শাস্তি

শাস্তি
মায়ের রক্তাক্ত দেহটা দেখে আমি মোটেই বিব্রত নই, অথবা নেই কোনো দুঃখ বোধ। কারণ খুনটা আমি নিজেই করেছি, তবে ভাববেন না আমি খুন করার জন্য উপযুক্ত কিংবা আমি একজন জুয়ান তাগড়া ছেলে, এখনও আমার বয়স চৌদ্দ পার হয়নি। তবে জীবন সংসার সম্পর্কে আমার জ্ঞান পরিপক্ব। সবকিছু সহ্য করা গেলেও মায়ের নষ্টামি সহ্য করা যায় না। আর সেই নষ্টামিটা যদি হয় পিতা-পুত্রের সামনে, তবে সেটা অসহনীয় পর্যায়ে চলে যায়।
বাবা বিছানাগত প্রায় বছর খানেক। স্টোক করে শরীরের এক পাশ প্যারালাইজড হয়ে গেছে, কথাও বলতে পারেন না। সংসার খরচের জন্য আমাদের চিন্তা করতে হয় না। এ বাড়িটা ছাড়াও আমাদের আরও দুইটা বাড়ি আছে। বিশাল সম্পদের মালিক আমার বাবা।
বাবার চিকিৎসার জন্য কম খরচ হয়নি, বিদেশও নেওয়া হয়েছে। কিন্তু তিনি ভালো হয়নি, বিছানাকেই জীবন সঙ্গী করে নিয়েছেন। প্রথম প্রথম মাকে দেখতাম বাবার খুব যত্নয়াদী করছেন। খুব কেয়ার করত বাবার। দেখে খুব ভালো লাগতো, কিন্তু কিছুদিন যেতেই মায়ের রূপ পরিবর্তন হতে লাগলো। এখন আর আগের মতো কেয়ার নেন না। এমনকি আমাকে পর্যন্ত ভুলে গেলেন। সন্ধার পর মাকে প্রায়ই বাইরে যেতে দেখতাম, তবে তেমন কিছুই বলতাম না। কিছু জিজ্ঞেস করলেই বিরক্তি নিয়ে বলতো, ‘কাজ ছিল, তাই বাইরে গিয়েছি। আর এতো বাবার মতো জেরা কর কেন?’
তারপর থেকে কিছু জিজ্ঞেসও করতাম না। সে থাকতো তার মতো, আমিও থাকতাম আমার মতো। তবে আমি নষ্ট হয়ে যাইনি। দিনের বেশি ভাগ সময় আমি বাবার সেবা করার চেষ্টা করেছি। কিন্তু বাবার মুখে হাসি দেখিনি কখনো, কেমন বিষণ্নতায় ডুবে থাকতেন। ইশারায় মার কথা জিজ্ঞেস করতেন। যখনই বলতাম বাইরে গেছে, বাবার মুখটা কালো হয়ে যেত। মাঝরাত হলে দেখতাম বাবার চোখ বেয়ে পানি পড়ছে। মা অনেক আগেই বাবার সাথে ঘুমানো বাদ দিয়েছে। আমি মাঝে মাঝে নিজেই বাবার পাশে ঘুমোতাম। একা একাই বাবার সাথে কথা বলতাম। বাবা মন দিয়ে শুনতেন আর করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতেন। সেই দৃষ্টিতে কী থাকতো আমি জানি না। শুধু এতটুকু বুঝতাম, তার অনেক কষ্ট! কিন্তু কষ্ট বোঝার মতো কেউ নেই। এই পর্যন্ত ঠিক ছিল, কিন্তু মা এবার ক্লাবের বন্ধুদের বাড়িতে আনা শুরু করলেন। সন্ধ্যার পরেই মদের আসর জমাতেন ড্রয়িং রুমে। কিছু বললেই বলতো, ‘দেখ মেহেদি আমার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে তোমার ইন্টারফেয়ার করা উচিত নয়। কই? আমি তো তোমার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে কিচ্ছু বলি না।’
এসব দেখেও সবকিছু সহ্য করে নিয়েছি। কিন্তু তখন আর সহ্য করতে পারলাম না, যখন একটি নির্দিষ্ট লোকের সাথে মা রাত কাটানো শুরু করলের। মদের আড্ডা শেষ হলে সবাই চলে গেলেও ওই লোকটি যেত না। ড্রয়িং রুমে হাসতে হাসতে লোকটি মাতাল অবস্থায় মায়ের গায়ে হাত দিতে দেখেছি। তারপর চলে যেতে দেখেছি মায়ের বেড রুমে। আসলে মা সম্পর্কে এইসব কথা বলা যায় না। বাবা সবকিছু সহ্য করলেও এই বিষয়টা সহ্য করতে পারলেন না। রাগে তার শরীর লাল হয়ে যেত। মাঝে মাঝে অদ্ভুত শব্দ করে কাঁদতেন। কিন্তু তার অপ্রকাশিত শব্দের কান্না বড় কষ্টের ছিল। যে কান্না আমাকে সাংঘাতিকভাবে পীড়া দিত।
মাকে বুঝানোর চেষ্টা করেছি, শোনেনি। ঝগড়া করেছি প্রচুর, কাজ হয়নি। তার উশৃঙ্খলতা দিন দিন বেড়েই চলছিল। মায়ের এহেন মানসিক অত্যাচারে বাবা একদিন হঠাৎ করে মারা গেলেন। মাকে ব্যথিত হতে দেখেনি, বা দেখেনি তার চোখে নির্মলা জল। তবে আমার চোখের জল আমি আটকাতে পারিনি। হাউমাউ করে কেঁদেছিলাম বাবার নির্লিপ্ত লাশটা ধরে।
এক সময় চোখের কান্না থেমে গেছে, সেখানে ভর করেছে ক্রোধ। ভর করেছে অসামাজিক নষ্টামির প্রতিশোধ। এই যে মায়ের লাশটা সামনে পড়ে আছে! না কোনো কষ্ট নেই, নেই কোনো দুঃখবোধ। বাবার মৃত্যর তিন দিনের মাথায় মাকে খুন করলাম। হয়তো আপনারা আমাকে সাইকো ভাবছেন, আসলে আমি সাইকো নই। খুব ঠান্ডা মাথায় মাকে খুন করেছি। যে তার স্বামী-সন্তানের সামনে নষ্টামি করতে পারে, সে আর যাই হোক; পৃথিবীতে বাঁচার অধিকার রাখে না। আর অধিকার রাখে না মা ডাক শোনার।
পুলিশ স্টেশনে কল দিয়েছি। হয়তো কিছুক্ষণের ভেতর পুলিশ এসে পড়বে। আমি ইচ্ছে করলে পালাতে পারতাম, কিন্তু পালাইনি। প্রতিটি পাপের শাস্তি আছে, আমারও শাস্তি হওয়া উচিত। যেমনটা পাপের শাস্তি ভোগ করেছে আমার মা এবং বাবা। বাবার কথা শুনে আঁতকে উঠলেন বুঝি ! বাবার অসহায়ত্ব দেখে তাকে হয়তো গ্রগাঢ় ভালোবাসতাম, কিন্তু আমি জানি বাবার এই বিশাল সম্পত্তির সবটাই ছিল অবৈধ, ঘুষের টাকার রাজ মহল ।
গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত