গ্রামের বাড়ি যাচ্ছি। বিয়ে করা নতুন বউ নিয়ে। পালিয়ে বিয়ে করলাম। এখন আব্বা-আম্মাকে বউ দর্শনের জন্যে রওনা দেয়া। রাত বাজে প্রায় ১টার মতো। নীলা(আমার বউ) বাচ্চাদের মতো শুরু করেছে। সে নাকি খালি পায়ে মাটিতে হাটবে। সাপ-খোপের ভয় দেখিয়েও কাজ হলো না।
এই মেয়েটার পাগলামী সহ্য করে আসছি প্রায় চার বছর ধরে। জ্বালিয়ে মারে। আমারো অবশ্য জ্বলতে ভালোই লাগে। ক্যাম্পাসে যেদিন প্রথম দেখা সেদিনও নাকি জ্বালাতেই এসেছিলো। বন্ধুরা সবাই একসাথে বসে গান গাচ্ছিলাম, কোত্থেকে যেন এসে আমাদের সাথে বসে পড়লো। গান শুনবে। সেই থেকেই কবিতা আর গান শুনিয়ে আসছি। যেদিন আমাকে বললো বাকিটা জীবন আমার গান আর কবিতা শুনেই পার করে দিতে চায়, আমি মানা করতে পারিনি।
ছন্দহীন কবিতা আর বেসুরো গলায় গাওয়া গানের একজন পারমানেন্ট শ্রোতা কে না চায় ? সেই থেকেই একসাথে দুজন জীবনের নৌকো ভাসিয়েছি। হাজারো স্বপ্ন দিয়ে বোনা পাল খাটিয়েছি নৌকোতে। তরতর করে এগিয়ে গেছে নৌকা। ঝড়ের কবলে যে একবারো পরিনি, তা না। অনেক ঝড়ের সাথে একসাথে লড়েছি। শেষমেশ বিশাল এক ঘূর্নিঝড়ের মোকাবেলা করে আজ গন্তব্যে পৌছুলাম। বিয়ের বন্ধনে সারাজীবনের জন্যে বন্দি করলাম নিজেদের। এখন সুন্দর কোনো দ্বীপে নৌকো ভিড়ানোর পালা। তাইতো আজ গ্রামের রাস্তায়, বাড়ির পথে হাটছি। কিছুদূর যাওয়ার পর হঠাত মাটিতে পা দিয়েই অস্ফুট একটা শব্দ করে মাটিতেই বসে পড়লো নীলা। পায়ে কাটা বিঁধেছে। অগ্যতা আমাকেও বসতে হলো। নীলার পা আমার কোলে তুলে নিয়ে কাটাটা বের করে জোর করে জুতো পরিয়ে দিলাম। মোবাইলের আলোয় পথ দেখে দেখে আবারো চলতে লাগলাম।
মোবাইলটার দিকে তাকিয়ে বাবুকে মনে মনে হাজারটা ধন্যবাদ দিলাম। বাবু এই মোবাইলটা না দিলে আজকে নীলার পায়ের কাটা তোলা ছাড়াও আরো অনেক সমস্যায় পড়তে হতো। আমারটাতো বিক্রি করে দিয়েছি সেই সকালেই। পুরো টাকাটা কাজী অফিসেই খরচ হয়ে গেছে। বজ্জাত কাজী গুনে গুনে পাঁচটা হাজার টাকা রেখেছে। আর আমাকে করেছে ফকির। তাও বন্ধু-বান্ধব থাকায় এ যাত্রা বেঁচে গেছি। নয়তো হাতের ঘড়িটাও খুলে দিতে হতো। কাজী অফিসে বিয়ে করার সময় ছাত্রদের সুবিধার জন্য স্টুডেন্টস পলিসি চালু করা খুব জুরুরী। যাতে আমার মতো ভ্যাগাবন্ড ছাত্ররা কম খরচে বিয়ে করতে পারে। বিয়ের খবর শুনে আধ ঘন্টার মধ্যে বন্ধু-বান্ধব সবাই এসে হাজির হয়েছে। ক্যামেরা এনে ছবি-টবি তুলে হুলস্থুল কান্ড। বিবাহ কার্যসম্পাদন হওয়ার পর সবাই জিজ্ঞেস করলো, এর পরের প্ল্যান কি ? কোথায় যাবো ? বললাম, “তোরা নিশিন্ত থাকতে পারিস। আমি আর নীলা আজ রাতের ফ্লাইটেই সুইজারল্যান্ড যাচ্ছি। অলরেডি টিকেট কাটা হয়ে গেছে।”
যেহেতু নীলার বাবা আর্থিক ও মানসিক উভয় দিক দিয়েই খুব বড় মাপের মানুষ, তাই সবাই আমার কথা নির্দ্বিধায় বিশ্বাস করলো। আরেকদফা সংবর্ধনা শেষে সবাই বিদায় নিলো। আমি আর নীলাও রাস্তায় নেমে হাটা শুরু করলাম। কোথায় যাবো জানিনা। খুব আফসোস হচ্ছে। সত্যি সত্যি সুইজারল্যান্ড যেতে পারলে ভালো হতো। না জানি সুইজারল্যান্ড কতো সুন্দর। কোনো কিছু নিয়ে মিথ্যা বললে নাকি তা কখনো সত্য হয়না। আমার হয়তো এ জীবনে আর সুইজারল্যান্ড যাওয়া হলো না। আর আজকে তো স্বপ্নেও সম্ভব নয়। কারন আমাদের আজকে ঘুমানোরই জায়গা নেই, স্বপ্ন দেখব কোত্থেকে ! মাথায় একরাশ দুশ্চিন্তা নিয়ে যদি জেগে জেগে স্বপ্ন দেখা যেতো, তাহলে হয়তো বিনে পয়সায় সুইজারল্যান্ড থেকে একটা সফর দিয়ে আসতে পারতাম। এমনসময় পিঠে কার যেনো হাত পরলো। বাবু ! হাফাচ্ছে।
: তোরা সুইজারল্যান্ড যাবি ?
: হুম , যাবোতো !
: তোদের কাছে টাকা পয়সা আছে কিছু ?
: আছেতো ! এইযে, নীলার ব্যাগ ভরতি টাকা।
: টাকা থাকলে বিয়ে করার জন্যে তোর মোবাইল বিক্রি করলি কেন ?
: না মানে , ভাংতি ছিলো নাতো !
: পাঁচ হাজার টাকার ভাংতি লাগে ? আর কতো চাপা মারবি ? এবার সত্যি করে বল, এখান থেকে কোথায় যাবি ?
: আমাদের গ্রামের বাড়িতে। বড় আপা ফোন দিয়েছিলো। সবাই বধূবরণ করার জন্য বসে আছে। বাসর ঘরও সাজানো হয়ে গেছে।
: যাবি কিভাবে ? টাকাতো নাই ! আমার কাছে অল্প কিছু টাকা আছে। তুই এই পাঁচশো টাকা রাখ। আর পৌছে একটা ফোন দিস্। ওহ ! তোর তো আবার ফোনও নাই। নে, আমার এই এক্সট্রা মোবাইলটা রাখ। কমদামী হলেও রাখ, কাজে লাগবে।
: ধুর ! এতো কমদামী মোবাইল দিচ্ছিস কেন ? একটা আইফোন কিনে দে !
: হারামজাদা ! নতুন ভাবী সামনে দেখে কিছু বললাম না। এখন রওনা দিয়ে দে, নয়তো পৌছাতে পৌছাতে সন্ধ্যা হয়ে যাবে।
: খোদা হাফেজ। দোয়া করি, আল্লাহ তোকে এই এগারোশোর বদলে একটা আইফোন দিবেন। বাবু আমাকে ওর চোখের আগুনে পোড়াবার বৃথা চেষ্টা করে চলে গেলো। নীলাকে নিয়ে আবারো হাটার গাড়িতে উঠলাম। হাটতে হাটতে নীলা আমার হাত ধরলো। ব্যস্ত রাজধানীর, ব্যস্ত ফুটপাথে একটি সদ্যবিবাহিত দম্পত্তি হাটছে। নীল শাড়ি পড়া একটি মেয়ে শাদা পাঞ্জাবী পড়া এক যুবকের পাশে হাটছে। হাত ধরে। সেদিকে কারো ভ্রুক্ষেপ নেই। সবাই ব্যস্ত। নীলাকে নিয়ে একটা পার্কে ঢুকলাম। নীলা ব্যঞ্চে বসে বসে পা ঝুলাচ্ছে আর বাদাম চিবুচ্ছে। আমি অলৌকিক কিছু ঘটার অপেক্ষা করছি। অলৌকিক ঘটনা ঘটলো। বাবুর দেয়া এগারোশো মডেলের হ্যান্ডসেটটা বেজে উঠলো। বড় আপার নাম্বার।
: কি করেছিস তুই ?
: কই কি করেছি ?
: তুই নাকি বিয়ে করেছিস ?
: ছিঃ আপা ! কে না কে তোমাকে উল্টাপাল্টা কিসব কথা বলেছে আর তুমি বিশ্বাস করে বসে আছো ?
: একদম মিথ্যে বলবি না ! আমি তোকে চিনি ! একটু আগে বাবু ফোন করেছিলো আমাকে। তোর আর তোর বউয়ের ছবিও পাঠিয়েছে।
: না মানে…
: চুপ থাক ! ইস্ ! কি বীরপুরুষ ভাইরে আমার ! বিয়ে করার সাহস আছে, সত্য বলার সাহস নাই ! কোথায় তোরা এখন?
: পার্কে।
: ওখানে কি করিস ?
: বসে বসে পা ঝুলাই আর বাদাম খাই।
: হতচ্ছাড়া ! তুই এক্ষন বাসায় আয় ! এক্ষন আসবি !
: হুম…
: হুম কি ? এক্ষন আয় ! নইলে আমি এসে নতুন বউয়ের সামনে তোর কান ধরে নিয়ে যাবো। এখন রওনা দে।
: আচ্ছা।
নীলার বাদাম খাওয়া শেষ। কিন্তু এখনো সে পা ঝুলাচ্ছে। পা ঝুলানো বন্ধ হওয়ার পর নীলাকে নিয়ে স্টেশানের উদ্দেশ্যে পা বাড়ালাম।
: স্যার দুইটা টেকা দ্যান, ভাত খামু। সারাদিন কিছু খাই নাই। ও স্যার !
পিচ্চিটা অনেক্ষন ধরে আশেপাশে ঘুরাঘুরি করছে। হাল্কা খাওয়া দাওয়া আর ট্রেনের টিকেট কাটার পর পকেটে আর মাত্র দশ টাকা আছে। সিগারেট খাওয়া দরকার। একটা বেনসনের দাম নয় টাকা হয়ে গেছে। পিচ্চিকে দুটাকা দিয়ে দিলে থাকবে আট টাকা। কি করবো বুঝতে পারছি না। অসহায় চোখে পিচ্চিটার দিকে তাকালাম। পিচ্চিটা আরো বেশি অসহায়ের মতো মুখ করে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো। পাশ থেকে নীলা বললো, “দিয়ে দাও না দুটা টাকা ! চেহারা দেখে মনে হচ্ছে সত্যিই সারাদিন কিছু খায়নি।” অগ্যতা সিগারেট খাওয়ার মায়া এবং দুটাকা দুটোই একসাথে ত্যাগ করতে হলো। পিচ্চি টাকা নিয়ে লাফাতে লাফাতে তার সঙ্গিদের কাছে চলে গেলো। তার সঙ্গীরা প্লাটফর্মের এক কোণায় বসে মারবেল খেলছিলো। পিচ্চি ওখানে গিয়ে চিল্লিয়ে বলতে লাগলো, “পাইছি ! পাইছি ! দুই টেকা পাইছি ! কে খেলবি এইবার আমার লগে আয়(!)” ট্রেন ছাড়লো আধঘন্টা লেট করে।
দীর্ঘ সাতঘন্টা জার্নির পর এখন বাসায় পৌছে গেছি প্রায়। ওইতো আমাদের ঘরের আলো জলছে। আপা এখনো ঘুমায়নি। আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। ঘরের সামনে গিয়ে আপাকে ডাকলাম। নীলা গায়ের কাপড় ঠিক করে মাথায় ঘোমটা টানলো। চার্জার লাইট হাতে নিয়ে আপা বেরিয়ে এলেন, “এসেছিস তোরা ? রাস্তায় কোনো সমস্যা হয়নি তো ? কই দেখি ! আমার ভাইয়ের বউইয়ের চেহারাটা একটু দেখি !” চার্জার লাইটের আলোয় আপা নীলার মুখটা দেখলেন, “মাশাআল্লাহ ! এক্কেবারে চাঁদের মতোন !”
আব্বা-আম্মার ঘরে লাইট জ্বলে উঠলো। আপা আমার কানের কাছে মুখ এনে বললেন, “কোনো সমস্যা নেই, আমি সব ম্যানেজ করে রেখেছি” আম্মা দরজায় বেরিয়ে এলেন, “এতো রাতে তোদের আসার সময় হলো ? আরো আগে রওনা দিলেই তো পারতিস। কখনো বুদ্ধিসুদ্ধি হবেনা নাকি তোর ?” নীলা এগিয়ে গিয়ে আম্মার পা ছুঁয়ে সালাম করলো। “বেঁচে থাকো মা, বেঁচে থাকো। বাহ ! চাঁদের বতো বউ আমার ! কইগো ? বেরোচ্ছো না কেনো ? ঘরে বউ এসেছে আর তুমি শুয়ে শুয়ে নাক ডাকাচ্ছো ?! ঘটে বুদ্ধি নাই নাকি তোমার ?” ঘুমে ঢুলুঢুলু চোখে লুঙ্গি ঠিক করতে করতে আব্বা বেরিয়ে এলেন। নীলা সালাম করলো। আব্বা আশীর্বাদ করলেন, “ওদেরকে খেতে দাও।” বলে ঘরে চলে গেলেন।
আমরা খেতে বসলাম। ভাত, পুটি মাছের চরচরি আর ডাল। অনেকদিন মা’র হাতের রান্না খাইনা। আমি মন আর পেট দুটো একসাথে ভরে খেলাম। নীলা তেমন একটা খেতে পারলো না। গুরুত্ব দিলাম না। বড়লোকের মেয়ে, ডায়েট কন্ট্রোল-ফন্ট্রোল করে। অভ্যাস আছে। সমস্যা হবে না। খাওয়ার পুরোটা সময় আম্মা হাতপাখা দিয়ে বাতাস করলেন আর আপা এটাসেটা এগিয়ে দিলেন। খাওয়া শেষ করে আমি তৃপ্তির ঢেকুর তুললাম আর নীলা বিতৃষ্ণা নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো। আম্মা পুত্রবধূর মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে চলে গেলেন। আপা বললেন, “আমি তোদের ঘর সাজিয়ে রেখেছি। আয়। আজ সারারাত তোদের সাথে গল্প করবো।” বেশ বড়সড় একটা হাই তুলে বললাম, “আপা, তোমরা দুজন গল্প করো, আমি ঘুমাবো।”
হঠাত মনে পড়ে যাওয়ায় আপা অপরাধীর মতো বললেন, “ওহ ! ভুলেই তো গিয়েছিলাম তোরা লম্বা জার্নি করে এসেছিস, দুজনেই ক্লান্ত। গল্প-সল্প কালকে করা যাবে, এখন একটু বিশ্রাম নে।” আমাদের ঘরের দরজা খুলে দিয়ে ভিতরে লাইট রেখে আপা চলে গেলেন। আপা যাওয়ার কিছুক্ষন পর আমি নীলাকে দুহাতে পাঁজাকোলা করে কোলে তুলে নিলাম। নীলা আমার গলায় হাত জড়িয়ে ধরে থাকলো। ঘরে ঢুকে দেখি বাসর ঘর ভালোই সাজানো হয়েছে। বিছানার ওপর দুচারটা শুকনো গোলাপ ফুল পড়ে আছে। মনে হয় ফুলদানি থেকে তুলে এনে ফেলে রাখা হয়েছে। সেদিক থেকে চোখ সরিয়ে নীলার দিকে তাকিয়ে বললাম, “ম্যাডাম, আপনার দেয়া প্রথম শর্ত তো পূরণ করা হলো। উপহার-টুপহার কিছু পাবো না নাকি ?” নীলা লজ্জা পেয়ে আমার বুকে মুখ লুকোলো।
আমার আর নীলার বিয়ের আগের রাতের কথা। এগারোটার দিকে হলের রুমে বসে বসে নিকোটিন পোড়াচ্ছি, হঠাৎ নীলার ফোন। আমাদের সূদীর্ঘ ৪ বছরের সম্পর্কের সমাপ্তি হয়েছে তিনদিন আগে। বিচ্ছেদের কারন আমার নির্লিপ্ততা। গত চারমাস ধরে নীলার বাবা নীলাকে আর নীলা আমাকে বিয়ের জন্য চাপ দিয়ে যাচ্ছিলো। কিন্তু আমি কোনো পদক্ষেপ নেইনি। শেষে-মেষ বুকে এক প্রকার পাথর চেপেই নীলা আমাদের সম্পর্কের ইতি টেনেছিলো। মাঝরাতে ওর ফোন পেয়ে তাই একটু অবাকই হয়েছিলাম। ফোন ধরার সাথে সাথেই নীলা বলে উঠলো, “তোমার দাওয়াত।”
: কীসের দাওয়াত ?!
: সামনের শুক্রবারে আমার বিয়ে।
: তাই নাকি ? কে সেই সৌভাগ্যবান পুরুষ ?
: এম.বি.বি.এস ডক্টর হামিদুল ইসলাম।
: বাহ ! খুব সুন্দর নাম তো ! আংকেলের মাথায় নিশ্চয় টাক আছে ?
: মশকারি করবা না ! আমি তোমার বেয়াইন না ! ছেলে খুব ভালো। অমায়িক ব্যাবহার। বাবা একবার কথা বলেই ওনাকে পছন্দ করে ফেলেছেন। আমারো বেশ পছন্দ হয়েছে। অন্যান্য ডাক্তারদের তুলনায় বেশ হ্যান্ডসাম।
: ভালোই তো ! সুদীর্ঘ চার বছরে এতো রিকোয়েস্টের পরও তো একবার গান গেয়ে শুনালে না, এখন তো হবু বরের বেশ গুন গাইছো ! তা হবু বরের সুনাম গাইতেই কি এতো রাতে ফোন দিয়েছো ?
: না। বিয়েতে দাওয়াত দেয়ার জন্যে তোমাকে ফোন দিয়েছি। আমি চাই তুমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অন্যের ঘরে আমার চলে যাওয়া দেখবে আর চোখ মুছবে।
: আচ্ছা, দেখবো আর মুছবো। কিন্তু আমার তো ভালো জামাকাপড় নেই !
: হুমমম, সেটাও তো কথা। তোমার ওই ফকির টাইপের জামাকাপড় পড়ে এলে তো চলবে না। আচ্ছা আমি টাকা পাঠিয়ে দিবো। শপিং করে নিয়ো। ধোয়ায় উড়িয়ে দিও না।
: আচ্ছা ঠিকা আছে। ম্যাডামের কাছে আরেকটা আর্জি ছিলো।
: কি ? বলো।
: বিয়ের আগে এম.বি.বি.এস ডক্টর হামিদুল ইসলাম সাহেবের হবু বউয়ের সাথে কি শেষ একবার দেখা করা যাবে ?
: কবে ? কোথায় ?
: কালকে সকাল দশটায়, তোমার বাদাম চিবানোর জায়গায়।
: আমি খুব ব্যস্ত। দশ মিনিটের বেশি সময় দিতে পারবো না।
: আমার দু মিনিট হলেই চলবে।
: আচ্ছা। এখন রাখলাম।
পরদিন সকালে, নীলা যথারীতি আমার পাশে বসে বাদাম চিবুচ্ছে। নীলাকে দেখার পর্ব চুকে গেছে অনেক আগেই। দশমিনিটের বদলে আধঘন্টা হয়ে গেছে তবু নীলার ওঠার নামগন্ধ নেই। মাটি থেকে একটা ঘাস ছিড়ে মুখে দিয়ে চিবুতে চিবুতে বললাম, “নীলা, চলো বিয়ে করে ফেলি।” নীলার হাত থেকে পড়ে গিয়ে প্রায় আড়াইটাকার বাদাম অপচয় হলো। ওর হরিণের মতো টানা চোখগুলো বড় বড় হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো। এক মূহুর্ত পরেই নিজেকে সামলে নিলো। হাতের দিকে তাকিয়ে নখ খুটতে খুটতে বললো, “আমার কিছু শর্ত আছে।” মনে মনে ভাবলাম, (বাব্বাহ ! এ দেখি বসতে দিলে খেতে চায়, খেতে দিলে ঘুমোতে চায় অবস্থা !) মুখে বললাম, “হুম, বলো।”
: বিয়ের পর প্রতিদিন রাতে আমি দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকবো। তুমি আমাকে কোলে নিয়ে ঘরে যাবা।
ভাবলাম, (চিকন-চাকন মানুষ। ওজন তেমন বেশি হবেনা বোধহয়। আমারো খানিক ব্যায়াম হবে !) বললাম, “অবশ্যই ! কোনো ব্যাপার না !”
: প্রতিদিন আমাকে বুকে জড়িয়ে ঘুমাতে হবে।
: হুম, হবে ! (যাক বাবা ! আলাদা করে কোনো লেপ, কম্বলের প্রয়োজন পড়বে না। নীলাকে দিয়েই কাজ চলে যাবে।)
: মাঝে মাঝে অনেক রাতে, ছাদে বসে আমাকে গীটার বাজিয়ে গান গেয়ে শুনাতে হবে।
: অবশ্যই ! অবশ্যই শুনাতে হবে ! (আমি আর গান ??!! শেষে না আমার সাধের গীটার আমার মাথায়ই ভাঙ্গে ! তারপরেও, একটু ত্যাগস্বীকার তো করতেই হবে !)
: প্রতিদিন বাইরে যাবার আগে আমার কপালে একটা চুমু দিয়ে যেতে হবে।
: হুম, মানলাম। (এটা না বললেও আমি জোর করে দিতাম !) আর ?
: আপাতত এগুলো মানলেই হবে। পরে আরো শর্ত দিলে দিতেও পারি। সেগুলোও মানতে হবে।
চিন্তা ভাবনা করে দেখলাম, ক্ষতির চাইতে লাভের পাল্লাই ভারী বেশি। এই সীমিত সময়ের সুযোগ হাতছাড়া করা উচিৎ হবেনা। বললাম, “আপনার সকল শর্ত বিনাদ্বিধায় পালন করা হবে ম্যাডাম।” নীলা খুশির চোটে আমার উপর ঝাপিয়ে পড়লো। আর আমি নীলাকে নিয়ে ব্যঞ্চ থেকে মাটিতে পড়লাম। শুয়ে আছি। বিছানায়। নীলা আমার বুকের উপর মাথা রেখে ঘুমিয়ে আছে। নীলার দেয়া দ্বিতীয় শর্ত মান্য করছি আমি। ভালোবাসার মানুষের দেয়া শর্ত, সে যতোই কঠিন হোক, পূরণ করতে পারার একটা অন্যরকম আনন্দ আছে। জানালা দিয়ে জোছনার আলো এসে পড়ছে আমাদের গায়ে। কেমন যেন মায়াময় একটা পরিবেশ সৃষ্টি করেছে।
আবৃত্তি করলাম, “চাঁদের আলোয় মাখামাখি তোমার মায়ার দুটি আঁখি তোমার পানে মুক্ত বাতাস আমার নাহয় খোলা আকাশ অনুভবেই তোমায় ছুলাম আমার স্বপ্ন এঁকে গেলাম তোমায় ছুয়ে বৃষ্টি হলাম পুরো পৃথিবী ভিজিয়ে দিলাম তোমায় ছোয়ায় রঙধনু পুব আকাশে নাচিয়ে তনু স্বপ্ন হয়ে স্বপ্ন সাজায় একটু শিশির সকল অনু তোমার ছোয়ায় সকল ব্যথা শতো কোটি দুঃখের কথা এক নিমিষেই সব হয়ে যায় আদিকালের রুপের কথা” আমি পেয়েছি। আমি আমার পা ঝুলানো, বাদাম চিবানো নীলাকে পেয়েছি। আজ আমাদের বাসর রাত। আমার আর নীলার। আমি আবৃত্তি করি, নীলা ঘুমোয়। এখন শুধু বর্তমানকে নিয়ে বাঁচবো। অতীতকে মুছে দিয়ে, ভবিষ্যতের চিন্তা ভুলে গিয়ে। বর্তমানে বাঁচবো। নিজেদের মাঝে বাঁচবো। আজ আমাদের বাসর রাত। আমার আর নীলার।
গল্পের বিষয়:
গল্প