প্রথম রাত্রির তৃতীয় গল্প

প্রথম রাত্রির তৃতীয় গল্প
সব চেয়ে অস্বস্তিকর বিয়ে কোন টা জানেন? যেখানে মেয়ে দেখতে এসে বিয়ে হয়ে যায়!যেমন টা আমার হয়েছে! এ বিয়ে গুলোতে মেয়ের স্বমন্ধে ঠিক মত খোঁজ ও নেয়া যায়না!শুধু ছেলে মেয়ে একে অপরকে পছন্দ করলেই হয়ে যায়! পকেটে আংটি থাকে আংটি পড়ানো হয়, তার কিছুক্ষন পর বলা হয়, বাকী কাজ টাও সেরে ফেলা যাক!
তবে সেঁজুতি নামের মেয়েটার স্বমন্ধে মোটামুটি অনেক খোঁজ নেয়া হয়ে গেছে আমাদের কারণ মেয়েটা বাবার কলিগের মেয়ে! মেয়েটাকে আমি আজকের আগে দেখেছি দুবার! একবার ওদের বাসায় এসেছিলাম তখন, , আরেকবার আমাদের বাসায় ও গিয়েছিল তখন! তবুও আজ শুধু আনুষ্টানিক ভাবে দেখতে আসার কথা ছিল কিন্তু এখানে আসার পর বাবা বলল, যেহেতু সবার পছন্দই আছে সেহেতু আর দেরী করে লাভ কি? পরে একটা অনুষ্ঠান করে দিলেই হবে। মেয়েটাকে অপছন্দের কিছু ছিল না তবে প্রস্তুতি বলে একটা কথা আছে! বিয়ের জন্য একটা প্রস্তুতি লাগে, অনেক দিনের প্রস্তুতি! হয়ত মেয়েটাও এমন টাই ভাবছে! আমি মোটামুটি শিউর ছিলাম এখানেই আমার বিয়ে হবে তবে আজকেই হবে তা ভাবিনি!
তবে সমস্যা বিয়ে করা ছিল না, সমস্যা ছিল অন্য জায়গায়! আমার ভাবনায় ছিল,অন্তত আজকের রাতে অবশ্যই এই মেয়েটার সাথে থাকতে হবেনা। যার সাথে আগে আমার কখনো কথাও হয়নি! একটু টাইমের তো দরকার আছেই! আজকের পর থেকে কথা হবে, দুই একের মধ্যই ফ্রি হয়ে যাবো তখন আর কোন সমস্যা হবেনা! কিন্তু আমার বাড়ি যাওয়া প্লান টা হুট করেই ভেস্তে গেল যখন শুনলাম কোত্থেকে যেন কিসের আন্দোলন শুরু হয়েছে, গাড়ি ঘোরা চলবেনা ভোর পর্যন্ত! ! তাই বাধ্য হয়ে সেঁজুতিদের বাসাতেই থাকতে হল। আর যখন থেকেই গেলাম, তাহলে একসাথে কেন থাকব না? সব ঝামেলা উপেক্ষা করে আপা আর দুলাভাই ব্যাবস্থা করলো!তাদের কথা মতো বিয়ে যেহেতু হয়েই গেছে সেহেতু এক সাথেই থাকতে হবে। মেয়ের বাসাতেই বাসর! খুব কম ক্ষেত্রেই হয়! নামে বাসর আরকি, অনুষ্টান দেরী আছে! তখন আরেক বার! তবে প্রথম বারের মত কোন বারই নয়!
ঘরে ঢোকার আগে দুলাভাই বলেও দিল, প্রথম রাতেই বিড়াল মারতে হবে তাহলে নাকি বউ হাতে থাকবে!
দুলাভাই বিড়াল মারতে পেরেছিল কিনা সিন্দেহ, আপা প্রায় দুলাভাই কে ধমকায়, সেই ধমক খেয়ে দুলাভাই নিজেই বিড়াল হয়ে যায়। আর অনার্স পড়ুয়া একটা মেয়েকে অবশ্যই হাতে রাখার কিছু নাই! সে নিজের ভাল ভালভাবেই বুঝবে। খুব অল্পবয়সী হলে একটা কথা ছিল! আর এখানে তো আমি বেশি অস্বস্তিতে আছি, মেয়েটা কিভাবে আছে সেটাতো মেয়েটার কাছে গেলেই বোঝা যাবে!
বাসর ঘরে ঢুকে তিনটা কারণে আমি হতাশ হলাম, প্রথমত ঘর টা মোটেও বাসর রাতের ঘর নয়! তবে ঘর টা সুন্দর!
মেয়েলী ঘর! ছেলেদের ঘর এমন হয়না! দ্বিতীয় বার হতাশ হলাম সেঁজুতি কে দেখে!মেয়েটা সেলোয়ার কামিজ পড়ে আছে! আশ্চর্য, একটা শাড়ি পড়া উচিত ছিল, একটু আগেও তো শাড়ি পড়ে ছিল! চেঞ্জ করার কি এমন দরকার ছিল! যতই হোক বিয়ের রাত! ইহা জীবনে একবারই আসে! তৃতীয় বার হতাশ হলাম খাট টা দেখে! এটা অবশ্যই দুজন থাকার মত নয় ! মেয়েটা এত বোকা কেন? অন্য কোন রুম এও থাকা যেত!
তবে দেয়াল এর দিকে তাকিয়ে বুঝলাম যে এটা ওর নিজের ঘর।তাই এ ঘরেই আয়োজন।যেমন টা সব ক্ষেত্রে হয় আরকি! দেয়ালে সেঁজুতির সুন্দর কিছু ফটো ফ্রেম ঝোলানো। আমি সব গুলো ফটো ভাল ভাবে দেখে তারপর সেঁজুতির দিকে তাকালাম। সেঁজুতি বিছানার এক পাশে বসে ছিল! আমাকে দেখে ও তেমন ভ্রুক্ষেপ করল না! শুধু ও যে বই টা পড়ছিল সেটা বন্ধ করে বিছানার পাশের টেবিলে রেখে দিল! বিয়ের রাতে ও বই এ কি করে? বই পোকা টাইপ মেয়ে! এমন মেয়েই তো খুঁজছিলাম, আগে জানা হলে তো বই শেয়ার করা যেত! বই কিনতে প্রচুর টাকা পয়সা খরচ হয়! আমি উঁকি দিয়ে বই টা দেখতে লাগলাম,অনেক দূরে ছিলাম তাই দেখা যাচ্ছিল না। তবে ব্যাপার টা সেঁজুতি সহজ করে দিল,বলল,
-জহির রায়হানের বই, শেষ বিকেলের মেয়ে!
-ওহ! পড়েছি!
সেঁজুতি আর কিছু বলল না। আমি কি করব ভেবে পেলাম না, বিছানায় বসব কিনা? দ্বিধা দ্বন্দ রেখে বিছানায় বসলাম। দুজনেই চুপ চাপ বসে ছিলাম।ভাবলাম কিছু কথা বলা শুরু করি,বললাম,
-বিছানা টা অনেক ছোট! দুজন ছিলে কখনো? সেঁজুতি কিছুক্ষন বাদে উত্তর দিল,
-আমার কাজিনেরা আসলে তিনজন থাকি,তবে আপনার সমস্যা হলে সামনে চেয়ারে গিয়ে বসতে পারেন।
-না আসলে!
মেয়েটা এত কঠিন করে কথা বলল কেন বুঝলাম না। বিয়েতে রাজী ছিল না? অথবা অন্য কোন ছেলের সাথে রিলেশন ছিল! এক গাদা প্রশ্ন মাথায় এসে গেল।ভাবলাম জিজ্ঞেস করি, তবে এসব কাছ থেকে জিজ্ঞেস করার চাইতে দূর থেকে জিজ্ঞেস করা ভাল হবে! আমি বিছানা থেকে উঠে গিয়ে চেয়ারে বসলাম।তারপর বললাম,
-তোমার বিয়েতে মত ছিল তো?
-বিয়ে তো করতেই হবে, অমত করে লাভ কি?
-ওহ! নাহ মানে বিয়ের আগে পছন্দের ছিল নাকি কেউ!
-এসব জিজ্ঞেস করা দরকারী!
প্রেম করলে তো চলেই যাইতাম! বাসার সবাই আমাকে যথেষ্ট ভয় পায়! আমি আর কিছু বললাম না! এত সিরিয়াস কেন মেয়েটা! শাড়ির ব্যাপার টা জিজ্ঞেস করার ইচ্ছা ছিল কিন্তু ভয়েই জিজ্ঞেস করলাম না। কখন যে কি বলে? সেঁজুতি আবার বই খুলে বই এর দিকে মনোযোগ দিল! আমি এবার ভাল কিছু বলার চেষ্টা করলাম, বললাম,
-কিছু ভাল বই হবে! দুজনেই পড়তাম! আমার কথার কোন উত্তর এলোনা তবে কিছুক্ষনের মধ্য এক গাদা বই টেবিলে এলো! আমি নেড়ে চেড়ে দেখলাম সব ভাল ভাল লেখকের বই। জিজ্ঞাসা করতে চাইলাম,ও সব গুলো পড়েছে কিনা? কিন্তু পিছন ফিরে দেখলাম, সেঁজুতি ঘুমিয়ে পড়েছে! তাই আমি বই পড়ার দিকে মনোযোগ দিলাম,আর মাঝে মাঝে ঘড়িও দেখছিলাম। রাত টা কোন ভাবেই কেঁটে গেলেই হয়!ঘড়িও স্লো হয়ে গিয়েছে কিনা কে জানে? মাত্র দুটা বাজে! রুমে এসেছিলাম একটার দিকে!এতক্ষনে মাত্র এক ঘন্টা গেল। ঘুম ভাঙল সেঁজুতির ডাকে, চোখ মেলে দেখলাম ও আমার পাশে দাঁড়িয়ে আছে! কখন ঘুম ধরেছিল মনে নেই! তাই টেবিলের ওপর মাথা রেখে শুয়ে পড়েছিলাম। আমি জিজ্ঞেস করলাম,
-সকাল হয়ে গেছে, সেঁজুতি কিছু না বলে ঘড়ির দিকে ইশারা করল,আমি ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি তিনটা পার হয়ে গেছে।
-আরেক টু পড়ে জাগানো উচিত ছিল!
-বই এর উপর ঘুমাচ্ছিলেন,তাই ডাক দিয়েছি। বই টা ছিড়ে গেলে কি হবে! বই সড়িয়ে নিচ্ছি ঘুমান!
-কি আশ্চর্য!
-আশ্চর্য র কি?
-তোমার দয়া মায়া এত কম কেন?
-দু ঘন্টাতেই দয়া মায়ার পাহাড় হবেনা নিশ্চয়! আমার জন্যও আপনার হয়নি!
-তা অবশ্য!
-বই গুলো আমার কাছে পাঁচ বছর ধরে আছে! আমি কিছু বললাম না, আসলে কি বলব ভেবে পেলাম না!সেঁজুতি নিজে থেকে আবার বলল,
-যখন মায়া দুজনের জন্মাবে তখন আমরা এই বিছানাতেও দুজন কেন, আমাদের ছেলে মেয়ে নিয়েও থাকতে পারবো,
-আমি ভেবেছিলাম তুমি অস্বস্তিতে না পরো!
-মায়া নেই তাই পড়তে পারতাম!
-তুমি বেশ কঠিন!
-আমি সহজ ও,
সমস্যা না থাকলে আসুন শুয়ে পড়ি। এখনো অনেক রাত বাকী! সেঁজুতি আর কিছু না বলে শুতে গেল।আমি কিছুক্ষন বাদে বিছানার দিকে গেলাম। সেঁজুতি এক পাশে সরে গিয়ে আমার জন্য জায়গা করে দিল! জায়গা কম, তবে আরেকজন শোয়া যাবে! আমি শুয়ে পড়লাম, গায়ে গা লাগছিল। তবে অস্বস্তি হচ্ছিল না, কয়েক ঘন্টার পরিচয় আমাদের তবুও মনে হলো অনেক দিনের! মেয়েটার সাথে যেখানে একটা জীবন শেয়ার করতে হবে সেখানে একটা বিছানা শেয়ার করা খুব সোজা! আমি শোয়ার কিছুক্ষন বাদেই সেঁজুতি বলা শুরু করল,
-এত ভাল হতে হবেনা!
-কিসের ভাল!
-বিছানা টা সিঙেল, চেপে আসেন! বেশি ভাল হতে গেলে পড়ে যাবেন! কোমড় ভেঙে যাবে,পরে দোষ হবে আমার।
সবাই বলবে প্রথম রাতেই ধাক্কা মেরে বরকে ফেলে দিছি! আমি সেঁজুতির কথা শুনে হাসলাম,সেজুতিও হাসলো।
-আমি পড়ব না! তুমি উলটা পড়ে যেওনা! আর যদি পড়ে যেতে ধরো তাহলে আমাকে ধরে রাখতে পারো!
-হাহাহা, আমি কক্ষনো পড়বোনা!
-পড়ে যাওয়ার বাহানা করেও আমাকে ধরে রাখতে পারো! সাবধানতা অবলম্বন করা উচিত! সেঁজুতিও আমার কথা শুনে হাসলো।
-ঘুমান!
-তুমি আপনি বলছ কেন?
-কালকে থেকে তুমি করে বলবো!এখন ঘুমান! আমি ঘড়ি দেখে বললাম,
-চারটা বাজে, সূর্য উঠে পাঁচটায়! আর ঘন্টা খানেক আছে কাল হওয়ার, তোমার মুখে তুমি শুনেই ঘুমাবো।
-উহু!
-আচ্ছা,তোমাকে তো আগে দেখলাম শাড়ি পড়া, চেঞ্জ করলা কেন?
-শাড়ি সামলাতেই পারিনা! আর শাড়ি পড়লে মোটা মোটা লাগে! বিছানা ছোট তাই চেঞ্জ করেছি!
-বাহ,দারুন লজিক!
-সত্যি বলছি!
-আমি অবশ্য কারণ টা জানি!
-কি কারণ?
-কাল বলব!
আমরা দুজন এক সাথে ঘড়ির দিকে তাকালাম। সেঁজুতি আবার হেসে উঠলো! আমি ওর হাসি শুনতে লাগলাম। খুব দ্রুতই সময় যাচ্ছে, পাঁচ টা বেজে সূর্য উঠলো বলে! তবে ওর মুখে তুমি শোনার চাইতেও মধুর কিছু ঘটল, সেঁজুতি হুট করে আমার হাত ধরলো। আমি হেসে উঠলাম, ও আমার হাসি দেখে বলল,
-পড়ে যাইতে ধরছিলাম হাসার কিছু নাই! আপনি ওই পাশে একটু সড়েন! আমি সরে না গিয়ে বললাম,
-তুমি এভাবেই থাকো!
-কেন?
-পড়ে যাওয়ার ভান করে হলেও হাত ধরে থাকো!
-আমি ভান করছি না!
ও হাত ছাড়তে চাইলে আমি নিজে থেকে ওর হাত ধরলাম। বললাম,আমি ধরে থাকি! তাতেও হবে! তুমি পড়বানা! সেঁজুতি মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে টেবিল ল্যাম্পের সুইচ টা অফ করে দিল! আর সাথে সাথে ঘড়িতেও শব্দ করে জানান দিলো পাঁচ টা বেজে গেছে! আমি সেঁজুতির কানে আস্তে করে বললাম,
-পাঁচ টা বেজে গেছে! ও পাশ থেকে শুধু এটুকু এলো,
-ঘুমাও,সকাল ও হয়ে গেছে!
গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত