শিলুর আত্মজীবনী

শিলুর আত্মজীবনী
বয়স তখন আর কতই বা হবে হয়তো আট কিংবা দশ।মার হাত ধরে সেদিন মতিঝিলের ব্যস্ততম রাস্তাটা পার হচ্ছিলাম, দানবের মতো একটা চলন্ত ট্রাক মুহূর্তেই ধেয়ে এলো। আমাকে ধাক্কা দিয়ে মা নিজেই চাকার নিচে পড়ে– আমার মা ওখানেই শেষ হয়ে গেলেন। কে বা কারা মার রক্তাক্ত দেহ নিয়ে গেলো।সেদিন মা বলে একটা চিৎকার দিয়েছিলাম,,,,,আজও যদি আপনারা কেউ দৈনিক বাংলার মোড়ের দিকে কান পাতেন,শিলুর মা হারা সে আর্তনাদ আজও শুনতে পাবেন।
তাই আজ আমার পৃথিবীতে আর কেউ রইল না। কারণ বাবাকে কখনো দেখিনি,আসলে বাবার পরিচয়ও জানি না। তাই আমার সম্পর্কে সঠিক করে বলতে পারছি না। প্রকৃতির নিয়মেই একদিন এই ধরাধামে এসেছিলাম তাতে সন্দেহ নেই,,, মাকে হারানোর পর; বড় রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ডাস্টবিন এর খাবার খেয়ে আমার দিন যাচ্ছিলো। একদিন হাঁটতে হাঁটতে হাজির হলাম নিউমার্কেট। দেখলাম আমার বয়সের অনেক ছেলে-মেয়ে গাড়ির আশপাশে দাড়িয়ে ভিক্ষা করছে। পেটের তাগিদে আমিও সেই পথটা ধরলাম। সেদিন ছিলো রবিবার, প্রতিদিন এর মতো ভিক্ষা করছি। এক সময় বড় একটা কালো গাড়ি আমার পাশ ঘেঁসে দাঁড়ালো। গাড়ি থেকে নেমে এলেন একজন ভদ্রমহিলা, দৌড়ে গিয়ে তার সামনে হাত বাড়ালাম,
“ভিক্ষা করিস কেন, কাজ করে খেতে পারিস না? আমার বাসায় তোকে নিয়ে যাব, যাবি?”
“হু”
“আচ্ছা তুই এখানে বসে থাক,শপিং শেষে তোকে নিয়ে যাব”
সেদিন সত্যি ওদের শপিং শেষে আমাকে নিয়ে এলো উত্তরার সেক্টর ৭ এর ২৭নম্বর বাড়িতে। উত্তরার সেই বিরাট বাড়িতে আশ্রয় পেয়ে আল্লাহর শুকরানা আদায় করলাম। এই বাড়ির উচ্ছিস্ট খাবার খেয়ে আমার মতো দু দু’টো শিলু স্বাভাবিক ভাবেই বেঁচে থাকতে পারে। আর সেই প্রথম দিনিই তনি আপার পুরোনো জামা পরে কত বার আয়নার সামনে দাড়িয়েছে তা মনে নেই।
এভাবে জীবন চলছিলো। খুব সুন্দর ছিলাম তাই তনি আপা আদর করতো। তিনিই আমাকে লেখাপড়ার পাশাপাশি নাচ-গানও শেখালেন। জীবনকে চালিয়ে নেওয়ার মতো অনেক কিছু আয়ত্তে এনেছিলাম। কিন্তু বিধাত আমার সুখ সহ্য হল না। তাই আগামী দিনের রঙিন সপ্নটা কাঁচভাঙ্গার শব্দের মতো খানখান করে ভেঙ্গে দিলেন।জীবন এর প্রথম অধ্যায়টা এভাবে শেষ। কিন্তু তার চেয়ে করুণ ছিলো পরের অধ্যায়,, বয়স তখন ১৮, প্রানবন্ত যৌবন নিয়ে খান সাহেবের শোকেসে রাখা বিদেশী পুতুল এর মতো সবার দৃষ্টি আর্কষন করে ফেলেছি। এটা যদিও আমার স্ব-ইচ্ছায় নয়। বিধতার সৃস্টির প্রতিফলন, যা আমার আয়ত্তের বাইরে। তাই আশ্রয়দাতার ছেলে রবি ভাই সেই সুযোগটা হাত ছাড়া করতে চায়নি। বিশ্বাস করুন, এত বড় দুরাশার স্বপ্ন কোনোকালে ছিল না। কিন্তু শিকারি বিড়ালের সামনে ইঁদুরের যে পরিণতি হয় আমারো ঠিক তা হয়ে ছিলো।
কিছুদিন না যেতে বড় আম্মার চোখে ধরা পড়লাম। আমার কিছু করার ছিল না, তাই বড় আম্মা ও তনি আপাকে সব বললাম। কিন্তু কে শুনে কার কথা। বাড়ির নিরাপরাধ ড্রাইবার কে দিয়ে অপবাধ রটালো। রবি ভাইকে বললাম এটা কার পাপের ফসল, কেন আমার জীবনটা শেষ করলেন? সেই কাপুরুষ সেদিন পিস্তল দিয়ে মারার ভয় দেখালো। হুম যেখান থেকে কুড়িয়ে আনা হয়েছিলো আজ সেখানেই আশ্রয় নিলাম। না জীবনটা ওখানেই শেষ হয়নি। কারণ শিলু রক্তে-মাংসে গড়া মানুষ। তাই শিলু আজ সমাজের বুকে দাড়িয়ে বলতে চায়-
-আমি কোনো অন্যায় বা পাপ করিনি। উত্তরা, গুলশান আর বনানীর খান সাহেবদের দুলালিরা অবৈধ সন্তানের মা হয়ে সমাজের রক্ত চক্ষুকে ভয় না করে মাথা উচুঁ করে চলতে পারে, রক্তচক্ষু দালালরা আর তথাকথিত বুদ্ধিজীবীরা ঘাতক হয়েও সমাজের উচ্চাসনে অধিষ্ঠিত হতে পারেন। কিন্তু এই রক্তচক্ষু দালালদের আমি ভয় পায় না আর ওসব তথাকথিত বুদ্ধিজীবীদেরও এতটুকু মূল্য দিই না। ওইসব বুদ্ধিজীবীর দুলালদের খেয়ালখুশির পুতুল হয়ে আমার মতো কত শিলুর প্রাণনাশ হচ্ছে তা কেও হিসাব রেখেছেন? অথচ তারাই আমাদের মতো হাজার শিলুর দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে তাদের টানাবাজার ব্যবসা চাঙ্গা রেখেছে। বলতে পারেন এই টানাবাজার কাদের সৃষ্টি?
আচ্ছা সমাজের তথাকথিত বুদ্ধিজীবী নামে শকুনরা ভুলে একবার আত্নবিশ্লেষন করছে না। সমাজের এই পাপের মূল শিকড় কোথায়? একজন সাংবাদিক কতটুকু সত্য তুলে ধরতে পারছেন? একজন পুলিশ তার দ্বায়িত্ব কতটুকু পালন করতে পারছেন? একজন আইনজীবী তার আইনকে কোন মাপকাঠিতে বিচার করছে? এ প্রশ্ন পাঠকের কাছে রইলো। হ্যাঁ, আমি হয়তো আমার বাবা মায়ের অবৈধ পাপের ফসল। কেননা গরিবের ঘরে এত সুন্দর ললনাকে আশা করা যায় না। কিন্তু আমার সন্তানকে এমন শিক্ষা দিবো যাতে, “শিলুর মতো আর কেও এর শিকার না হয়। যদি হয়, প্রতিবাধ নয়, প্রতিরোধ করে দাঁড়াতে পারে।
গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত