সৌন্দর্য্য

সৌন্দর্য্য
লাঞ্চ শেষে অফিসে কাজের খুব একটা চাপ থাকে না।তেমনি আজকেও কাজের খুব একটা চাপ নেই। আমি চেয়ারে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে আছি। এমন সময় রাকিবুলের (অফিসের পিয়ন) ডাকে চোখ মেলে তাকালাম। রাকিবুল বললো,
~স্যার, আপনার সাথে একটা মেয়ে দেখা করতে এসেছে। আমি অবাক হয়ে বললাম,
— আমার সাথে একটা মেয়ে দেখা করতে এসেছে! তাও আবার অফিসে! রাকিবুল বললো,
~স্যার, দেখে তো মনে হচ্ছে কোনো বস্তি থেকে এসেছে। হতে পারে কোন চাকরি নয়তো সাহায্যের জন্য এসেছে।
আমি রকিবুলকে বললাম মেয়েটাকে পাঠিয়ে দিতে। মেয়েটা আমার রুমে আসলে মেয়েটাকে আমি চেয়ারে বসতে বললাম। মেয়েটা চেয়ারে বসতে বসতে বললো,
– আমার নাম শোভা। আগামীকাল বিকালে আপনার আমাকে দেখতে যাওয়ার কথা। কথাটা শুনে আমার মনে হলো মা আমায় বলেছিলো কাল আমার বিয়ের জন্য মেয়ে দেখতে যাবে। আমি নীরব হয়ে মেয়েটাকে কতক্ষণ দেখলাম তারপর অবাক হয়ে বললাম,
–কিন্তু আপনি হঠাৎ অফিসে আসলেন! মেয়েটা মুচকি হেসে উত্তর দিলো,
-অফিসে এসে আপনার সময়টা বাঁচালাম আর আমিও অপমানের হাত থেকে কিছুটা রক্ষা পেলাম।
— মানে! আপনার কথাটা ঠিক বুঝলাম না! মেয়েটা এইবার আমার চোখে চোখ রেখে বললো,
-মানেটা খুবই সহজ। আমি যখন আপনাকে বললাম আপনার আমাকে দেখতে যাওয়ার কথা তখন আপনি খুব ভালো করে আমার দিকে তাকিয়েছিলেন। আর আমি লক্ষ্য করেছি ঠিক তখনি আপনার কপালের চামড়াটা কুঁচকে গিয়েছিলো। এর কারণ হলো আমি দেখতে কালো। আজকাল বিয়ের জন্য মেয়ের গুণ দেখে না কেউ; দেখে শুধু গায়ের ফর্সা চামড়াটা।যেটা আমার নেই। আমাকে দেখে আপনাম মা আমার বাবাকে বলবে, “আমার ছেলের জন্য একটা সুন্দরী মেয়ে দরকার।” তারপর আপনারা চলে যাবেন আর আমার তখন বাবার মুখে অকথ্য ভাষায় গালাগালি শুনতে হবে। আমাকে জন্ম দেওয়ায় উনাদের পাপ হয়েছে, আমি কেন এখনো মরি না আরো অনেক কিছু শুনতে হবে। আমার এইকথাগুলো যেন শুনতে না হয় তাই আপনার এইখানে আসা। আমাকে যেহেতু দেখেছেন, আশাকরি কাল আর আমায় দেখতে আসবেন না। কথাগুলো বলে মেয়েটি যখন চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালো তখন আমি বললাম,
— আপনার কেন এমন ধারণা হলো আপনাকে আমার পছন্দ হবে না? মেয়েটি হাসতে হাসতে বললো,
– পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে বলেছি। এটা ২০০পৃষ্ঠার কোনো উপন্যাস না যে একটা কালো মেয়েকে দেখে যুবরাজের পছন্দ হয়ে গেলো তারপর তারা সুখে শান্তিতে সংসার করতে লাগলো। এটা বাস্তব জীবন।আর এই বাস্তব জীবনে একটা কালো মেয়েকে প্রতিটা পদে পদে অপমানিত হতে হয়। আপনাকে সমান্য কয়েকটা উদাহরণ দেই। আমি যখন আপনার জন্য অপেক্ষা করছিলাম তখন আমার পাশে সুন্দরী একটা মেয়ে কারো জন্য হয়তো অপেক্ষা করছিলো । আপনার পিয়ন সেই মেয়েটাকে চা দিলো অথচ আমি পাশে বসা.. আমার দিকে ফিরেও তাকালো না।
পাহেলা ফাল্গুনের দিন আমিও সবার মত লাল শাড়ি পরলাম। সবার মত আমিও সাজলাম। বাহিরে বের হওয়ার জন্য যখন বের হলাম তখন পাশের বাসার আন্টি আমার দিকে আড়চোখে তাকিয়ে বললো, “যতই মেকাপ করো না কেন কাক কখনো বক হবে না!”
সেদিনের পর আর সাজতে ইচ্ছে হয় নি কারণ কালো মেয়েদের সাজতে হয় না বান্ধবীর গায়ে হলুদে সবার মত আমিও হলুদ শাড়ি পরেছিলাম। চেয়েছিলাম আমিও সবার মত বান্ধবীর সাথে সেলফি তুলবো কিন্তু বান্ধবীর সেলফিতে সবার জায়গা হলেও আমার জায়গা হয় নি। কারণ আমি সেলফির ভিতর থাকলে ওদের সেলফিটা নষ্ট হয়ে যাবে। এরপর আর কখনো সেলফি তোলার ইচ্ছে হয় নি। কারণ কালো মেয়েদের সেলফি তুলতে নেই আমাদের ভার্সিটির একটা মেয়ে ধর্ষিত হয়েছিলো। আমরা প্রতিবাদ করার জন্য সবাই যখন আলোচনা করছিলাম তখন হঠাৎ একজন বললো, ” মেয়েটা যদি শোভার মত হতো তাহলে ধর্ষিত হতো না। কারণ ধর্ষণকারী চেহারা দেখেই ভূত ভেবে দৌড়ে পালাতো।” কথাটা শুনে সবাই হাসতে লাগলো আর আমি নীরবে চোখের জল ফেললাম। কথাগুলো শেষে মেয়েটি চোখের কোণে জমে থাকা জলটা আড়াল করে আমায় বললো,
– আপনি দেখতেও সুদর্শন আর ভালো জব ও করেন। যেকোনো সুন্দরী মেয়ের বাবা আপনার কাছে মেয়ে বিয়ে দিতে রাজি হবে। তাই শুধু শুধু আমার মত মেয়েকে দেখতে এসে নিজের সময় নষ্ট করবেন না। আর আমাকেও আর অপমানিত করবেন না। কথাগুলো বলে মেয়েটি চলে যায় আর আমি রাকিবুলকে ডেকে বললাম,
— নেক্সট টাইম এই মেয়ে যখন অফিসে আসবে তখন চা, কফি সব উনার সামনে দিবে। রাকিবুল মাথা চুলকাতে চুলকাতে বললো,
~ কেনো স্যার? আমি রাকিবুলের দিকে তাকিয়ে বললাম,
— কারণটা কয়েকদিন পর বুঝবে। বাসায় এসে মাকে বললাম,
– মা, তুমি আমার জন্য কেমন বউ চাও? মা হাসতে হাসতে বললো,
–লাল টুকটুকে খুব সুন্দরী একটা বউ চাই। আমি মা’র হাতটা ধরে বললাম,
-মা, ধরো তুমি আমাকে খুব সুন্দরী একটা মেয়ে বিয়ে করালে। কিন্তু সেই মেয়েটার চরিত্র ভালো না। বিয়ের পর মেয়েটা তোমার থেকে আমাকে আলাদা করে দিলো। আমিও তোমার থেকে দূরে সরে গেলাম। কারণ মেয়েটার সৌন্দর্য্যে আমি আটকে গিয়েছিলাম। তখন তুমি কি করবে মা? আমার দূরে যাওয়াটা কি তুমি সহ্য করতে পারবে?
মা কিছু বললো না শুধু অবাক চোখে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো। আমি তখন মাকে বললাম,
— মা আমি লাল টুকটুকে বউ চাই না। আমি চাই এমন একটা মেয়ে যে আমাদের সবাইকে একই সুতোয় বেঁধে রাখবে। আলাদা ভাবে কথা বলার জন্য আমি আর শোভা ছাদে দাঁড়িয়ে আছি। কিছুটা রেগে গিয়ে শোভা আমায় বললো,
– আপনাকে না করার পরেও আপনি আজ এসে পড়েছেন! খুব ইচ্ছে আমায় অপমান করার? আমি মুচকি হেসে বললাম,
— রাগলে তোমায় খুব সুন্দর লাগে। শোভা বিরক্ত হয়ে বললো,
-এইসব ডায়লগ সুন্দরী কোনো মেয়েকে দিবেন। আমাকে না। আমি ব্যস্ত শহরটার দিকে তাকিয়ে বললাম,
–প্রচন্ড সুন্দরী মেয়ের ১০তম ভালোবাসার মানুষ হওয়ার চেয়ে কালো মেয়ের প্রথম ভালোবাসা হওয়া অনেক ভালো।
শোভা অবাক হয়ে বললো,
-মানে! আমি মুচকি হেসে বললাম,
— মানেটা খুবই সহজ। ভার্সিটি পড়াকালীন ক্লাসের সবচেয়ে সুন্দরী মেয়ে সুপ্তির সাথে আমার রিলেশন হয়। রিলেশনের কয়েকদিন পর জানতে পারি সুপ্তির আমার আগেও কয়েকটা রিলেশন করেছে। আর আমার সাথে রিলেশন করার পরেও আরো একটা রিলেশন কন্টিনিউ করছে। অথচ আমায় সে মিথ্যা বলেছে। আমার কথা শুনে শোভা চুপ হয়ে আছে। আমি ওর হাতটা ধরে বললাম,
— একটু খেয়াল করে দেখো ২০০ পৃষ্ঠার উপন্যাসটাও কারো না কারো জীবনের সাথে মিলে যায় আমাদের বিয়ের তিন মাস পর একদিন হঠাৎ সুপ্তি আমায় ফোন করে। আমি ফোন রিসিভ করতেই সুপ্তি অপর প্রান্ত থেকে হাসতে হাসতে বলতে লাগলো,
-ফেইসবুকে তোমার আর তোমার বউয়ের ছবি দেখলাম। খুব তো বড় গলায় বলেছিলে আমার চেয়ে ও সুন্দরী মেয়েকে বিয়ে করবে। তা এই তোমার সুন্দরী বউয়ের নমুনা? আমি তখন বললাম,
— আমাদের বিয়ের ৩মাস হয়ে গেছে।এই ৩মাসে আমার স্ত্রী আমাকে একটাও মিথ্যা কথা বলে নি। এই ৩মাসে এমনটা কখনো হয় নি যে আমার স্ত্রী আমার আগে খেয়েছে। হয় আমার সাথে খেয়েছে না হয় আমার খাওয়ার পর। এই ৩মাসে আমি একদিনও দেখি নি আমার মা রান্না করতে।সব রান্না আমার স্ত্রী করে। এই ৩ মাসে আমি একদিনও দেখি নি আমার স্ত্রী আমার সাথে কিংবা আমার মা’র সাথে গোমড়া মুখে একটা কথা বলতে। তোমার চোখে সুন্দর মানে সাদা চামড়া আর আমার চোখে সুন্দর মানে চামড়ার ভিতরের মানুষটা। তোমার সৌন্দর্য্য আর ৫বছর পর এমনিতেই নষ্ট হয়ে যাবে কিন্তু আমার স্ত্রীর সৌন্দর্য্য আজীবন থাকবে। আমি কথা শেষ করতে পারি নি। তার আগেই সুপ্তি ফোন কেটে দিলো। এমন সময় শুনি শোভা মাকে বকা দিচ্ছে। মার অপরাধ মা কেন রান্নাঘরে গিয়েছে।
গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত