বীণামিকা কে আমি ভুলতে পারব না ! জানি এটা কোন দিন সম্ভব নয় ! একটা অদ্ভুত অপরাধ বোধ আমাকে প্রতিনিয়ত তাড়িয়ে বেড়ায় । কথা গুলো বলেই মাহাবুব চেয়ারটা সোজা করে সিটি হল থেকে সোজা পাহাড়ের দিকে তাকাল ।অদিতি প্রায়ই সাপ্পোরো সিটি হলে যায় ইতালিয়ান পেস্তা খেতে ।জাপানিজ আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান জাইকাতে চাকুরির কারনে অদিতি সাপ্পোরোতে আছে প্রায় দুই বছর হল । একা একা ঘুরে বেড়ানো আর নিজেকে কিছু সময় দেওয়ার মধ্যে একটা আলাদা সুখ আছে । এখানে কিছু ইন্ডিয়ান এবং নেপালি দেখা গেলে ও বাংলাদেশিদের খুব কম দেখা যায় ।
আর সেখানেই সে মাহাবুব কে দেখে । প্রথমে কয়দিন ভেবেছে হয়তো অন্য কোন দেশের হবে । তারপর পরিচয় । মাহাবুব কিউশু বিশ্ব বিদ্যালয়ের শিক্ষক ।এখানে এসেছে ছয় মাসের একটি প্রোজেক্ট এর কাজ নিয়ে।খুব অল্প পরিচয় । কিন্তু দুই সপ্তাহে বেশ আন্তরিক বোঝাপড়া হয়ে গেছে দুজনের মধ্যে। ব্যক্তিগত বিষয় আর সম্পর্ক এর এক প্রশ্নেই সে নিজের গল্পটা শুরু করল ।তারপর সে আবার চেয়ারের সামনে এসে বসল । নিজ থেকেই বলা শুরু করল ।
বুঝতে পারিনা । সৃষ্টিকর্তার অদ্ভুত খেয়াল । সে ছিল একটা সঙ্গীতের মতো প্রানবন্ত আর উচ্ছল । একটা দুর্দান্ত সুরের মূর্ছনা হয়ে আমার ভিতরের কান্নার শব্দ গুলোকে নিরব করে রেখে ছিল । আমার স্বপ্নের আকাশে জমা মেঘ গুলোকে সরিয়ে দিয়ে জোস্না রাতের চাঁদ নামিয়ে এনে ছিল । আমার জীবনের থেমে থাকা দুঃসময় গুলোকে দুর্দান্ত সমুদ্রের মতো করে তুলেছিল । আমি যেন আবার নতুন জীবন নিয়ে পৃথিবী দেখা শুরু করলাম । আমি তখন মাত্র ঢাকা বিশ্ব বিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে পড়াশুনা শেষ করে পুলিশ বাহিনীতে যোগ দিচ্ছি । এর মধ্যেই বাবা আমার জন্য মেয়ে দেখা শুরু করেছে । ট্রেনিং শেষ করে প্রথম চাকুরি এএসপি হিসেবে গাজিপুর থানা । সেখানেই আমার বিয়ে হল অরু নামের একটি মেয়ের সাথে । মেয়েটি অনার্স প্রথম বর্ষের ছাত্রী । দেখতে ভাল । আমার মতো ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে আগ্রহ । মনে মনে ভাবলাম ভালই হবে । কবিতা আর সাহিত্য আলোচনা করে সংসারটা সুন্দর ভাবেই কেটে যাবে । কিন্তু বিয়ের দ্বিতীয় দিন অরু আমাকে জানিয়ে দিল সে আমাকে কোন দিন ভালবাসতে পারবে না । কারন স্কুল জীবন থেকে সে তার চাচাতো ভাইকে ভালবাসে । সে আমাকে ঠকাতে চায়না । তার মা তাকে জোর করে আমার সাথে বিয়ে দিয়েছে ।
অদিতি খুব চুপচাপ তার কথা গুলো শুনছিল । তারপর বলল আপনি কি করলেন ?
জানিনা হঠাৎ শরীরের রক্ত প্রবাহ কোথায় যেন থেমে গেল । স্বপ্নের আকাশে উড়া বুনো পাখি গুলো পাখা ঝাপটে এক এক করে নিচে পড়ে যেতে লাগল । গভীর স্বপ্নে নদীতে পাল তোলা নৌকা নিয়ে হারিয়ে যাওয়ার পথ অন্য দিকে বাঁক নিল । এ কেমন নিয়তি ! নিজের স্বপ্নের জীবনটা বিষাদে ভরে উঠলো । আমি আর এই বিষাদের ভার বইতে পারছিলাম না । যাকে ভালবাসব বলে জীবনে জায়গা দিলাম সে আমাকে ভালবাসে না । যে ভালবাসে না কিংবা ভালবাসা চায়না তাকে নিয়ে ভাবা যে খুব কঠিন । বিবেক আমাকে থামিয়ে দিল । আমি একদিন অরুকে মুক্তি দিয়ে দিলাম । কিন্তু অরু খুশি হলেও অরুর মা কিছুতেই মানতে চাইল না । একটা ভাল পাত্র ,একটা চাকুরি একটা সামাজিক অবস্থান এই সব কিছুই হয়তো একটা সম্পর্ক তৈরি করেছিল । কিন্তু সেখানে মন নিয়ে ভাবনার কোন অবকাশ ছিল না তাই কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হলাম । অরু ফিরে গেল তার ভালবাসার মানুষের কাছে । আমি অনেক দিন অনেক বেশি কাজে মনোযোগী হয়ে গেলাম ।
অদিতি বলল ,কেন আপনি কাউকে খুঁজে নিতে পারতেন ।জীবন ছোট মনে হয় কিন্তু আসলে অনেক বড় । মাহাবুব মাথা ঝাঁকাল । কেউ একজন তো এসেছিল আমার জীবনে !
তারপর কোন একদিন । বীণামিকার গল্পটা শুরু হল ।সে ছিল ডাক্তার । মনের মতো পাত্র পাচ্ছিল না । ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে এক আসামী কে দেখতে গিয়ে পরিচয় । তারপর জানা শোনা । জীবনের অভিজ্ঞতা বিনিময় । তারপর সবটুকু দুঃখকে আপন করে নিয়ে বীণামিকা আমার জীবনে এল । তথাকথিত সমাজ এবং সামাজিক নিয়মের দৃষ্টি অনেকটা যেন বাঁকা চোখে তাকাল । কারন টা হল বীণামিকার জীবনে পূর্বে স্বীকৃত কেউ ছিল না । ঠিক অরু যেমন ছিল আমার জীবনে । সে হয়তো ভালবাসত কাউকে তা কেবল মনে মনে । শিক্ষা এবং পেশাগত জীবনেই সে সময় উপভোগ করেছে । অনেক ব্যস্ততা কে সঙ্গী করে । দুঃখ কে অতীত করে আমরা একটি নতুন জীবন রচনা করলাম । ওই যে সমাজ বলে একটা শব্দ আছে আমাদের জীবনে । অনেক গুলো সামাজিক সম্পর্ক দিয়ে একটা সমাজ । আর ওই সম্পর্ক গুলোর মধ্যে কিছু মানুষ আমার আর বীণামিকার সম্পর্কটা কে বিষিয়ে তুলল । আমরা বড় হিংসাত্মক আর হীন মানসিকতায় ভরপুর পৃথিবীতে জন্মেছি । সেখানে বেঁচে থাকাটা সত্যি কষ্টের । যে দুর্ঘটনার গল্প আমরা নিজেরা ভুলে যাই । যে দুঃস্বপ্নের ছায়া আমরা নিজেরা স্বীকার করিনা । তখন কিছু কুৎসিত মনের মানুষ খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মনে করিয়ে দিয়ে এক ধরনের বিকৃত আনন্দ পায় । আমার আর বীণামিকার সুন্দর নতুন জীবনটা অনেক হিংসুট চোখ যেন সহ্য করতে পার ছিল না । কখনও এই জটিল সমাজ আমার গল্প টেনে এনে বীণামিকার মনটা ছোট করে দিতো । আবার কখন ও বীণামিকার সাহস আর উদারতা কে সন্দেহের জালে আঁটকে দিত । এই যেন হীন সমাজ ব্যবস্থার অদ্ভুত আর নিভৃত কুৎসিত আনন্দ । ধীরে ধীরে বীণামিকা মানুষ আর সমাজ এড়িয়ে থাকতে ভালবাসত । একা থাকাতেই শান্তি পেত । আমি আমার কাজ নিয়ে অনেক বেশি ব্যস্ত থাকাতে ঠিক যেন ওর স্পর্শ কাতর আর সংবেদশীল মন টা কে বুঝে উঠতে পারিনি । একদিন বুঝলাম বীণামিকা কেমন যেন শুকিয়ে যাচ্ছে । চোখের নিচে গভীর দুঃখের ছায়া । ওর আগের চেহারাখানি আর নেই । ও ভিতরে ভিতরে খুব কষ্ট পেত । নিয়তি আর জীবন ওর কাছে ভীষণ দুর্বোধ্য হয়ে উঠেছিল । সেখানে মানুষের প্রতি মানুষের ভালবাসা ,স্নেহ ,সহানুভূতি ছিল না । মানুষের মন আর জীবন হৃদয় দিয়ে বুঝবার মানুষ নাই পৃথিবীতে । এই সব শূন্যতা ওকে অসহায় করে তুলে ছিল । ওর গভীর দুঃখবোধ অচেনা এক কঠিন রোগ ডেকে নিয়ে এল । আমি হারালাম আমার বেঁচে থাকা । আমার জীবন । আমি পুলিশের চাকুরিটা ছেড়ে দিয়ে উচ্চ শিক্ষা নিতে জাপান চলে এলাম । আর ফিরে যাওয়া হয়নি । অনেকদিন পর কোন বাংলাদেশির সাথে কথা বলছি ।খুব ভাল লাগছে । অদিতি একদম স্তব্ধ হয়ে গেল । সেদিনের পেস্তাটা আর খাওয়া হল না । কিছু গল্প যেন কোথাও কারও না কারও কাছে প্রকাশ করতে হয় । আবার কিছু গল্প থাকে কখনও প্রকাশ করা হয় না । ঠিক প্রকাশ করা যায়না । অদিতির একান্ত গল্পটা হয়তো সেই রকম কিছু । তাই আর সেদিন সে কোন কিছু ভেবে পাচ্ছিলনা । মাহাবুব এর দুঃখে পোড়া চেহারার দিকে আর তাকাতে ইচ্ছে করল না । কিছু বলতে ও ইচ্ছে করল না । শুধু জিজ্ঞেস করল ,কবে সাপ্পোরো ছেড়ে যাচ্ছেন ?
মাহাবুব একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে দিয়ে বলল ,সামনের সপ্তাহে । আপনি ?
অদিতি উত্তর দিল , সামনের বছর । কথাটা বলেই সে একটু আগে আগে বের হয়ে গেল । আর পিছনে তাকাল না । কারন দুঃখ হয়তো মায়া বাড়াতে পারে । মায়া মমতা খুব বেশি কঠিন আর ব্যাখ্যাতিত ।