আশ্রয়

আশ্রয়
রাত দু’টার সময় শাহরিয়ার এর হাত আমার গায়ের উপর থেকে আস্তে করে সরিয়ে আমি পাশের রুমে গিয়ে দরজা লাগিয়ে ফ্যানের সাথে দড়ি লাগিয়ে তাতে ঝুলে পড়লাম৷ গলায় ভীষণ চাপ খেয়ে আমি গোঙাতে লাগলাম৷ গোঙানোর আওয়াজ শুনেই হোক বা যে কারণেই হোক শাহরিয়ার কিছু টের পেয়ে দরজা ভেঙে আমাকে নামালো। নামিয়ে ঠাস ঠাস করে কতগুলো থাপ্পড় দিয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলো। কাঁদতে কাঁদতে বললো
-সরি স্বর্ণা আমি দুপুরে তোমাকে ইচ্ছে করে মারিনি। আমাকে ক্ষমা করে দাও স্বর্ণা।আর কখনোই এমন হবে না প্রমিজ।
শাহরিয়ার আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতেই থাকলো ক্রমাগত। আমি কিছু না বলে চুপ করেই ছিলাম আর নিরবে চোখের পানি ফেলছিলাম। শাহরিয়ার ভীষণ বড়লোকের ছেলে। নিজস্ব ব্যবসা তার। বিয়েটা আমাদের প্রেম করেই হয়েছিলো। ৭বছর হয়ে গেছে আমাদের বিয়ের। আমি কোনো সুন্দরী মেয়ে না হলেও শাহরিয়ার এর কাছে কখনো অবহেলিত হইনি। তার কাছে আমিই ছিলাম সব। শাহরিয়ার সবদিক দিয়েই ভালো ছেলে ছিলো। সব দিক দিয়ে ভালো ছেলে হওয়ায় বাবা-মাও এ বিয়েতে অমত করেনি। খুব ধুম-ধাম করেই হয়েছিলো আমাদের বিয়েটা। আমি হিল পড়ায় অভ্যস্ত ছিলাম না বিয়ের দিন হিল পড়তে হয়েছিলো। বিয়ে শেষে ওদের বাড়িতে যাবার পর গাড়ি থেকে নেমে হাঁটতে গিয়ে শাড়ির সাথে হিল আটকে পড়ে যেতে লাগছিলাম তখন শাহরিয়ার আমাকে ধরে নিলো। আর ঘটনাটির সাথে সাথেই শাহরিয়ার এর বড় ভাবি বলে উঠে
– এসব ন্যাকামি করেই আমার সহজ সরল দেবরের মাথা খেয়েছে। বাড়িতে ঢুকেই এমন কথা শোনার জন্য আমি প্রস্তুত ছিলাম না। মধ্যবিত্ত ঘরের মেয়ে হওয়ায় প্রায়ই আমাকে নানান কটু কথা শুনতে হতো।সব মুখ বুঝে সহ্য করে নিতাম। একবার খাবার টেবিলে সকলের খাবার বেড়ে দিচ্ছিলাম। বড় আপু পানি চাইলে তাকে পানি এগিয়ে দিতে গিয়ে আপুর গায়ে কিছুটা পানি পড়ায় আপু খাওয়া থেকে উঠে গেল আর যাবার সময় বলে
-এসব ছোট ঘরের কোথা থেকে ধরে নিয়ে আসিস কে জানে মিনিমাম ভদ্রতা সভ্যতা শেখেনি। যত্তসব ছোট লোক কোথাকার। একদিন আমার ননদ চৈতি আমাকে বললো ভাবি আজ তুমি আমাদের কেক বানিয়ে খাওয়াবে চলো। আমি কেক বানানো পারতাম না তাই বলে দিলাম যে আমি তো কেক বানাতে পারিনা। আমার কথা শুনে কাজের মেয়েটি হেসে হেসে বললো ভাবি আমিই তো বানাতে পারি আর আপনে পারেন না?কাজের মেয়ের মুখে এমন কথা শুনে খুব অপমানিত বোধ করলাম। যদিও চৈতি ওই সময় কাজের মেয়েকে ধমক দিয়ে চুপ করিয়ে দিয়ে আমাকে বললো
-আচ্ছা ভাবি চলো আজ আমি তোমাকে শেখাবো কেক বানানো।
আমার ননদ চৈতি,শাহরিয়ার আর আমার শ্বশুর বাদে ও বাড়িতে আর কেউই আমাকে দেখতে পারতো না। দিনের পর দিন নানা ভাবেই নানা সুযোগে কেউই আমাকে অপমান করতে ছাড়তো না শাহরিয়ার সবসময় আমাকে খুব সাপোর্ট দিতো আর বলতো দেখো স্বর্ণা আমি সবসময়ই তোমার পাশে আছি যে যা বলুক না কেন তুমি ওসব কানে দিবে না। শাহরিয়ার এই কথাগুলো আমাকে অনেক ভালো রাখতো। এভাবেই চলে আসছে ৭টা বছর। শাহরিয়ার আমাকে সবসময়ই সুখি রাখার চেষ্টা করে এসেছে। না চাইতেই সব দিয়েছে। কিন্তু আমি পারিনি ওকে সুখি করতে। ৭ বছর হয়ে গেল কিন্তু আমি ওকে বাবা ডাক শোনাতে পারিনি আজ পর্যন্ত। এ নিয়ে শ্বশুর বাড়িতে নানা ভাবেই কটাক্ষ হতে হয়েছে আমাকে। আজ পর্যন্ত শাহরিয়ার এ নিয়ে আমাকে কিছু না বললেও আজ দুপুরে বাসায় যখন ল্যাপটপ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো আমি তখন গতকাল রাতে ওর আনা বেলিফুলগুলো মাথায় লাগিয়ে শাড়ি পড়ে সেজেগুজে ওর সামনে দাড়িয়ে বলছিলাম
-দেখো তো শাহরিয়ার আমাকে কেমন লাগছে। শাহরিয়ার না তাকিয়েই বলে দিয়েছিলো
-হ্যাঁ সুন্দর কথাটি বলেই সে আবার তার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লো।
– তুমি তো তাকাওনি শাহরিয়ার। না তাকিয়ে মিছিমিছি বলছো কেন?
-কি তাকাবো স্বর্ণা। আজ পর্যন্ত একটা সন্তান দিতে পারলে আবার বড়বড় কথা? কাজের সময় ডিস্টার্ব করো না।
সামনে থেকে সরে যাও প্লিজ। আমি তোমাকে আর সহ্য করতে পারছি না। আমি তখন শাহরিয়ার এর কথায় শুধু বলেছিলাম
-তুমি আমাকে এইভাবে বললে শাহরিয়ার?
সে বিছানা থেকে উঠে আমাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়ে বললো সরে যাও প্লিজ আমি তোমাকে সহ্য করতে পারছি না। যেদিন বাবা ডাক শোনাতে পারবে সেদিন এসব কথা বলো আমার সামনে এসে। এসব ন্যাকামি এখন ভালো লাগছে না। ওর ধাক্কার জন্য দরজার সাথে লেগে কপালে কেটে রক্ত বের হচ্ছিলো। আমি তখন ওইখান থেকে সরে গেলাম আর কিছু না বলে। কিন্তু শাহরিয়ার এর কথাটা বারবার আমার কানে বাজছিলো। কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলাম না এ কথাগুলো। রাগের বশে হলেও সে কথাগুলো ভুল বলেনি। যে মেয়ে মা হতে পারেনা তাকে সাজগোজ মানায় না। আর তাছাড়া আমার জন্য শাহরিয়ার আরেকটা বিয়ে করতে পারছে না। আমি বোঝা হয়ে গিয়েলাম ওর জন্য।অনেকটা গলার কাটার মতো না পারছে গিলে ফেলতে আর না পারছে উপরে ফেলতে।
আমার শ্বাশুড়ি অনেক করে শাহরিয়ারকে বলেছে আরেকটা বিয়ে করার জন্য। কিন্তু আমার মুখের দিকে তাকিয়ে সে বিয়ে করেনি। আমি না থাকলে শাহরিয়ার এর এই রাস্তাটাও মুক্ত হয়ে যাবে। তার তো কোনো দোষ নেই আমার জন্য সে কেন বাবা হবার অধিকার থেকে বঞ্চিত হবে৷ আমি প্রায়ই দেখলাম ওর সাথে কোথাও ঘুরতে গেলে বাচ্চা দেখলে সে বাচ্চাটিকে কোলে নিয়ে আদর করার জন্য পাগল হয়ে যেতো। ভীষণ বাচ্চা পাগল ছেলে ছিলো শাহরিয়ার। কিন্তু আমি ওর এই ইচ্ছাটা পূরণ করার যোগ্যতাও রাখিনি।
এই বাড়িতে এতদিন কেউ আমার সাথে না থাকলেও শাহরিয়ার এর জন্য আমি ভালো থাকতাম। ওর ভালোবাসা আমাকে অনুপ্রেরণা যোগাতো। কিন্তু আজকের পর এবাড়িতে নিজেকে খুব অসহায় মনে হলো। পালিয়ে গিয়ে লাভ হতো না। শাহরিয়ার আমাকে খুব সহজেই খুজে বের করে নিতো। তাই সুইসাইড করার রাস্তা বেছে নিয়েছিলাম।
সে ঘুমিয়ে যাবার পর আমি সুইসাইড করার জন্য দড়িতে ঝুলে পরলেও আমাকে ঠিকই বাঁচিয়ে নিলো শাহরিয়ার।
কাঁদতে কাঁদতে বারবার বলতে লাগলো বিশ্বাস করো স্বর্ণা আমি ইচ্ছে করে এমন করিনি। কি হতে কি হলো আমি বুঝতে পারিনি। তুমি আর কখনো এমন করবে না কথা দাও স্বর্ণা তুমি ত জানো আমি তোমাকে কত ভালোবাসি। আমার তখন মাথা ঠিক ছিলো না একটু বুঝার চেষ্টা করো। এতক্ষণ চুপ থাকলেও এবার আমি মুখ খুললাম আর বললাম -আমার একটা কথা রাখবে শাহরিয়ার? সে আমাকে ছেড়ে বললো
-হ্যাঁ বলো কি কি কথা?
-আগে প্রমিজ করো রাখবে?
-আচ্ছা প্রমিজ করলাম তুমি যা বলবে তাই হবে।
– তুমি আমাকে ডিভোর্স দাও শাহরিয়ার। আমি আর কিছু শুনতে চাইনা। তুমি তাড়াতাড়ি সকল কিছুর ব্যবস্থা করো।
-স্বর্ণা প্লিজ এসব কথা বলো না।
-শাহরিয়ার তুমি কিন্তু আমাকে কথা দিয়েছো।
সে আর কিছু বললো না নীরবে ঘর থেকে বের হয়ে গেল। ৫দিন পর সে সত্যিই ডিভোর্স পেপার নিয়ে আমার হাতে দিলো। এই ৫দিন আমি ওর সাথে কোনো কথা বলিনি কিছু খাইওনি। বলেছিলাম হয় তুমি ডিভোর্স পেপার দাও আর নয়তো এভাবেই মারা যাবো। আমার এইভাবে অসুস্থ হয়ে পরা সে দেখতে পারছিলোনা বলেই আজ এই ডিভোর্স পেপার এনে দিলো। এই ৫দিন অনেক করে নানা কৌশলে আমাকে বুঝানোর চেষ্টা করেছে। কিন্তু আমি আমার সিদ্ধান্তে অনড় ছিলাম। অবশেষে সে ডিভোর্স পেপার আমার হাতে তুলে দিতে বাধ্য হয়। আমি ডিভোর্স পেপারটিতে সাইন করলাম সে আবারও আমাকে জড়িয়ে ধরে কান্না শুরু করলো। আমি শাহরিয়ারকে ছাড়িয়ে বললাম আমার আর খোঁজার চেষ্টা করো না কথাটি বলেই বাড়ি থেকে বের হয়ে গেলাম। সে একজায়গায় থ হয়েই দাড়িয়ে ছিলো। এখন হয়তো শাহরিয়ার ভালো থাকবে। শাহরিয়ার এর মাও শাহরিয়ারকে ভালো বড় ঘরের মেয়ের সাথে বিয়ে দিতে পারবে।শাহরিয়ার এর বাবা হবার ইচ্ছাও অপূর্ণ থাকবে না।
আর আমি? এরপর আর বাড়ি ফিরে যাবার ইচ্ছেও হয়নি।সেদিন সেই মা না হবার কলঙ্ক থেকে মুক্তি নিয়ে এখন এক শতশত বাচ্চার দ্বায়িত্ব আমার উপর। ছয় মাস পার হয়ে গেছে। সেদিন এর পর শাহরিয়ার আমাকে আর খোঁজার চেষ্টা করেনি কারণ সে জানতো আমাকে খুঁজে পেলেও আমি আর তার সাথে ওই বাড়িতে ফিরবো না। তাই সে আমাকে আমার মতো করে ছেড়ে দিয়েছে। আজ এতিমখানার শত বাচ্চা যখন আমাকে মা বলে ডাকে আমি মা না হয়েও যেন মা হবার সকল শান্তি খুঁজে পাই এদের মাঝে। আর এখানেই খুঁজে পেয়েছি আমার আশ্রয়।
গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত