আপনাকে না বলছি প্রতিদিন আমাদের বিরক্ত করবেন না। নামাজ আমরা পড়লে পড়লাম, না পড়লে নাই, তাতে আপনার সমস্যা কই?
– জ্বি আমার কোন সমস্যা নাই ভাইয়েরা। আপনারা আমার ছোট ভাইয়ের মতো। আমি যেমন আমার ছোট ভাইয়ের ক্ষতি কখনো চাই না তেমনি আপনাদেরও ক্ষতি চাই না। যদি দেখি আমার ছোট ভাই আগুনে জ্বলে পুড়ে যাচ্ছে, তাকে বাঁচানো আমার কর্তব্য, তেমনি আপনাদের বাঁচানোটাও আমার কর্তব্য।
– ঐ মিয়া আমরা কী আগুনে পরছি নাকি, যে আমাদের বাঁচাইতে হইব? আমরা তো চায়ের দোকানেই বইসা আছি।
– জ্বি ভাই, নামাজ না পড়ায় আপনারা আগুনের পথেই হেঁটে যাচ্ছেন । তাই সেই আগুনের পথ থেকে বাঁচানোটা আমার কর্তব্য।
– দেখেন ভাই,আপনাকে আবারও বলতেছি , এতো জ্ঞান দিতে হইব না। আমরা আগুনের পথে যাই, নাকি জাহান্নামের পথে যাই সেটা আপনার দেখতে ইহব না, আপনি আপনার পথ দেখেন। এভাবেই প্রতিদিন অপমানিত হয় আল- আমিন। তবুও সে ক্ষান্ত হয় না। সে তাদেরকে দাওয়াত দিতেই থাকে, যদি কখনো ছেলে গুলো ইসলামের পথে ফিরে আসে। মনে সামান্য তম অনুভূতির সৃষ্টি হয়। আল্লাহ তাদের হেদায়েত দেন তবেই তার কষ্ট সার্থক হয়। আল আমিন আজ হঠাৎ লক্ষ করে ছেলে গুলো চায়ের দোকানে নেই। কিন্তু এই সময়টায় তো তারা এখানেই থাকার কথা।
– আসসালামু ওয়ালাইকুম সামাদ ভাই।
– ওয়ালাইকুম আসসালাম, হুজুর।
– তো আপনার চায়ের দোকান কেমন চলছে?
– আপনাগো দোয়ায় চলছে কোন রকম আরকি।
– সামাদ ভাই, এখানে যে ছেলে গুলো বসে আড্ডা দেয়, তারা আজ কোথায়?
– ক্যান আপনি খবর জানেন না ?
– কেন, কী হয়েছে !
– ঐ যে মোটা কইরা ছেলেটা আছে না, আর জাহিদ নামের ছেলেটা। ওরা বাইক এক্সিডেন্ট করছে । হাসপাতালে ভর্তি। তাই সবাই হাসপাতালে গেছে । কথাটা শুনে আল আমিনের মনটা কেমন যেন করে উঠলো। আহারে,,, তারা কী অবস্থায় আছে আল্লাহ,ই ভাল জানেন।
– কোন হাসপাতালে আছে বলতে পারেন কিছু ?
– হ, ঢাকা মেডিকেলে আছে ।
আসরের নামাজ শেষ করেই আল আমিন হাসপাতালের উদ্দেশ্য রওনা দেয়। শত হলেও এলাকার ছেলে পেলে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। এটা হাসপাতাল নয় যেন একটা মৃত্যুপুরী। হাজার মানুষের আহাজারি শত মানেষের কান্না, হাসপাতালের পরিবেশ কে ভারি করে তুলেছে। মানুষে কষ্ট গুলো স্বচোখে না দেখলে আসলে কষ্ট গুলো অনুভব করা যায় না। ইমারজেন্সিতে খোঁজ করতেই তাদের সন্ধান পাওয়া গেল। তিনটি ছেলে মাথা নিচু করে বেঞ্চের উপর বসে আছে। তাদের চেহারায় স্পষ্ট দুশ্চিন্তার ছাপ। কারো মুখে কোন কথা নেই।
– আসসালামু ওয়ালাইকুম। সালামের উত্তর না দিয়ে তারা হুজুরের চেহারার দিকে তাকিয়ে আছে।
– শুনলাম আপনাদের দুটো ফ্রেন্ড নাকি বাইক এক্সিডেন্ট করে এখানে ভর্তি, তাই দেখতে আসলাম। তো তাদের কী অবস্থা এখন?
– মোটা বাবুলের পা ভাইঙ্গা গেছে আর জাহিদ মাথায় প্রচণ্ড আঘাত পাইছে, তার এখনও জ্ঞান ফিরে নাই । ডাক্তার বলছে কিছুই বলা যাচ্ছে না, জ্ঞান ফেরার আগ পর্যন্ত। কথা গুলো শুনে অনেইটাই ব্যথিত আল আমিন। ছেলে গুলো কেন হেলমেট ছাড়া এতো বেপরোয়া বাইক চালায়। তাদের কী জীবনের মায়া দয়া নাই, তার বুঝে আসে না।
– আল্লাহ ভরসা, হায়াৎ মউতের মালিক আল্লাহ। আল্লাহ্ কে স্মরণ করেন। অবশ্যই আল্লাহ তাদের সুস্থ করে দিবেন।
তাদের নিজ নিজ ভাবনায় কিছুটা সময় কেটে যায়। অতঃপর আল আমিন মোটা বাবুলের সাথে দেখা করতে পারলেও, জাহিদের সাথে দেখা করতে পারে না, কারণ তাকে ICU তে রাখা হয়েছে। আল আমিন আবার তাদের মাঝে ফিরে আসে। এরই মাঝে দূরের মসজিদ থেকে আযানের সুমধুর ধ্বনি ভেসে আসে। আল আমিনের মন নামাজের জন্য চঞ্চল হয়ে উঠে।
– ভাইরেরা আমার, আপনাদের বন্ধুরা আজ চরম সংকটাপন্ন অবস্থায় অবতীর্ণ। আপনারা যদি নামাজ পড়ে বন্ধুর জন্য সামান্য দোয়া করেন, অবশ্যই আল্লাহ তাদের প্রতি মেহেরবান হবেন। চলেন নামাজে যাই আজ আর তারা মুখের উপর না করতে পারেনা। হুজুরের পিছু নেয় নামাজ পড়ার জন্য। হাসপাতালের ভেতরেই নামাজ পড়ার জায়গা আছে সেখানেই তারা হুজুরের পেছনে নামাজ আদায় করে। নামাজ শেষে হুজুরের মোনাজাতে তারা কেন যেন চোখের পানি আটকাতে পারে না।
– হে আমার পরয়ার দিগার, হে আমার পরম করুণাময়। হে আমার আল্লাহ। আমি তো তোমার কাছে কখনোই কিছু চাইনি। আজ আমার এক ভাই মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছে, এখনও তার জ্ঞান ফেরেনি । আরেক ভাইয়ের পা ভেঙ্গে বিছানায় পরে আছে। তাদেরকে তুমি সুস্থতা দান কর। তাদের জীবনের সমস্ত গুণা মাপ করে দাও। তারা ছোট মানুষ এতকিছু বোঝে না আল্লাহ। কিন্তু তুমি তো বুঝদার তবে কেন তুমি তাদের উপর রহম করবেনা আল্লাহ। আজ আমার তিন ভাই আমার সাথে নামাজে এসেছে, তাদেকেও তুমি কবুল কর আল্লাহ। তাদের উঠছিলায় তার বন্ধুদের তুমি ভালো করে দাও। তেদেরকে সুস্থতা দান কর।
আমিন নামাজ শেষ করে তারা আবার কেবিনে ফিরে এসেছে। কেবিনে ফিরে এসেই তারা খুবই আশ্চর্য হয়ে গেছে। শত চেষ্টা করেও ডাক্তাররা জাহিদের জ্ঞান ফেরাতে পারছিল না অথচ নামাজ শেষে হুজুরের সামান্য দোয়াতেই জাহিদের জ্ঞান ফিরে এলো ? এমন দৃশ্য তো শুধু সিনেমাতেই দেখা যায়, যা অনেকটা হাস্যকর আর অবাস্তবিক । কিন্তু বাস্তবে এমনটা দেখতে পেয়ে খোদার প্রতি তাদের শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে আসে। আসলেই তিনি মহান, আসলেই তিনি ক্ষমাশীল।
না, আর তাদেরকে নামাজের জন্য তাগিদ দিতে হয়নি। সেই ঘটনার পর থেকে তারা নিয়মিত নাজাজ পড়ে। এমন কী মোটা বাবলু আর জাহিদও সুস্থ হয়ে নামাজ ধরেছে। এখন আর তারা দোকানে বসে আড্ডা দেয় না। আশালীন কথায় মেয়েদের টিজ করেনা। বাইক চালানো এক প্রকার ছেড়েই দিয়েছে তারা, যদিও কখনও চালায় অবশ্যই হেলমেট মাথায় দিয়ে নেয়। আল আমিন হুজুর তাদের দিকে তাকায় আর আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া জ্ঞাপন করে। আল্লাহ চাইলে কী না হয়! কোন ঘটনার পরিপেক্ষিতে, কাদের প্রতি তিনি সন্তুষ্ট হন তিনিই সেটা ভালো জানেন। আসলেই আল্লাহর মহান, পরম দয়ালু।
গল্পের বিষয়:
গল্প