এই গরম থেকে নিজেকে রক্ষা করার জন্য অনেক কষ্ট করে একটা টিউশনি মেনেজ করেছি। তাও আমার বাসা থেকে দুই কিলোমিটার দূরে। যাতায়াত ভাড়া মাসে ৬৩০ টাকা চলে যাবে এই ভয়ে প্রতিদিন দুই কিলোমিটার হেটে হেটে যাই আর আসি। অর্থাৎ দিন মোট চার কিলোমিটার হাটি। মনকে সান্তনা দেই এই বলে যে ” ডেইলি চার কিলোমিটার হাটা স্বাস্থ্যের জন্য অনেক উপকারী। ” আজ টিউশনির বয়স বিশ দিন। মাইনে এখনো ঠিক করিনি। তবে আন্টি মানে আমার ছাত্রের মা একবার মাইনে নিয়ে কথা বলতে চাইছিলেন। আমি হাত উচু করে উনাকে থামিয়ে দিয়ে বলেছি ” আরে আন্টি এইসব কথা রাখেন তো! আমি তো আপনার ছেলের মত-ই। আপনার মন চাইলে টাকা দিয়েন আর নইলে দেওয়ার দরকার নেই ” আন্টিকে দেখে মনেহল উনি নেপালের ভূমিকম্প দেখছেন।
মর্মবিদ্ধ হরিণীর মত আমার দিকে অনেকক্ষণ চেয়ে থাকলেন তারপর বিড়বিড় করে বললেন ” আসলে বাবা তোমাকে দেখলেই বুঝা যায় তুমি যে ভদ্র ঘরের ছেলে” আমি একটু লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করে ফেললাম। আজ মাসের বেশ অর্ধেক দিন কেটে গেল অথচ আমি একদিনই টিউশনি ফাঁকি দেইনি। ঝড়-বৃষ্টি তোয়াক্কা না করে প্রতিদিন জাস্ট টাইমে গিয়ে অয়নদের বাসায় হাজির হই! অয়ন আমার ছাত্র। এবার ক্লাস সিক্সে পড়ে। ওকে পড়ানোর টাইম শেষ হয়ে গেলেও এক্সট্রা আরো দুই ঘন্টা মনযোগ দিয়ে পড়াই। এইত দুই দিন আগের কথা। অয়নকে পড়াচ্ছিলাম এমন সময় আন্টি এসে আমাকে বললেন, ” বাবা, আজ তুমি একটু আগে চলে যাও! আমরা অয়নকে নিয়ে একটু বেড় হব” “আরে আন্টি কী বলেন এইসব? ওর তো এখনো ১৫টা ম্যাথ বাকী। একটু অপেক্ষা করুন। দুই ঘন্টার ভেতরেই আমি শেষ করার চেষ্টা করব।”
আন্টি আর কিছু বললেন না। কিছু একটা ভাবলেন মনহল। তবে ছাত্রকে তখন ঠিক বাংলা ছবির বাপ্পারাজ লাগছিল। যেন এইমাত্র বড়সড় ছ্যাকা খেয়েছে। গতকাল অয়নের আব্বু আমাকে কল দিয়ে বলছিলেন ” বাবা, তোমাকে আজ আসতে হবে না! অয়নের মাথা ব্যাথা করছে” “আংকেল, অয়নের তো এক মাস পরে পরীক্ষা। না পড়লে পিছে পরে যাবে তো! আচ্ছা, আপনি চিন্তা কইরেন না! আমি অয়নের জন্য মাথা ব্যাথার ট্যাবলেট নিয়ে আসছি। মাথা ব্যাথা সেরে যাবে।” “আচ্ছা বাবা দেখ! তোমার ইচ্ছা।” বলে আংকেল ফোন কেটে দিলেন। টিউশনির প্রথম শুক্রবারে যেদিন বৃষ্টিতে ভিজে অয়নকে পড়াতে গিয়েছিলাম। আন্টি আমার দিকে এমনভাবে থাকালেন যেন মনেহল উনি বহুবছর আগে বিলীন হয়ে যাওয়া ডাইনোসার কে দেখছেন।ভ্র কুঁচকে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন,
“আরে! আরে! শুক্রবারে তুমি আসলা কেন? এই বৃষ্টিতে ভিজে না আসলেও তো পারতা।” “আন্টি, থামুন তো! অয়ন তো আমার ছোট ভাইয়েরই মতন।ওর ভালো রেজাল্ট করাই তো আমার দায়িত্ব। আপনি শুধু শুধু টেনশন কইরেন না।” আন্টি শুধু বাংলা ছবির আনোয়ারা বেগমের মত থাকিয়ে থাকলেন আমার দিকে। দেখে মনেহল কৃতজ্ঞতায় উনার মুখ আটখানা। অয়ন তখন গেম খেলতে ছিল।আমাকে দেখেই সে আঁতকে উঠল। যেন এইমাত্র কেউ ওর কলিজায় বুলেট মেরেছে। আজকে শুক্রবার! প্রতিদিনের মত আমি অয়নকে পড়াচ্ছি। হঠাৎ আন্টি আমার পাসে এসে মাথায় হাত বুলিয়ে বুলিয়ে বললেন,
“বাবা, আগামী সপ্তাহ তোমার আসতে হবে না! আমরা অয়নকে নিয়ে তার নানু বাড়ী যাব “
“আরে আন্টি কী বলেন এইসব?”
“হ্যা বাবা, অয়নের নানু খুব অসুস্থ। আর ওখানেও অনেকদিন ধরে যাই না”
“আচ্ছ যান! তবে অয়নকে রেখে যান! আমি প্রতিদিন আমার মেস থেকে খাবার এনে দিব আর ওকে মনযোগ দিয়ে অনেক টাইম পড়াব।”
” নাহ! বাবা। তোমার এতে কষ্ট হবে আর অয়ন ছোট মানুষ থাকতে পারবে না” আমি আর কিছু বললাম না। এই প্রথম নিজেকে বাপ্পারাজ মনেহল। একটু পর আংকেল এসে আমার কাছে ছয় হাজার টাকার একটা বাণ্ডিল ধরিয়ে দিয়ে বললেন, “বাবা, কিছু মনেকর না। এগুলো রাখ। সামনের মাস থেকে আরো বাড়িয়ে দেব। আর অয়নের প্রতি তুমার এত্ত ভালোবাসা দেখে সত্যিই আমি অবাক। ভালো থেক” “আচ্ছা, আপনারাও ভালো থাইকেন। যত সম্ভব তাড়াতাড়ি ফিইরেন। আমি পথচেয়ে থাকব।”
হয়ত সামনের মাস থেকে আংকেল আমার বেতন আরো বাড়িয়ে দেবেন। তবে আমার একটাই ভয়! একটাই চিন্তা! ওনারা যদি কখনো জেনে যান এই গরমে উনাদের বাসায় ফিটিং করা এয়ারকন্ডিশনের বাতাস খাওয়ার জন্য আমি একদিনও টিউশনি মিস দেই না! অয়নকে এত্ত কেয়ার করি। তখন আমার কী হবে? আমার খুব ভয় করতাছে।
গল্পের বিষয়:
গল্প