চন্দননগরের রায়চৌধুরী বাড়িতে আজ মহোৎসব লেগেছে । আর হবে নাই বা কেন, ছোটোকর্তার ছোটোছেলে বিয়ে করে ঘরে বৌ আনবে আজ । দুদিন পরে বৌভাত। তারই প্রস্তুতি চলছে জোর কদমে।
রায়চৌধুরী বাড়িকে বাড়ি না বলে অবশ্য প্রাসাদ বলা উচিত। শোনা যায় নাকি পঞ্চাশ বছর আগেও কর্তাদের হাতিশালে হাতি আর ঘোড়াশালে ঘোড়া বাঁধা রইতো। নামকরা ওস্তাদ এবং লক্ষ্ণৌ-এর বিখ্যাত বাইজীদের সাধা গলায় গাওয়া ধ্রুপদ, দরবারী কানাড়ার আওয়াজে প্রতি সন্ধ্যায় ভরে উঠতো কর্তাদের বৈঠকখানা।
এখন অবশ্য আর অত ঠাটবাট নেই। কিন্ত সেই যে কথায আছেনা, “মরা হাতি, লাখ টাকা”, এও হলো ঠিক তাই। জমিদারী না থাকলেও বনেদীয়ানা বজায় আছে পুরোমাত্রায়। তাই বাড়ির সবচাইতে ছোটো ছেলের বিয়ের আয়োজনে অভাব নেই কিছু।
কর্তাদের মধ্যে বড়কর্তা শিবরঞ্জন রায়চৌধুরীই শুধু বেঁচে আছেন এখন। তার পরের দুইভাই সময়ের নিয়মে স্বর্গগমন করেছেন পরিপক্ক বয়সে। মহাকাল বোধকরি ভুলে গিয়েছেন বড়কর্তার কথা।
শিবরঞ্জন রায়চৌধুরী বিয়ে করেননি তাই তার দিকের বংশবৃদ্ধিও হয়নি আর। অবশ্য দুইভাইয়ের সন্তান-সন্ততি, নাতি-নাতনীরা তাদের জ্যাঠামশায় এবং বড়দাদুকে দেবতার মতো ভক্তি করে, তাই নিজস্ব পরিবারের অভাবও কখোনো বোধ করেননি তিনি।
শোনা যায় শিবরঞ্জনের যৌবনকালে তিনি ছিলেন কন্দর্পকান্তি, এবং কথাটা যে মিথ্যে নয় তার সাক্ষী বৈঠকখানার দেয়ালে ঝুলিয়ে রাখা ছয়ফুট লম্বা অয়েল পেইন্টিং। মুগুড় ভাজা পেশীবহুল শরীর, পাকা আমের মতো টকটকে গায়ের রঙ , ঘাড় অবধি নেমে আসা বাবরি চুল, পাকানো গোঁফ ; পৌরুষ ও আভিজাত্য যেন ঠিকড়ে ছড়িয়ে পড়ছে শরীরের প্রতিটি রোমকূপ থেকে । কিন্তু সমস্যাটা হলো স্বাস্হ্য ও পৌরুষের সাথে দম্ভও ছিলো কানায় কানায় ভরা। কিংবদন্তী অনুযায়ী শিবরঞ্জন নাকি সত্যিই হাজারবার পাত্রী দেখতে গিয়েছিলেন, এবং প্রত্যেকবারই নাকচ করে দিয়েছিলেন এটাসেটা কারণ দেখিয়ে। মোসাহেবের দল তোয়াজ করে বলতো,
“পুরুষসিংহ শিবরঞ্জন রায়চৌধুরীর জন্য যুগ্যি কন্যে ভগবানও তৈরী করে উঠতে পারেননি।”
মুখে হাসলেও সেই কথাটাই আজও মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেন শিবরঞ্জন।
বধূবরণের জন্য পুরোনো রেওয়াজ মতো, গিলে করা পাঞ্জাবি আর চুনোট ধুতি পরে তৈরী হয়েছেন বড়কর্তা। পাঞ্জাবীতে হীরের বোতাম। হাতে রুপো বাঁধানো ছড়ি, পায়ে সাদা ভেলভেটের তৈরী পাম্পশু। বয়স প্রায় পচানব্বই হয়ে গেলেও তার জ্ঞান-বুদ্ধি আজও তরতাজা রয়েছে । বাড়ির মেজবৌমার হাত ধরে ধীরে ধীরে দক্ষিণের ঝুল বারান্দায় রাখা আরাম কেদারায় গিয়ে বসলেন তিনি। মেজবৌমা নন্দনা বলে গেলেন,
“ আপনি এখানেই বসুন জ্যাঠামশায়, নতুন বৌমা এলে তাকে এখানে নিয়ে আসবো আমি। দুতলা সিঁড়ি ভেঙে নীচে গেলে আপনার পায়ে ব্যাথা হবে আবার।”
মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিলেন শিবরঞ্জন। শুনেছেন পাত্রী নাকি ছোটো খোকার নিজেরই পছন্দ করা। মেয়েটির নাম সেঁজুতি, পড়াশোনা জানা, চাকরি করা আধুনিকা মেয়ে । কী করে যে কোনো পুরুষ এসব সহ্য করে তিনি বোঝেন না। ঘরের মেয়েরা অন্ত:পুরচারিকা। ঘর সামলানো, সন্তান পালন, পরিবারের সকলের সেবা, এই তাদের কাজ। মেয়েরা মা, কন্যা ও বধূ; এর বাইরে কোনো পরিচয়ের প্রয়োজন কেন পড়বে তাদের ? কালের নিয়ম, কত কিছু আরও দেখতে হবে কে জানে? কমলেন্দু কে অনেক বলেও বোঝাতে পারেনি তার মা । বড়ো বংশের মর্যাদা আজকালকার ছেলেরা কী আর বুঝবে ? অত:পর কমলেন্দুর মায়ের মুখ চেয়ে হবু কনের মুখদর্শন না করেই এ বিয়েতে মত দিয়েছেন তিনি। বাড়ির সবাই এই নিয়ে আশ্চর্য হয়ে গিয়েছিলো যদিও। চাকরি করা মেয়ে এই সংসারে বৌ হয়ে আসবে, এতো অনাচার!
মনে ভেবেছিলেন বড়কর্তা, বিয়ে হচ্ছে হোক, পরে ওসব অনাসৃষ্টি বন্ধ করে দিলেই হবে। তিনি যতদিন বেঁচে আছেন, ততদিন এসব রায়চৌধুরী বাড়িতে ঢুকতে দেবেন না।
হঠাৎ নীচের থেকে মেয়েদের উলুধ্বনি ও শঙ্খের আওয়াজ তীব্র হয়ে উঠতে তিনি বুঝলেন নতুন বৌমাকে নিয়ে কমলেন্দু এসে গিয়েছে। এরপরের প্রতিটি রীতি রেওয়াজ জানা আছে তার।
নতুন বৌমা কাঁখে লক্ষ্মীর কলস নিয়ে, কাঁসার রেকাবে রাখা দুধে-আলতায় পা ডুবিয়ে দাঁড়াবে। বংশের সর্বজ্যেষ্ঠা, স্বামী-সন্তানবতী নারী নব দম্পতিকে বরণ করে নেবে বরণডালার মঙ্গলছোঁয়ায়। বধূর হাতে আশীর্বাদী কঙ্কন ও নোয়া পরিয়ে দেওয়া হবে। এরপর বৌমা আলতা ভেজা পায়ের ছাপ ফেলে বাড়ির মন্দিরে উঠে এসে প্রণাম জানাবে কুলদেবতার উদ্দেশ্যে। সবকিছু মুখস্হ হয়ে গেছে তার।
প্রায় পনেরো-কুড়ি মিনিট পরে নব দম্পতিকে সাথে নিয়ে বাড়ির আর সবাই উঠে এলেন শিবরঞ্জনের কাছে। কাঁপা হাতে বারাণসী হারের বাক্সটি বের করলেন তিনি পাঞ্জাবীর পকেট থেকে। বর-বধূ এসে প্রণাম করলো তাকে। কিন্তু নববধূর মুখ দেখে যেন পিঠে চাবুক পড়লো তার।
ঠিক যেন তার মা ভুবনমোহিনীর মুখখানা কেটে বসানো। কোঁকড়ানো চুল, শ্যামবর্ণা, পানপাতা মুখ, মায়ায় ভরা চোখদুটি । কিন্তু রুপ নয়, মেয়েটির হাসি ও ব্যক্তিত্বে যেন ঘরের সবকিছু যেন আলো হয়ে উঠলো এক মুহুর্তে।
নববধূর লজ্জা ও দ্বিধা কাটিয়ে কেমন সহজ ভাবে সে বললো,
“কেমন আছো জেঠুমনি?”
“ভালো, ভালো আছি মা ।“
অভিভূত হয়ে গেলেন শিবরঞ্জন। নববধূর লজ্জা নয় বরং সচ্ছতোয়া নদীর মতো সহজ আনন্দে ভরা সেঁজুতির চোখদুটি । কুলদেবী জগদ্ধাত্রীই বুঝিবা কৌশিকীরূপে সামনে এসে দাঁড়ালেন । নারী এমনও হয় । এত সহজ, অথচ ব্যক্তিত্বময়ী । মেয়েটিকে দেখে মনে হলো যেন কতকালের চেনা। তবে কী মা ভুবনমোহিনীই ফিরে এলেন তাঁর সংসারে আবার ? কোনোরকমে আশীর্বাদ সেরে, মেজবৌমার হাত ধরে ফিরে এলেন আবার নিজের ঘরে।
আটপৌড়ে ধুতি, আর নরম সুতির বেনিয়ানখানা গায়ে দিয়ে নিজের অতীতের চুলচেড়া হিসেব করতে বসলেন রায়চৌধুরী বাড়ির বড়কর্তা। তবে কী ভুল হয়ে গেল তার ? সারাজীবন ধরে নারীর যোগ্যতা নির্ধারণ করেছেন তিনি শুধুই তাদের সৌন্দর্যের মাপকাঠিতে । গায়ের রঙ, চুলের দৈর্ঘ্য, ভুরুর বাঁক, ঘরের কাজ, সন্তান-সন্ততির জন্মদান ; এসবের বাইরে কখোনোই কী ভেবেছেন কোনো নারীকে শুধুমাত্র একটি মানুষ হিসেবে?
গৃহের তুলসীমঞ্চে জ্বলতে থাকা সন্ধ্যাবেলার মঙ্গলদীপ সোনার হোক বা মাটির, আলো তো সে সমান দেয়।
তবে গৃহলক্ষ্মী নির্বাচনে রূপের কাঙাল কেন হয় মানুষ? নারীর সবচাইতে বড় সৌন্দর্য্য তার শিক্ষা, স্বভাবগত মাধুর্য, তার ভালোবাসা, শ্রদ্ধা, সমর্পন, শক্তি, এইসবের মধ্যে শুধুই রূপের প্রয়োজন ঠিক কতটুকু?
মনে পড়লো, বাবার জন্যে মায়ের পরম যত্নে বানিয়ে দেওয়া বারাণসী মিঠে পান। গরমের দুপুরে ঠান্ডা শ্বেতপাথরের গেলাসে তৈরী করে রাখা কচি ডাবের শরবত। বাবাকে আরও একটা লুচি বেশী খাইয়ে মায়ের মুখে সেই অনাবিল আনন্দ। এর কোনটা পাওয়া যায় রূপের বাজারে ?
বড় গর্ব ছিলো তার মনে যে তিনি এক হাজার পাত্রীকে নাকচ করেছেন। কিন্তু আজ যেন মনে হলো সেই কাত্যায়নী, মৃণালিনী, ক্ষেমঙ্করীরা সবাই একসাথে তার দিকে করুণার চোখে চাইছে। হয়তো তাদের মধ্যেই কেউ ছিলো তার উপযুক্ত সহধর্মিণী। নিজের অহংকারই অন্ধ করে রেখেছিলো তাকে। আর সেই অহংকারই গর্জন করছে আজ আরেকটি মেয়ের জীবন গড়ে তোলার স্বপ্নকে ধূলোয় মিশিয়ে দিতে। সত্যি তবে কী?
আর্তনাদ করে উঠলেন বড়কর্তা ,
“ মা গো, বড় ভুল হয়ে গেলো, সারাটা জীবন শুধুই ভুলে কেটে গেলো !”
ভেতরে ভেতরে গর্জাতে থাকা অহংকার বুঝি মরেনা তবু । নাহ্, রায়চৌধুরী বাড়ির দন্ডমুন্ডের কর্তা তিনি, কোনোদিনই তার বিনা অনুমতিতে কোনো সিন্ধান্ত নেয়নি এবাড়ির মানুষ, এবারেও তার অন্যথা হবেনা।
ভোর ছটায় উঠে স্নান সেরে, চা বানিয়ে সবার আগে শিবরঞ্জনের ঘরেই নিয়ে গেলো সেঁজুতি। কমলেন্দুর কাছে আগেই শুনেছে তিনি খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে পড়েন।
শিবরঞ্জন তার ঘরের লাগোয়া ব্যালকনিতে বসে দূর্গামন্ত্র স্মরণ করছিলেন তখন। সেঁজুতিকে দেখে বললেন ,
“ ছোটোবৌমা, এখানে এসো।”
চায়ের ট্রে টেবিলে রেখে তাকে প্রণাম করে বললো সেঁজুতি,
“বলো জেঠুমনি।”
“শুনলাম নাকি তোমার অফিসে কাজ করা হয়……“
মনে মনে লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত হলো সেঁজুতি এবার।
একটু থেমে শিবরঞ্জন এবার বললেন,
“এবাড়ির কেউ যদি তোমার অফিসে কাজ করা নিয়ে কিছু বলে, তবে তাকে বলো যা বলার বড়কর্তাকে গিয়ে বলতে । আর হ্যাঁ, ছুটি শেষ হলে বাসে করে নয়, এ বাড়ির গাড়ি নিয়ে যাবে প্রতিদিন । ড্রাইভার বনশীলালকে বলা থাকবে আমার।”
কথাগুলো বলে অনেকদিন পর সত্যিকারের আনন্দ উপলব্ধি করলেন শিবরঞ্জন। সেঁজুতির স্বপ্ন নয়, বরং নিজের অহংকারকে গলা টিপে শেষ করে আজ ন্যায্যরূপেই পুরুষসিংহ হলেন তিনি।