অপেক্ষা

অপেক্ষা
ওয়াক থু!” মুখভর্তি সেমাই থু করে ফেলছেন লিয়াকত আলি। “এর নাম সেমাই? রানছে কে? কে রানছে এই গরুর মুত দিয়া সেমাই?” “আমি আব্বা।”
শাহানা মাথায় ঘোমটা টানতে টানতে বললো। লজ্জায় তার মাথা হেট হয়ে যাচ্ছে। বিয়ের পর এই প্রথম ইদ তার শ্বশুরবাড়ীতে। সারাজীবন সে বাড়ীতে দেখে এসেছে কুরবানী ইদের সময় একেবারে গরুর মাংস রান্না হলে তবেই সবাই খেতো। আগে থেকে সেমাই বা পায়েস বানানো থাকলেও সেটা কেউ খেতো না। কিন্তু এই বাড়ীতে সব কেমন জানি অন্যরকম নিয়মকানুন। তার মধ্যে এই সেমাই খেতে এসে ওই কাহিনী। সকালে একপ্রকার জোর করেই নিজে সেমাই রান্না ট করেছে শাহানা। মাকসুদা বেগম কিছুতেই দেবেন না করতে। হাজার হোক, মেয়েটার প্রথম ঈদ শ্বশুরবাড়ীতে৷ শাহানাকে দেখে বারবার তার নিজের প্রথম বিয়ে হয়ে আসার দিনগুলি মনে পড়ছে। এই যে এক বাড়ী ভর্তি মানুষ রেখে এসে অন্য এক ভর্তি বাড়ীর একজন হওয়া খুব একটা আনন্দের বিষয় না। পদে পদে সবকিছুর সাথে তুলনা চলে আসে। অল্পতেই মন খারাপ হয়। ওই যে বলেনা, মেয়েরা পানির মত, যে পাত্রে রাখা হয়, সেই পাত্রের আকার ধারন করে, কথাটা একদম সত্য। নইলে এমন অচেনা পরিবেশে মানিয়ে নেয়া সহজ কথা তো নয়।
লিয়াকত আলি শাহানার চেহারার দিকে আর তাকালেন না। তাকালে দেখতে পেতেন লজ্জায় শাহানার চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে। সেমাইয়ের বাটিটা শব্দ করে টেবিলে রেখে চলে গেলেন লিয়াকত আলী। চামচটা বাটি থেকে পড়ে ঝনঝন শব্দ করেই থেমে গেলো। শাহানার চোখে পানি গড়িয়ে গালে পড়েছে। কি এমন খারাপ হয়েছে সেমাই, তাই বলে এভাবে বলতে হবে? ভুল তো হতেই পারে মানুষের। অবশ্য লিয়াকত আলী মানুষটা ঠিক এমন না। বিয়ে হয়ে শাহানা এ বাড়ীতে আসার পর কখনোই এমন ব্যবহার দেখেনি লিয়াকত আলীর। বেশ অবাকই হলো শাহানা ওর শ্বশুড়ের এই আচরণে।
বিয়ের সময় শাহানার বড় চাচা ইসমাইল হোসেন বড় কাতর ভাবে বলেছিলেন, “মেয়েটা বড়ই ভালো বেয়াইসাহেব। বাপহারা মেয়ে সারাজীবন বাপের আদর পায় নাই৷ ওকে আপনারা নিজের মেয়ের মত করে দেখবেন।” লিয়াকত আলী হাতে হাত রেখে কথা দিয়েছিলেন, যে তিনি শাহানাকে নিজের মেয়ের মত করেই রাখবেন৷ কিন্তু এমন কেন করলেন কে জানে। শাহানার ইচ্ছে করছে ছুটে চলে যাক এখানে থেকে। বাথরুমের দরজা বন্ধ করে কাঁদুক কিছুক্ষণ।মাকসুদা বেগম পেঁয়াজ কাটছিলেন। সেটা বাদ দিয়ে উঠে এসে বললেন, “মন খারাপ করো না মা। এই প্রথম ঈদে বড় ছেলেটা কাছে নাই। মন-মেজাজ খারাপ তোমার আব্বার।” শাহানার বলতে ইচ্ছা করলো, “আপনাদের বড় ছেলের জন্য আমার নিজের ও খারাপ লাগছে।” কিন্তু বলা যায় না। স্বামীর জন্য খারাপ লাগা শ্বাশুড়ীকে বলা শাহানার পক্ষে সম্ভব না।
বিয়ের কদিন পরেই আসগর পারি জমায় মধ্যপ্রাচ্যের এক দেশে। ভালোভাবে কথা বলার আগে, পরিচিত হবার আগেই আলাদা হয়ে গেল দুজনেই। মানুষটার জন্য খারাপ লাগার থেকে আফসোস হয় বেশী। যাওয়ার আগের দিন কত কথা, সমস্ত আত্নীয়-স্বজন আসগর যাওয়ার আগের দিন এসে জড়ো হলো। রাতে সবাই ছড়িয়ে ছিটিয়ে শুয়ে আছে চারপাশে। তাও আসগর কথা বলতে লাগলো শাহানার সাথে। কত কথা, রাতটা কেন জানি টুপ করেই শেষ হয়ে গেলো সেদিন। শাহানার তখনো কোনো ভালোলাগা বা খারাপলাগা বোধ তৈরী হয়নি তখনো। আসগর চলে যাবার পরপরই শাহানার বড় চাচা এসে লিয়াকত আলীকে বললেন, “জামাই যতদিন না আসে, মেয়ে আমাদের বাড়ীতে থাকুক বেয়াইসাহেব।”
লিয়াকিত আলী বললেন, “ছেলে আমার দেড় বছর পরে দেশে আসবে বেয়াই সাহেব। ততদিনে মেয়েটা যাওয়া-আসা করুক। একেবারে নিয়ে রাখবেন? আমরা যে বড্ড একা হয়ে যাবো!” ইসমাইল হোসেন কি বুঝেছিলেন কে জানে, যাবার সময় শাহানার হাতে চকচকে দুটা পাঁচশো টাকার নোট ধরিয়ে দিয়ে বলেছিলেন, “এখন থেকে এটাই তোমার বাড়ী মা। মাঝে মাঝে বেড়িয়ে যেও এই গরীব চাচার বাড়ীতে।” শাহানা মাথা নেড়েছিলো সেদিন। এখন মনে হচ্ছে সেদিন বড় চাচার সাথে চলে গেলেই সে বেশ করতো৷ কার জন্য থাকবে এখানে সে? এখানে কেউ আপন না। স্বামীই এখানে নেই। যার জন্য এ বাড়ীতে আসা, সেই যখন নেই, তখন আর এখানে থাকার কি এমন মানে।
আসগর যাওয়ার পরে প্রতিমাসে দুটো করে চিঠি আসে বাড়ীতে। একটা সবার জন্য। আরেকটা শাহানার জন্য। সবাই কেন জানি উদ্বিগ্ন হয়ে থাকে শাহানার চিঠিতে কি এমন লেখা থাকে তা জানার জন্য। শাহানা ভেবে কুল পায় না এসব আবার জানানোর কি আছে। সব চিঠির ভাববস্তু মুলত একই। তাও শাহানা প্রতিরাতে চিঠিগুলো পড়ে, আরেকটা চিঠি না আসা পর্যন্ত। একেকটা চিঠি যে সে কতবার করে পড়ে তার ইয়াত্তা নেই। সব চিঠিগুলো সে এখনই গড়গড় করে বলে দিতে পারবে।
সারাক্ষণই মানুষটার জন্য মনটা কেমন করে শাহানার। এত সুন্দর করে চিঠি লেখে মানুষটা। মনে হয় এই তো সামনে বসে বসে কথাগুলো বলছে যেন। বিয়ের সময় ছেলেপক্ষ বললো, কদিন পরেই ছেলে বিদেশ যাবে। এজন্য বিয়ে দেয়া। বউ বাড়ীতে থাকলো বছর দেড়েক পর তো ছেলে ছুটি পেলেই আসবে। কিন্তু দিন আর কাটে না শাহানার, এক একটা দিন মনে হয় এক একটা বছর। কবে আসবে মানুষটা, এই প্রতিক্ষায় দিন কাটে কেবল। পোষ্টম্যান যখন চিঠি নিয়ে আসে, সে এক আনন্দের মুহূর্ত শাহানার কাছে। সে জানে লম্বা এক চিঠি লিখবে তাকে আসগর। শাহানার দেয়া চিঠির উত্তরের সাথে সাথে নিজের একগাদা কথা লিখে পাঠাবে মানুষটা। শাহানার কেন জানি মনে হয়, বিদেশে মানুষটার মন টেকে না। যতই লেখা থাকুক, “আমি ভালো আছি, আমার জন্য চিন্তা করবে না।” ততই বুকটা হা হা অরে ওঠে কেবল। শাহানার খুব জানতে ইচ্ছা হয়, সেই দেশটা কেমন।
সবাই বলে বিদেশে গেলে খালি টাকা আর টাকা। শাহানা নিজেও বিশ্বাস করে সেটা। মানুষটা হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করে চিঠির সাথে টাকাও পাঠায় নিয়মিত। তা দিয়েই তো সব ধারদেনা শোধ হয় যেখানে যা আছে। এর মধ্যে কয়েকবার সে বড় চাচার বাড়ী থেকে ঘুরেও এসেছে। কেবলই তার মনে হয়েছে এটা অন্যের বাড়ী। দু’দিনের বেশী সে থাকতেও পারেনি স্থির হয়ে। কেবলই মনে হয়েছে মানুষটার চিঠি আসবে হয়তো। চিঠিটা কেউ পড়ে ফেলবে তার অনুপস্থিতিতে। একরকম উতলা হয়ে ফিরে এসে কোনো চিঠিই দেখেনি। নিজের উপর এজন্যই মাঝে মাঝে বড্ড রাগ লাগে শাহানার।
এইতো এয়ারপোর্টে আসগর তাকে বলেছিলো, “তোমার হাতটা একটু এগিয়ে দাও, ধরে রাখি।” মানুষ গিজিগিজ
করছে চারিদিকে, এর মধ্যে সব আত্নীয়স্বজনও আছে আশেপাশে, কিভাবে হাত ধরবে সে? লজ্জা করবে না? মাথা নিচু করে শাহানা বলেছিলো, “সবাই আছে যে। লজ্জা করছে আমার।” আসগর আর জোর করেনি। এখন শাহানার মনে হয় মানুষটা ফিরে আসলেই তাকে বলবে, “এখন থেকে যে কদিন বাড়ীতে আছো, আমি তোমার হাত ধরে বসে থাকবো।” যতটা না কয়েকমাস বিয়ের পর চিনেছিলো দুজন দুজনকে, এখন তার থেকে আরো বেশী চিনে ফেলেছে এই চিঠিতে। শাহানার মনে হয়, এমন অনেক কথা সে চিঠিতে লিখেছে, যা কখনো কোনো দিন আসগরকে সামনাসামনি মুখে বলতে পারতো না। পারবেও না কখনো। যে কথা মুখে বলা যায় না, সে কথা অকপটে লিখে বলা যায় বিনা সংকোচে।
সকাল সকাল ভাতের মাড় গলাতে যেয়ে হাত ফসকে গরম ভাতের হাড়ি উলটে পড়লো শাহানার হাতে। হাতে ফোস্কা পড়ে গেছে একেবারে বেশ খানিকটা জায়গা জুড়ে। পানিতে হাত ডুবিয়ে বসে থাকলো শাহানা বেশ কিছুক্ষণ। পুকুরপাড়ে বসে থাকতে থাকতে একটা কাক মাথার উপর দিয়ে উড়ে পাশের ফুল গাছের উপরে বসে কা কা করে ডাকতে লাগলো। মনটা কেমন জানি করে উঠলো শাহানার। কাক কা কা করলে নাকি সেটা অলুক্ষণ। শাহানা ভাবলো মানুষটার কোনো বিপদ হলো না তো। পুকুর পাড়ে থাকা একটা কাঠের ছোট্ট টুকরা ছুড়ে মারলো কাকের দিকে। কাকটা উড়ে অন্য ডালে যেয়ে বসলো। শাহানার কেন জানি খুব অস্থির লাগছে। এমন হচ্ছে কেন কে জানে। অবশ্য চিঠি এসেছে কিছুদিন আগে। কিন্তু এই মুহূর্তের খবর তো আর জানা যাচ্ছে না।
আসগরের মৃত্যুর সপ্তাখানেক পরে খবর এলো আসগর মারা গেছে উঁচু ভবনের একটা অংশ ধসে পড়ে। লাশটা
দেশে পাঠানোর অনেক চেষ্টা করা হয়েছিলো কিন্তু সেই ধ্বংসাবশেষ থেকে আলাদা করা যায়নি আসগরের দেহটা। একেবারে থেতলে গিয়েছিলো তার শরীরের প্রতিটা অংশ। আসগরের জিনিসপত্রগুলো ফেরত এসেছে। মানুষ মরে যাওয়ার সাথে সাথে সাথে তার সকল জিনিসপত্রও বোধহয় মরে যায়। নয়তো এমন অপরিচিত গন্ধ লাগছে কেন সবকিছুতেই।
শাহানার দেয়া শেষ চিঠিটা ফেরত এসেছে আর সাথে আসগরের পাঠানো শেষ চিঠিটাও এসেছে। শাহানা আগের মত করেই চিঠি পড়ছে। কই? তার তো একবারের জন্যও মনে হচ্ছে না মানুষটা মরে গেছে। এই তো লিখেছে, যেন আরো বড় চিঠি লেখে তাকে শাহানা। সেই চিঠিটা শাহানা যত্ন করে তুলে রাখে তার সমস্ত চিঠির সাথে। পরের চিঠি লিখতে হবে তাকে অনেক বড় করে লিখবে। লিখেই যাবে। মানুষটা বড় চিঠি চেয়েছে আরো। না লিখলে হয়? উত্তরের অপেক্ষা সে করবে না আর। কেন করবে? চিঠি লিখলেই যে জবাব পেতো আগে, এখন সেই জবাব তাকে মনে মনে খুঁজে নিতে হবে। চিঠি লিখে সে রেখে দেবে নিজের কাছে যত্ন করে। কেউ জানুক আর না জানুক সে জানে, এই মানুষটাই তার সব থেকে আপন। বেঁচে থাকতে যে আপন ছিলো মরে যেয়ে সে পর হবে কিভাবে?
গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত