বন্ধু

বন্ধু
-দোস্ত…একটু আফসানা দের বাড়িতে আসবি? ধরা পড়ছি ঘুমঘুম চোখে “হ্যালো” বলতেই ওপাশ থেকে স্পষ্ট গলায় এই কথাটি বললো হাবিব। একমুহুর্তের জন্য স্ট্যাচু হয়ে গেলাম। হাবিব কি বললো তা বুঝতে একটু সময় লাগলো। বোঝার পরেও প্রশ্ন করে উঠলাম,
-কি হইছে?বুঝলাম না…
-একটু আফসানা দের বাড়িতে আয়। ধরা খাইছি, কেও না আসলে বেধে পিটাইবে ঘড়ির দিকে তাকালাম। রাত্রি ১১ টা বেজে ৫৬ মিনিট। পুরো কাহিনী বুঝতে পারলাম ঘটনা কি ঘটেছে। খেকিয়ে উঠলাম,
-কু*র বাচ্চা…তোর মাইর খাওয়াই উচিত…এই কাম করতে গেছিস ক্যান? আমি আসতে পারবো না হাবিব দুর্বল গলায় বললো,
-মাফি…ভাই,প্লিজ..এরকম জীবনেও করবো না। প্লিজ আয়…ভয় করতাছে…প্লিজ ভাই..তুই ছাড়া আমার কে আছে বল এই জঘন্যতম কাজ করার পরেও ওর উপর রাগে হাত পা কিড়মিড় করার কথা ছিলো। কিন্তু ওর ভয়েস শুনে একটু মায়া ই হলো। ধপ করে উঠে বসলাম। সারাদিন খাটাখাটুনি করে একটু আগেই চোখ বুজেছি…এর মধ্যেই ফোন বেজে উঠলো আর ফোন ধরার পর এই নিউজ শুনলে মেজাজ খারাপ হওয়াই স্বাভাবিক। মাথাটা ঝিমঝিম করছিলো। সারাদিনের ক্লান্তির পর কই একটা ঘুম দিবো..তা না লাফিয়ে খাট থেকে নামলাম। ট্রাওজারের উপর দিয়েই প্যান্ট পরলাম। শার্ট গায়ে চাপিয়ে আস্তে করে দরজা খুললাম। ভাগ্যিস আমার রুমমেট গ্রামের বাড়ি গেছে। নাইলে কাল হোস্টেল সুপারের কাছে কমপ্লেইন দিত নিশ্চিত হয়ে বলা যায়। দরজা খুলে পা টিপে টিপে নিচতলায় আসলাম।
এখন মুল দরজা খোলা থাকলেই হয়। যাক, আমাকে সহযোগিতা করতে দরজা টা খোলা আছে। তারাতারি করে বেড়িয়ে বাইরে আসলাম। এখন বাউন্ডারি ওয়াল টপকাতে হবে। সেটা খুব একটা কঠিন কাজ না। দক্ষিন পাশে টিউবওয়েল এর সাইডে রডের উপর পারা দিয়ে বাতাবি লেবু গাছের ডাল ধরে সোজা বাউন্ডারি ওয়ালের উপর উঠলাম। বেশ উচু ওয়াল। তারপরেও লাফ দিয়ে ওপারে পরলাম। হাবিবের উপর প্রচন্ড রাগ নিয়েই আফসানা মেয়েটার বাড়ির দিকে পা চালিয়ে যেতে লাগলাম। আকাশে মেঘ জমেছে। মেঘের আড়ালেই পুর্নিমার চাঁদ উকি দিচ্ছে। আচ্ছা..সুর্যের আলো থেকেই তো চাঁদ আলোকিত হয়। তাহলে সুর্যের আলোতে ভিটামিন ডি থাকলে, চাঁদের আলোতে কোন ভিটামিন নেই কেন? নিজের মনের ভিতর লুকিয়ে থাকা বিজ্ঞানী টাকে এই বলে শান্তনা দিলাম যে,
-“ভিটামিন পরে খুজিস আগে তোর বন্ধুকে বাচা আরো জোরে হাটতে লাগলাম। আফসানা মেয়েটাও আমাদের ক্লাসেই পরে। ওর বাসা কলেজের থেকে একটু দুরেই। আমি কলেজ হোস্টেলে থাকি। আর হাবিব আফসানা দের বাড়ির পাশেই একটা মেস এ থাকে। হাবিব যে এমন একটা কাজ করবে,আমি ধারনাও করতে পারি নাই। যাই হোক, ধারনার “খেতা পোড়াই”..কিংবা শুদ্ধ বাংলায় “কাথা দহন করি” বলে দিলাম এক দৌড়.. হাপাতে হাপাতে আফসানাদের বাড়ির পাশের গলিতে ঢুকেছি…তার পরেই, ঠাস করে পায়ে কিছু একটা বেধে পরে গেলাম।
শক্ত পিচঢালা রাস্তায় আছাড় খাওয়ার ফলে হাতে বেশ ব্যাথা পেয়েছি। কিন্তু তা দেখার সময় নেই। পিছনে তাকালাম।
অন্ধকারের মধ্যেই আবছা আলোতে বুঝতে পারলাম, দড়ি টানিয়ে রাখা হয়েছে যাতে কেও আছাড় খায়। সামান্য ভ্রু কুচকে উল্টা দিকে তাকিয়ে দেখলাম একজন দাড়িয়ে আছে। বেশ ভয় ই পেলাম। এত রাত্রে কে দাড়িয়ে আছে? কিছু বলার আগেই বা দিক থেকে আরো একজন এসে দাড়ালো। আমার ভয়টা বেড়ে গেলো। গা থেকে মাটি ঝাড়তে ঝাড়তে উঠতে লাগলাম। তাকিয়ে দেখি সামনে ৫ জন। এক পা এক পা করে পিছনে যেতে লাগলাম। আরেকটু এগিয়ে গেলেই চাদের আলোতে ক্লিয়ার দেখতে পাবো। উল্টা দিক হয়ে পিছনে এগিয়ে যেতেই কিছু একটার সাথে গুতো খেলাম। তাকিয়ে দেখি হাবিব। একটু ভরসা পেলেও ভয় আরো কয়েকগুন বেড়ে গেলো। আমি থতমত খেয়ে বললাম,
-কিছু বুঝতে পারতেছি না হাবিব….হচ্ছে টা কি?? হাবিব কিছু না বলে রহস্য মাখা একটা হাসি দিলো। বাকি ৫ জন এগিয়ে আসলো। আমি কিছু বুঝে ওঠার আগেই ওরা আমাকে ধরে ফেললো আমার হার্টবিট তখন সেকেন্ডে ৩ বার হয়তো হয়ে গেছে…নিশ্বাস ভারী হয়ে আসলো। কিছু একটা হতে চলেছে বুঝতে পারলাম। আমাকে ল্যাম্পপোস্ট এর সঙ্গে বেধে রাখলো। বাকি ৫ জনের চেহারা এখনো দেখতে পারি নাই। মনে মনে আল্লাহ কে ডাকছিলাম আর গুনাহ মাফ করার প্রার্থনা করছিলাম। বাকি ৫ জন একে একে এসে মুখের সামনে থেকে কাপড় সরালো জয়, শরীফ, আসিফ ,সুমন এবং অন্তর আমার মাথা পাক খেতে লাগলো। মাঝরাত্রে হোস্টেল থেকে মিথ্যা বলে ডেকে এনে কি করতে পারে..আমি বুঝতে পারলাম। বিনীত গলায় বললাম,
-বন্ধুরা..প্লিজ..আমি কি করেছি..একটু বল জয় এক পা এগিয়ে এসে বললো,
-তোর দ্বারা এটা হবে,আমরা ধারণা ও করি নাই..এটা কি করছিস তুই?
-আমি কি করলাম আবার? অপরপাশ থেকে শরীফ বললো,
-মনে করে দেখ কি করেছিস.. আমি মনে করার চেস্টা করলাম..তেমন কোন অপরাধ এর কথা মাথায় আসলো না। ভীত গলায় আবার বললাম,
-প্লিজ দোস্ত..একটু খুলে বল..আমি সেইটা শোধরানোর চেস্টা করবো হাবিব বললো,
– আমাদের লুকিয়ে লুকিয়ে যেটা করছিস..সেইটা বল…
-খোদার কসম…ফাইজা কে আমি পছন্দ করি…কিন্তু ওর সাথে কোনদিন কথাও বলতে পারি নাই এইবার ওরা অবাক হয়ে গেলো। আমি বুঝতে পারলাম, ফাইজা এর ঘটনা নিয়ে ওরা কেও এসব করছে না।
জয় এগিয়ে এসে বললো,
-ফাইজা কে নিয়ে সব কথা খুলে বল আমি একটু ঢোক গিলে বললাম,
-অনেক আগে থেকেই.. ইয়ে মানে..তোদের বলি নাই…ফাইজাকে ভালো লাগে। কিন্তু ওর সামনে কোনদিন কোন কথাও বলতে পারি নাই। জয় গম্ভীর মুখে সরে গেলো। আমি একটু গলায় জোর দিয়ে বললাম,
-প্লিজ..কেও বল..আমি এমন কি করেছি,যাতে করে আমাকে এইভাবে এনে বেধে রাখা হলো? কেও কিছু বললো না। হাবিব এক পা এগিয়ে এলো। পকেটে হাত দিয়ে একটা চার ইঞ্চি ছোট ছুড়ি বের করলো। চাদের আলো পরে চিকচিক করে উঠলো ফলা টা আমি কোৎ করে একটা ঢোক গিললাম। হাবিব বললো,
-তোর এখনো মনে পড়ছে না তুই কি করেছিস?
-খোদার কসম..কিছু করি নাই হাবিব ছুড়ি হাতে নিয়ে আমার সামনে দাড়ালো। আমি মনে মনে শেষ বারের মতো আল্লাহর নাম স্মরণ করে চোখ বন্ধ করলাম। হঠাৎ ই ছুড়িটা দিয়ে আমার বাধন কাটা হচ্ছে বুঝতে পারলাম। আশা নিয়ে চোখ খুলে তাকালাম হাবিব পিছিয়ে গিয়ে ওদের সাথে সিরিয়ালে দাড়ালো।
-ওয়ান,টু,থ্রি…
-হ্যাপি বার্থডে টু ইউ….হ্যাপি বার্থডে টু ইউ….হ্যাপি বার্থডে ডিয়ার মাফি পাগলা..হ্যাপি বার্থডে টু ইউ আমার মাথা সেই মুহুর্তে ফাকা হয়ে গেছে। ওরা কি বলছে বুঝতে পারছিলাম না। ওরা ৬ জন এগিয়ে এলো। আমি আনন্দে প্রায় কেদে দিয়েছি এটা ভয় কেটে যাওয়ার আনন্দ না…এটা আমার প্রতি ওদের ভালোবাসা দেখার আনন্দ চোখের পানি গড়ে গিয়ে আমার হাসি মুখের আকার পাল্টে দিচ্ছে, কিন্তু মুছতে পারতেছি না..আমার হাত তো বাধা জোর গলায় বললাম,
-হাত খুলে দে..তোদের একটু জড়িয়ে ধরবো আমার হাত খুলে দিলে এখন যে ওদের কি করবো..তা ওরা জানে জয় এগিয়ে এসে বললো,
-সালা..একটা মেয়েকে এক বছর হলো পছন্দ করিস…বলতে পারিস নাই?আমাদের ও বলিস নাই? তোর হাত খোলা হবে না…থাক এভাবেই ওরা হাসতে লাগলো আমার মুখের উপর ইচ্ছামত পোস্টার মেরে পিক তুলতেছে….আমি শুধু হাসছি…হাসিটা সংক্রমিত হয়ে যাচ্ছে অন্যদের মাঝেও। সত্যিই বন্ধু তো কতরকমের ই হয়। কিন্তু স্কুল আর কলেজের বন্ধুদের কথা সম্পুর্ন আলাদা এরা বুঝতে জানে,বুঝাতেও জানে বাবা-মা না বুঝলেও এরা বোঝে…তারপর আমাদের বুঝিয়ে দেয় সেইটা কিসের জন্য বাবা-মা বোঝে নাই এরা সত্যিই হারামি হয়। এক এক টা বদের হাড্ডি ও হয়। সুযোগ পেলে যে কাওকে,এমন পচানো পচায়..আবার সুযোগ পেলেই বুকে জড়িয়ে ধরে।
এরকম বন্ধু পাওয়া.. জীবনের সবচেয়ে বড় অর্জন বিপদের সময়, ভাইবোন ও অনেক সময় কাজে আসে না। কিন্তু একজন প্রকৃত বন্ধু..কোন সময় হাত ছাড়ে না স্যালুট জানাই দুনিয়ার সকল প্রকৃত বন্ধুত্ব কে। ল্যাম্পপোস্ট এর সাথে এখনো বাধা অবস্থায় আছি। আমার মাথার উপর ইতিমধ্যে ডিম ভেঙ্গেও ছবি তোলা শেষ । মেঘ সম্পুর্ন কেটে গিয়েছে । চাঁদের আলো এসে আমার উপর পরছে…সেই আলোতে নিজেকে পথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ বলে মনে হচ্ছে আমি হাসছি মন খুলে হাসছি যে হাসিটার আড়ালে কোন ভেজাল নেই বুক ভরে শ্বাস নিচ্ছি  চাঁদটাও আমার সাথে মনে হয় হাসছে সেটা বোধহয় পুর্ণতার হাসি যে হাসি কেও দেখে না কেও না ।
গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত