আম্মা আফনে কি এ বাড়ির বউ? কথাটা শুনে থমকে দাঁড়ালাম আমি। পেছন ফিরে তাকাতেই দেখি মহিলাটি উত্তরের অপেক্ষায় আমার দিকে উৎসুক ভাবে তাকিয়ে। রোদ লেগে চোখের কর্ণিয়া দুটো চিকচিক করছে। বনরুটিতে কামড় দিচ্ছে গোগ্রাসে। হঠাৎ কোথা থেকে এসে বাসার গেট ধাক্কা দিয়ে ভেতরে ঢুকে বারান্দার বাইরে এসে হাক ছুঁড়ে বলছিল।
– ” আম্মাআআআ মেলা খিদা লাগছে। কিছু খাইতে দেন।” মহিলার চিৎকার শুনে বাইরে এসে একটা প্যাকেটে কয়েকটা বড় বড় বনরুটি মহিলাটিকে দিয়ে চলে যাচ্ছিলাম ঠিক তখনই মহিলাটি উপরের প্রশ্নটি ছুঁড়ে দিলো আমাকে। আমি উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন মনে করি নি। তাই উত্তর না দিয়েই যেই না বারান্দার দরজার চৌকাঠের দিকে ঘুরে দাঁড়িয়েছি মহিলাটি আবার মুখে থাকা বনরুটি কোনো মতে গিলে একই প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো আমার দিকে।
-” আম্মা! কইলেন না? আফনে কি এ বাড়ির বউ? “
-” না।” এক শব্দে উত্তর দিলাম আমি।
-” তাইলে?” কপালের ভ্রুঁ দুটো কুঁচকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে মহিলাটির দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে বললাম,
-” এ বাড়ির মেয়ে। ” মহিলাটি হাস্যজ্বল মুখে বললো,
– ” শশুর বাড়িত তো বউয়েরা মাইয়ার মতোনই। কি কন আম্মা! ঠিক কইলাম না? “
-” হ্যাঁ। ” বলে আমি আবারও বারান্দায় ঢুকতে পা এগিয়ে দিতেই মহিলাটি আবার প্রশ্ন করলো।
-” আম্মা! তা আফনের বাপের বাড়ি কৈনে?” আমি খানিক বিরক্ত হয়েই উত্তর দিলাম।
-“এটাই।”
-” তাইলে শশুড় বাড়ি কৈনে?”
– ” বিয়ে করিনি।” মহিলাটি এবার কালচে দাগ পরা এবড়োখেবড়ো দা্ঁতগুলো ক্যালিয়ে হেঁসে দিয়ে বললো,
-” আম্মা দিহি মোর লগে তামাশা নয়, মশকরা করে। ” আমি মনে মনে নিজেই নিজেকে বলে ওঠলাম, ” সিরিয়াসলি! আই এ্যাম জোকিং! হাউ? “
-” তা আম্মা জামাই কি করে? ” আবারও প্রশ্ন করলো। এবার মহিলাটির কথায় আশ্চর্য না হয়ে পারলাম না।
এদিকে বড় আপুর কুঁইকুঁই করা হাসির শব্দে আমি পেছন ফিরে তাকালাম। ঘরের দরজার আড়াল থেকে সব শুনছে কাত করে অর্ধেক মাথা বাইরে বের করে। আমার দিকে তাকিয়ে হাত দিয়ে মুখ চেপে ধরে আপ্রাণ চেষ্টা করছে হাসি দমিয়ে রাখতে। আমি বড় আপুর দিকে ভ্রুঁক্ষেপ না করে মহিলাটির দিকে তাকিয়ে উত্তর দিলাম,
-” কিছু না। “
-” বেকার?” আমি মাথা উপরনিচ করে হ্যাঁ সূচক সম্মতি জানালাম।
-” বেকার? তাইলে লেহাপড়া করে? ” জিজ্ঞেস করলো। একটু ভেবে মাথা নেড়ে উত্তর দিলাম আমি।
-” হ্যাঁ। “
-” থাহে কৈ?”
-” বিদেশ। ” আমি হাসি মুখে উত্তর দিলাম।
-” কোন দেশ?”
-” উগান্ডা। ” আমার কথায় কি বুঝতে পারলো তা জানি না। মুখটা শুকনো করে বললো, ” ওহ্! “
-” অহন এ দেশে নাই? “
-” আছে। নিজের বাসায় ঘুমুচ্ছে। “
এ কথা শুনে এক দৌঁড়ে বড় আপু হাসতে হাসতে রান্না ঘরের দিকে ছুঁট লাগানো। মাকে গিয়ে এখন সব বলবে রসালো করে। বড় আপু খুব সুন্দর করে একটা সাধারণ ঘটনা রসালো ভাবে বর্ণনা করতে পারে। এটা তার একটা গুণ। আপু রান্না ঘরের দিকে যেতে যেতেই চিৎকার করে বলছে, ” মাআআআ এবার যে তোমার ছোট মেয়েকে আমার আগেই বিয়ের পিঁড়িতে । “
-” বাচ্চা নাই? “
আমি ভ্রুঁ দুটো কুঁচকে তাকালাম মহিলাটির দিকে। মহিলার প্রশ্ন ছুঁড়ে দেওয়া ক্রমাগত আমাকে আরো বেশি কৌতুহলী করে তুলছে। আমি বারান্দায় ফ্লোরে পা গুটিয়ে বসে পড়লাম। কী ভেবে? জানি না। দুষ্টুমি করে মুচকি হেঁসে আমি আমার পেটের দিকে ডান হাতের তর্জনী আঙ্গুল তাক করে বলেই দিলাম,
-” এখানে আছে। ” আমার কথা শুনে এ দিকে মহিলার মুখ এক মূহুর্তে হাস্যজ্বল হয়ে উঠলো। এতো এতো খুশি হলো যে বলার মতো না। খুশি যেন উপচে পড়ছে চোখে মুখে। লক্ষ্য করলাম হাসলে মহিলার শ্যাম ময়লা গালে টোল পড়ে। দেখতে সুন্দর লাগে। চোখে বেশ মায়াও আছে। খুশিতে আত্মহারা হয়ে কয়েক কদম আমার দিকে এগিয়ে এসে বলেই ফেললো, ” আম্মা! আম্মা! কয় মাস! কয় মাস? মহিলার কথায় আমি এতোক্ষণ খুব মজা পাচ্ছিলাম। কারণ ক্লাস এইটে পড়ুয়া একটা পিচ্চি মেয়েকে বিবাহিতা বানিয়ে দিয়েছে এক মূহুর্তে । মহিলাকে খুশি করতে একের পর এক মিথ্যে বলে চলেছি। বিয়ে ছাড়াই স্বামী, সংসার, শশুড়বাড়ি এমন কি গর্ভে বাচ্চাও আছে আমার। মজা না! মিথ্যাে বললে যদি কেউ খুশি হয়। কারো মুখে এক চিলতে হাসি ফুটে ওঠে। তাহলে খারপ কী?
-” তিন মাস। ” আমি উত্তর দিলাম।
-” আইচ্ছা! আইচ্ছা দোয়া করি। দোয়া করি। আল্লাহ ভালা রাহুক। ভালা থাক। কিন্তু আম্মা! খবরদার! দিঘির ঘাটে যাইবেন না! একদম যাইবেন না! একদম না! ” খানিক উত্তেজিত হয়ে বললো কথা গুলো। আমি কৌতুহলী হয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
-“কেন?” মহিলাটিও আমার মতো দেখাদেখি বাইরে মাটিতে বসে পড়লো। আমি মহিলাটিকে আবারও জিজ্ঞেস করলাম,
-” দিঘিতে যাবো না কেন? “
-” বাচ্চার ক্ষতি হইবো!”
-” কেন? কিভাবে?”
-” হইবো তো! হইবো।
আমি জানি। বর্ষাকালে আমিও একদিন দিঘির ঘাটে নাইতে গেছিলাম। ঘাট দিয়া উঠবার সময় শ্যাওলায় পা পিছলাইয়া পইরা গেছিলাম। পেটের পাঁচ মাসের বাইচ্চাটা মইরা গেছিলো। আর বাইচ্চা পেটে ধরে নাই। কয়েকমাস পরে জামাই আরেকটা বিয়া কইরা আমারে মাইরা ঘরতে বাইর কইরা দিছে। “
মহিলাটি এমন কিছু বলবে তার জন্য আমি মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না। আমি মহিলাটির দিকে তাকালাম। মহিলাটির চোখ দুটো লাল লাল হয়ে আছে। কারণ দু’টো চোখ থেকে টপ টপ করে নোনা জল পড়ছে গাল বেয়ে বুকের ময়লা শাড়ির ভাঁজে ভাঁজে। কারণ মহিলাটি যে মস্তিষ্কের ভারসাম্য হারিয়েছে। এ বিষয়ে আমি নিশ্চিত ছিলাম। আমি বিয়ে করিনি বলার পরও মহিলাটি বিশ্বাস করে নি যে আমি অবিবাহিতা। বরং উল্টো জিজ্ঞেস করেছে, ” জামাই কি করে? ” মহিলাটি তার মস্তিষ্কে সব কল্পনায় গুছিয়ে রেখেছে। হোক তা মিথ্যে। আর তা সে বাস্তবেও সত্যি মনে করছে। মহিলাটিকে হাজার বার বললেও কোন কাজ হবে না যে আমি অবিবাহিতা। তাই এই মিথ্যাের খেলাটা খেলছি। চলুক না! ক্ষতি কি? সে এতে খুশি! আমি বললাম,
-” বাবার বাড়ি যাওনি কেন? “
– ” বাপ মা নাই। গ্যারামের মাতবর ঘর ভাইঙ্গা জমিজমা কাইরা নিছে গা। ” মহিলাটি চোখ মুছে বললো।
-” তোমার গ্রামের বাড়ি কোথায়? ” আমি জিজ্ঞেস করলাম। কিছুক্ষণ ভেবে মাথা চুঁলকিয়ে উত্তর দিলো,
-” কুড়িগ্যারাম । “
মহিলাটির কথায় আমার খুব খারাপ লাগলো এবার। মায়াও হলো। এমনটা কি না হলেও পারতো না!
হঠাৎ পেছন থেকে মা হাসতে হাসতে এসে বলে উঠলো,
-” কিরে! এবার তাহলে মা-র কথা শেষ না হতেই মহিলাটি এক লাফে বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে পাগলের মতো বলে উঠলো,
-” মাআআ দিঘির ঘাটে যেতে দিয়েন না আম্মারে। দিয়েন না। বাইচ্চার ক্ষতি হইবো! ক্ষতি হইবো, ক্ষতি হইবো! বলেই পাগলের মতো এক ছুঁটে বাসার গেট দিয়ে দৌঁড়ে পালিয়ে গেলো। মাটিতে বন রুটির প্যাকেটটা পরে আছে।
আমি মা-র দিকে তাকালাম। মা হতভম্ব হয়ে গেটের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
একটু অসাবধানতা মানুষের জীবনে কতোটা ভয়াবহ হতে পারে তা আমরা কল্পনারও করতে পারিনা । ছোট একটা ভুল মানুষের জীবনের গতির কাটা উল্টো ঘুরিয়ে দেয়। ঘূর্ণিঝড়ের তান্ডবের মতো এক মূহুর্তে সব ভেঙ্গে লন্ড ভন্ড তসনস দেয়। ঝড়ে পড়ে অকালে কিছু জীবন। ধ্বংস হয়ে যায় কিছু স্বপ্ন, আশা, আকাঙ্ক্ষা, ইচ্ছে, ভালোবাসা। বড্ড ঠুনকো শুকনো পাতার মতো মলিন হয়ে যায় সব! দশ বছর পর। আমি এখন সাত মাসের অন্তঃসত্ত্বা। গুটিগুটি পায়ে বাগানের ছোট পুকুর ঘাটে এসে দাঁড়ালাম। ঝমঝমিয়ে এক পশলা বৃষ্টির নেমে এলো। কারণ এখন বর্ষাকাল।
গল্পের বিষয়:
গল্প