মোটরসাইকেলের এক্সিলারেটর হঠাত বাড়িয়ে দিলে ভুমভুম শব্দ হয়। সেই শব্দে মনু মিয়ার ঘুম ভেঙে গেছে। প্রায় তিনমাস পর এরকম শব্দে তার ঘুম ভাঙল। অবশ্য গ্রামের একটা চায়ের দোকানদারের রাত দুইটায় সচরাচর ঘুম ভাঙে না। মনু মিয়া একটা নিরিবিলি গ্রামের বাসিন্দা আর পেশায় চায়ের দোকানদার।
প্রায় দুইবছর আগের ঘটনা। যথারীতি রাত দশটায় দোকান বন্ধ করে ঘুমিয়ে পড়ল। সে বিপত্নীক তাই বেশিরভাগ রাতে সে দোকানে থাকে। বিশেষ দরকার ছাড়া সে বাড়ি যায় না। দোকান বন্ধ করে সে তার ক্যাসেটপ্লেয়ারে মমতাজের গান শুনে। যৌতুক হিসেবে বিয়ের সময় এটা সে পেয়েছিল। জাপানি ক্যাসেটপ্লেয়ার তাই এতদিনে একবারও নষ্ট হয়নি। সারাদিনের ক্লান্তিতে সে কিছুক্ষণের মধ্যে ঘুমিয়ে পড়ল। আনুমানিক রাত দুইটার দিকে দোকানের দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ শুনল। ঘুমঘুম চোখে দেখল বড়বড় চুলদাড়িওয়ালা এক যুবক কালোচশমা পরে দাঁড়িয়ে আছে।
-কী চাই, বাবা? ছেলেটা মোটাগলায় বলল, চা খাওয়াতে পারবেন? মনু মিয়া যতটা না বিরক্ত হল, তারচেয়ে বেশি অবাক হল। বলল, বসেন। আমি চুলা জ্বালাই। নেন, বিস্কুট খান।
-সিগারেট দেন। বিস্কুট লাগবে না।
চা তৈরি করতে করতে ছেলেটা তিনটা সিগারেট শেষ করল। পরপর তিন কাপ চা খেয়ে মনু মিয়াকে একটা খাম দিল। ছেলেটা চলে যাওয়ার পর খাম খুলে দেখে তাতে দুইহাজার টাকা। টাকা পেয়ে মনু মিয়ার খুব আনন্দ হল। কেন না, মনু মিয়া এক মাসে দুইহাজার টাকা আয় করতে পারে না। সে মাঝরাতে তিনকাপ চা বিক্রি করে দুইহাজার টাকা পেল।
পরদিন সকালে খোশমেজাজে দোকান খোলে সে। সে সবাইকে রাতের ঘটনা বলার অপেক্ষায় থাকে। কিন্তু হঠাৎ খুব চেঁচামেচি শুনতে পায়। স্কুলের মাঠে কে নাকি খুন হয়েছে। মনু মিয়ার কিঞ্চিৎ সন্দেহ হয় মাঝরাতে আসা ছেলেটার প্রতি। কিন্তু ভয়ে সে কাউকে কিছু বলে না। এরকমভাবে ছেলেটা প্রায় দুচারমাস পর আসে। আর ছেলেটা আসলেই এলাকায় কোন দুর্ঘটনা ঘটে। মনু মিয়ার সন্দেহ বিশ্বাসে পরিণত হয়। আজও সেই ছেলেটা এসেছে। মনু মিয়া ছেলেটার নাম জানে না। দরজা খুলে বলল, বাইক রাইখা বসেন। চুলা জ্বালাইতাছি। ছেলেটা বেঞ্চে হেলান দিয়ে গা এলিয়ে বসল। প্রতিবার মনু মিয়া ছেলেটার সাথে কথা বলার চেষ্টা করে কিন্তু ছেলেটা কোন কথা বলে না। কিছু জিজ্ঞেস করলে জবাব দেয় না। আজ ছেলেটা জিজ্ঞেস করল, চাচা কেমন আছেন? প্রথমদিনে ছেলেটার কণ্ঠে কেমন রুক্ষতা ছিল কিন্তু আজ কেমন যেন দরদমাখা লাগছে।
-ভাল আছি।
-আচ্ছা, এই গ্রামে নজরুল মাস্টারকে চিনেন?
-চিনব না কেন? বড় ভাল মানুষ ছিলেন। সবাই তাকে মাস্টারজি বলত। চেয়ারম্যানের সাথে একটা বিষয়ে তার গ্যাঞ্জাম হয়। এর কিছুদিন পর দিনেদুপুরে স্কুল থেকে ফেরার পথে কে বা কারা তাকে খুন করে চলে যায়।
-মাস্টারের পরিবার?
-বাবা, মাস্টার না, বলেন মাস্টারজি।
তাকে মাস্টারজি না বললে অসম্মান করা হয়। তার পরিবার বলতে এক ছেলে আর এক মেয়ে। তাঁর মৃত্যুর কয়েকদিন পর তাঁর স্ত্রী স্ট্রোক করে মারা যান। মেয়েটাকে বিয়ে দিয়েছিলেন আগে। তারা এখন বিদেশ থাকে। আর কপালপোড়া ছেলেটা তখন ভার্সিটিতে লেখাপড়া করত। মাস্টারজির মৃত্যুর খবর শুনে ছেলেটা এসেছিল। এরপর যে গেল, আর কোনদিন ফিরল না। কোথায় আছে, কী করছে কেউ জানে না। আহারে বেচারা! বলতে বলতে মনু মিয়া বড় করে নিঃশ্বাস ছাড়ল। আচ্ছা বাবা, আপনি কে? আর আপনি আসার পর প্রত্যেকবার গ্রামে একটা খুন অথবা বড় কোন ঘটনা ঘটে। অবশ্য খারাপ লোকগুলোই খুন হয়। আমার তো মনে হয়… মনু মিয়া নিজের কথায় নিজেই অবাক হল। তার তো অনেক সাহস হয়েছে। এমন একটা হিংস্র লোকের সামনে এভাবে কথা বলছে।
ছেলেটা কিছু বলল না। ততক্ষণে চা তৈরি হয়েছে। পরপর তিনকাপ চা খেয়ে উঠে বলল, আজ টাকা দিতে পারব না চাচা। আমি উঠি। ভুমভুম শব্দ করে মোটরসাইকেলে করে ছেলেটা চলে গেল। মনু মিয়ার কিঞ্চিৎ মন খারাপ হয়েছে। তারপরও লস হয় নাই। এপর্যন্ত ছেলেটা অনেক টাকা দিয়েছে। মনু মিয়া শুয়ে পড়ল। ঘুমের মধ্যে শুনতে পেল মসজিদে ফজরের আজান দিয়েছে। ঠিক তখনই আবার দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ পেল। দরজা খুলে দেখে ছেলেটা। সে বলল, প্রতিবার অন্যদের কাছ থেকে আপনি খবর পান যে কেউ খুন হয়েছে। আজ আপনি খবর দিবেন সবাইকে যে চেয়ারম্যান খুন হয়েছে।
মনু মিয়া ভয় পাচ্ছে। ছেলেটা তাকে এবার একশত টাকার একটা বাণ্ডিল দিল। সাথে একটা কাগজ। বলল, এখানে আমার পরিচয় লেখা আছে। মনু মিয়া টাকা আর কাগজটা হাতে নিয়ে থ হয়ে বসে পড়ল। ছেলেটা চলে গেল। মনু মিয়া কাউকে খবর দিল না। অন্যদিনের মত চেঁচামেচি শুনতে পেল। তার অন্য একটা ভয় হচ্ছে। সে লেখাপড়া না জানায় কাগজটা পড়তে পারল না। অন্য কাউকে দিয়ে পড়াবে সে সাহস পেল না। ছেলেটা তার কাছে এক আততায়ী আতঙ্ক হয়ে রয়ে গেল।
গল্পের বিষয়:
গল্প