বাঁধনের ইচ্ছের অমতেই বিয়েটা হয়ে গেল।হাসবেন্ড একটি সরকারি কলেজে কেমিস্ট্রি পড়ায়।আর বাঁধন ইংরেজি নিয়ে অনার্স করছে,এবার ফাইনাল ইয়ার। বাঁধন ঝিম মেরে বাসর ঘরে বসে আছে।এমন সুন্দর সাজানো গোছানো রুমটাও বিষময় মনে হচ্ছে। মাথায় এখন রাজ্যের চিন্তা।রায়হানকে ও কথা দিয়েছে যেইভাবেই হোক এ বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে ওর কাছে ফিরে যাবে।
ফায়াজ আহমেদ ঘরে আসলেন,সেদিকে বাঁধনের কোন খেয়াল নেই।সামনে এসে দাঁড়াতেই টপটপ করে চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পরলো। ফায়াজ বুঝে ওঠতে পারছেনা কি হয়েছে। ফায়াজ সামনে বসে নরম গলায় জানতে চাইলো কি হয়েছে আপনার?কান্না করছেন কেন?মা-বাবার কথা মনে পড়ছে,তাহলে ফোন করে কথা বলুন।মা-বাবার কথা শুনে বাঁধনের মন যেন আরও বিষাক্ত হয়ে ওঠলো।বাঁধন ঝাঁঝালো গলায়, দাঁতে দাঁত চেপে বললো সব কান্না মা-বাবার জন্য হয় না!এই কথা শুনে ফায়াজ খুব অবাক হলো।তাহলে কি হয়েছে?
বাঁধন শুনেছে ফায়াজ কেমিস্ট্রি পড়ায়।তাই ভাবলো এমন রসকষহীন বিষয় যে পড়ায় কে জানে সে কেমন হবে!তারপরও দ্বিধা কাটিয়ে বললো,দেখেন আপনার সাথে বিয়েটা আমার অমতে হয়েছে।আমি চাইনি বিয়েটা করতে,কারণ আমি একজনকে ভালোবাসি,খুব ভালোবাসি।তাহলে আটকালেন না কেন?বলেছিলাম,কিন্তু আমি যাকে ভালোবাসি সে বেকার,ডিগ্রি নিয়ে ঘুরছে,কিন্তু চাকরি হচ্ছে না।আর আপনারা আমাকে দেখে বলেছেন,আপনাদের পছন্দ হয়েছে।আমাদের পরিবারের সবারও আপনাকে খুব পছন্দ হয়েছে।বিয়ে করবো না শুনে বাবা হার্ট অ্যাটাক করে।ডাক্তার বলেছে ওনাকে উত্তেজিত করা চলবে না,তাই বিয়েটা করতে হয়েছে।
ফায়াজ চুপচাপ কিছুক্ষণ বসে থেকে বললো,ঠিক আছে ছয় মাস অপেক্ষা করুন।কারণ ছয় মাসের আগে ডিভোর্স দেয়া যায় না।এই ছয় মাস কষ্ট করে মানিয়ে চলতে হবে,পারবেন তো?বাঁধন ফায়াজের কথা শুনে খুব অবাক হলো,একটা মানুষ এতো ভালো হয় কি করে।যদিও দেখতে গম্ভীর, রাশভারি আর রাগী মনে হয়,কিন্তু মানুষটা তেমন না।বাঁধন বললো,জ্বী অবশ্যই পারবো।কিন্তু ছয় মাস পরে সে আপনাকে নিবে তো?জ্বী নিবে,তাতে কোন সন্দেহ নাই।সারাদিন খুব ধকল গিয়েছে, নিশ্চিন্তে এখন একটা লম্বা ঘুম দিন।চিন্তা করবেন না আপনার ভালোবাসার মানুষের কাছে আপনাকে অবশ্যই ফিরিয়ে দিব।
বিয়ের সব ফর্মালিটি শেষ হওয়ার পরে ফায়াজ ওর ফ্ল্যাটে বাঁধন কে নিয়ে ওঠে গেল।এতদিন ফায়াজ বড় ভাই ভাবির সাথেই থাকতো।মা-বাবা গত হয়েছে অনেক আগেই।ভাইয়ের ছেলে-মেয়েরা বড় হয়েছে,তাই একটা ফ্ল্যাটে আর হচ্ছিলো না।তাই ফায়াজ বিয়ের আগেই একটা ফ্ল্যাট দেখে রেখেছিলো। যে জন্য নতুন ফ্ল্যাটে সিফট করলো। বাঁধন সারাদিন বাসায় একাই থাকে।ছয় মাস থাকতে হবে বলে থাকে।বাঁধন ভাবেনি ফায়াজ যে এতোটা ভালো মানুষ।বাঁধন মনে মনে ভাবে যাক নিশ্চিন্তে ছয় মাস কাটিয়ে দেয়া যাবে।বাঁধন এদিকে রায়হানের সাথে যোগাযোগ বজায় রেখেছে।বলা যায় দিনের বেশির ভাগ সময় রায়হানের সাথে কথা আর চ্যাটিং করে কাটিয়ে দেয়।ফায়াজও উকিলের সাথে কথা বলে নিয়েছে। ফায়াজ নিজের কাজগুলো নিজেই করে।এমনকি সন্ধ্যায় চা ওনি নিজে বানিয়ে খান,সাথে বাঁধননকেও বানিয়ে দেয়।সকালে বাঁধন ঘুম থেকে ওঠতে দেরি হলে বাহির থেকে খাবার এনে খেয়ে নেয় আর বাঁধনের জন্য রেখে যায়।
ফায়াজ আর বাঁধনের বিয়ের তিনমাস। ওরা এখন অনেকটা বন্ধুর মতো।বাঁধন চেষ্টা করে রান্নার ব্যপারটা সামলাতে,যে মানুষটা এতোটা ভালো তার জন্য এইটুকু করা ই যায়।এখন ওরা প্রায়ই রাতের খাবারের পরে কফি হাতে বারান্দায় গল্প করতে বসে।কফিটা ফায়াজই বানায়।মাঝেমধ্যে বাঁধন ভেজা কাপড় ছড়াতে ভুলে গেলে ফায়াজ তা ছড়িয়ে দেয়।শুধু তা ই না,প্রতি শুক্রবারে নিজের কাপড়গুলো আয়রন করার সময় বাঁধনের শাড়ি থাকলে সেটাও আয়রন করে দেয়। এই ছোট ছোট কেয়ারিংগুলো বাঁধনকে খুব টানে।ফায়াজের জায়গায় অন্য কেউ হলে অবশ্যই মা-বাবা পর্যন্ত কথাগুলো পৌঁছাতো।বাঁধন মনে মনে খুব করে চায় ও চলে যাওয়ার পর যেন ওনার জীবনে খুব ভালো একটি মেয়ে আসে। ফায়াজ জানে যখন একটি মেয়ে ওরে ভরসা আর বিশ্বাস করে ছয় মাস অপেক্ষা করবে তখন সর্বোচ্চ নিরাপত্তা আর খেয়াল রাখা অবশ্যই ওর দায়িত্ব। ফায়াজ তাই সেভাবেই চেষ্টা করছে।
কলেজ থেকে ফিরে এসে কলিং বেল দেওয়ার পর বাঁধন দরজা খুলে দিল।ফায়াজের বাঁধনকে দেখে কেমন ক্লান্ত লাগলো।আপনে কি অসুস্থ? না মানে একটু জ্বর জ্বর লাগছে।ও ওষুধ খাননি?বাসায় নরমাল ওষুধগুলো রয়েছে ত।দুপুরে কিছু খেয়েছেন?নাহ খেতে ইচ্ছে হয়নি।ঠিক আছে আপনে রুমে যান,আমি দেখছি কি করা যায়।ফায়াজ নিজ হাতে চিকেন স্যুপ করে বাঁধনের জন্য নিয়ে গেল।স্যুপ খাইয়ে তারপরে জ্বরের সাধারণ ওষুধগুলো খাইয়ে দিলো।আচ্ছা আমি রুমে যাচ্ছি, আপনার কিছু লাগলে বলবেন।আচ্ছা এতো ব্যস্ত হওয়ার কিছু নেই, সামান্য জ্বর ঠিক হয়ে যাবে।বন্ধু হিসেবে এইটুকু করা তো আমার দায়িত্ব। আচ্ছা ঠিক আছে আপনে একটু রেস্ট নিন এবার,সারাদিন ক্লাস শেষে নিশ্চয় ক্লান্ত। ঠিক আছে,খারাপবোধ করলে বলবেন। ফায়াজ আর বাঁধন আলাদা রুমেই থাকে।বাঁধনের বাসা থেকে কেউ আসলে বাঁধন একদম স্বাভাবিক আচরণ করে,মানে দেখে কোন বোঝার উপায় নাই যে ওদের মাঝে কি চলে।
ফায়াজ সন্ধ্যার পরে বাঁধনের রুমে খোঁজ নিতে আসলো।এসে দেখলো জ্বরে কাঁপছে।ফায়াজ কাঁথা দিয়ে দিলো,কপালে হাত রেখে দেখলো জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে। ফায়াজ বালতি দিয়ে পানি এনে আধাঘন্টা মাথায় পানি ঢাললো।তারপর জলপট্টি দিয়ে দিচ্ছিলো।বাঁধন চোখ খোলে দেখলো ফায়াজ জলপট্টি দিচ্ছে। সে কি আপনে এত কষ্ট করছেন কেন? জ্বরই ত ঠিক হয়ে যাবে।আপনে খেয়ে শুয়ে পড়ুন।ফায়াজ তেমন কিছু বললো না,ঠিক আছে আপনে কিছু খাবেন ত নাকি?না আর কিছু খাব না,আপনে খেয়ে নিন।আর সত্যি বলছি,আপনে বন্ধু হিসেবে খুবই ভালো,তাই ধন্যবাদ দিয়ে ছোট করবো না। ফায়াজের ছোট ছোট বিষয়গুলো বাঁধনের হঠাৎ কেমন যেন ভালো লাগতে শুরু করেছে।ফায়াজ কি দিনে দিনে মায়ায় বেঁধে ফেলছে,না আমি বাঁধায় পড়ছি।তবে কি আমি…ছিঃ,ছিঃ আমি এসব কি ভাবছি।রায়হানকে ছেড়ে অন্য কাউকে ভাবা যায় না।
সকালে বাঁধন পত্রিকা পড়ছিলো।হঠাৎ ওর ক্লোজ বান্ধবী ফোন করে বললো,রায়হান বিয়ের জন্য মেয়ে দেখছে।এমন কি রায়হানের বন্দরে খুব ভালো পোস্টে জবও হয়েছে। শোনার পরে বাঁধনের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো।
বাঁধন রায়হানকে ফোন করলো।রায়হান কল রিসিভ করলো।রায়হান তোমার সাথে আমার প্রতিদিন কথা হয় বলোনি তো তোমার বন্দরে চাকরি হয়েছে,তার উপর নাকি মেয়ে দেখছো?তোমাকে কে বললো?ইরা বলেছে কারণ তুমি ওর কাজিন কে দেখতে গিয়েছিলে?
হুম যা শুনেছো ঠিক।মানে তাহলে আমি ডিভোর্সের ব্যবস্থা করছি কেন?আমাকে কেন ডিভোর্স দিতে বাধ্য করছো?রায়হান বললো, তুমি কি ভেবেছো, আমি তোমাকে বিয়ে করবো?অসম্ভব, আর এখন আমার এত ভালো চাকরি যখন আছে তখন তোমার থেকে বেটার কোন সুন্দরী না,তাদের বাবা-মা আমার পিছনে লাইন দিবে।তোমার হাসবেন্ড অবশ্যই তোমাকে বাসায় নিয়ে ফুলদানিতে সাজিয়ে রাখেনি!অন্য জনের এঁটো খাবার আমি খাবো ভাবো কি করে?আর ডিভোর্সের প্ল্যানটা তোমার অহংকারী বাবাকে শায়েস্তা করার জন্য। ছিঃ রায়হান কত জঘন্য তোমার চিন্তা ভাবনা,মন কতোটা নিচু তার প্রমাণ দিলে।তোমার মত অমানুষের জন্য আমি কি না একটা ফেরেশতাসম মানুষকে অবহেলা করে চলেছি।তোমাকে যদি বলি ঘৃণা করি,তাহলে ঘৃণা শব্দটারও অপমান হবে।এটা বলে বাঁধন ফোনের লাইন কেটে দিলো আর নম্বর ব্লক লিস্টে। বাঁধনের চোখ ফেটে পানি আসতে চাইছে, কিন্তু প্রাণপণে তা আটকালো।কারণ কোন বেইমান বা বিশ্বাসঘাতকের জন্য একফোঁটা চোখের পানি ফেললেও পাপ হবে।
যদিও ছয়মাস হওয়ার আর মাত্র পনেরো দিন বাকি।হয়তো ডিভোর্স লেটারও রেডি হয়ে গিয়েছে।বাঁধন আর কিছু ভাবতে পারছে না,যা হওয়ার হবে।তবে এই পনেরো দিন খুব ভালো সময় কাটাতে চাই এই ভালো মানুষটার সাথে।
ফায়াজ সন্ধ্যায় দুই মগ কফি করে বাঁধনকে ডাকলো,কফি খাবেন?চলেন বারান্দায় বসে কফি খাই।একটা দারুণ খুশির খবর আছে,আপনে জেনে অবশ্য খুব খুশি হবেন।এ কথা শুনে বাঁধনের কলিজায় কাঁপন ওঠলো।কেননা এক সপ্তাহ আগেই ওদের বিয়ের ছয় মাস পূর্ণ হয়েছে।ফায়াজ বললো কি হয়েছে চলুন। বাঁধন অনিচ্ছা সত্ত্বেও বারান্দায় গিয়ে চেয়ারে বসলো।
ফায়াজ হেসে বললো,এই ধরুন আপনার মুক্তির দলিল।কলমটা নিন,একটা সাইন করে দিলেই আপনে মুক্ত হয়ে যাবেন।বাঁধন দুই মিনিট ডিভোর্স পেপারটার দিকে তাকিয়ে থেকে গরম কফির মগটা হাতে নিয়ে, পুরো কফিটা পেপারের উপর ঢেলে দিল।ফায়াজ দেখে অবাক হয়ে গেল।এমা একি আপনে পেপারটা নষ্ট করে দিলেন যে?সাথে আমার বানানো কফিটাও।বেশি কথা বললে বাকি যে এক মগ আছে তা মাথায় ঢেলে দিব! ফায়াজ এবার গম্ভীর সুরে জানতে চাইলো,কি হয়েছে বুঝিয়ে বলবেন? বাঁধন যতটুকু বলা যায় ততটুকু বললো। বাঁধন বললো,সব থেকে বড় কথা একজন মিথ্যে মানুষের মিথ্যে অভিনয়ের জালে আটকে একজন সত্যিকারের মানুষ হারাতে বসেছিলাম।এখন এটা আর আমি চাই না।আল্লাহর কাছে অনেক শুকরিয়া তিনি আমার সহায় ছিলেন।
এখন বলেন আপনার আমার সাথে থাকতে কোন আপত্তি নেই তো?আমাকে এখন গ্রহণ করতে আপনার খারাপ লাগবে না ত?ফায়াজ বাঁধনের চোখে চোখ রেখে বললো,দেখেন ভালোবাসা কখনো জোর করে হয় না।আমি চাইলেই আপনাকে নিজের করে পেতে পারতাম।কিন্তু সে পাওয়াতে কোন সুখ বা শান্তি থাকতো না।আর এখন যখন নিজ থেকে চাইছেন কিছুতেই আমি ফিরিয়ে দিবো না।সৃষ্টিকর্তা আমাদের দুজনের ভাগ্য একই সুতোয় যে বেঁধে রেখেছেন।বাঁধন হাতে হাত রেখে বললো,চলুন এক মগে কফি খাই!ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে যে। বিয়ের ছয় বছর পর,পত্রিকা হাতে নিয়ে বাঁধনের পত্রিকার একটি ছবিতে চোখ গেল,পাঁচজনের একটা ছবি সেখানে রায়হানও রয়েছে।হেডলাইন পড়ে চোখ কপালে ওঠে গেল”বন্দরে উপরিপদের কর্মকর্তাদের সাথে হাত মিলিয়ে চোরা কারবারিদের রমরমা ব্যবসা।”
ভিতরে বিস্তারিত পড়ে বুঝতে পারলো এতে রায়হানের ও হাত রয়েছে।চাকরিটাও চলে গিয়েছে।এর জন্য ই বলে আল্লাহর বিচার খুবই সুন্দর! ঠিক তখন বাঁধনের মেয়েটা মামনি মামনি বলে কোলে এসে বসলো।বাঁধনের মেয়ের নাম ফাবিহা।ফাবিহার বয়স তিন বছরের উপরে।ফায়াজ আর বাঁধনের এখন ফাবিহা কে নিয়ে সাজানো গোছানো ছোট্ট সুখী পরিবার।
গল্পের বিষয়:
গল্প