ক্রিং ক্রিং ল্যান্ডফোন বেজে উঠলো। আমি গিয়ে কলটা ধরলাম, ধরতেই শুনি কলটা ‘জননী বৃদ্ধাশ্রম’ থেকে। তারা জানতে চায় হাবিবুর রহমান আছে কিনা। আমি বললাম, সে বাসায় নাই। তারা বলে, “রানা সাহেবের জন্য সিট খালি করা হয়েছে। আজই নিয়ে আসতে পারবেন। হাবিবুর সাহেবকে বলতে বলছে। ” কথাটা শুনে বড়সড় একটা ধাক্কা খেলাম আমার ছেলেই কিনা, আমাকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠাতে এত আয়োজন। যে ছেলেটাকে জন্ম দিতে গিয়ে আমার স্ত্রী সুরাইয়া দুনিয়া ছেড়ে চলে যায়। তখন বয়সটা ছিলো ২৫। ২য় বিয়ে করি নাই আর। ছেলেকে যদি অযত্ম করে ।
একাই দেখে রেখে বড় করেছিলাম ছেলেকে। আর ছেলে আমাকেই বৃদ্ধাশ্রমে পাঠাতে চাইছে, বউয়ের কথা শুনে। ছেলের বউ আমাকে পছন্দ করে না। বুড়া মানুষ বাসায় বসে বসে নাকি খাই। এইসব কিছু সহ্য করতে হয়। ছেলের বউ কেউ না, আমার বন্ধু নিজামের মেয়ে। তার একটা ছেলে ও মেয়ে । আর অনেক আদর করে ছেলেকে বিয়ে করিয়ে, বন্ধুকে বেয়াই বানালাম। সবাই যেনো মিলে মিশে থাকতে পারি।বন্ধু গত সপ্তাহে নাকি বিদেশ সফরে গেছে। দু বন্ধু কোটি টাকার মালিক। আর আমার জীবনের আয় দিয়ে বাড়ি করলাম সেই বাড়ি থেকে বৃদ্ধাশ্রমে!
একটু আগে সুন্দর করে বলে ছেলে ও ছেলের বউ মার্কেটে গেছে কেনাকাটা করতে আমার জন্য। আমি আজ অনেক খুশী ছেলের বউ আমার জন্য কেনাকাটা করবে। আর এই ছিলো আসল কারণ। বয়সের ভারে জীবনটা আজ কি হলো! চোঁখের কোণে পানি জমে যাচ্ছে। আজ সুরাইয়াকে খুব মিস করতেছি। মনে হচ্ছে এখন যদি থাকতো আমার হাতটা ধরে চলে যেতো সাথে করে বৃদ্ধাশ্রমে। তার বয়স ১৮যখন ছিলো, তখন হাত ধরে ভালবেসে বাড়ি ছেড়ে দিয়েছিলো। নিজের রুমে গিয়ে সব কিছু ব্যাগে গুছিয়ে নিচ্ছি তখনই আসলো ছেলে ও তার বউ। আমার রুমে এসে একগাদা কাপড় দিলো। কিছু বলার আগেই ছেলের বউ বলে, “বাবা আপনি বাসায় একা থেকে থেকে সময় কাটে না। তাই ভাবছি আপনার বয়সের সবার সাথে থেকে সময় কাটাতে পারবেন। তাই বৃদ্ধাশ্রমে একটা সিট বুকিং দিয়েছি। “
আমি বলি,” ঠিকই বলছো বউ মা।আমিও তাই ভাবছি। বৃদ্ধাশ্রম থেকে কল এসে ছিলো। আজই যেতে বলছে। “
ছেলে বলে,” আপনি সব গুছিয়ে নেন। খাবার খেয়েই চলে যাবো আমরা । আর আমার শ্বশুরকে বলার দরকার নাই। “
আমি বলি,”ঠিক আছে সব রেডি চলো এখনই যাই ” আর এক গ্লাস পানিও খেলাম না বাসায়। আমার সব কিছু আগেই ছেলের নাম করে দিয়েছিলাম। আমার নাতি যখন জন্ম নেয় তখনই খুশীতে সব লিখে দেই। সবাই গাড়ি করে হু হু করে চললাম বৃদ্ধাশ্রমের দিকে। ঘন্টাখানিক পরই চলে আসলাম আমরা। বাড়িটা ছেড়ে আসতে আমার কলিজা ফেটে যেতে ছিলো। বৃদ্ধাশ্রমে এসেই আমাকে একটা রুমে দেখিয়ে দেওয়া হলো। আমার সকল জিনিস পত্র নিয়ে আসা হলো রুমে। বৃদ্ধাশ্রমের ম্যানেজারও আসলো।
আমার ছেলে বলে,” বাবা সব চেয়ে ভালো খাবার দেওয়া হবে আপনাকে। প্রতিবেলায় মাংস, ডিম ও থাকবে। সবজি চাইলে দেওয়া হবে। মাসিক ৫হাজার করে দিবো এদের ” আমি একটা হাসি দিলাম। মনে মনে বলছি, তুমি ছেলের জন্য কলেজে থাকতেই মাসে হাত খরচ দিতাম ৭-৮হাজার টাকা। ম্যানেজার বলে, “টেনশন করতে হবে না। সবচেয়ে ভালো ভাবেই রাখা হবে আপনার বাবাকে ” ছেলে আমার থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেলো। ছেলের বউও আসলো নাতিকে নিয়ে। আমার থেকে বিদায় নিয়ে গেলো। একটু পরই খাবারের সময় হলো। আমাকে নেয়া হলো খাবার রুমে। যারা ভালো মানের খাবার খায় তাদের আলাদা ঘর। যাদের টাকা কম দেয় তাদের ডাল ভাতেই খায়। খাবার রুমে গিয়ে বসলাম। দূরে একজনকে দেখে থমকে গেলাম। চোঁখের চশমাটা ভালো করে দিয়ে দেখি, নিজামের মতো কেউ। তার বউ মারা গেছে গত ১০বছর আগে। এগিয়ে গিয়ে দেখি আসলেই নিজাম।
_দোস্ত, এখানে?
_আরে দেখি তুইও এখানে যে? চল দুজনের রুমে গিয়ে বসি । দুজন বন্ধু হাটতে হাটতে গেলাম রুমে। বসলাম খাটের উপর।
_এখানে কি করে তুই?(আমি)
_গত সপ্তাহে বিদেশ না। আমাকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠানোর ব্যবস্থা করে। তাই মেয়ের কথা সবার কথা চিন্তা করে বললাম বিদেশ যাচ্ছি। ছেলের বউ ও ছেলে মিলে এনে দিছে এখানে। আমার বাড়িতে আমিই ছেড়ে দিলাম। আর তুই রানা? (নিজাম)
_বন্ধুর আদরের দুলারি আমায় আজ এখানে এনে দিছে। তোর মেয়ে কেয়া আমাকে এখানে পাঠিয়ে দিছে ছেলের সাথে মিশে। (আমি)
_আমার মেয়ে?
_আমার ছেলে কি দশটা যেভাবে বলতেছিস? (আমি)
_আমার মেয়ের সাঁজা আমাকেই ফিরিয়ে দিছে। ছেলের বউ হয়ে প্রকৃতি প্রতিশোধ নিলো। (নিজাম)
_আরে বন্ধু, আমরা চাইছি দুজনে একসাথে থাকতে। কপাল সবই বৃদ্ধাশ্রমে একসাথেই আছি। (আমি)
_আমার মেয়ে আজ যদি আমায় দেখে বুঝবে কষ্ট। কিন্তু শ্বশুরকে বুঝে না। যাক আমি কখন বলতে চাই না মেয়েকে। মরার পরই শুনবে। আজ থেকে নতুন জীবন আমাদের এখানে। চল খাবার খেয়ে আসি। (নিজাম)
_হুম।
দু-বৃদ্ধা বন্ধু হাত ধরে হাঁটছি। খাবারের রুমের দিকে যাচ্ছি। বৃদ্ধাশ্রমে নতুনজীবন শুরু আমাদের। আমাদের শেষ ঠিকানা এখানেই এখন। আমাদের সন্তানরা বুঝলো না পিতা মাতা কি। একদিন ঠিকই বুঝবে যখন তাদের সন্তান তাদের বৃদ্ধাশ্রমে দিয়ে আসবে। প্রকৃতি কারো ঋণ বাকি রাখে না। ফিরে দিবেই সব কিছু।
গল্পের বিষয়:
গল্প