ঈদ নয় চাই তৃপ্তি

ঈদ নয় চাই তৃপ্তি
১৬০ নাম্বার রুমটাতে আজ রাতে আমার ডিউটি। রুমটাতে ডিউটি পড়লেই আমার সারা দিন-রাত গলা শুকিয়ে থাকে।ব্লাড প্রেশার চেক,পালস রেট চেক এসবই কাজ।ইমারজেন্সিতে সিনিয়র ডক্টর কে কল করা। আর রোগীর পাশে বসে তাকে সাহস জোগানো।একজন জুনিয়র ডক্টর হিসেবে এটুকুই কাজ আমার।এই রুমের যে পেশেন্ট তিনি একজন বৃদ্ধ লোক।বয়স ৮০ ছুঁই ছুঁই। গায়ের রং গৌর,বয়সে চামড়া যতোটা ঝুলে পড়ার কথা তার চেয়ে খানিকটা বেশিই ঝুলে পড়েছে।চোখে সোনালী ফ্রেমের চশমা।আমার দেখা সবচেয়ে অদ্ভুত মানুষ।যাকে দেখলেই গা ছমছম করে আমার।একজন ডক্টর হিসেবে এটা আমার সাথে যায়না।ওনাকে আমি দাদু বলেই ডাকি।ওনার কভিড ১৯ পজিটিভ ধরা পরে আজ প্রায় ১৫ দিন।এই ১৫ দিন এর ১০দিনই রাতে আমি ডিউটিতে থাকি।উনি এখন একটু সুস্থ আলহামদুলিল্লাহ। কিন্তু ইমপ্রুভ খুব কম হচ্ছে ওনার।আমি যতদূর ধরতে পেরেছি কনফিডেন্সের অভাব।আরও বিভিন্ন অসুখ থাকায় কাবু করে ফেলছে।
অদ্ভুত কাজ তার।আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে কি যেন লিখতে তাকে একটা নোটবুকে।এই তাকিয়ে থাকা সাধারণ কোনো তাকিয়ে থাকা নয়।মনে হয় খুব কাছের কাউকে সে অনেকদিন পর তৃপ্তি নিয়ে দেখছে।কিন্তু কিছু বলতোওনা।কিছু আস্ক করলে পাশ ফিরে শুয়ে থাকতো।আরেকটা অদ্ভুত বিষয় লক্ষ্য করেছি,প্রতিদিন ঠিক রাত ১২ টায় উনি একবার জেগে উঠে জানালার কাছে দাঁড়িয়ে থাকেন।মনে হয় কেউ যেন আসবে,অপেক্ষার প্রহর গুনছেন তিনি।সবটাই গা ছমছমে ব্যাপার।সবচেয়ে অবাক করা বিষয় হলো উনি এখনো পর্যন্ত কারো সাথে নাকি কথা বলেননি।আমার খুব আগ্রহ জাগছিলো কে উনি?জানতে হবে।রিসিপশনে গিয়ে একবার ফাইলটা চেক করে আসবো ভেবেছি।কিন্তু হয়ে উঠেনা আর।এত্ত পেশেন্ট,আতংক,ব্যস্ততা নিজের সংসার সামলাতে হিমশিম অবস্থা আমার।তাই আর হয়ে উঠেনি। দুদিন পরের ঘটনা।
দাদুর হঠাৎ খুব বাজেভাবে শ্বাসকষ্ট শুরু হয়।তাকে ইমিডিয়েটলি আইসিইউতে শিফট করা হয়।খুব অস্থির লাগছে।আমি অন্য একটা রুমে ডিউটিতে। এই পেশেন্টের অবস্থাও ভালোনা।তার ট্রিটমেন্টে আমি ব্যস্ত কিন্তু মনটা আইসিইউতেই পড়ে আছে কেন যেন।রাত ১০ টা।দাদুর কনডিশন এখন নরমাল আলহামদুলিল্লাহ। ডিউটিতে কাকতালীয় ভাবে আমিই পড়লাম।তার আগের রুমের জিনিসপত্র একজন ওয়ার্ডবয় কে দিয়ে যেতে বলেছিলাম।সেগুলো সামনে নিয়েই বসে আছি।বেশি কিছুনা।দুটো পাঞ্জাবি,কয়েকটা বই,একটা ওষুধের বক্স,একটা কার্ড আর একটা নোটবুক। কার্ডে লেখা “গোধূলি বৃদ্ধাশ্রম ” দাদুর নাম।তাকে যে দিয়ে গেছেন তার সম্মানীয় পুত্রের নাম,এড্রেস দেয়া। বুকের ভেতরটা ধক করে উঠলো।কোনো আত্মীয় স্বজন খোঁজ খবর নেয়না যে বুঝাই গেলো।করোনার কারনে দেখা করা নিষেধ তাই কখনো মাথায় আসেনি পরিবারের কথা।কিন্তু দাদুর যে আসোলেই কেউ নেই।এবার আমি হাতে নিলাম নোটবুকটা।
অসম্ভব সুন্দর হাতের লেখা। একজন বৃদ্ধের হাতের লেখা এতোটা সুন্দর হতে পারে আমি কল্পনাও করতে পারিনি।দাদু বিভোরে ঘুমোচ্ছে।আমাকে খুব টানছে নোটবুকটা,যদিও কারো ব্যক্তিগত জিনিসে অনুমতি ছাড়া হাত দেয়াটা খুবই গর্হিত কাজ তবুও নিজের কৌতূহল কে চেপে রাখতে পারছিনা।এত চুপচাপ, শান্ত যার চোখের দিকে তাকালে,মায়ার আকর্ষণ থেকে নিজেকে তোলা যায়না,সেরকম একজন বাবাকে একজন সন্তান ঠিক কি কারনে ফেলে যেতে পারে?জানার খুব ইচ্ছে আমার।যদি কোনো ক্লু পেয়ে যাই!!আল্লাহর কাছে ক্ষমা চেয়ে নোটবুকটার পাতা উল্টালাম।প্রথম পৃষ্ঠাঃ
রানু, তুমি চলে যাওয়ার পর আজ প্রথম তোমাকে ছাড়া নতুন একটা জায়গায় এসেছিগো।তোমার মনে আছে?আগে যখন আমি কোথাও তোমাকে রেখে ঘুরতে যেতাম, তখন কত্ত রাগ,অভিমান জমা হতো তোমার।সত্যি বলতে পুরোটা সময় আমি তোমাকে ভাবতাম।তোমার অনুপস্থিতি আমাকে ভীষণ যন্ত্রণা দিতো। মনে হতো তোমাকে নিয়ে আসি এক্ষুনি গিয়ে।কিন্তু আজকে একটুও যন্ত্রণা হচ্ছেনা জানো?আজকের দিনটা তুমি সহ্য করতে পারতেনাগো রানু।আমাদের রায়হান আজকে আমায় বৃদ্ধাশ্রমে রেখে গেছে।আমার জন্য নাকি ওর বউ তার অফিস ঠিকমতো করতে পারেনা।ওর ছেলে ব্যাকডেটেড হয়ে যাচ্ছে।
আর আমি নাকি ওদের অন্নধ্বংস করছি।এ কথাগুলো আমার শুনতে খারাপ লেগেছে কিন্তু ওতোটা খারাপ ও না।যতোটা খারাপ তোমার চোখের পানি দেখলে আমার লাগতো।তাই আজকে আমি অনেক খুশি যে তুমি আমার কাছে নেই।জানো রানু?আমাদের ইহান দাদুভাই এখন হাঁটতে পারে।আমার সাথে ঘোড়া ঘোড়া খেলেছে কদিন।দারুন মেধা বুঝলে?যা একবার বলি ওমনি আর বের হয়না মাথা থেকে।খুব দেখতে ইচ্ছে করছে ওকে।বৌমাতো সারাদিন ল্যাপটপ নিয়ে বসে থাকে,দাদুভাই আমার রান্নাঘরে চলে যায়,ওয়াশরুমে চলে যায়।বড্ড চিন্তা হচ্ছেগো।দোয়া করো তুমি ওদের জন্য।আজ তাহলে যাই।মাথাটা বড্ড ব্যথা করছেগো।
২৫এপ্রিল,২০১৬ রাত (১২.২৫) পড়া শেষ হতেই টের পেলাম চোখ ভিজে গেছে আমার।পাতা উল্টালাম।হাজারো অপ্রকাশিত অনুভূতি লুকিয়ে আছে এই নোটবুকে।একটা জায়গায় গিয়ে থমকে গেলাম সাবা, কেমন আছিসরে মা?আমি আল্লাহর রহমতে ভালোই আছি।জানিস,আজ অনেকদিন পর তোকে দেখতে পেলাম।অবাক হচ্ছিস?প্রথম প্রথম আমিও অবাক হতাম।আমার রুমে যে মেয়েটা আসলো ওই মেয়েটার চোখ একদম তোর মতো।আমি দেখেই কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলাম।ওরাতো কিসব পড়ে থাকে একদম প্যাকেট করা।শুধু চোখদুটোই দেখতে পেয়েছি।অবিকল তোর চোখ।অনেকদিন হলো তোর মাও স্বপ্নে আসেনা।দেখাও হয়না।তোর মাঝে আমি তোর মাকে দেখতাম। দুজনের চোখ ছিলো একই গঠনে সৃষ্টি।
মেয়েটাকে দেখে মনে অনেক শান্তি পেলামরে মা।তোকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে।অনেক শখ করে তোকে ডাক্তারি পড়িয়েছিলাম।শুনেছি অনেক বড় ডাক্তার তুই এখন।কিন্তু আমি তোকে সাদা এপ্রোনে আজও দেখলামনারে মা।যে মেয়েটার কথা বলছি মেয়েটার নাম খুশি।নামের মতোই তার চাহনির প্রফুল্লতা।খুব ইচ্ছে করে বলতে,”মা একটু বসো আমার পাশে,তোমার দাদুর চোখগুলোও একদম তোমার মতো ছিলো।তোমাকে একটু দেখি।আমার রানুকে দেখিনা আজ অনেক দিন।জানোতো মা রানুর দুটো ছবি ছিলো বাসাতে।অনেক বড় ছবি দুটো। বসার ঘরে সাজানো ছিলো।একদিন বউমা এসে ছবিদুটো নিয়ে স্টোর রুমে ফেলে এসেছে।মরা মানুষের ছবি রাখলে নাকি ঘরের অকল্যাণ হয়।তুমি একটু বসো,আমি আমার রানুকে একটি দেখি।”
কিন্তু বলা হয়নিরে মা।ভয় লাগে যদি তোদের মতো ওই চোখজোড়াও হারিয়ে যায়!তাইতো লুকিয়ে দেখি।হারিয়ে যাবে চোখ ফেরালেই।সাবারে,রায়হান আসেনা আজ অনেকদিন মা,আগে প্রতিমাসে একবার আসতো টাকা দিতে।এখন কিসব অনলাইনে পে করে দেয়।আমার করোনা হয়েছে ফোন করে বলা হয়েছে।ও তাঁদের বলেছে,”আমার ছোট বাচ্চা আছে।আমি রিস্ক নিতে পারবোনা।আপনারা ম্যানেজ করুন।দাফন কাফনে কোনো টাকা লাগলে বলবেন,আমি পাঠিয়ে দিবো।”আচ্ছা মা,আমি কি এতোটাই বোঝা হয়ে গেছিলামরে তোদের কাছে?ছোট্টবেলা একবার রায়হানের প্রচুর জ্বর হয়েছিলো।তোর মা জলপট্টি দিচ্ছিলো।কিন্তু জ্বর কমার কোনো নাম গন্ধ ছিলোনারে।বাইরে প্রচুর বৃষ্টি, ঘন ঘন বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে।ওর মাঝেই আমি বেরিয়ে যাই।পথে কয়েকটা বড় বড় গাছ পড়ে আমার সামনে।সেদিন স্বয়ং আল্লাহ এসে বাঁছিয়েছিলেন আমায়।বৃষ্টিতে কাকভেজা হয়ে আমি ডাক্তার সাহেবের বাসায় পৌঁছাই।ওনার পা ধরে ওনাকে নিয়ে আসি।অনেক বড় ডাক্তার তাই বৃষ্টিতে বের হওয়া সম্ভব ছিলোনা তার পক্ষে।
অগত্যা একজন স্কুল মাস্টার সেদিন একজন ডাক্তারের কাছে মাথা নিচু করে ফেলেছিলো নিজের ছেলের জীবন বাঁচাতে।অনেক যুদ্ধ করে সেবার রায়হান ম্যালেরিয়ার কবল থেকে বেঁচেছিলো।কতোটা আনন্দ হয়েছিলো আমাদের তা বুঝাতে পারবোনা মা।আর সেই রায়হান আমাকে আমার মৃত্যুর আগেই মেরে ফেললোরে মা।ভালো থাক।চোখগুলো ঝাঁপসা হয়ে আসছে। ১লা মে,২০২০(রাত১০.৫০) আমাদের জীবনের সবচেয়ে তিক্ত সত্য এটাই যে আমাদের আধুনিক ছেলেমেয়েগুলো বাবা মাকে চিনেনা।তারা চিনে শুধু টাকা আর প্রতিপত্তি। এরা ভুলে যায় দিনের পর দিন এই বাবা মা রাতের ঘুম হারাম করে তাদের শিয়রে বসে মাথায় জলপট্টি দিয়েছে।
তাদের স্কুলের জুতার জন্য নিজে কয়েকবার শিলাই করা জুতোটা পড়েছে।তারা দেখে অচেনা অজানা একটা মেয়ে তাদের জন্য রান্না করছে,তাদের যত্ন নিচ্ছে, সন্তানদের দেখাশুনা করছে।এতোই যখন একটা মেয়ে করছে তোমার জন্য তাহলে বেকার অবস্থায় কেন ছেড়ে চলে যায় তোমার সেই তথাকথিত প্রাক্তন? পৃথিবীতে টাকা ছাড়া গাছের পাতাও নড়েনা। স্বার্থপর মানুষে ভরপুর এখন এই ধরা।যেখানে অকৃত্রিম বলতে যদি কিছু থাকে তা হলো বাবা মায়ের ভালোবাসা। দাদুর ডায়েরিটা পড়ে আমার বুকের ভিতর যে ঝড় উঠেছে তা জানিনা আমি কিভাবে থামাবো। এক অসহায় পিতার দুঃখ ভরা এই ডায়েরি। চোখ থেকে অনবরত পানি পড়ছে।আরো অনেক কথা লিখা।আর পড়ার শক্তি আমার নেই।দাদুরও ঘুম ভেঙ্গে গেছে।আমাকে দেখে শুধু তাকিয়ে আছে।এখন আর সেই গা ছমছমে ভাবটা কেটে গেছে ইচ্ছে করছে দৌড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরি।ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও উপায় নেই।আল্লাহ পাঁচিল তুলে দিয়েছেন আজ অনুভূতির মাঝে।সহ্য করতে পারছিলামনা এত্ত কষ্ট। ওয়াশরুমে গিয়ে খুব কাঁদলাম।
তারপর আবার ফিরে গেলাম এক অসহায় বাবার কাছে। কদিন পরের কথা।দাদু এখন আলহামদুলিল্লাহ পুরো সুস্থ।কদিন পরই ডিসচার্জ করা হবে। দুপুর একটার দিকে আমি উঁকি দেই দাদু কি করছে দেখতে।দেখলাম দাদু নোটবুকটাতে কি যেন লিখছেন।কেন যেন মনে হলো দাদু কাঁদছে।আমি ঢুকে পড়লাম।দেখলাম দাদু চোখ মোছার চেষ্টা করছে মানে আমার ধারণা সঠিক ছিলো।দাদু কাঁদছিলো।বাট এত্ত স্ট্রোং পারসোনালিটি যে আমাকে বুঝতেই দিলোনা কান্নার কথা।বুকের ভেতর তোলপাড় করছে।চলে গেলাম।আজকে রাতে যেভাবেই হোক দেখতে হবে নোটবুক। রাতে খুব চুপিসারে ঢুকে পড়লাম রুমে।দাদু ঘুমোচ্ছে।বয়স হয়েছে।ঘুম ভাঙ্গবেনা আশা করছি।নোটবুকটা নিয়ে পড়তে লাগলাম।
রায়হান, কেমন আছিস বাবা?বৌমা কেমন আছেরে?আমার দাদুভাই ইহান ভালো আছেতো?ওর কি এখনো ঠান্ডার লাগার ধাঁত?ও কি হাঁটতে পারে এখন?”দাদু “বলতে পারে বাবা?আচ্ছা তোরা আসিসনা কেন?জানিস আমার খুব ইচ্ছে করে তোদের দেখতে।কাল বাদে পরশু ঈদ।রায়হান, তোর মনে আছে?ছোট্টবেলায়,ঈদের চাঁদ দেখার সাথে সাথেই তুই পাড়ায় বাজি ফুটানোর জন্য বায়না ধরতি।আমি বলতাম চল,আমিও একটু বাজি ফুটাবো আজ।তোর মা বলতো,”যেমন বাপ তার তেমন ছেলে।আমার ছেলের যদি কিছু হয় তোমার খবর আছে!”আচ্ছা তুইকি এখন ইহানকে নিয়ে বাজি ফোটাস?নাকি ও জানেইনা বাজি কি?ইহানওকি তোর মতো বাবার হাত ধরে ঈদগাহ যায়?তুইও যেতি আমার সাথে।আমি যখন সিজদাহ্ দিতাম তুই তখন আমার কাঁধে উঠে বসে থাকতি।আমার যে কি ভালো লাগতো তখন জানিস?
তোর মা আমাকে পায়েস খেতে দিতোনা ডায়াবেটিস এর জন্য।আমি চুরি করে তোর বাটি থেকে নিয়ে খেতাম।মনে আছে তোর?রায়হান,বাবা,অনেকদিন হলো তোর বাটি থেকে আমি পায়েস খাইনারে।একটু দিবি ভাগ?বেশিনা বিশ্বাস কর মাত্র দু চামচ খাবো।পাক্কা প্রোমিজ।তোর মা ঈদের দিন অনেক খুশি থাকতো,সারাটাদিন চিল্লাতো মনে হতো কত কাজ সে করে ফেলছে।অথচ সে খুশিতেই চিল্লাতো।বাবা,একবার কি হয়েছিলো বলতো আমি তোর জন্য যে শার্ট কিনেছিলাম তার রং ছিলো সাদা আর আমার পাঞ্জাবীর কালার ছিলো নীল।তার জন্য তোর সেকি কান্না।তোর শার্ট কেন সাদা?নীল হতে হবে।অভিমান করে নামাজেও যাসনি।সেই ঈদের দিনই আমি তোকে নিয়ে মার্কেটে গিয়ে নীল শার্ট নিয়ে আসি। পাগল একটা।তারপর আর কখনো ভুল হয়নি বাবা।এই ৫০ টা বছর আমাদের ৫০ টা সেট ড্রেস ছিলো।এক রং,এক ডিজাইন,এক কোয়ালিটি। বাবা এখন আমার ৫৪ টা সেট হওয়ার কথা ছিলোরে।কিন্তু হচ্ছেনা।
৫০ টাতেই সীমাবদ্ধ হয়ে আছে।আমার খুব শখ ছিলো জানিস,আমি, তুই আর দাদুভাই একসাথে এক কালারের পাঞ্জাবি পড়ে নামাজ পড়বো,ঘুরবো।হলোনারে বাবা।তুই কিন্তু আমার মতোই ঘুরিস দাদুভাইকে নিয়ে।আমি চাইনা তোর ড্রেসের সংখ্যা ও আমার মতো কোনোদিন কমে যাক।আমি চাইনা,তুইও ছেলে মেয়েকে দেখার জন্য পথ চেয়ে বসে থাকিস।আমিতো জানি আমার ছেলেটা অত্যাধিক নরম মনের।তুই পারবিনা সহ্য করতে।জানিস বাবা,আমার এখনো একটা অভ্যাস থেকে গেছেরে।আমি এখনো রাত ১২ টায় জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়াই।তুইতো এই সময়ই বাসায় আসিস।অভ্যেসটা গেলোনারে বাপ।এবার ভেবেছিলাম আর ঈদ দেখবোনা।কিন্তু দেখা হয়তো হবে।করোনার মতো বিশ্রি রোগটারও আমার উপর রূচি ধরেনি বাপ।ফেলে রেখে গেলো।আরেকটা ম্যাচিং ড্রেস কমানোর জন্য।আজ তোর মাকে খুব মনে পড়ছে বাবা।মনে হচ্ছে এটাই আমার লাস্ট ঈদ।ভালোভাবে থাকিস বাপ,সবার খেয়াল রাখিস।আমার জন্য একটু পায়েস তুলে রাখবিরে বাপ?আমার এখানকার খাবার ভালোলাগেনা তোর বাটির পায়েসটাই আমি চাই।
২৪ মে ২০২০(দুপুর ১টা) জানিনা কষ্ট কি আমারই হচ্ছে।এরা কি মানুষ? এই মানুষটাকে রেখে কিভাবে এরা থাকে।আমি সইতে পারলামনা।আমি চোখের পানি মুছতে মুছতে ওনার ছেলের নাম্বার কালেক্ট করে তার ফেসবুক একাউন্ট খুঁজে বের করি।বেশি বেগ পেতে হয়নি আমার তাতে।স্বনামধন্য ব্যবসায়ী তিনি।তাকে কিছু বলিনি।শুধু দাদুর লেখাগুলোর কিছু ছবি সেন্ড করলাম ২৬ এপ্রিল, ২০২০ আমি,আমার হাজবেন্ড আর আমার শ্বশুর -শাশুড়ী দাদুকে সামনে নিয়ে বসে আছি।আমার হাজবেন্ডও একজন ডক্টর। আমাদের বিয়ে হয়েছে আজ প্রায় দুবছর।বাবা মাকে নিয়েই আমরা ঢাকাতে থাকি।দাদুকে ডিসচার্জ আমিই করিয়ে আনি।দাদু একবারও জিজ্ঞাসা করেননি কোথায় নিয়ে যাচ্ছি কেন নিয়ে যাচ্ছি?
শুধু নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে তাকিয়ে ছিলো হয়তো এই ভালোবাসাটুকুই সে অন্যভাবে পেতে চেয়েছিলো।দাদুর জন্য দীপ(আমার হাজবেন্ড)পাঞ্জাবি কিনেছেন।আমার শ্বশুর,দীপ ও দাদুর পাঞ্জাবি এক কালারের।সবাই বসে আছি,গল্প করছি।কিন্তু দাদু কোনো কথাই বলছেনা।আমাদের খুব খারাপ লাগছিলো।হঠাৎ কলিংবেল বেজে উঠলো।আমি দাদুকে ধরে তুলে দরজার সামনে গিয়ে দরজাটা খুললাম।দরজায় আর কেউ না মিস্টার রায়হান,দাদুর একমাত্র ছেলে দাড়িয়ে ছিলো।সাথে তার স্ত্রী আর নাতি ইহান।দাদুকে মুর্তির মতো দাড়িয়ে থাকতে দেখলাম।ওদিকে মিস্টার রায়হান আর তার স্ত্রী দাদুর পা জড়িয়ে কাঁদছে আর বলছে, “বাবা আমাদের ক্ষমা করে দাও প্লিজ,এবারের মতো ক্ষমা কতে দাও।আমরাতো ছোট ভুলতো করতেই পারি বলো।তুমি আমাদের ক্ষমা না করলে আমরা বাঁচতে পারবোনা বাবা।ক্ষমা করে দাও।”দাদু তাদের টেনে তুলে মিস্টার রায়হান কে জড়িয়ে বাচ্চাদের মতো হাউমাউ করে কেঁদে দিলেন।কেই কাউকে ছাড়ছেনা।বাচ্চাদের কাঁদছে দুজনে।
দাদু শুধু বলছে আমার রায়হান,আমার রায়হান।এই প্রথম দাদুর মুখে কথা শুনলাম।প্রায় ১০ মিনিট পেড়িয়ে গেলো এবার দাদু ইহানকে দেখে কোলে নিয়ে গগনবিদারী কান্না শুরু করলেন।” আমার দাদুভাই কেমন আছো তুমি,দাদুভাই আমার”। পাশ থেকে মিসেস রায়হান বলে উঠলো,”বাবা আজ আমি পরের মেয়ে বলে আমায় ক্ষমা করবেননা?(কান্না করতে করতে) দাদু তাকেও দুহাত জড়িয়ে ধরে বলে,”নারে মা,তোরা ভুল করবিই।ছেলেমেয়েদের আবার ক্ষমা কিসের মা।এতো শুধু অভিমানরে মা। গতকাল রাতে মেসেজ সিন হওয়ার আধাঘন্টায় মিস্টার রায়হান আমায় ফোন দেয়।কান্না বিজড়িয়ত কন্ঠে বলে,”পারমিশন ছাড়া ফোন দেয়ার জন্য সরি।আমার বাবা কোথায়।বলুন।আমি এক্ষুনি আসবো বাবার কাছে প্লিজ বলুন।আমি আর এই পাপের বোঝা বইতে পারবোনা”।
বাকিটা আমার প্লান মাফিক হয়েছে।এখন দাদু তার ছেলের আনা পায়েসের বাটিতে ছেলে,নাতি নিয়ে খাচ্ছে।পরম তৃপ্তিতে উদ্ভাসিত সবার মুখ।সাবা আন্টি আমেরিকাতে থাকায় ভিডিও কলে কথা বলে ভ বাবার কাছে ক্ষমা চেয়ে নিয়েছে।এখন আমরা কি করছি জানেন?এখন আমরা সবাই মিলে ছবি তুলছি বাবা,দীপ,দাদু,মিস্টার রায়হায়,ইহান এক কালার পাঞ্জাবিতে সেজেছে।এক ফ্রেমে বন্দি হলাম।দুটো নয় একটা পরিবার আমরা এখন।দাদুভাই আমাকে জড়িয়ে কান্না করছিলো শুধু আর? আর বলছিলো “তোর মতো মেয়ে যেন আল্লাহ প্রত্যেক দেশে একটা করে দেয় তাহলেই হবে। দেশে কোনো মানুষের কষ্ট থাকবেনা মা।প্রতি ঘরে না প্রতি দেশে তোর মতো একটা মেয়ে চাই আমি রাব্বুল আলামিনের কাছে।”
গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত