দুঘন্টা হতে চললো আজমল ভাই আমার লিভিং রুমে বসে আছেন। তিনি আমাকে গল্প শোনাতে এসেছেন, এবং তাঁর বসার ভঙ্গিই বলে দিচ্ছে আজ তিনি গল্প না শুনিয়ে যাবেন না।
আমি যন্ত্রনা তাড়াবার চেষ্টা করছি, টুকটাক গৃহস্থালি কাজ নিয়ে অতিরিক্ত ব্যস্ত হয়ে গেছি, তাঁর কথার জবাবে হু হার বেশি একটাও কথা বলছি না – তবুও তিনি অনড়। আমার ল্যাপটপে নিজের ফেসবুক প্রোফাইল দেখছেন, এবং কথা বলেই যাচ্ছেন।
আজমল ভাই খুবই ভাল মানুষ। মাই ডিয়ার প্রকৃতির ভদ্রলোক। কারোর সাথেই কোন ঝামেলা করেননা। সবার সাথেই হাসিমুখে গল্প করেন। তিনি আমাকে বেশ স্নেহও করেন। তবু আজকে ঘরে তাঁর উপস্থিতি অসহ্য লাগার কারন হচ্ছে অন্য একটা বিষয়ে আমার মেজাজ এই মুহূর্তে বিক্ষিপ্ত আছে, জিনিসপত্র ভাংচুর করতে ইচ্ছা করছে এবং ঠিক সেই সময়টাকেই তিনি বেছে নিয়েছেন আমার ফ্ল্যাটে এসে আমাকে গল্প শোনাবার। এবং তাঁর গল্প মানেই হলো “সত্যিকারের” ভূতের গল্প। তাঁর অমুক নিজে দেখেছে, তাঁর তমুক নিজে এক্সপিরিয়েন্স করেছে টাইপ ঘটনা। ঘুরে ফিরে সব এক কাহিনী – যত্তসব গাঁজাখুরি।
আমি তখনও বিয়ে করিনি, একা ফ্ল্যাট ভাড়া করে থাকি। প্রেমিকার সাথে লংডিস্টেন্স প্রেম চলছে। টেলিফোনে যোগাযোগ, যেখানে কথা হয় কম, ঝগড়া হয় বেশি। আজমল ভাইর ধারণা আমি একা একা দুঃখী হয়ে যেতে পারি, কাজেই তিনি আমার বাড়িতে এসে ঘন্টার পর ঘন্টার ভৌতিক গল্প শোনানোকে সমাজসেবা মূলক কর্মকান্ড হিসেবে গণ্য করেন।
“ফুল মেটাল জ্যাকেট সিনেমাটা দেখেছো? অসাধারন একটা সিনেমা। দেখে খারাপ লাগলে আমাকে বলো, আমি কানে ধরে তোমার সামনে দশবার উঠবস করবো।”
আমি বুঝে গেলাম কিছুতেই তাঁকে এভয়েড করা সম্ভব নয়। ভদ্রলোকের মনে গল্প না শুনিয়ে যাবার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই। কাজেই আমি একটা পর্যায়ে তাঁর সামনে এসে বললাম, “ঠিক আছে, শুরু করুন।”
“কী শুরু করবো?”
এইটাও তাঁর এক স্বভাব। তিনি ভাল করেই জানেন আমি কী শুরু করতে বলেছি। তবু তিনি চান আমি তাঁকে গল্প শোনাতে অনুরোধ করি।
“ঐ যে শাখাওয়াত হোসেনের গল্প শোনাতে চেয়েছিলেন না?”
“ও আচ্ছা, ঠিক ঠিক। খুবই ইন্টারেস্টিং একটা ঘটনা। বাস্তব। আমাকে শাখাওয়াত হোসেন নিজে বলেছে।”
আমি দীর্ঘশ্বাস চেপে গেলাম। সব ঘটনাই “ইন্টারেস্টিং,” সব ঘটনাই “বাস্তব” এবং সব ঘটনাই তাঁকে ব্যক্তি “নিজেই” শোনায়। তবু দেখা যায় ঘটনা ঘুরে ফিরে সেই লাশ উঠে বসেছে, কিংবা লাশ খাচ্ছে টাইপ। একই গপ্পো বারবার শুনতে আজমল ভাই বিরক্ত হন না?
“শাখাওয়াত হোসেনের জন্ম ঢাকায়, বিরাট ধনী পরিবারে। প্রচুর টাকা পয়সার মালিক ছিলেন তাঁর বাবা। ধানমন্ডিতে রাজপ্রাসাদ বানিয়ে থাকতেন। দুঁদে ব্যবসায়ী। বাজারকে একদম নিজের হাতের তালুর উল্টো পিঠের মতন জানতেন। যেখানেই হাত দিয়েছিলেন, সেখানেই সোনা ফলিয়েছেন। প্রচুর খাটতে পারতেন ভদ্রলোক। সাথে দুইনম্বরীও করতেন বেশ। তাইলেই বুঝো, একে পরিশ্রমী, তার উপর দুই নম্বরি, তিনি সাকসেসফুল হবেন না তো কে হবে? জামাইল্যার পোলা?”
প্রসঙ্গত বলে রাখি, জামাইল্যা হচ্ছেন আজমল ভাইয়ের বাবার নাম। আসল নাম জামালুদ্দিন তালুকদার, কিন্তু আজমল ভাই মাঝে মাঝেই তাঁকে জামাইল্যা বলে ডাকেন। সেই শৈশব থেকেই। মাঝে মাঝে পিতার সামনেই। এককালে এজন্য প্রচুর মার খেতেন, পরে তিনিও হাল ছেড়ে দিয়েছেন। কুকুরের লেজের মতোই কিছু জিনিস কখনই সোজা হবার নয়।
তাঁর গল্পে আমি শুধু হু হা করে যাই। এখানেও তাই করলাম।
“তো শাখাওয়াত হোসেনের জন্ম হয়েছিল একদম সোনার চামচ মুখে নিয়ে। তাঁর পিতামাতার তিনিই প্রথম সন্তান। এবং একমাত্রও। বাবা মায়ের বিয়ের ষোল বছর পরে তাঁর জন্ম হয়েছিল। কাজেই তাঁর প্রতি তাঁদের স্নেহ ছিল বাড়াবাড়ি পর্যায়ের। তাঁর কোন শখ মনে জাগলে সেটা সাথে সাথে পালিত হতো। ঘর ভরে গিয়েছিল খেলনায়, কমিক বইয়ে, ভিডিও গেমসে। পৃথিবীর এমন কিছুই ছিল না তাঁর বাবা কেনার যোগ্যতা রাখতো না। এবং পুত্রের মুখ থেকে কোন আবদার বেরুবার আগেই তিনি সেটা এনে হাজির করতেন।”
গল্প বলতে বলতে আজমল ভাইয়ের চোখ চকচক করছে। মনে হচ্ছে তিনি যেন নিজেকে শিশু শাখাওয়াতের স্থানে কল্পনা করছেন। পৃথিবীর সকল ধন সম্পদ ঐশ্বর্য্য চাহিবামাত্র তাঁহার পিতা তাঁহার সুম্মুখে আনিয়া হাজির করিতেছেন।
“আদরে বাদঁর হয়, এবং শাখাওয়াত হোসেনও পুরোপুরি বিগড়ে গেলেন। পড়ালেখা করেন না। সারাদিন বন্ধু বান্ধব নিয়ে আড্ডাবাজি। স্কুলের মাস্টাররা কিছু বলেন না, কারন তাঁর বাবা স্কুল ফান্ডের একজন বড়সড় ডোনার। মাও কিছু বলেন না। লেখাপড়া শিখে কী হয়? চাকরি? সেটাতো তাঁকে করতে হবেনা, তাহলে এত লেখাপড়ার দরকারটা কী? বাবার এত এত টাকা, কে খাবে?
টাকা থাকলে দেশে নষ্ট হওয়া ওয়ান টু। দুধের মাছির অভাব হয়না। বয়স হবার আগেই শাখাওয়াত হোসেনের আশেপাশে এসব মাছি ভনভন করতে শুরু করলো। মদ, জুয়া, মেয়ে মানুষ এমন কোন খারাপ অভ্যাস ছিল না যা তাঁর ছিল না। বাবা মা খুব একটা পছন্দ না করলেও তেমন কিছুই বলতেন না। তাঁদের পুত্রস্নেহ ছিল লাগামছাড়া।
একদিন নিকটাত্মীয়রা সব সমস্যার মহাসমাধান নিয়ে হাজির হলেন।
“ছেলের বিয়ে দিয়ে দাও। দেখবে, বৌ আসতেই সব বাজে অভ্যাস দূর হয়ে গেছে। পুরুষের জন্য মেয়ে মানুষের উপরে আর কোন ওষুধ আছে নাকি? হেহেহে।”
এবং যথাসময়ে এক অতি সুন্দরী ললনার সাথে তাঁর বিয়েও হয়ে গেল। টাকা পয়সা থাকলে, বুঝলে মঞ্জুর, বাঘের চোখও যেখানে মেলে, সেখানে সুন্দরী মেয়ে পাওয়াটাওতো ওয়ান টু। তাঁর বৌকে দেখলে আমরা সাধারণ পাবলিকতো পাবলিক, সিনেমার নায়কদেরও চোখ কপালে উঠে যাবে। হিংসে হবে কেন আমাদের বাবারা পরিশ্রমী আর দুইনম্বরীর কম্বিনেশন হলেন না!”
এইবারও আজমল ভাইয়ের চোখ চকচক করে উঠলো। অন্যের সুন্দরী স্ত্রীদের দেখে এমনিতেও যেখানে পুরুষদের চোখ চকচক করে উঠে, তিনিতো সেখানে তখনও ব্যাচেলর।
জ্বি, আজমল ভাই এখনও বিয়ে করেননি। তাঁর বয়স চল্লিশ পেরিয়ে গেছে, মাথায় টাক ধরেছে বহু আগেই। অ্যামেরিকায় এসেছিলেন ছাত্রাবস্থায়। বয়স তখন কুড়ি একুশ হবে। এসেই তাঁর মাথা নষ্ট হয়ে গেল। চারিদিকে সুন্দর সুন্দর মেয়ে ছোট ছোট হাফপ্যান্ট পরে ফর্সা পা দেখিয়ে ঘুরে বেড়ায়। বেশিরভাগই স্বাস্থ সচেতন। নিয়মিত বেয়াম করে, খেলাধুলা করে, দৌড়ায়। চেহারার নাক নকশার ত্রুটি শারীরিক গঠনের সৌন্দর্য্যের নিচে চাপা পরে যায়। এদের ফেলে তিনি কেন বাংলাদেশ থেকে রোগা শুঁটকি, কিংবা স্বাস্থবান মুটকি মেয়ে বিয়ে করতে যাবেন? একটাই জীবন। কার না শখ হয় সুন্দরী স্ত্রীর স্বামী হতে?
তো তিনি বাবা মায়ের সাথে রীতিমত বিদ্রোহ করে বসলেন তাঁকে বিদেশী মেয়ের সাথে বিয়ে দিতে হবে। মা বাবাও জেদ ধরে বললেন, যদি তাই হয়, তাহলে তিনি তাঁদের মরা মুখও দেখতে পারবেন না। তাঁকে ত্যাজ্য পুত্র ঘোষণা করা হবে।
দুপক্ষের এই দ্বন্দ্ব সমান তালে চলল। মাঝে দিয়ে আজমল ভাইয়ের পাকা চুলের সংখ্যা বাড়তে লাগলো। মাতা পিতা গত হতে হতে তাঁর বয়স চল্লিশ ছুঁয়ে ফেলেছে। এই বয়সে এসে তিনি তাঁর বয়সী “ফিট” বিদেশী নারী খুঁজে পান না। বেশিরভাগই অফিস জব করতে গিয়ে মুটিয়ে গেছে, প্রায় সবগুলোই বিবাহিতা। অন্যের বৌ ভাগিয়ে এনে বিয়ে করার পক্ষপাতী তিনি নন। যুৎসই বিধবা বা ডিভোর্সিও খুঁজে বের করতে পারেননা। কাজেই মেনেই নিয়েছেন, ইহজনমে তাঁর আর বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া হবে না।
“বৌ বাড়িতে উঠে এলো। তিনি কতটুকু শুধরালেন সেটা বলতে পারবো না, তবে বৌ ভালোই বিগড়ালো। সিগারেট ধরলো, সোশ্যাল ড্রিংকিং শুরু করলো, ক্লিভেজ ফোকাস করা টপ্স পড়তে শুরু করলো এবং প্রায় প্রতি রাতেই স্বামী স্ত্রী ঘুমাতে যাবার আগে গঞ্জিকা সেবন করতে শুরু করলো। এছাড়া এক্সটেসি, মেক্সটেসি জাতীয় পার্টি ড্রাগসতো ছিলই। চায়ের সাথে বিস্কিট খাবার মতোই ড্রিংকসের সাথে ওসব টপাটপ পেটে চালান হয়ে যেত। জীবনটাকে পুরা উরাধুরা পর্যায়ের উপভোগ যাকে বলে আর কি।”
অনেকক্ষন ধরে আমি কিছু বলছি না। তাই এইবার শব্দ করলাম, “হুম।”
তিনি গল্প চালিয়ে গেলেন। যদিও আমি নিশ্চিত নই কাহিনীর এত ডিটেইল কী শাখাওয়াত হোসেন সাহেব নিজে শুনিয়েছেন নাকি আজমল ভাই নিজে থেকেই যুক্ত করছেন। তিনি একজন ভাল বক্তা, এইটা আমি স্বীকার করি।
“একদিন তাঁদের বাড়িতে বিনা মেঘে বজ্রপাত হলো। শাখাওয়াত হোসেনের বাবা দেলোয়ার হোসেন স্ট্রোক করে পুরো ডান অংশ প্যারালাইজ্ড হয়ে গেলেন। বিছানার উপর পরে থাকা একটি বাড়তি ফার্নিচার ছাড়া তাঁর আর কোন ফাংশন ছিল না পরিবারে। এবং খুব এক্সপেন্সিভ ফার্নিচার। তাঁর চিকিৎসার পেছনে প্রতিমাসে লাখে লাখে টাকা খরচ হতে লাগলো। ব্যবসার অবস্থা তখন দশ ভূতে লুটে খাচ্ছে। শাখাওয়াত হোসেন তখন কোন অভিজ্ঞতা ছাড়াই ব্যবসার হাল ধরলেন। এবং তলোয়ার হাতে যুদ্ধক্ষেত্রে ঝাঁপিয়ে পড়ার মতন যেখানেই চোর ধরেছেন, সাথে সাথে ছাঁটাই করেছেন। ক্ষেত্র বিশেষে জেল। দেখা গেল অর্ধেকের বেশি পুরানো কর্মচারী বাদ পরে গেলেও ব্যবসা ডুবতে ডুবতে ঠিকই ভেসে উঠলো। পিতার পরিশ্রমী স্বভাবের ছিটেফোঁটা না পেলেও দুইনম্বরির সবকটা গুণ তিনি উত্তরাধিকার সূত্রে ঠিকই পেয়েছিলেন। কাজেই যেখানেই তিনি সুযোগ পেলেন, দুর্নীতি করতে শুরু করলেন। দুইহাতে টাকা ঢেলে প্রশাসনের মাথা কিনে ফেললেন। মন্ত্রী, এমপিদের বাড়িতে নিয়মিত মিষ্টির প্যাকেট ভর্তি টাকার বান্ডেল নিয়ে তাঁর লোক হাজিরা দিতে শুরু করলো। পিতার মতন পুলিশ, বা এইরকম চুনোপুটিতে টাকা পয়সা ঢালা বন্ধ করে দিলেন। উপর থেকে টেলিফোন আসতেই যখন সব হারাম কর্ম হালাল হয়ে যাচ্ছে, তখন শুধুশুধু ফালতু টাকা নষ্ট করার মানে কী? কস্ট কাটিং, বুঝলে? হাহাহা। তা ফুড চেইনের নিচের তলার মানুষেরা এতে ক্ষিপ্ত হলেও কিছুই করতে পারতো না। জলের কুমির, সাগরের হাঙ্গর সব তাঁর মিত্র। তবে এই পরিস্থিতিও বদলালো দ্রুত।
নির্বাচনে সরকার বদল ঘটলো। তাঁর পার্টির লোকজনের ভরাডুবি হলো। মন্ত্রীত্বতো দূর, প্রায় কেউই এমপিও হতে পারলো না। এদিকে ওদের প্রভাবে যারা এতদিন অত্যাচারিত হয়েছিল, তাঁরাই এখন ক্ষমতায় এসে প্রতিশোধ নেয়া শুরু করলো। বলেছি না, তিনি পুলিশ, সরকারি কর্মচারী কাউকেই ঘুষ দিয়ে খুশি করতেন না, কাজেই ওরাও এইবার নিজেদের ক্ষমতা প্রদর্শন শুরু করলো।
তাঁর রমরমা ব্যবসা বন্ধ হতে সময় লাগলো না। তাঁর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানাও জারি হলো। তবে তখন পর্যন্ত যেটুকু নেটওয়ার্কিং লিঙ্ক বাকি ছিল সেটা কাজে লাগিয়ে তিনি স্বস্ত্রীক নিউইয়র্কে পালিয়ে আসতে পারলেন। বর্তমানে তিনি নিউইয়র্কেই আছেন, এবং ট্যাক্সি চালান। দেখলে বুঝতেই পারবা না এই লোকটাই কী ভীষণ রকমের ধনী পরিবার থেকে এসেছেন! এক গাল দাড়ি রেখে ফুল মোল্লা হয়ে গিয়েছিলেন। নাইন ইলেভেনের পরপরই সেই দাড়িও কেটে ফেললেন, নাম বদলে শাখাওয়াত হোসেনের পরিবর্তে “স্যাম হোসে” হয়ে গেলেন। তাঁকে দেখতে আগে থেকেই ম্যাক্সিকান ম্যাক্সিকান লাগতো, এইবার নামেও ম্যাক্সিকান হয়ে গেলেন।
তা আজকের ঘটনা তাঁরই।”
আজমল ভাই বিরতি নিতে একটু থামলেন। আমিও একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে নিলাম। আমি যেন এতক্ষন জানতামই না আজকের ঘটনা শাখাওয়াত হোসেন সাহেবকে ঘিরেই। আমি ধারণা করেছিলাম কোন ফজলু মজলুর গল্প শোনাতেই এত লম্বা ভূমিকা টানা হয়েছে।
“তো শাখাওয়াত হোসেন সাহেবের তখন আর সেই রমরমা দিন নেই। দেশ থেকে টাকা পয়সা বলতে তিনি কিছুই আনেননি। দেশের ব্যাংক একাউন্টগুলোও সরকার জব্দ করেছে। বিনা চিকিৎসায় বাবার অসুস্থতা আরও বেড়েছে। স্বামীর সেবা করতে করতে মাও এখন শয্যাশায়ী। তিনি ট্যাক্সি চালিয়ে যা আয় করেন, তার থেকে নিজের পরিবার এবং দেশে মা বাবার খরচ চালাতে তাঁকে রীতিমত হিমশিম খেতে হয়। বলেছি কিনা ভুলে গেছি, তাঁর সংসারে তিন তিনটা সন্তানও এসে পড়েছে।
পিতা হবার পরে তাঁর মধ্যে দায়িত্ববোধ জেগে উঠেছে। আগের মতন নেশাদ্রব্য সেবন করেন না। প্রচুর পরিশ্রম করেন। এবং প্রায় প্রতিটা ক্ষেত্রেই সন্তানদের অপব্যয় না করার শিক্ষা প্রদান করেন।
তা একদিন তিনি ট্যাক্সি চালাচ্ছিলেন। যাত্রী নিয়ে গেছেন কুইন্স শহরে। সিদ্ধান্ত নিলেন জ্যাকসন হাইটসে তাঁর বাড়িতে ফিরে আসবেন। ঐদিকের কোন যাত্রী পেলে ভাল, নাহলে খালি ট্যাক্সি নিয়েই ফেরত আসবেন।
এমন সময়ে তাঁর ট্যাক্সিতে এক যাত্রী পেলেন যে ঐদিকেই যাবে। সাদা ভদ্রলোক। তিরিশ বত্রিশ বছর বয়স হবে। বাইরে ঠান্ডা বাতাস বইছে বলে একটি কোট চাপিয়ে ছিলেন, গাড়িতে ঢুকেই তিনি যেটা খুলে ফেলেছিলেন।
তুমিতো জানোই অ্যামেরিকানরা চুপচাপ বসে থাকতে পারেনা। যাত্রী ভদ্রলোকও গাড়িতে ঢুকে তাঁর সাথে কথোপকথন শুরু করে দিলেন। তাঁর নাম কী, তিনি কোথায় থাকেন, কতদিন হলো এই দেশে এসেছেন, কোন দেশ থেকে এসেছেন, ব্যাংলাদেশের কালচার কী ইত্যাদি সব বেশ আগ্রহের সাথেই জেনে নিলেন।
শাখাওয়াত ভাইয়ের কথা বলতে ইচ্ছে করছিল না, তারপরেও তিনি কথা চালিয়ে গেলেন। কথাবার্তা বলে প্যাসেঞ্জারের মন জয় করতে পারলে ভাল টিপ পাওয়া যায়। তাঁর পেশায় প্রতিটা বাড়তি পয়সা উপার্জনের গুরুত্ব অসীম।”
আজমল ভাই একটু বিরতি নিলেন। সম্পূর্ণ প্রসঙ্গ পাল্টে বললেন, “বাসায় আজ কী রান্না করেছো?”
আমি তখন মোটামুটি গল্পের মধ্যে আগ্রহ পেতে শুরু করেছিলাম। এইটা বুঝতে পেরেই হয়তো তিনি কাজটা করলেন। কাজটা তিনি প্রায়ই করেন। তাঁর গল্প বলার ট্রিক হতে পারে। টিভি অনুষ্ঠানে যেমন গুরুত্বপূর্ণ টুইস্টে বিজ্ঞাপন বিরতি চলে আসে, এক্ষেত্রেও যেন ব্যাপারটা তাই।
আমি বললাম, “ভাত আর ডাল গোশ্ত।”
“সেদিনওতো ডাল গোশ্ত রেঁধেছিলে, আজকেও একই ডিশ? বোর হও না?”
“প্রতিদিনতো আর এক খাবার রাঁধি না। মাঝে মাঝে চিংড়ি ভুনা, ডিম ভুনাও রাঁধি। আপনার ভাগ্য খারাপ, ডাল গোশ্তের দিনই আপনি কেবল আমার বাড়িতে আসেন।”
“এক তরকারি দিয়েই তোমার হয়ে যায়?”
“যত বেশি তরকারি, তত ঝামেলা। নিজেকেই রাঁধতে হয়, নিজেকেই ক্লিন করতে হয়। কে এত ঝামেলা করে?”
“বুঝেছি। তোমার একটা বিয়ে দেয়া জরুরি। তখন স্বামী স্ত্রী মিলে রান্না করবে। সময় থাকতেই এক শ্বেতাঙ্গিনীর গলায় মালা ঝুলিয়ে দাও। নাহলে আমার মতন আফসোস করে মরবে।”
মজা করে বললাম, “কিন্তু শ্বেতাঙ্গিনীর পরিবর্তে কোন কৃষ্ণাঙ্গিনীর প্রেমে যদি পরে যাই, তখন?”
তিনি বেশ সিরিয়াস স্বরেই বললেন, “দেখো ভাই, একটা কথা মাথায় ভাল মতন রেখে দাও। I might sound racist, কিন্তু এইটা ট্রু ফ্যাক্ট, কালোদের থেকে সাবধান থেকো। আমার জীবনে আমি যতবার বিপদে পড়েছি, প্রত্যেকবার কোন না কোন কাউলা কাজগুলি করেছে।”
আজমল ভাই অ্যামেরিকান-আফ্রিকান কালোদের কাউলা ডাকে। এখানের অনেক বাঙালিই তাই ডাকে। নিগ্রো উচ্চারণ করে কেউই মার খেতে আগ্রহী নন।
“একবার আমার এপার্টমেন্টে দরজা ভেঙে ডাকাত ঢুকলো। আমি ঘরেই ছিলাম। সাড়ে ছয় ফুট লম্বা, বিশালাকৃতির দুই কাউলা। কোন মুখোশ পড়াপড়ি নাই। দেখেই বুঝা যায় ড্রাগ ডিলার। মানুষ খুন করা ওদের কাছে কেএফসি খাবার মতোই ওয়ান টু। কোন ঝামেলা না করে আমি সোফার নিচে লুকিয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু হারামজাদা বদমাইশগুলি আমাকে সোফার নিচ থেকে টেনে বের করে পেটানো শুরু করলো। আরে হারামি! তোর ঘর লুটতে হয় লুটে নে। টাকা পয়সা ছিনতাই করতে হয়, ছিনিয়ে নে। আমিতো বাঁধা দিচ্ছিলাম না। আমাকে টেনে বের করে এনে মারধর করার কী দরকার ছিল?”
আজমল ভাই এমনভাবে ট্র্যাজিক কথাগুলো বলছেন, শুনে আমার প্রচন্ড হাসি পাচ্ছে। কিন্তু তিনি বেশ সিরিয়াস। তাছাড়া এই ঘটনায় হাসাহাসি করাটাও অন্যায়। তাই বহু কষ্টে হাসি চেপে রাখলাম।
কথা ভিন্ন প্রসঙ্গে চলে যাচ্ছে দেখে বললাম, “তা শাখাওয়াত সাহেবের ঘটনা বলছিলেন। তারপর কী হলো?”
তিনি বললেন, “সেটাতো বলবোই। চল আগে ভাত খেয়ে নেয়া যাক। ক্ষিধায় পেট চো চো করছে।”
আমি রাইসকুকার থেকে গরম গরম ভাত নামালাম। প্রেশার কুকার থেকে গরম গরম ডাল গোশ্ত। মুখে দিয়েই বুঝলাম অমৃত হয়েছে। আমি খুব বেশি রান্না বান্না পারি না, তবে যেগুলো পারি সেগুলোর মধ্যে চিংড়ি ভুনা এবং ডাল গোশ্ত অন্যতম। একবার খেলে বারবার খেতে ইচ্ছে করে।
আজমল ভাই খেতে খেতে অনেক কথা বললেন। তিনি কিভাবে একবার সমুদ্রের মাঝখানে সামুদ্রিক ঝড়ের কবলে পড়েছিলেন। এদিকে তাঁদের বহনকারী ট্রলারের তেল গিয়েছিল ফুরিয়ে। এবং কিভাবে উদ্ধার পেলেন।
কিংবা একদিন কিভাবে অ্যামেরিকান পুলিশ তাঁকে সন্ত্রাসী সন্দেহে থানায় নিয়ে গিয়েছিল, এবং সেখান থেকে তিনি কিভাবে মুক্তি পেলেন।
কিন্তু একবারের জন্যও শাখাওয়াত হোসেনের প্রসঙ্গ তুললেন না। ইচ্ছে করেই এই লম্বা বিরতি, নাকি এটাই তাঁর চারিত্র্যিক বৈশিষ্ট্য সেই ব্যাপারে নিশ্চিত নই।
খাওয়া দাওয়া শেষে প্লেট ধুতে ধুতে আবারও তিনি মূল গল্পে ফেরত গেলেন।
“তা শাখাওয়াত ভাইকে যাত্রী জানালো যে তাঁর নাম জন। জন্ম, বেড়ে ওঠা সব ব্রঙ্কসে। এনএফএলের বিরাট ফলোয়ার, নিউইয়র্ক জায়ান্টসের পাগলা ফ্যান। শাখাওয়াত ভাই তখনও অ্যামেরিকায় নতুন। এনএফএলের নিয়ম কানুন কিছুই জানেন না। শুধু বুঝেন যে সুপারবোলের দিন পুরো অ্যামেরিকা স্তব্ধ হয়ে যায়। আমাদের দেশে ফুটবল বিশ্বকাপ ফাইনালে যদি ব্রাজিল আর্জেন্টিনা খেলে – সেইরকম।
কথা বলতে বলতে তাঁরা নির্দিষ্ট গন্তব্যে চলে এলেন। যাত্রী ভাড়া মিটিয়ে দিলেন। ভালোই টিপস দিলেন। শাখাওয়াত ভাইয়ের মন ভাল হয়ে গেল। দুই ব্লক পরেই তাঁর বাসা। আজকের আয় ভালোই হয়েছে বলা চলে।
এই সময়ে তিনি লক্ষ্য করেন যে যাত্রী তাঁর কোটটি পেছনের সিটে ফেলে গেছেন। তিনি সাথে সাথে গাড়ি পার্ক করেন। কোট হাতে হেঁটেই সেই বাড়িতে পৌঁছান। পুরানো আমলের বাড়ি। চল্লিশ পঞ্চাশের দশকের নিশ্চিত। দরজা খুলে দিলেন এক বৃদ্ধ। তাঁকে দেখে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে বললেন, “ইয়েস? হাউ মে আই হেল্প য়ু?”
শাখাওয়াত ভাই জানালেন এই মাত্রই তাঁর গাড়িতে চড়ে যে যাত্রীটি এসেছেন, তিনি আসার সময়ে কোটটি ফেলে এসেছেন।
বৃদ্ধ ভদ্রলোক বেশ অবাক হলেন। তিনি পেছন ফিরে বললেন, “হানি, এই ভদ্রলোক বলছেন কিছুক্ষন আগে নাকি আমাদের বাসায় তাঁর একজন যাত্রী এসেছেন।”
ভিতর থেকে হানি, মানে ভদ্রলোকের বৃদ্ধা স্ত্রী জবাব দিলেন, “তুমি নিশ্চই ভুল করছো ডিয়ার, আমি সন্ধ্যা থেকেই এই চেয়ারে বসে আছি। আমাদের বাড়িতে কেউ আসেনি।”
শাখাওয়াত ভাই বেশ অবাক হলেন। তিনি নিশ্চিত তাঁর ভুল হয়নি। এই বাড়ির সামনেই তিনি নামিয়ে দিয়েছেন। ফ্রন্ট ইয়ার্ডে উইপিং চেরি গাছটা তাঁর চোখ এড়াবে কী করে?
বৃদ্ধ বললেন, “পাশের বাড়িও হতে পারে।”
শাখাওয়াত ভাই বললেন, “হতে পারে।”
কিন্তু তিনি নিশ্চিত তিনি ভুল নন।
“হ্যাভ আ ব্লেস্ড নাইট” বলে তিনি বেরিয়ে আসছিলেন, ঠিক এমন সময়ে বৃদ্ধ বললেন, “তোমার হাতের কোটটা একটু দেখিতো।”
শাখাওয়াত ভাই সাথে সাথে কোটটা এগিয়ে দিলেন।
বৃদ্ধ নিজের হাতে কোটটা নিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে শুরু করলেন। এবং যতই তিনি দেখছেন, ততই তাঁর চোখ বিস্ফোরিত হচ্ছিল। শাখাওয়াত ভাই ছাড়াও বৃদ্ধের স্ত্রীও সেটি লক্ষ্য করছিলেন।
“কী হয়েছে হানি?” বলে তিনি ইজি চেয়ার থেকে উঠে এলেন।
বৃদ্ধ নির্বাক, স্ত্রীর দিকে কোটটি এগিয়ে দিলেন। কোট হাতে নিয়ে স্ত্রীরও চোখ বিস্ফোরিত হলো।
“এই কোট তুমি কোথায় পেলে?” বৃদ্ধ জানতে চান।
শাখাওয়াত ভাই বলেন, “আমার ট্যাক্সির প্যাসেঞ্জার এই কোট ফেলে গেছেন।”
বৃদ্ধ বিড়বিড় করে বলেন, “কিভাবে সম্ভব?”
বৃদ্ধা ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করলেন।
শাখাওয়াত ভাই বললেন, “কেন, কোন সমস্যা হয়েছে?”
বৃদ্ধ বললেন, “তুমি যা বলছো সেটা যে একদমই অবাস্তব!”
শাখাওয়াত ভাই কিছু না বলে দাঁড়িয়ে রইলেন। কিই বা বলবেন বুঝতে পারছেন না।
বৃদ্ধার কান্নার বেগ বৃদ্ধি পাচ্ছে। বৃদ্ধ আপাতত নিজের বুড়ি স্ত্রীকে সামলাতে ব্যস্ত। চলে যাবেন কিনা ভাবছেন। আবার কিছু না বলে চলে যাওয়াটাও এদেশীয় সংস্কৃতিতে রুড কিনা বুঝতে পারছেন না। এরা কথায় কথায় আমাদের আচরণকে রুড বলে কিনা।
তিনি দাঁড়িয়ে রইলেন। বৃদ্ধ একটু সামলে উঠে নিজে থেকেই বললেন, “তুমি যে যাত্রীর কথা বলছো, সে দেখতে কেমন?”
শাখাওয়াত ভাই চেহারার বর্ননা দিলেন। নাম বললেন। বৃদ্ধার কান্না দ্বিতীয় দফায় বৃদ্ধি পেল। বৃদ্ধ বলছেন, “ছবি দেখলে চিনতে পারবে?”
শাখাওয়াত ভাই মনে মনে ভাবলেন কী যন্ত্রনায় পড়া গেল! আর যদি কোন যাত্রী কিছু ফেলে গেলে শালার জিনিস ফেরত দিতে গেছেন!
ভদ্রতার খাতিরে বললেন, “আমি সেইভাবেও লক্ষ্য করিনি, তবে চেনার চেষ্টা নিতে পারি।”
বৃদ্ধ দেয়াল থেকে একটি ফ্রেম নামালেন। চারজন যুবকের ছবি। স্টেডিয়ামে গেছে ফুটবল খেলা দেখতে। হাতে বিয়ারের মগ। পেছনে জার্সি দেখে বুঝা যাচ্ছে নিউইয়র্ক জায়ান্টসের খেলা। তিনি চার ছেলের ভিড়ে নিজের যাত্রীকে ঠিকই চিনতে পারলেন।
বৃদ্ধ আইরিশ, ত্বক এমনিতেই সাদা। কিন্তু এইবার একেবারেই রক্তশূন্য হয়ে গেল। তিনি ইজি চেয়ারে বসতে বসতে বললেন, “ও গড! এইটা কিভাবে সম্ভব হবে!”
শাখাওয়াত ভাইয়ের বাঙালি কৌতূহল জেগে উঠলো। তিনি এইবার সরাসরিই জিজ্ঞেস করলেন, “কী হয়েছে? কী সম্ভব, কিই বা অসম্ভব?”
বৃদ্ধ বললেন, “তুমি যে যাত্রীকে আজকে আমার বাড়ির সামনে নামিয়ে দিয়ে গেছ, সে আজ থেকে দশ বছর আগে মারা গেছে।”
শাখাওয়াত ভাই প্রথম ধাক্কা খেলেন।
“এবং যে কোটটা তুমি এনে দিয়েছো, সেটা পরেই তাঁর কবর হয়েছিল। ওটা তাঁর হাইস্কুলের টিম কোট ছিল, ভীষণ প্রিয় ছিল তাঁর।”
শাখাওয়াত ভাই রীতিমতন চমকে উঠলেন। কী যা তা ঘটনা! এইবার তিনি নিজেও বিড়বিড় করে বললেন, “কিভাবে সম্ভব! তোমরা নিশ্চিত এই কোটই সেই কোট?”
এইবারে বৃদ্ধা বলে উঠলেন।
“হ্যা, এই যে বুক পকেটে আমি নিজ হাতে সেলাই করে তাঁর আদ্যক্ষর লিখে দিয়েছিলাম। জে.সি। জনাথন চার্লস।”
শাখাওয়াত ভাইর মনে হলো তাঁর পায়ের নিচের মাটি দুলতে শুরু করেছে। এতদিন ভৌতিক গল্প কেবল শুনে এসেছেন। আজকে তিনি নিজে ভূতের সাক্ষাৎ পেলেন। তিনি পাশের চেয়ারে বসতে বসতে বললেন, “এক গ্লাস পানি খাওয়া যাবে?”
বৃদ্ধ বৃদ্ধা কেউই কিছু বললেন না। উঠলেনও না। একজন কোট জড়িয়ে কাঁদছেন, আরেকজন গভীর চিন্তায় ডুবে আছেন।
শাখাওয়াত ভাই বললেন, “তোমরা নিশ্চিত তোমাদের কোন ভুল হচ্ছেনা?”
এইবার বৃদ্ধ বললেন, “তোমার সন্তান আছে?”
“জ্বি।”
“তুমি তাহলে কিভাবে আমাদের উপর সন্দেহ করো? নিজের ছেলেকে যেই পোশাকে কবর দিয়েছি, আমরা সেই পোশাক ভুলে যাব?”
এরপর আর কোন কথা থাকেনা। শাখাওয়াত ভাই উঠে দাঁড়ালেন। পানির তেষ্টা তখনও যায়নি। তবে আর পানি চাইলেন না। বললেন, “আমি তাহলে আসি।”
বৃদ্ধ বৃদ্ধা বললেন, “নিজের যত্ন নিও।”
তিনি তাঁদের ঐ অবস্থায় ছেড়ে চলে এলেন।”
আজমল ভাই গল্প শেষ করে এক বিজয়ীর হাসি হাসলেন।
“কী ভয়ের না গল্পটা?”
বললাম, “ইন্টারেস্টিং, তবে ভয়ের না।”
“কী বলছো! এই গল্প কিভাবে ভয়ের না হয়ে পারে? একটা লোক সেই ব্রঙ্কস থেকে ড্রাইভ করে একটা মৃত মানুষকে বাড়িতে পৌঁছে দিলেন। তারপর তাঁর সেই কোট ফেরত দিতে এসে জানলেন দশ বছর ধরে সেই কোট একটা কবরে লাশের শরীর জড়িয়ে ছিল…..তোমাকে ভয় পাওয়াতে কী এখন ঘটনায় প্রেতাত্মা ফ্ৰেতাত্মা খুনখারাবি শুরু করে দিবে নাকি? অমাবশ্যার রাতে মানুষের রক্ত খাওয়া ক্যারেক্টারের ঘটনা না শুনলে বুঝি তুমি ভয় পাবা না? একে ফালতু গল্প কিভাবে বল?”
আজমল ভাই খুবই মর্মাহত হলেন বলে মনে হলো। তাঁর বিশ্বাস করা গল্প আমি বিশ্বাস করতে চাইছি না বলেই।
আমি বললাম, “ঘটনা ফালতু সেটাতো বলিনি ভাই। বরং বলেছি, ঘটনা খুবই ইন্টারেস্টিং। তবে ভয় না পাবার যথেষ্ট কারন আছে আমার।”
“শোনাও তবে শুনি।”
আমি একটু নড়ে চড়ে বললাম, “প্রথমেইতো বললেন ভাই সাহেবের নেশা টেশার অভ্যাস ছিল। যারা ফুলটাইম নেশারু, তাঁদের কিন্তু সহজে মুক্তি মেলে না। আমার ধারণা, তাঁর ব্রেন তাঁকে নিয়ে খেলেছে। তিনি স্বপ্নে ঘটনাটা দেখতে পারেন।”
“তাঁর পকেটে ঐ লোকটার দেয়া টিপ্স এলো কিভাবে?”
“তিনিতো ফুলটাইম ট্যাক্সি চালান। প্রতিদিন পঞ্চাশটা ট্রিপতো মারেনই। প্রতিটা যাত্রীর টিপসের কথা তাঁর আলাদা আলাদা মনে থাকবে?”
“না, কিন্তু মোটা টাকা টিপস দিলে অবশ্যই মনে থাকবে। আমার উদাহরণই নাও। আমাদের অফিসে প্রতি কোয়ার্টার এন্ডেই বোনাস দেয়া হয়। কিন্তু আমার এখনও মনে আছে ছয় বছর আগে একবার সেকেন্ড কোয়ার্টার এন্ডে আমার অফিস আমাকে চার হাজার ডলার বোনাস দিয়েছিল।”
আমি আর যুক্তি তর্ক বাড়ালাম না। আজমল ভাই সিরিয়াসলিই আধিভৌতিক জগতে বাস করেন। তাঁর আশেপাশের সব ঘটনাই পারলৌকিক। শুধু শুধু সেসব নিয়ে তর্ক করতে গেলে মাঝে দিয়ে শুধু শুধু তাঁর সাথেই সম্পর্ক নষ্ট হবে। বান্ধবহীন এই বিদেশ বিভূঁইয়ে একেকটা ভাল বন্ধু কোহিনূর হীরার চেয়েও মূল্যবান। কী দরকার ফালতু বিষয় নিয়ে সেই বন্ধুর সাথে ঝামেলা করে?
আজমল ভাই তাঁর মতন আড্ডাবাজি শেষ করে বাড়িতে চলে গেলেন। আমিও থালাবাসন ধুয়ে পরেরদিনের ক্লাসের জন্য হোমওয়ার্ক করে ঘুমাতে গেলাম।
কিছুতেই ঘুম আসছিল না। কোন কারন ছাড়াই কেমন যেন অস্থির অস্থির লাগছিল। লাইট নেভানো, ঘুটঘুটে অন্ধকার, আশেপাশে কোন শব্দও নেই – তারপরেও মনে হচ্ছিল আজ রাতটা নির্ঘুম কাটবে।
অনেকক্ষন শুয়ে থেকে জোর করে ঘুমানোর চেষ্টা করে বিফল হয়ে ল্যাপটপ খুলে বসলাম। বই পড়া যাক। এমন কোন গল্পের বই যা অত্যন্ত বিরক্তিকর হবে। এতে মন এবং চোখ দুটিই ক্লান্ত হবে। তাতে যদি কাজ হয়!
আমি পিডিএফ বই খুলেছি কেবল আর তখনই হঠাৎ বিদ্যুৎ চমকের মতন একটি ঘটনা আমার মনে এসে হানা দিল। কিছুদিন আগে আমি ইউনিভার্সিটিতে ক্লাস করছিলাম। এই দেশে আমার তেমন বন্ধু বান্ধব নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ে যাই ক্লাস করতে, ক্লাস শেষে দৌড় দেই কাজে। কাজ শেষে বাড়িতে ফিরে হোমওয়ার্ক অ্যাসাইনমেন্ট নিয়ে ব্যস্ত হয়ে যাওয়া। আড্ডাবাজির সময় কোই?
তারপরেও পাশাপাশি বসতে বসতে কারো কারো সাথে পরিচয় হয়েই যায়। বন্ধুত্ব না হলেও, সাধারণ কথাবার্তাতো হয়ই। অ্যাশলী গ্লোভার তাঁদেরই একজন।
মেয়েটি স্বর্ণকেশী, নীলাঞ্জনা, সুদর্শনা এবং সবচেয়ে বড় কথা – সুপার জিনিয়াস। প্রোগ্রামিং ক্লাসে আমি যেখানে একটা অক্ষরও বুঝতে পারতাম না এই মেয়ে সেখানে মুখে মুখেই সব প্রোগ্রামিং করে ফেলতে পারে। মাঝে মাঝে বুঝার জন্য তাঁর দ্বারস্থ হই। সে স্বাগ্রহে সাহায্য করে। একবারের জন্যও তাঁর ব্যবহারে প্রকাশ পায় না যে “এই সাধারণ বিষয়টাও বুঝোস না? বলদ নাকি? এইখানে কী করতেছিস? দ্যাশে ফেরত যা ব্যাটা গর্ধব!”
তো যা বলছিলাম,কিছুদিন আগে আমি ইউনিভার্সিটিতে ক্লাস করছিলাম। মানে ক্লাসে বসে ছিলাম, প্রফেসর আসতে তখনও সাত আট মিনিট বাকি। ছাত্রছাত্রীরা ক্লাসে আসতে শুরু করেছে। যে যার সিটে বসে যাচ্ছে। প্রসঙ্গত বলে ফেলি, এই দেশে ক্লাসের প্রথম দিন যে যেখানে বসে, পরের দিনগুলোতেও দুনিয়া উল্টেপাল্টে না গেলে তাঁরা আসন পরিবর্তন করে না। আসনগুলোর যেন অলিখিত মালিকানা পেয়ে যায় সবাই।
তা আমি আমার আসনে বসে আছি। অ্যাশলি এসে নিজের আসনে বসলো। এবং একটি খাম ধরিয়ে দিল।
আমি বললাম, “কী আছে এতে?”
বললো, “আমি জানিনা। একটি ছেলে দিয়ে গেল।”
আমি অবাক হলাম। খাম খুললাম। তা থেকে পাঁচশো ডলার বেরুলো। আমার চোখ কপালে উঠে গেল।
“কে দিয়েছে চেন তাঁকে?”
“না। আফ্রিকান অ্যামেরিকান এক ছেলে ছিল। তোমার নাম মেনশন করে বলল তোমাকে দিতে। সাথে বললো দিতে দেরি হওয়ায় ও আন্তরিকভাবেই দুঃখিত।”
আমি কিছুতেই বুঝতে পারছি না ঘটনা কী। পাঁচশো ডলার অনেক টাকা। আমার এক মাসের এপার্টমেন্ট ভাড়া! এই দেশে কেউ কাউকে শুধুশুধু এত বিপুলাংকের টাকা ধরিয়ে দিবে না। অ্যাশলি নিজেও কাজটি করবে না। সে বেচারি ছাত্রী মানুষ। একটা রেস্টুরেন্টে কাজ করে পড়ালেখা আর অন্যান্য খরচ চালায়। তাঁর নিজেরও নুন আনতে পান্তা ফুরায় অবস্থা।
“কী আছে ওতে?”
আমি পাঁচটা একশো ডলারের নোট দেখালাম। সে চোখ বড় বড় করে বলল, “তুমিতো বড়লোক হয়ে গেলে! বাহ্!”
“হ্যা, কিন্তু কে দিয়েছে সেটাওতো জানার দরকার।”
অ্যাশলি বলল, “তোমার যদি নিতে সংকোচ হয়, তাহলে আমাকে দিয়ে দিতে পারো। আমার কোনই আপত্তি নেই পাঁচশো ‘bucks’ নিজের পকেটে পুড়তে।”
আমি আমার পকেটে টাকাগুলো চালান করে দিলাম। মাথায় তখনও চিন্তা ঘুরছে।
এখন হঠাৎ মনে পড়লো। তিন বছর আগে আমি এক আফ্রিকান অ্যামেরিকান বন্ধুর কাছে (ব্রায়ান হান্টার) বাকিতে একটা ল্যাপটপ বিক্রি করেছিলাম। শিপ করে দিয়েছিলাম ল্যাপটপ, কিন্তু ছেলেটি টাকাটা ব্যাংকে জমা দিতে পারেনি। বলেছিল একমাস পরেই দিবে। কিন্তু দুই তিন সপ্তাহের মধ্যেই অ্যাকসিডেন্টে ছেলেটি মারা যায়। বাঙালি সেন্টিমেন্টের কারনে আমি আর ছেলেটির মা বাবার কাছে ল্যাপটপের দাম চাইতে যাইনি। মৃতের কাছে দাবি রেখেও লাভ নাই। তাই দেনা মাফ করে দিয়েছি। কেউ জানেনা আমি তাঁর কাছে এত টাকা পাই।
এই ঘটনার সাথে সেই ছেলেটি যুক্ত নাতো? অ্যাশলির ভাষ্যমতে টাকাটাতো এক আফ্রিকান অ্যামেরিকান ছেলেই দিয়ে গেছে।
চিন্তাটা মাথায় ঘুরপাক খেতে লাগলো। রহস্যটা তালগোল পাকিয়ে গেল। তাহলে কী নিউইয়র্কের ট্যাক্সিড্রাইভার ভাই, কী যেন নাম ছিল? শাখাওয়াত হোসেন? তিনিও কী আমার মতোই কোন ঘটনার শিকার? তাহলে কী আজমল ভাইয়ের মতবাদই সঠিক? পৃথিবীতেই রহস্যময় ঘটনা ঘটে?
আমি তড়িৎ গতিতে বিছানা ছেড়ে উঠে অ্যাশলিকে ফোন দিলাম। যদি সে সেই ছেলেটির চেহারা মনে করতে পারে। ব্রায়ানের ঠোঁটের নিচে বাঁদিকে একটা সেলাইয়ের দাগ ছিল। কখনই জিজ্ঞেস করিনি কিভাবে ঐ দাগটা চেহারায় এলো। ব্যক্তিগত প্রশ্ন জিজ্ঞেস করা এই দেশে পরম অসভ্যতা গণ্য করা হয়। অ্যাশলির হাতে যদি ব্রায়ানই টাকাটা দিয়ে থাকে, তাহলে অবশ্যই ব্রায়ানের ঠোঁটের নিচের কাটা দাগটা তাঁর চোখে পড়বে। কোনই চান্স নেই মিস হবার।
ওপাশে রিং যাচ্ছে। ক্রিংক্রিংক্রিং। আমি বিড়বিড় করে বললাম, “পিক আপ দ্য ফোন অ্যাশলি! পিক আপ দ্য ড্যাম ফোন!”
গল্পের বিষয়:
গল্প