রহস্যের রহস্য

রহস্যের রহস্য
আপনার এই নাপাক আর অপবিত্র শরীর নিয়ে আমাদের বাসায় আসা উচিত হয়নি স্যার।
– এসব তুমি কী বলছ ??
– আমি যা বলছি সত্যি বলছি, আপনি আপনার প্রেমিকার বাসা থেকে এসেছেন এবং অবশ্যই খারাপ কাজ করেছেন।
সিপন অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে ইফতি নামের মেয়েটির দিকে। এই মেয়েটা এইসব কী বলছে, আর সে এসব জানলো কীভাবে !!
– স্যার আপনি এখন চলে যান, আমি এখন আপনার কাছে পড়বো না, আমার শরীর খারাপ লাগছে এছাড়া বই স্পর্শ করার অধিকার আপনার নেই। এগুলো সাধারণ জিনিস হলেও পবিত্র জিনিস।
সিপন পথভ্রষ্টের মতো রাস্তা দিয়ে হাঁটছে আর চিন্তা করছে, মেয়েটি কিভাবে বুঝতে পারল সে কোনো নারীর স্বাদ নিয়েছে, কিন্তু পবিত্র হয়নি? আসলে সে তার প্রেমিকা মেহজাবিনের বাসায় গিয়েছিল এবং শারীরিক সম্পর্ক করেছে কিন্তু এটাই নতুন নয়, এর আগেও কয়েকবার হয়েছে। তবে কোন টিউশনিতে যাওয়ার আগে পাক পবিত্র বা গোসল করে নিয়েছিল কিন্তু আজ সেই সুযোগটা হয়নি আর টিউশনির সময়ও পার হয়ে যাচ্ছিল, তাই নাপাক শরীরেই ইফতিদের বাসায় পড়াতে গিয়েছিল। কিন্তু মেয়েটি কিভাবে বুঝলো তার শরীর নাপাক বা অন্য কিছু ?
স্যার কিছু না বলেই হঠাৎ চলে গেল কেন, লায়লা বেগম ঠিক বুঝতে পারছে না। এটা জিজ্ঞেস করার জন্য ইফতির রুমে ডুকতেই দেখে ইফতি খাটের উপর থরথর করে কাঁপছে। কাছে যেতেই লায়লা বেগমের বুঝতে বাকি থাকেনা ইফতির কী হয়েছে। কারণ এই রোগটির সাথে সে ভাল ভাবেই পরিচিত। ইফতি একেবারেই ছোট থাকতেই, তারা স্বামী স্ত্রী শারীরিক সম্পর্ক করলেই ইফতির গা কাঁপিয়ে জ্বর আসতো। প্রথম প্রথম ব্যাপারটি তারা ধরতে পারেনি। তখনই তাদের খেয়াল হলো, তারা শারীরিক সম্পর্ক করলেই ইফতির জ্বর আসে। ঠিক এ কারণেই তারা আর কখনোই ইফতিকে পাশে রেখে মিলিত হয়নি। একেবারে পাক পবিত্র হয়ে তারপর ইফতির সামনে হাজির হয়েছে।
এটা চলে আসছে ইফতির একেবারে পিচ্চি বয়স থেকে। শুধু একটি কারনেই ইফতিকে নিয়ে কোথাও বের হওয়া যায়না। মার্কেটে বা অন্য কোথাও গেলেই ইফতির জ্বর এসে যায়। শুধু এখানেই শেষ নয় হঠাৎ হঠাৎ ইফতি পরিচিত বা অপরিচিত মানুষকে নিয়ে ভবিষ্যৎ বাণী করে যা পরে হুবহু মিলে যায়, এছাড়া অতীত ও বলে দেয় হুটহাট করে । ইফতি আট দশটা সাধারণ মেয়ের মতো না। সে কারো সাথে মিশে না, তার কোন বন্ধু বান্ধব নেই, কথাও খুব কম বলে। বাসা টু স্কুল, স্কুল টু বাসা এটাই তার সীমাবদ্ধতা। সকাল হতেই স্কুলের গাড়ি এসে ইফতিকে নিয়ে গেছে কারণ জ্বরটা ভয়ংকর হলেও দুই এক ঘন্টার বেশি থাকে না, তারপরেই একেবারে সুস্থ। আজ মেথ নিয়ে আলোচনা করছে ফারুক স্যার কিন্তু ইফতির আলোচনায় মনোনিবেশ নেই, সে তাকিয়ে আছে ফারুক স্যারের চোখের গভীরে। আর সেই গভীরতায় কী যেন দেখতে পারছে সে।
– এই মেয়ে এভাবে তাকিয়ে আছ কেন বললাম না ব্লাকবোর্ড থেকে মেথটা তুলে নিতে ।
– স্যার, আপনি আজ বাসায় যাবেন না স্যার ।
– কী বলছ আবোল তাবোল, বাসায় যাব না কেন?
– জ্বি স্যার আজ বাসায় যাবেন না প্লীজ।
– তোমার কী মাথা ঠিক আছে, বস, অংক কর। যতসব আইজেরা প্যাচাল।
– স্যার আপনার ক্ষতি হতে পারে
– বসতে বলেছি তোমাকে
ইফতি বসে পরেছে, কিন্তু ইফতির অংকে মন নেই। কেন সে হঠাৎ হঠাৎ মানুষের ভবিষ্যৎ দেখতে পায়, সে নিজেই জানেনা। তবে স্বপ্নে সে অদ্ভুত প্রকৃতির কিছু মানুষ দেখতে পায়, তারা দাবী করে তারাই নাকি তার উত্তরসূরী। তবে কী সে মানুষ নয়? পরের দিন আর ফারুক স্যারকে স্কুলে আসতে দেখা যায়না, বাসায় যাওয়ার পথে রোড এক্সিডেন্টে মারা গেছেন। খবরটা শুনে ইফতির মনটা বিষন্নতায় ভরে যায়। বারবার স্যারকে নিষেধ করা সত্বেও, সে তার কথা শুনেনি। সিপন দুই দিন ইফতিদের বাসায় পড়াতে যায়নি তবে আজ ইফতির আম্মু ফোন করতেই ইফতিকে আজ পড়াতে এসেছে, কিন্তু লজ্জা বা সংকোচে ইফতির দিকে তাকাতে পারছে না কিন্তু ইফতি যে তার দিকে গভীর ভাবে তাকিয়ে আছে, সেটা সে বুঝতে পারছে।
– কি ব্যাপার এভাবে তাকিয়ে আছ কেন বই নাও।
– স্যার একটা কথা বলি, একটি মেয়ের অন্যায়ের প্রতিশোধ নিতে গিয়ে আরেকটি মেয়েকে নষ্ট করা আপনার উচিত হচ্ছে না।
– আজকে আবার কী শুরু করলে উল্টা পাল্টা
– উল্টা পাল্টা না স্যার,
আপনি নাফিসা নামের একটি মেয়েকে ভালবাসেননি? যে মেয়েটি আপনাকে ধোঁকা দিয়েছিল। আর সেই ধোঁকার প্রতিশোধ নিচ্ছেন ইসরাত নামের মেয়েটির উপর, এটা ঠিক না স্যার, একেবারেই ঠিক না। সিপন চেয়ারে বসেই কেঁপে উঠেছে। এই মেয়েটি এত কিছু জানলো কিভাবে ? না, না এই মেয়েটি কোন সাধারণ মেয়ে নয়। অবশ্যই অদ্ভুত কিছু আছে এই মেয়েটির ভেতর। ধবধবে সাদা পোশাকের কিছু মানুষ, যাদের মুখ দেখা যায় না তারা আবার ইফতির স্বপ্ন জগতে হানা দিয়েছে।
– ইলিনা, শুনতে পাচ্ছো আমাদের?
– ইলিনা? কে ইলিনা ? আমি তো ইফতি
– না তুমি ইফতি নও, এটা তোমার এ জগতের নাম কিন্তু তুমি অন্য জগতের বাসিন্দা, তোমার আসল নাম ইলিনা । তোমার যখন ঠিক ষোল বছর পূর্ণ হবে তখন তোমাকে আমরা নিয়ে যাব তোমার আসল ঠিকানায়।
– তাহলে আমি এই পৃথিবীতে আসলাম কীভাবে ?
– জানতে পারবে, ধীরে ধীরে সব জানতে পারবে। সময় হলে আমরাই তোমাকে সব কিছু বলব।
– ইফতির ঘুম ভেঙে গেছে কিন্তু ইফতির ভয় হচ্ছে না কারণ তার কাছে মনে হচ্ছে যারা তার স্বপ্নে এসেছিলো তারাই তার আপন, পৃথিবীর সকল কিছু মায়াময়।
– আম্মু, আমি যদি হঠাৎ করে তোমাদের ছেড়ে অন্যত্র কোথাও চলে যাই তোমরা কী খুব কষ্ট পাবে?
– ইফতি, কি বলছিস এগুলো? আর কেন বলছিস? তোর শরীর ঠিক আছে তো।
– আচ্ছা আম্মু আমি কী তোমাদের সত্যিকারের মেয়ে? নাকী কোথাও থেকে কুড়িয়ে পেয়েছিলে ?
– এবার কিন্তু তুই আমার হাতে সত্যি মার খাবি ইফতি ? দশ মাস পেটে ধরে তোকে জন্ম দিয়েছি তারপর কষ্ট করে তোকে মানুষ করেছি। আর এখন বলছিস তোকে আমরা কুড়িয়ে পেয়েছি কিনা ? রাত গভীর হয় তার সাথে গভীর হয় স্বপ্ন। আবার তারা ইফতির স্বপ্নে হাজির হয়েছে, তবে নারী রূপে একজনকে দেখা যাচ্ছে কিন্তু মুখ স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে না।
– মা ইলিনা, কেমন আছ ?
– কে আপনি?
– আমি তোমার জন্মদাত্রী
– জন্মদাত্রী!!
– হ্যাঁ জন্মদাত্রী, তুমি যে এখন মানুষ রূপে পৃথিবীতে আছ এটা তোমার খোলস মাত্র, তোমার আসল অস্তিত্ব ভিন্ন জায়গায়। পৃথিবীতে তোমার যে ‘মা, সে কখনোই সন্তান জন্ম দানে সক্ষম ছিল না। সে ছিল বন্ধ্যা নারী। বন্ধ্যাত্ব ছিল তার অদৃষ্টের লিখন। কিন্তু তার সন্তানের প্রতি আকাঙ্ক্ষা আর উদগ্রীব সেটা আমাকে আকৃষ্ট করেছে, আর তাইতো আমার মাঝে জন্ম নেয়া নতুন অস্তিত্বকে তোমার মায়ের গর্ভে প্রতিস্থাপন করেছি আর সেখানেই তুমি বড় হয়েছ মানুষ রুপে কিন্তু তুমি মানুষ নও। মানুষকে কখনোই অতীত ভবিষ্যৎ দেখার ক্ষমতা দেওয়া হয়নি যা আমাদের দেওয়া হয়েছে তবে পুরোপুরি নয়। অতীত আমরা সম্পূর্ণটা দেখতে পারলেও ভবিষ্যৎ সম্পূর্ণটা দেখতে পারি না আবার দেখতে পারিনা নিজের ভবিষ্যৎও।
– সেটা না হয় বুঝলাম, কিন্তু তুমি যদি আমার মাকে পূর্ণতা দেওয়ার জন্য তোমার নতুন অস্তিত্ব তার গর্ভে প্রেরণ করে থাক, তবে কেন আমি ষোড়শী হতেই আমাকে আবার তাদের কাছ থেকে কেন কেড়ে আনবে ?
– আমি হয়তো সেদিন আবেগের বশে তোমার মাকে পূর্ণতা দিয়েছিলাম কিন্তু আমাদের এই পরা বাস্তবতার জগতের নিয়মে তুমি সেখানে স্থায়ী হতে পারনা। আমি চাইলেও তুমি সেখানে থাকতে পার না । নির্দিষ্ট সময় পরে তোমাকে আমাদের সাথে ফিরে আসতেই হবে।
ইফতির পুরো ঘর আলোয় আলোকিত। সমস্ত আসবাব শূন্যে ভেসে আছে সাথে ইফতিও। স্বপ্নের সেই মহাজাগতিক মানুষ গুলো হাত প্রস্তুত করে ইফতিকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে। ইফতির শরীরের সমস্ত অনু পরমাণু ধীরে ধীরে আলোর কণায় পরিনত হচ্ছে তারপর সেটা চলে যাচ্ছে একজন নারী রূপি মানুষের শরীরে, যার শরীর থেকেও আলোর কণা বিচ্ছুরন হচ্ছে। সে এক অভূতপূর্ব দৃশ্য। যে দৃশ্য পৃথিবীর কোন মানুষ এখন পর্যন্ত অবলোকন করেনি। ছোট একটি কেক আনা হয়েছে, তবে তেমন কোন আয়োজন নেই। হই হুল্লোড়, অনুষ্ঠান বা পার্টি কোনটাই ইফতির পছন্দের না আর তাই ইফতির আব্বু এই ছোট কেকটা দিয়েই খুব ভোরে ইফতিকে সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছিলেন কিন্তু ইফতিকে এতো ডাকাডাকি করছে কিন্তু দরজা খুলছে না। এক সময় ভয় ডুকে গেছে ইফতির আব্বু আম্মুর মনে।
দরজা ভাঙা হয়েছে, কিন্তু একি! ইফতি কোথায় ? ইফতির পরনের জমা কাপড় খাটের উপর পরে আছে। ঘরের আসবাবপত্র এলোমেলো। কেউ কিছু বুঝতে পারছে না। ঘর ভেতর থেকে লাগানো, কিন্তু ইফতি নেই। ইফতি এখান থেকে কিভাবে কোথায় অদৃশ্য হয়ে গেছে এর রহস্য কেও ভেদ করতে পারছে না। আসলে সব রহস্যের রহস্য ভেদ করার ক্ষমতা মানুষকে দেওয়া হয়নি
গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত