চোখজোড়া বুঁজেই ছিলাম, হঠাৎই মাথায় একটি শীতল স্পর্শের ছোঁয়া অনুভব করলাম। আমি চোখ মেলে তাকালাম না। কিছু সময় পর বুঝতে পারলাম কেউ একজন বেশ যত্ন করে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে।তাঁর আংগুলের ডগা যখন মাথার চুল ভেদ করে মাথার ত্বকে গিয়ে ঠেকলো আমি হচকচিয়ে চোখজোড়া মেলে তাঁকালাম।
আমার দৃষ্টি ঝাপসা, আবছা আবছা চাহনিতে আমি দেখতে পেলাম একজন মহিলা আমার মাথায় ক্রমাগত হাত বুলিয়ে যাচ্ছেন। আমি তখনো শুয়ে, চোখজোড়া বেয়ে ডানেবামে টপটপ ফোঁটা গড়িয়ে পড়ছিলো। আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম না সেই মমতাময়ী মহিলার চেহারাখানা! কে সে? কেনো এতটা কাছে আমার? যেখানে বাকিরা আমায় বিষাক্ত ঘোষণা করে আমায় ঠাঁই দিয়েছে এককৌণে। আমার শ্বাস, আমার স্পর্শ,আমার বুলিতেও নাকি বিষ ছড়িয়ে পড়তে পারে, আর সেখানে এই মহিলা আমার শিয়রের পাশে বসে আমার মাথায় প্রশান্তির ছোঁয়া বুলিয়ে যাচ্ছেন। আমি আবারো চোখ বুঁজে ফেললাম। আমার ভালো লাগছে,বেশ ভালো লাগছে। চারদিকে কেমন যেনো এক সুঘ্রাণ ছড়িয়ে পড়েছে। হঠাৎ শুনতে পেলাম,
-“তুই কি খুব কষ্টে আছিস বাবু?” মহিলাটির ছোঁয়ার মতই তার কণ্ঠেও যেনো একরাশ প্রশান্তি মিশে ছিলো, তবে এই কণ্ঠ আমার চেনা ঠেকছে। আমার ভাবনার ঘোর কাঁটাতে তিনি আবারো বলে উঠলেন,
-“আমায় চিনতে পারিস নি বুঝি? আমি তো তোর জননী! চেয়ে দেখ বাবু, আজ আমি তোর খুব কাছে। আমি তো তোর জননী ” কথাটি যেনো আমার রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছেঁয়ে গেলো! আমি আবারো চোখ মেললাম। কিন্তু এবার সেই মহিলাটির মুখশ্রী স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম আমি। এই মুখশ্রী আমি অতবার দেখিনি, শেষ বার দেখেছিলাম সাড়ে বারো বছর আগে। তবে এখনো ঠিক তেমনি আছে এই চেহারাটি। একটুও বদলায়নি, অথবা বদলালেও আমি বুঝে উঠতে অক্ষম। চোখজোড়ার পাশ বেয়ে গড়িয়ে পড়া জলস্রোত আরো তীব্র হলো, কাঁপাকাঁপা কন্ঠে আমি তাঁর উদ্দেশ্যে বললাম,
-“আপনি আমার জননী??মানে আমার জন্মদায়িনী? সত্যিই কি তাই?”- তিনি মাথা নাড়ালেন,হ্যাঁ সূচক। স্মিত হেসে বললেন,
-“হ্যাঁ সত্যিই।”- তাঁর প্রতি আমার এক হিমালয় সমান অভিমান আর অভিযোগ জমা ছিলো। হিমালয়ের হিমের ন্যায় যেনো আজ তা গলছে, আমি কাতর কণ্ঠে বললাম,
-“আপনি ছোঁবেন না আমায়, আজ কি অধিকারে আপনি আমার শিয়রে? কেনো আজ একযুগ পরে নিজেকে আমার জননী দাবী করছেন? আপনি আমার কেউ নন, আমি মা’হীনা। শুনছেন তো!”- আমার কাতর কণ্ঠেও আক্রোশের ঝংকার ছিলো। তিনি উত্তরে স্মিত হাসলেন, আবারো আগের মত প্রশ্ন করলেন,
-“তোর কি খুব কষ্ট হচ্ছে? খুব কি একা পড়ে গিয়েছিস?”- কথাখানা যেনো আমায় দূর্বল করে দিলো। আমি অশ্রুসিক্ত চাহনি রেখে বললাম,
-“হ্যাঁ, আমার প্রচন্ড কষ্ট হচ্ছে প্রচন্ড! আর একাকিত্ব যেনো চার দেয়ালে আবদ্ধ করে নিয়েছে আমায়। সবাই দূরত্ব বজিয়ে রাখছে, আমি নাকি বিষাক্ত হয়ে উঠেছি। আজকাল কাউকেই আপন ভাবতে পারিনা। তবে দূর প্রান্তে কেউ একজন আছে, যার এক শব্দের “ভালোবাসি” আর চার লাইনের একটি বার্তাতেও যেনো আমি সাহস পাই। আমি নিজেকে অনন্য মনে করি। সে দূর প্রান্তে দাঁড়িয়েও আমায় একা হতে দেয়নি, অথচ আমার কাছেপিঠের, আপনজনেরাই আমায় একা করে দিলো। আর তার মাঝে অন্যতম আপনি। যে তো আমাকে আমার শৈশবেই একা করে দিয়েছিলো। তাহলে আজ কেনো সামনে এলেন?”- মহিলাটি চুপ করে রইলেন। কোনো উত্তর নেই তার। ঠোঁটের কোণে লেপ্টে থাকা স্মিত হাসিটিকে আজ আমার বিদ্রুপ ও ঠাট্টার ছলের ন্যায় লাগছে। তিনি অনবরত আমার মাথায় হাত বুলিয়ে যাচ্ছেন। আমি আরো একরাশ রাগ ঝাড়লাম। এই একপাক্ষিক কথপোকথনের এক পর্যায়ে তিনি উচ্চস্বরে হেসে উঠলেন। আমার কানে ফিসফিসিয়ে বললেন,
-” এই একাকিত্ব একদিন ঘুচে যাবে তোর, আমি জানি আমার উপর তুই এক ঝাঁপি ঘৃণা জমিয়ে রেখেছিস, হতেও পারে আমায় খুন করতে তোর হাত কাঁপবে না। তবে একটা কথা যে চিরন্তন সত্য, আমিই তো তোর জননী, তোর জন্মদায়িনী।। তুই চাইলেও যে এই সত্য বদলাতে পারবি না,অস্বীকার করতে পারবি না। “- বলেই তিনি আবারো হাসলেন। আমার রাগ দ্বিগুণ বেড়ে গেলো। হঠাৎই যেনো পুরো শরীর ঝাঁকুনি দিয়ে উঠলো! পশ্চিমা জানলার এক দমকা বাতাসের সাথে সাথে আমার চোখজোড়া এবার স্পষ্টভাবে খুলে গেলো। প্রচন্ড অসুস্থতা আর অপারগতা নিয়ে আমি উঠে বসলাম। পুরো ঘরজুড়ে আমি ব্যাতিত আর দ্বিতীয়জন কেউ নেই। তবে কি সেই মহিলাকে আমি স্বপ্নে অনুভব করছিলাম?
মস্তিষ্ককে কিছুটা স্তব্ধ করে নিয়ে ভাবলাম সত্যিই স্বপ্ন ছিলো। মহিলাটি আমার জীবনের চৌহদ্দি হতে বেশ দূরে, এর ছায়া এবং ছোঁয়াও আমার জন্যে দূর্লভ! ভেবেছিলাম স্বপ্নে এসে হয়তোবা তিনি নিজের জন্যে ভালোবাসা কুড়িয়ে যাবেন। তাও পারলেন না তিনি। আমার সূক্ষ্ম মনে আরো এক চিলতে ঘৃণা ভরে দিয়ে গেলেন। তিক্ত হলেও সত্য, কিছু জননীরা মমতাময়ী নন। কিছু জননীরা আঁচলের ছায়ায় সন্তানকে আগলে রাখতে পারেন না। তাদের মধ্যে আমার জননী অন্যতম! “”জন্মদায়িনী হলেই জননী হয়ে উঠা যায় না। আর জননী হতে হলে জন্মদায়িনী হবার প্রয়োজন হয়ে উঠে না।””
গল্পের বিষয়:
গল্প