আমার সামনে পড়ে আছে ৭বছরের একটা বাচ্চা মেয়ের লাশ। নাম অবন্তি। মেয়েটার শরীরে সুতো পরিমাণ ও কোনো কাপড় নেই। প্রথমে রেপ, তারপর খুন। শরীর রক্তাক্ত। শরীরের প্রত্যেকটা জায়গায় ছুরির আঘাতের চিহ্ন। হাতের পায়ের সব আঙুল কাটা। লজ্জাস্থানে শ’খানেক বার ছুরি দিয়ে আঘাত। এইটুকুন একটা বাচ্চা মেয়েকে এভাবে খুন? ভাবা যায়? খুনটা যেই করুক, ও কোনো মানুষের বাচ্চা হতে পারেনা। কোনো মানুষ এতো ভয়ানক ভাবে একটা বাচ্চা মেয়েকে খুন করতে পারবেনা।
অবন্তির লাশের দিকে তাকিয়ে যতোটা রাগ লাগছে, তারচাইতেও বেশি ভয় হচ্ছে। আমার নিজের একটা মেয়ে আছে। আরশিতা। বয়স ৭। অবন্তির মতোই ফুটফুটে নিষ্পাপ। এই নিষ্পাপ বাচ্চাটার সাথে কোন শুওরের বাচ্চা এমন কাজ করবে? কেনো করবে? লাশটা দেখে বুঝা যাচ্ছে শুধুমাত্র রেপ করার জন্য খুনটা করেনি। শরীরের প্রত্যেকটা জায়গায় বহুবার ছুরির আঘাত। হয়তো অনেক বেশি ক্ষোভ, রাগ, বা প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য এভাবে খুন করেছে। কিন্ত এই নিষ্পাপ বাচ্চাটার উপর এতো রাগ? এতো ক্ষোভ? সম্ভব না। মনে হচ্ছে কেউ অবন্তির বাবা মায়ের উপর প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য বাচ্চাটার সাথে এমন করেছে। কিন্তু এতো ভয়ানকভাবে খুন?
কেনো?? দুইদিন আগে স্কুল ছুটির পর অবন্তি নিখোঁজ হয়। স্কুলের কয়েকটা বাচ্চার কথা অনুযায়ী একটা কালো গাড়ি এসে স্কুলের গেইটের সামনে দাঁড়ায়। অবন্তি প্রথমে গাড়ির ভিতরে থাকা কারো সাথে কথা বলে। তারপর নিজ ইচ্ছায় গাড়িতে উঠে। বাচ্চারা বারবার বলছে “কেউ অবন্তিকে কোনো জোর করেনি”। তারা দেখেছে অবন্তি নিজ ইচ্ছায় গাড়ির ভিতরে ঢুকেছে। গাড়ির ভিতরে কে ছিলো, বা কেমন মানুষ ছিলো সেটা দেখা যায়নি’। অবন্তিকে শেষবার ওই গাড়িতে উঠার সময় দেখা যায়। তারপর থেকে অবন্তি নিখোঁজ। দুইদিন ধরে খোঁজেও অবন্তির কোনো খোঁজ পাইনি। এই দুই দিনে অবন্তির বাবা আসাদ সাহেবের কাছে কেউ কল করে মুক্তিপণ ও চায়নি।
তারমানে কিডন্যাপ বা খুনের পিছনে টাকার কোনো উদ্দেশ্য নেই। কিন্তু কেউ কেনো এতো ভয়ানক ভাবে খুন করবে একটা বাচ্চাকে? গাড়ির ভিতরে থাকা মানুষটা কে ছিলো? অবন্তি কেনো নিজ ইচ্ছায় গাড়িতে ঢুকলো? তাহলে কি অবন্তির পরিচিত কেউ? অবন্তির লাশের পাশে বসে চিৎকার করে কান্না করছেন অবন্তির মা ‘রিয়া’ হক। অবন্তির বাবা আসাদ সাহেবের চোখেও পানি দেখা যাচ্ছে। কিন্তু তিনি চিৎকার করে কান্না করছেন না। যথেষ্ট শক্ত মনের মানুষ। রিয়া হককে দেখে অনেক মায়া হচ্ছে। পাগলের মতো কান্না করছেন। একমাত্র মেয়ে, তাও আবার মাত্র ৭বছর। দুনিয়ার কিছুই দেখেনি বলা যায়। এতটা নিষ্পাপ আর ফুটফুটে মেয়ের এভাবে মৃত্যু কোনো মা সহ্য করতে পারার কথা না। এই কান্নার আর্তনাদ শুনার ক্ষমতাও সবার নেই”। অবন্তির বাবা আসাদ সাহেবের চোখ থেকে অবিরাম পানি পড়ছে। বুঝতে পারছি কথা বলার মতো অবস্থায় নেই। তারপরেও উনার কাছে গিয়ে আস্তে করে বললাম-
-আপনাকে কি বলে স্বান্তনা দিবো ঠিক বুঝতে পারছিনা। তবে যে কুত্তার বাচ্চা এই কাজ করেছে, খুব তাড়াতাড়ি তাকে খোঁজে বের করবো”। আমার কথা শুনে উনি কোনো কথা বললেন না। চোখ থেকে তখনো অবিরাম পানি পড়ছে। আমি আবার বললাম-
-আপনার কি খুব বড় কোনো শত্রু আছে? যে আপনার উপর অনেক রাগ, বা প্রতিশোধ নিতে চায় এমন কেউ?
খুনের ধরন দেখে বুঝা যাচ্ছে কেউ অনেক বেশি রাগ নিয়ে খুনটা করেছে”। আসাদ সাহেব চোখ মুছতে মুছতে বললেন-
-না মেহরাব স্যার! আমার এমন কোনো শত্রু নেই”।
-কাউকে কি সন্দেহ করছেন”? আমার পশ্ন শুনে আসাদ সাহেব চুপ করে রইলেন। কিছু বললেন না। মনে হলো কিছু লুকাতে চাচ্ছেন। খানিকক্ষণ পর কান্না জড়িত কন্ঠে বললেন-
-দেখুন মেহরাব স্যার, আমি খুব-ই সহজ জীবনযাপন করি। কারো সাথে শত্রুতা নেই বললেই চলে৷ তবে আমার ছোট ভাই রিফাতের সাথে জায়গা নিয়ে কিছু ঝামেলা চলছে। আমার মনে হয়না জায়গা জমিনের ঝামেলার জন্য রিফাত এভাবে আমার মেয়েকে খুন করবে। তাছাড়া আমার আর কোনো শত্রু নেই। এখন খুন কে করেছে খোঁজে বের করাটা আপনাদের কাজ। আমি শুধু আমার মেয়ের খুনিদের শাস্তি চাই, ব্যাস”। কথাটা বলে আসাদ সাহেব আবারো ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না শুরু করলেন। একমাত্র মেয়ে হারানোর যন্ত্রণাটা আমি বুঝতে পারছি”। ওইখান থেকে চলে আসবো ঠিক এমন সময় রিয়া হক কান্না জড়িত কন্ঠে চিল্লায়া উঠলেন-
-আমার মেয়েকে ওর ভাই রিফাত ই মেরেছে। ওই লম্পট রিফাত খুনিইইই”। কিছুক্ষণের জন্য আমি হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। রিয়া ঠিক কি বলতে চাচ্ছে বুঝতে পারছিনা। বললাম-
-মানে? কি বলতে চাচ্ছেন? আপনার দেবর অবন্তিকে এভাবে খুন করেছে”? রিয়া কান্না করতে করতে বললো-
-হ্যা স্যার। আমার অবন্তিকে ওই রিফাত-ই মেরেছে।
সারাদিন বন্ধুদের সাথে টাকা উড়ায়। ড্রাগ নেয়। মদ খায়। মেয়েদের সাথে নষ্টামি করে। এসব খারাপ কাজের জন্য যখন আমার স্বামী আসাদের কাছে টাকা চাইতো, আসাদ টাকা দিতোনা। রিফাত রাগারাগি করতো। বলতো বাবার সম্পত্তি চাই। আমার সামনেই রিফাত অনেকবার আসাদকে বলেছে- “প্রথমে তোমার বউ বাচ্চা খুন করবো, তারপর তোমাকে। তোমাদের খুন করার পর আমাকে কেউ টাকা নিতে মানা করবেনা। আমার বাবার সম্পত্তি আমি যেভাবে ইচ্ছা ব্যাবহার করবো”।
ওই রিফাত ই মেরেছে আমার মেয়েকে। আপনি প্লিজ আমার মেয়েকে বিচার পাইয়ে দিন। প্লিজ”। কথাটা বলেই দু’হাতে মুখ ঢেকে হু হু করে কান্না করে যাচ্ছেন রিয়া। আমি আসাদ সাহেবের দিকে একবার তাকালম। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছেন। নিঃশব্দ। স্ত্রী’র মুখে তার ভাইয়ের নাম শুনেও কিছু বলছেন না। তারমানে কিছু’তো গন্ডগোল আছে। সম্পত্তির জন্য খুন করাটা আজকাল নতুন না। তাছাড়া রিয়ার কথা অনুযায়ী আসাদ সাহেবের উপর রিফাতের অনেক রাগ আছে। এমনকি সরাসরি খুন করার কথাও বলেছে। হতে পারে অবন্তির খুনটা রিফাত করেছে”। আস্তে আস্তে হেঁটে আসাদ সাহেবের কাছে গেলাম। বললাম-
-নিজের মেয়ের এমন রক্তাক্ত লাশের দেহ দেখেও নিজের ভাইকে বাঁচাতে চাচ্ছেন? বাহ আসাদ সাহেব”। চোখের পানি মুছতে মুছতে আসাদ সাহেব বললেন-
-মেহরাব স্যার, আমি রিফাতকে সেই ছোট থেকে দেখে আসছি। আমি মানছি রিফাত অনেক রাগী, বদমেজাজি।
কিন্তু ও আগে এমন ছিলোনা। আম্মা মারা যাওয়ার পর থেকে আস্তে আস্তে খারাপ হয়ে যাচ্ছে। আজেবাজে জিনিষ খাচ্ছে। কিন্তু রিফাত এতোটাও খারাপ হয়ে যায়নি যে “সম্পত্তির জন্য রাগারাগি করে আমার মেয়েকে এভাবে রেপ করে খুন করবে। এটা অসম্ভব স্যার”। আমি আসাদ সাহেবের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলাম। দুনিয়াতে এখন কি চলছে তার কোনো ধারণাই নেই। ড্রাগে আসক্ত হয়ে সন্তানেরা এখন নিজের বাবা-মা কে খুন করতেও হাত কাঁপেনা। অথচ আসাদ সাহেব এখনো আগের যুগে রয়ে গেছেন। একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বললাম-
-আমাদের কাজটা আমাদের করতে দিন আসাদ সাহেব। রিফাতকে এখন কোথায় পাবো বলতে পারেন”?
-স্যার ও আমার সাথে কথা কাটাকাটি করে ২সপ্তাহ আগেই বাসা থেকে চলে গেছে। আমি জানিনা রিফাত এখন কোথায়”।
আমি উনার সাথে আর কোনো কথা বাড়ালাম না। রিফাতকে এখন খোঁজে বের করাটা জরুরী। অবন্তির লাশ পোস্টমর্টেম করার জন্য পাঠিয়ে থানায় চলে আসলাম। আপাতত আমার নজর রিফাতের উপর। এই খুনটা ৮-১০টা খুনের মতো না। এত ভয়ানক’ভাবে কাউকে রেপ করে খুন করতে আমি আজ অবধি দেখিনি। তাও আবার নিষ্পাপ একটা বাচ্চাকে। খুনি যেইহোক, অবন্তির প্রতিটা চিৎকার, প্রতিটা যন্ত্রণার মূল্য তাকে দিতেই হবে”।
গল্পের বিষয়:
গল্প