ভালবাসা,তোমায় ­ দিলাম ছুটি

ফোনটা ভাইব্রেট করেই চলেছে । স্ক্রিনের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি । হাত কাঁপছে । এত দিন,এতবছর পর আবার সেই নাম্বার থেকে ফোন এসেছে বিশ্বাস হচ্ছে না । আজও নাম্বারটা দেখে হৃদস্পন্দন কয়েকগুণ বেড়ে যায় । মনের মাঝে প্রবল ঝড় বয়ে যায় । শেষপর্যন্ত রিসিভ করে ফেল্লাম । ওপাশ থেকে ভেসে এল সেই পরিচিত কন্ঠস্বর । এতবছর পরও একটুও বদলায়নি। সেই আগের মতই আছে ….
:হ্যালো ……..
…………… ­…………… ­…
কি হল? কিছু বলছ না যে?
:না আসলে পাঁচ বছর পর এই নাম্বার থেকে ফোন আশা করিনি । তাই বুঝতে পারছিনা যে কি বলব ।
:কয়েকদিন থেকেই তোমার কথা খুব মনে পড়ছিল । কিন্তু ফোন করার ঠিক সাহস পাচ্ছিলাম না । কাল থেকে তোমার কন্ঠ শোনার খুব ইচ্ছে করছিল । তাই আজ সাহস করে ফোনটা দিয়েই দিলাম । কেমন আছ তুমি ?
:মানুষ বদলে যায় কিন্তু তাদের কন্ঠ বদলায়না । হুম আছি নিজের মত করে । নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত আছি ।
:জিঞ্জেস করবেনা আমি কেমন আছি ?
:উহু,প্রয়োজন নেই । কিছু কিছু মানুষ আছে যারা সবসময় ভাল থাকে । তুমি হচ্ছ তাদের একজন ।
:(ওপাশে কিছুক্ষণ নীরবতা…….) আমার কথা মনে পড়েনি তোমার ?
:হ্যা পড়েছে । অনেক মনে পড়েছে । যথন দিনের পর দিন না খেয়ে থাকতাম তখন মনে পড়ত “তুমি ঠিকমত খাচ্ছ তো?” যখন রাতের পর রাত না ঘুমিয়ে,কেঁদে কেঁদে অসুস্থ হয়ে পড়তাম তখন মনে পড়ত “তুমি সুস্থ আছ তো?” যখন কোন আনন্দোত্সবে সবাই হইচই আর আনন্দে মেতে উঠত আর আমি ঘরের দরজা বন্ধ করে অন্ধকারে বসে থাকতাম তখন মনে পড়ত “তুমি সবারসাথে খুশি আর আনন্দে মেতে উঠছ তো?” যখন আয়নায় নিজের অযত্ন অবহেলায় শুকিয়ে যাওয়া চেহারাটার দিকে তাকাতাম তখন মনে পড়ত “তুমি নিশ্চই আরো সুন্দর হয়ে গেছ ।” একসময় অনেক মনে পড়েছে । এখন আর পড়ে না । এখন এত সময় কই এগুলো মনে পড়ার?
:(ওপাশে আবার নিরবতা ……) আমাকে কি ক্ষমা করা যায় না?
:ক্ষমা তো আমি তোমাকে পাঁচ বছর আগেই করে দিয়েছিলাম । তোমায় ক্ষমা না করলে আমার মনে তোমার দেয়া কষ্টগুলোর ক্ষত কোনভাবেই শুকাত না । আচ্ছা এখন তাহলে রাখি । এখন আমার আকাশ দেখার সময় । প্রতিদিন রাতে এইসময় আমিআকাশ দেখি । আকাশের সাথে কথা বলি । আকাশ কখনো আমার সাথে ছলনা করেনা । প্রতিরাতে সে তারার ঝুলি নিয়ে আমার সামনে হাজির হয় । আমি কথা বলি সে চুপচাপ শোনে । একটুও বিরক্ত হয়না ।
:……একরাত আকাশের সাথে কথা না বল্লে হয় না?আমাদের কথা থেকে আকাশের কথা কি খুব বেশি জরুরী?
:আপাতত তাই । আমার চরম অসহায়ত্ব আর একাকিত্বের সময় এই আকাশ আমায় সঙ্গ দিয়েছে । যে পাঁচ বছর আমায় দূরে সরিয়ে রেখেছিল তার জন্য আমি আমার পাঁচ বছরের পাশে থাকা সঙ্গীকে দূরে সরিয়েরাখতে পারবনা ।
আচ্ছা আমি এখন যাব । রাতের আকাশ আমার জন্য অপেক্ষা করছে । আজ খুব সুন্দর একটা চাঁদও উঠেছে আকাশে । আজ চাঁদের সাথেও কথা বলব ……
ফোনটা কেটে দিলাম । বারান্দায় এসে দাড়ালাম । আকাশের বুকে গোল একটা চাঁদ উঠেছে । তাকিয়ে আছি । খুব কষ্ট হচ্ছে । সেই পাঁচবছর আগের মত কষ্ট যখন তুমি আমাকে ছেড়ে চলে গিয়েছিলে । কি দোষ ছিল আমার?কেন চলে গিয়েছিলে?আজ ও তা আমি জানিনা । তারপরও অটুট বিশ্বাস,আশা ধরে রেখেছিলাম একদিন তুমি আসবে । আমি অপেক্ষা করব । করেছি,অনেক অপেক্ষা করেছি। ভেবেছিলাম যেদিন তোমার ফোন আসবে খুশিতে চিত্কার দেব । তোমার পানে ছুটে চলে যাব । দিন যায়,মাস যায়,বছর যায় কিন্তু তুমি আসনা । ভার্সিটি পাশ করার দু বছর হয়ে গেল । বাবা আমার আমাকে অনেক ভালবাসে । সেই বাবাকে পর্যন্ত বলে দিলাম বিয়ে করবনা । বাবার দীর্ঘঃশ্বাস,দুঃ ­খভরাক্রান্ত মন সবই উপেক্ষা করতাম । ঠিক পাঁচমাস আগে বাবা অনেক অসুস্থ হয়ে গেল । ডাক্তার বল্লেন মাইনর এট্যাক । এই বয়সে এত টেনশন ওনার সাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর । বাবার অসুস্থতার জন্য কোন না কোন ভাবে আমি দায়ী । কারণ বাবার সব টেনশন ছিল আমাকে নিয়ে । সারাদিন বাবার হাত ধরে বসে থাকতাম । বেশ কয়েকদিন পর বাবা একটু সুস্থ হয়ে উঠলেন । আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বল্লেন,”মা,আমার ­ জীবনের মনে হয় আর খুব বেশি দিন বাকি নেই । আমি সবসময় থেকে তোমাকে সুখী রাখতে চেয়েছি । মৃত্যুর আগেও আমি তোমাকে সুখী দেখে যেতে চাই । এটাই এখন আমার শেষ ইচ্ছা । একজন বাবা হিসেবে এর বেশি আর কিইবা চাওয়ার থাকতে পারে?মা,তুমি একবার ভেবে দেখ । ছেলেটা অনেক ভাল । তোমাকে অনেক সুখে রাখবে আমার বিশ্বাস । কোন তাড়াহুড়ো নেই । ছেলেটারসাথে দেখা কর । তাকে বুঝার,চেনার চেষ্টা কর । তোমার পছন্দ না হলে কোন অসুবিধা নেই । শুধু তার সাথে দেখা করে,কথা বলে দেখ ।” না,পারলামনা আর বাবার কথা অমান্য করতে । তার আকুতি ভরা দৃষ্টি উপেক্ষাকরতে । বাবার পছন্দের ছেলেটার সাথে প্রথম দেখা করলাম দেড় মাস আগে । ইঞ্জিনিয়ার । কিন্তু দেখে বোঝার উপায় নেই । খুব সাধাসিধে ছা পোষা ধরণের মানুষ । কথার মারপ্যাঁচ ধরতে পারেন না । লোকটার মা নেই । ওনার মনেঅনেক কষ্ট । একদিন ভয়ে ভয়ে বল্লেন,”একটা কথা বলি?আপনার মাঝে কোথায় যেন আমার মায়ের ছায়া আছে । মাকে চোখের সামনে দেখতে পাই নি কিন্তু অনুভব করেছি । সরি আপনি রাগ করলেন না তো আমার কথায়?” বলে লোকটা চোখের পানি লুকোতে চেষ্টা করত । ব্যর্থ চেষ্টা । বাবাকে অনেক সম্মান করেন । প্রায় প্রতিদিন সময় করেবাবাকে দেখতে আসেন । ওষুধ ঠিকমত খাচ্ছেন কিনা,নিজেরশরীরের যত্ন নিচ্ছেন কিনাআরো কত কি । একদিন বাবার সাথে দেখা করতে এসে আমাকে বেশ লাজুক স্বরে বল্লেন,”ইয়ে মানে আপনার জন্য একটা জিনিষ এনেছিলাম। আমি নিজে রান্না করেছি । অনেক আগে থেকেই রান্না করতে করতে এখন মোটামুটি ভালো রান্না করতে পারি । বিয়ের পর আপনার কোন সমস্যা হবে না …….ওহ সরি আই মিন যদি বিয়ে হয় । কই মাছের পাতুরি রান্না করেছি । অনেক কষ্ট এটা রান্না করা । আশা করি আপনার ভালো লাগবে ।”
“আমি কই মাছ খাইনা” বেশ নির্লিপ্ত সুরে বললাম । উনি আহত স্বরে বল্লেন “ওহ সরি সরি । আমারি ভুল হয়ে গেছে । আমার আসলে আপনাকে জিঞ্জেস করা উচিত ছিল আপনার কি খেতে ভাল লাগে ।”
বড্ড দেরি করে ফেলেছ তুমি । গতকাল বাবাকে বলে দিয়েছি যে বিয়েতে আমি রাজি । বাবার চোখে যে খুশি আমি দেখেছি সেটা আজ তোমার কাছে ফিরে (চলবে)
(তারপর থেকে)
গিয়ে নষ্ট করে দিতে পারতাম । হ্যা পারতাম বাবাকে যেয়ে বলতে যে এই বিয়ে আমি করবনা । পারতাম বাবাকে সেই লোকটার সামনে ছোট করে দিতে । কিন্তু না,পারলাম না আমার বাবার মনে কষ্ট দিতে । পারলামনা তাকে ছোট করতে । তুমি যখন আমাকে কুকুর-বিড়ালের চাইতেও বেশি অবহেলা করতে তখন এই মানুষটা আমাকে রাজকুমারীর মত রাখত । আমার খেয়াল রাখত । বল আজ কিভাবে পারি তোমার জন্য তাকে কষ্ট দিতে?পারতাম তোমার ভালবাসাকে বুকে জড়িয়ে সেই সাধাসিধে লোকটাকে বলে দিতে যে,”সরি আপনাকে বিয়ে করা আমার পক্ষে সম্ভব না ।” পারতাম সেই মা হারা একাকী লোকটার স্বপ্ন ভেঙে দিতে । হ্যা বলার পর থেকে লোকটা এক ঘন্টা পরপর ফোন দিয়ে জিঞ্জেস করছে,”ইয়ে মানে বিয়ের শাড়ী আপনি কবে কিনতে যাবেন?আপনাকে নিয়ে যাব । আমি আবার এগুলো একদম বুঝি না । আমি কিনলে সিওর আপনার পছন্দ হবে না ।”
“না মানে আবার ফোন করলাম জানার জন্য যে আপনার আগের কালের ডিজাইনের গহনা পছন্দ কিনা । আসলে আমার মার দুটো বালা আমি আপনাকে দিতে চাচ্ছিলাম । অনেক পুরোনো ডিজাইন । আজকালকারমেয়ে আপনি । তাই ভাবলাম একবার জিঞ্জেস করে নেই যে আপনার পছন্দ হবে কিনা …।” পারতাম লোকটার এত আকাঙ্খাআর উচ্ছ্বাস ভেঙে টুকরো টুকরো করে দিতে । কিন্তু না,পারলামনা এত স্বার্থপরহতে । তুমি তো অনেক স্বার্থপর হতে পেরেছিলে,তাই তো আমার এত কষ্ট আর ভালবাসাকে উপেক্ষা করে চলে গিয়েছিলে শুধু একটু মুক্তির স্বাদ গ্রহণ করতে। কিন্তু আমি পারিনা,পারবনা এত স্বার্থপর হতে । পারবনা নিজের ভালবাসার জন্য এই দুইজন মানুষের ভালবাসা আরস্বপ্নকে ধুলিস্যাত্ করতে । হয়তো আজ তুমি ভাবছ আমি প্রতিশোধ নিয়েছি । তাই সই । তোমার চোখে অপরাধী হয়ে আমি যদি এইদুইজন মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে পারি তাহলে তাই সই । যদি তুমি আরেকটু আগে আসতে তাহলে তোমার ভালবাসাকে আপন করে নিতাম,যা এখন আর সম্ভব নয় । অনেক দেরি হয়ে গেছে । এখন আর নিজের ভালবাসা নয়,তাদের ভালবাসার প্রতিদান দেবার পালা যারাআমাকে তোমার চেয়ে অনেক বেশী ভালবাসে ।
আকাশের দিকে তাকিয়ে আছি । চোখদুটো ঝাপসা হয়ে আসছে । দু ফোটা পানি গড়িয়ে পড়ল চোখ দিয়ে । মনে মনে বললাম,
“ভালবাসা,তোমায় ­ দিলাম ছুটি

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত