয়েরা হলো জান্নাত। জান্নাতে আলো আছে, সবুজ বাগান আছে,বালাখানা আছে।অত অত সুন্দর জিনিস থাকার পরেও ওখানে শোরগোল করার মতন কেউ না থাকলে জান্নাত নিজেই বোর হয়ে যাবে একলা একা থাকতে থাকতে।মন খারাপ থাকবে সব সময়। আমি বলি কী, জান্নাতকে শোরগোলময় করে তুলতে একটা হরবোলা পাখির প্রয়োজন। সেই হরবোলা পাখিটি হবে আমাদের ছেলে সন্তান।’
ফুপির রাগ আরো বাড়ে। তিনি দূরে সরে গিয়ে বলেন,’তার মানে মেয়েরা শোরগোল করতে পারে না?আর একটি ঘরের সবগুলো সন্তান শুধু মেয়ে হলে তার সুন্দর্য নেই?’ ফুপা তখন হেসে বলেন,’সালমা,রাগ করো না তুমি। আসলে এভাবে বলিনি আমি। আমি মনে করি তো বোনেরা যদি একটি ঘর হয় সেই ঘরের খুঁটি তার ভাই।এটা বিয়ের আগের হিসেব।ধরো, হঠাৎ আমার মৃত্যু হয়ে গেল। তখন কে আগলে রাখবে আমাদের মরিয়মকে?’ ফুপু সঙ্গে সঙ্গে ফুপার মুখ চেপে ধরে বলেন,’যতসব অলুক্ষণে কথাবার্তা বলো! মরার নাম আর মুখেও আনবে না কোনদিন। আমার ভয় করে!’
ফুপা মৃদু হেসে বলেন,’সালমা, মৃত্যুর নাম রোজ রোজ স্মরণ করতে হয়। মৃত্যুর স্বাদ থেকে কোন জীবের রেহাই পাওয়ার কোন সুযোগ নেই।আজরাঈল ফেরেশতা মানুষের বয়স বিচার করে না।তার কাছে ডায়েরি আছে।ডায়েরির তারিখ মেনে সে চলে। আজকের পৃষ্ঠায় যদি এক বছরের শিশুর নাম থাকে তবুও তার রুহই কবজ করবে সে। আবার এই একবছরের দুধের সন্তানটিকে রেখেও তার মার নাম থাকলে তার জানই কবজ করবে। তোমার বোধহয় জানার কথা শাদ্দাদের মায়ের মৃত্যুর কাহিনী অথবা শাদ্দাদের মৃত্যুর কাহিনী।শাদ্দাদ ভূমিষ্ঠ হওয়ার সাথে সাথেই তার মায়ের জান কবজ করে নিয়ে গেল আজরাঈল ফেরেশতা।
আবার যখন অনেক অনেক অর্থ খরচ করে বহু আকাঙ্ক্ষিত দুনিয়ায় তার নিজের তৈরি জান্নাতে যখন শাদ্দাদ প্রবেশ করবে ঠিক তখন তার জানও কবজ করে নিয়ে গেল আজরাঈল।’ ফুপির সারা শরীর কেন জানি হঠাৎ কেঁপে উঠলো। আসলে সত্যি সত্যি মৃত্যুর কথা মনে পড়লে কে বা না ভয় পায়! এভাবে নিয়মিত তাদের অনাগত সন্তান নিয়ে মজাদার ঝগড়ায় সেদিনও লিপ্ত ছিলেন আমাদের ফুপা-ফুপি।এক মুহূর্তে ফুপা বললেন,’সালমা, আমার শরীরটা কেমন লাগছে। মাথায় কী যেন হলো!’
ফুপি অস্হির হয়ে গেলেন।সুইচ টিপে লাইট জ্বালিয়ে দেখেন ফুপার সারা শরীর ঘামে ভেজা।এর ঠিক দশ মিনিট পর পৃথিবীর মায়া ছেড়ে চলে গেলেন আমাদের ফুপা। তখন তিন বছরের মেয়েটাকে বুকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে কেঁদে উঠলেন ফুপি। কাঁদার সময় তিনি বলতে লাগলেন,’এই জন্যই তো রোজদিন আপনি মরণের কথা বলতেন।মরণ আপনাকে আগে থেকেই তাড়িয়ে বেড়াচ্ছিল।’ ফুপির কান্নামাখা মুখের দিকে তাকিয়ে মরিয়ম বোকা বনে গেলো। তিন বছরের শিশুটা তখনও জানে না মৃত্যুর পর বাবা আর কোনদিন ফিরবে না এই পৃথিবীতে!
ফুপির পেট থেকে দ্বিতীয় সন্তানটিও জন্ম নিলো মেয়ে হয়ে।এই দিনটি ফুপির বিজয়ের দিন। কারণ তিনি চাইতেন তার মেয়ে হোক। তার মেয়েই হলো।কিন্তু এই বিজয়ের দিনে তিনি মোটেও হাসতে পারছেন না। কারণ,ফুপির মনে হচ্ছে এই বিজয়টাই তার সবচেয়ে বড় পরাজয়।ফুপা বলতেন, তিনি মরে গেলে মরিয়মের যদি একটা ভাই থাকে তবে তা হবে মরিয়মের শক্তি। তিনি মরিয়মকে ঘর আর সেই ঘরের খুঁটি স্বরুপ চিন্তা করেছিলেন তার ভাইকে। কিন্তু ভাই তো তার আর হলো না। দুই দুটো মেয়ে নিয়ে কী করে সামনের দিনগুলো কাটাবেন ফুপি এই চিন্তায় অস্থির হয়ে গেলেন তিনি। খাওয়ার সময় খান না।
নিজের শরীরের যত্ন নেন না।সবাই বললো, এভাবে একটা মেয়ে মানুষ তার দুই দুটি মেয়ে নিয়ে কীভাবে দিনাতিপাত করবে! এদিকে আমাদের সংসারও চলে টানাপোড়েনে। তবুও আব্বা ফুপিকে বাড়িতে নিয়ে আসতে চাইলেন। কিন্তু ফুপি কিছুতেই বাড়ি আসবেন না। তিনি থাকবেন স্বামীর বাড়িতে। ওখানে তার বৃদ্ধা শাশুড়ি আছে। আব্বা বললেন,’শাশুড়ি থাকলে কী হলো, তোমার ভবিষ্যৎ তো তোমাকে দেখতে হবে?’ ফুপি বললেন,’ভাইজান, আপনাদের বোন জামাই না থাকা সত্ত্বে তার স্ত্রী হিসেবে তার বৃদ্ধা মাকে দেখা শোনা, সেবাযত্ন করার পুরো দায়িত্বটাই কিন্তু আমার উপর বর্তায়।আজ যদি তাকে ফেলে রেখে আমি চলে যাই তখন এই বৃদ্ধাকে কে দেখবে? বৃদ্ধা শাশুড়ি কী তার এই বিপদের দিনে আমায় পাশে না পেয়ে অকৃতজ্ঞ ভাববে না?’ আব্বা তখন বললেন,’তোমারও তো এখন বিপদ, তোমার নিজের বিপদের দিনে অন্যের সাহায্য কী করে করবে তুমি?’
ফুপি বললেন,’আমার শরীরে এখনও সামর্থ্য আছে কিন্তু আমার শাশুড়ির শরীরে মোটেও সামর্থ্য নাই। ভাইজান, আপনি আর আমায় জোর জবরদস্তি করবেন না বাড়িতে যেতে। মাঝেমধ্যে এসে খোঁজখবর নিবেন। বাকীটা আল্লাহই ব্যবস্হা করবেন।’ অবশেষে অপারগ হয়ে আব্বা আম্মাকে বললেন ফুপিকে অনুরোধ করতে। আম্মা তখন ফুপিকে বললেন,’সালমা, তোমার বয়স এখনও কাঁচা। বিয়ে শাদীর কথাও তো ভাবতে হবে নাকি?’ ফুপি তখন মৃদু হেসে বললেন,’ভাবী, নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমার মতো বিধবার জন্য বিরাট বড় সুখবর দিয়ে রেখেছেন। তিনি বলেছেন, ‘কোন বিধবা যদি তার এতিম সন্তানের কথা চিন্তা করে নতুন বিয়ে না করে তবে আমার জান্নাত আর ওই বিধবা মহিলার জান্নাত পাশাপাশি।’ ভাবী,অতবড় সুযোগ আমি কিছুতেই হারাতে চাই না!’
আম্মা তখন আর কী বলবেন।অন্যের অসৎ কাজে বাঁধা দেয়ার নিয়ম আছে কিন্তু পূণ্যের কাজে বাঁধা দেয়ার নিয়ম নেই। আম্মা তখন ফুপিকে তার মহৎ সিদ্ধান্তের জন্য বাধা দেয়ার বদল উৎসাহিতই করলেন। আমাদের সমাজে এমন একটা সিদ্ধান্ত নেওয়া সত্যিই কঠিন।একে তো ফুপি বিধবা, তার মাথার উপর ছায়া নাই। তারপর আবার তার দুটো ছোট ছোট সন্তানই মেয়ে। কিন্তু আল্লাহর বড় দয়া, তিনি তার বান্দা-বান্দীর প্রতি কখনোই নিষ্ঠুর হন না। আমাদের ফুপিও তার বৃদ্ধা শাশুড়িকে নিয়ে বিপদে পড়লেন না। বিপদে পড়লেন না তার মেয়েদের নিয়েও।ফুপার মৃত্যুর পর কীভাবে যেন আপনা -আপনি সবকিছু সহজে হয়ে যেতে লাগলো।যে জমিতে ফসলের ফলন কম ছিল সেই জমিতে ফলন বৃদ্ধি পেতে লাগলো।যে গাছে ফল কম হতো সেই গাছ ফলে ভারী হতে লাগলো।
মানুষও কেন জানি তাদের প্রতি মায়া দেখাতো। এভাবেই ফুপি তার দুটো মেয়েকে শিক্ষা দীক্ষা দিয়ে বড় করে তুললেন। তারপর বিয়ে দিলেন দীনদার তাক্বওয়াবান ছেলেদের কাছে।ফুপির শাশুড়িও বয়সের ভারে ন্যূহ হয়ে একদিন মৃত্যু বরণ করলেন ঠিক। আর মৃত্যুর পূর্বে তিনি দোয়া করে গেলেন,’ও মাবূদ,দয়ার সাগর,যে মেয়ে বিধবা হওয়া সত্ত্বেও আমি নাদান শাশুড়ির প্রতি এতো মায়া দেখালো তার প্রতি তুমি মায়া দেখাইও।ও আল্লাহ, তুমি আমার বউমারে জান্নাতুল ফেরদাউস দান কইরো।’
শাশুড়ির এমন দোয়া শোনে কৃতজ্ঞতায় ফুপি জড়জড় করে কেঁদে উঠলেন। কেঁদে কেঁদে তিনি মৃত্যুপথযাত্রী শাশুড়ির সামনেই আকাশের দিকে তাকিয়ে বলতে লাগলেন,’আল্লাহ, আমার এ ক্ষুদ্র জীবন স্বার্থক। তুমি আমায় আরো বড়ো ধৈর্যশীলদের কাতারে শামিল করো।যেন বড় কঠিনতম দিনেও তোমায় না ভুলে ধৈর্য্য ধারণ করে বলতে পারি, আমার কোন ভয় নেই কারণ আমার আল্লাহ আছেন।’
গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত