পুরো আলমারি তন্নতন্ন করে খুঁজে কোথাও সবুজ রংয়ের শাড়িটা পেলাম না। চিৎকার করে কয়েকবার নিহারকে ডাকলাম, কোনো সাড়া পেলাম না। বেশ কয়েকবার আম্মাকে ডাকলাম, আম্মা মনে হয় রান্নাঘর থেকে কিছু শুনতে পাননি। বেশ কদিন ধরে খেয়াল করছি আম্মা রান্নাঘরে থাকলে এদিকের কোনো কথাই উনি শুনেন না।
আম্মা গরুর মাংস বসিয়েছেন চুলায়, রান্নার ঘ্রাণ আমার নাক পর্যন্ত পৌঁছাতেই শাড়ির কথা ভুলে গেলাম। আম্মা গরুর মাংস খুব ভালো রাঁধেন। যদিও আম্মার হাতের কোনো রান্নাই আমার খেতে খারাপ লাগে না। ঠিক দুই মাস পর আজকে বাসায় গরু মাংস রান্না হচ্ছে। আব্বার রিটায়ারমেন্টের পর ফ্যামিলির খরচ চালানো কষ্টকর হয়ে যাচ্ছে। আমি কয়েকটা টিউশন জোগাড় করেছি, তবে এতে হয় না। আব্বা সামান্য কয়টা টাকা পেনশন পায়। সংসারের খরচ, নিহার আর নিশানের পড়াশোনার খরচ সব মিলিয়ে আব্বা হিমশিম খেয়ে যান। নিহার এসবের কিছুই বুঝতে চায় না। আগের মতো সব কিছুতেই বায়না করে। যখন যা লাগবে তখনই সেটা দিতে হবে ওকে। অথচ ক্লাস নাইনে পড়ুয়া নিশান নিহারের থেকে সংসারের অভাব ভালো বুঝে।
বিকেল চারটায় রাজীবের সাথে দেখা করতে যাবো বলেছি। অনেক দিন থেকেই রাজীব দেখা করার কথা বলছে। রাজীব আমার প্রেমিক না আবার খুব ভালো বন্ধুও না। রাজীব পেশায় একজন ডাক্তার। দু’বছর আগে সিড়ি থেকে পড়ে পা মচকে হাসপাতালে যেতে হয়েছে। রাজীব তখন ইন্টার্ন ডাক্তার। পায়ের ব্যান্ডেজ করতে করতেই রাজীব আমার সাথে কথা বলেছিলো। আমি চোখে মুখে বিরক্ত নিয়েই কোনোরকমে তার কথাগুলোর জবাব দিচ্ছিলাম।
রাজীব দেখতে খুব স্মার্ট। বর্তমান যুগের ডাক্তার যেমন হয় আর কি! সুন্দরের প্রশংসা করতে গেলে ফুল মার্কস থেকেও কিছু মার্কস বেশি দিতে হবে। কিন্তু সেসব কিছুই আমার মনে জায়গা করে নেয়নি। আমার চিন্তা ছিলো ফ্যামিলি নিয়ে। আব্বার রিটায়ারমেন্টের পর সংসার কিভাবে চলবে সেটা নিয়ে। অনার্স পাশ করে কোনো চাকরী হবে নাকি সেটারও কোনো নিশ্চয়তা নেই।
ব্যান্ডেজ শেষে রাজীব আমাকে প্রেসক্রিপশন ধরিয়ে দিয়ে সাথে তার ফোন নম্বরটাও দিয়েছিলো। পায়ের কোনো প্রবলেম হলে যেনো তাকে জানাই। আমি কিছুই না বলে নিহারকে নিয়ে হাসপাতাল থেকে চলে এসেছিলাম।
পথে আসতে আসতে নিহার রাজীবের ব্যাপারে অনেক কথা বললো, আমি চুপ করে ছিলাম। নিহার সব ব্যাপারেই এমন। কিছু একটা পেলে সেটা নিয়ে অনেকক্ষণ কথা বলবে। তারপর কেউ পাত্তা না দিলে চুপ করবে। রাজীবের সাথে আমার কোনো যোগাযোগ হয়নি আর। পায়ের ব্যান্ডেজ খুলেছিলাম পাশের ডিসপেন্সারিতে গিয়ে। আমার পড়াশোনা, টিউশন সব মিলিয়ে খুব ব্যস্ত কাটছিলো দিন। রাজীবের কথা মনে ছিলো না। অবশ্য রাজীবকে মনে রাখার মতো কিছু ছিলোও না। সে আমার কাছে সামান্য একজন ডাক্তারই ছিলো। তাকে নিয়ে অন্য কিছু আমার মাথায় আসেনি।
আব্বা একদিন আমাকে ডেকে বললেন, উনার রিটায়ারমেন্টের আগেই উনি আমাকে বিয়ে দিতে চান। ভালো একটা বিয়ের প্রস্তাব নাকি এসেছে। ছেলে ডাক্তার। আমার মাথায় তখন রাজীবের কথা ঘুরছিলো। পাত্র রাজীব নয় তো! আমি আব্বাকে কিছু না বলেই নিজের রুমে চলে এসেছিলাম। বিয়ের জন্য তখনো আমি প্রস্তুত ছিলাম না। এক সপ্তাহ পরই ছেলেপক্ষ আমাকে দেখতে এসেছে।কিন্তু ছেলে আসেনি। আমাকে দেখে তারা বলে গেলো এক সপ্তাহ পর জানাবে। আব্বা অপেক্ষায় রইলো, কিন্তু এক সপ্তাহ পর আর ছেলেপক্ষ কিছু জানায়নি। আব্বা আশা ছেড়ে দিয়েছিলেন। এরপর থেকে বিয়ের যত প্রস্তাব এসেছে আমি রাজি হইনি।
আব্বার রিটায়ারমেন্টের পর রাজীব আমাকে হঠাৎ একদিন কল দিলো। কোথায় নম্বর পেয়েছে জানতে চাইলে কিছুই বললো না। আমিও জোর করলাম না। এতটা কৌতুহল হলো না আর ইচ্ছেও করেনি আসলে জানতে। এরপর থেকে রাজীব আমাকে প্রায়ই কল দেয়, ২-৩ মিনিট কথা বলেই আমি কেটে দিই বিরক্ত হয়ে। এতো ব্যস্ততার পর কারো সাথে অযথা আলাপচারিতা আমার ভালো লাগে না। রাজীব বেশ কয়দিন ধরেই আমার সাথে দেখা করতে চায়, কিছু বলতে চায়। আমিও তাই অনিচ্ছাসত্ত্বেও কথা দিয়েছিলাম আজকে দেখা করবো। সবুজ রঙের শাড়িটা আব্বা আমার এক জন্মদিনে কিনে দিয়েছিলেন। আমার সবুজ রঙ খুব পছন্দ। কিন্তু শাড়িটা কোথাও পাচ্ছি না। হয়তো নিহারের কাছেই শাড়িটা। তিনটা বেজে গেছে। আম্মার আলমারি থেকে জলপাই রঙের একটা শাড়ি পরে রওনা হলাম। পথ যেনো শেষ হচ্ছে না। এতদিন পর একটা মানুষকে দেখবো। অথচ কেনো দেখা করতে যাচ্ছি সেটাই অজানা।
জ্যামে আটকে গন্তব্যে পৌঁছাতে সাড়ে চারটা বেজে গেলো। রিকশা থেকে নেমে চারপাশে তাকিয়ে কোথাও রাজীবকে দেখতে পেলাম না। ফোন দেয়ার চেষ্টা করলাম, ফোন বন্ধ। সন্ধ্যে সাতটা পর্যন্ত দাঁড়িয়ে থেকে আর পারছিলাম না। পুরোটা রাস্তা কান্না করতে করতে আসলাম। জানিনা এ কিসের কান্না! কেনো এমন একটা মানুষের জন্য কাঁদছি যার জন্য আমার মনে কোনো জায়গাই নেই। বাসায় এসে কলিং বেল চাপতেই নিহার দরজা খুলে দিলো। অবুঝের মতো নিহারকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদলাম। আম্মা ওপাশ থেকে বললেন, “কান্না থামাও, ছেলেপক্ষ তোমাকে দেখতে এসেছেন। রুমে গিয়ে তৈরি হয়ে এসো!” আম্মার কথাগুলো সূঁচের মতো কানে এসে বিঁধলো। তবুও কিছু না বলে রুমে চলে এলাম। সবুজ রঙের শাড়িটা খাটের উপর ভাঁজ করে রাখা, নিহার রেখেছে সম্ভবত। এই মুহুর্তে নিহারকে কিছু জিজ্ঞেস করার অবস্থায় নেই আমি। সবুজ শাড়িটা পরে রেডি হয়ে নিলাম। বুকের ভেতরের আর্তনাদ যেনো থামছেই না। কিন্তু কেনো এমন লাগছে আমার? কার জন্য এমন লাগছে?
নিহার এসে জানালো ছেলেপক্ষ আব্বার সাথে আগেই কথা পাকা করে এসেছে, তারা চায় আজকেই যেন বিয়েটা হয়। আব্বা জানিয়ে দিয়েছে আমি যেন কোনো দ্বিমত না করি। কেননা এমন ভালো প্রস্তাব সবসময় আসে না। ছোটবেলা থেকেই আব্বার সব কথা শুনে এসেছি। বিয়ের ব্যাপারে এতোদিন আব্বাকে অপেক্ষা করিয়েছি, আর কতো! আমিও দ্বিমত করলাম না। ছেলের ব্যাপারেও আমার কিছু জানতে ইচ্ছে করছে না। রাত দশটা! বিয়ের সব কাজ শেষ। রাতের খাবার শেষ করেছে সবাই। ছেলেপক্ষ থেকে কেবল ছেলে, তার বাবা-মা আর ভাই এসেছে। এখনই আমাকে সাথে করে নিয়ে যেতে চায়। আম্মা এসে আমাকে জড়িয়ে কাঁদলেন কিছুক্ষণ। আমি অসাড় হয়ে আছি। আম্মার কান্না আমার মনে কোনো প্রভাব ফেলছে না। এই মূহুর্তে রাজীবের জন্যেও আমার কোনো কষ্ট হচ্ছে না। সব নিয়ম শেষ করে কন্যা বিদায় দিয়ে আম্মা-আব্বা দায় মুক্ত হলেন যেনো।
শাশুড়ি মা গাড়ি থেকে নেমেই বাসায় গিয়ে আমাকে বরণ করলেন। মানুষটা আম্মার মতো অমায়িক। আমাকে একা রুমে রেখে উনি চলে গেলেন। চুপচাপ বসে আছি। অজানা, অচেনা একটা ঘর। কেউ আমার পূর্ব পরিচিত না। আব্বা-আম্মা আর ছোট ভাইবোন দুইটার জন্য খুব কান্না পাচ্ছে। “উফফ স্যরি! হাসপাতাল থেকে ইমারজেন্সি কল আসায় হাসপাতালে ছুটতে হয়েছিলো। ফোনটাও বন্ধ হয়ে গিয়েছিলো। তাই তোমাকে কিছু না জানিয়েই হাসপাতাল থেকে তোমাদের বাসায় চলে যেতে হয়েছিলো।” আমি চুপ করে কথাগুলো শুনলাম। আমার মনে হচ্ছিলো রাজীব কথাগুলো বলছে। মানুষটার দিকে তাকানোর সাহস পাচ্ছি না, যদি আমার এই মনে হওয়াটা মিথ্যে হয়ে যায় !
“কি হলো? রাগ করেই থাকবে? একটু তাকাবে না আমার দিকে?” আমি কিচ্ছু না ভেবেই মানুষটার বুকে ঝাপিয়ে পড়লাম। মনে হলো হ্যা, এটাই রাজীব। আমার ভুল হচ্ছে না কন্ঠ না চিনতে! হাউমাউ করে কাঁদছি আমি। এক জীবনের সব সুখের কান্না কেঁদে ফেলছি বোধহয়। রাজীব কিচ্ছু বলছে না, আমার কান্না থামানোর চেষ্টাও করছে না। অনেকক্ষণ পর আমার কানের কাছে মুখ এনে বললো, “আল্লাহ না চাইলে আর নিহার না থাকলে এভাবে তোমার কান্না দেখার সুযোগ হয়তো পেতাম না।” তার মানে নিহার আমাকে না জানিয়েই এতো সব করেছে! অথচ আমাকে কোনো কথা না জানালে তার পেটের ভাত যেনো হজম হতে চাইতো না।
আব্বার দেয়া সবুজ শাড়িটা পরে আছি। এই শাড়িটা আমার পছন্দের তাই রাজীব বিয়ের শপিং করে আর আমাদের বাসায় নেয়নি সেসব। জানিনা এই শাড়িটা হয়তো আমার জীবনের সুখের প্রতীক! রাজীব আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ফিসফিস করে “আলহামদুলিল্লাহ” পড়ছে। আমিও পড়ছি আর কাঁদছি। এ যে সুখের কান্না আমার !
গল্পের বিষয়:
গল্প