শুকনো পাতা

শুকনো পাতা
‘নাম কি তোর?’ প্রশ্নটা করেই লোকটা সিগারেট ধরায়। ধোয়া ছেড়ে ছেলেটার দিকে তাকায়। ছেলেটা চায়ের কাপ টেবিলে রেখে বলে…
-সোলায়মান মিয়া।
–বয়স কত?
-জানিনা।
–বাপের নাম কি?
-তা দিয়া আপনের কাম কি? চা খাইতে আইছেন চা খাইয়া চইলা যান। লোকটা চায়ের কাপে সুররুত করে চুমু দেয়। তারপর মুচকি হেসে বলে….
-বড়দের সম্মান করতে হয় এভাবে কথা বলতে নেই।
–আমার বাপ নাই৷ মাও নাই। আমার বুদ্ধি অওনের পর থেইক্কা এই দোকানে কাম করি…!
-এতরাত পর্যন্ত কেন করিস? তোর মহাজন কই?
–মহাজন রাইত ৯ টার পর বাসায় চইল্লা যায়, তারপর দুএকটা কাস্টমার আইয়ে হেগোর চা খাওয়াই৷ সারে ১০ টায় সাডার নামাই দেই।
-আজ তো ১১ টা বাজে। অনেক রাত বাসায় যাবিনা?
–আমার বাসা নাই।
-থাকিস কোথায়?
–দোকানের ভিতরেই থাকি।
-কষ্ট হয়না!
–না।
লোকটা আর কিছু বলেনা। সোলায়মান বাকি চায়ের কাপ গুলো সুন্দর করে ধোয়। সেগুলো টেবিলের উপর সুন্দর করে গুছিয়ে রাখে৷ দোকানের সাডার একটা নামিয়ে দেই। লোকটা জিজ্ঞেস করে….
–দোকান বন্ধ করবি?
-না, টিভিতে ছবি দেখমু রাত ২ টা পর্যন্ত। তারপর বন্ধ কইরা ঘুমামু।
–সকালে উঠতে পারিস?
-হ, উইঠা দোকান খুলি।
–লেখাপড়া জানিস?
-না, তয় নাম লেখতে জানি।
–দেখি নাম লেখতো, কেমন পারিস।
সোলায়মানের চোখ চকচক করে ওঠে৷ কেউ ওকে লেখাপড়া বিষয়ক প্রশ্ন করলে ও প্রচণ্ড খুশি হয়। সোলায়মান ক্যাশ টেবিলের ড্রয়ার থেকে খাতা কলম বের করে। তারপর সুন্দর করে লেখে, ‘সোলামন।’ লোকটার দিকে খাতা এগিয়ে দেয়। লোকটা হেসে ওঠে, সোলায়মান আগ্রহের স্বরে বলে….
–হইছে না? লোকটা খেয়াল করলো ‘য়’ দেয়নি। এখন যদি বলে নাম লেখা ভুল হয়েছে তাহলে নিশ্চিত সোলায়মানের মন খারাপ হবে৷ দেখা গেলো ওর সারারাত টা কেটে গেলো মন খারাপে। লোকটা অবাক হওয়ার ভঙ্গিতে বলল…
–বাহ! কি সুন্দর লেখা। কোথায় শিখছিস এত সুন্দর করে লেখা?
-একদিন হাবিব কাকায় নাম লেইখা দিছিলো খাতায়, সেইটা দেইখা দেইখা শিখছি।
–তোরতো খুব বুদ্ধি। স্কুলে না গিয়ে শুধু দেখেই এত সুন্দর লেখা? গুড বয়!
সোলায়মান একটু লজ্জা পায়। একটু আগে যে লোকটার প্রতি বিরক্ত ভাব ছিল সেটা এখন নেই। এখন যেটা আছে সেটা শ্রদ্ধা। সোলায়মান আবার বলল….
–স্যার আরেক কাপ চা দিমু? চা খাবেন?
-না আর খাবনা।
–খাননা এক কাপ! টাকা দেওন লাগবনা।
-তুই খাওয়াবি?
–হ, সাথে একটা বিস্কুট দেই খাড়ান।
-তুই চা খাসনা?
–না, মেলা গরম খাইতে পারিনা।
-আচ্ছা দে আমায়, তবে এটা কিন্তু তুই খাওয়াবি।
–হেইডা কইতে অইবনা।
সোলায়মান ঝটপট করে এককাপ চা বানায়। বয়াম থেকে এক বিস্কুট বের করে এক প্রিচ সহ এগিয়ে দেয়। লোকটা খেয়াল করলো সোলায়মানের চোখ চকচক করছে খুশিতে। সামান্য একটু প্রশংসা করাতে ছেলেটা কতই না খুশি। শুধু মাত্র সুযোগের অভাবে পারেনা লেখাপড়া করতে। লোকটা বলল….
–ইংরেজিতে নাম লিখতে পারিস?
-না।
–দে খাতা, আমি লিখে দেই।
-আমিতো ইংরেজি অক্ষর চিনিনা।
–আচ্ছা এককাজ কর, তুই বোস। আমি চা শেষ করে তোকে শেখাচ্ছি।
-আইচ্ছা।
সোলায়মান খুব খুশি। টিউবওয়েলে গিয়ে সুন্দর করে হাত মুখ ধুয়ে নেয়। তারপর খাতা কলম নিয়ে বসলো লোকটার সম্মুখে। লোকটা বলল….
–তোর অসুবিধে হবেনা?
-না দুইটা পর্যন্ত আমি ফ্রি৷ দুইটার মইধ্যে পারমুনা শিখতে?
–পারবি।
-তাহলে তাড়াতাড়ি শেখান।
লোকটা খাতা নিলো। A থেকে Z পর্যন্ত লিখলো। তারপর একটা একটা করতে বলতে থাকলো। তার সাথে সাথে সোলায়মানও বলা শুরু করছে। সোলায়মান বেশ মজা পাচ্ছে। পড়ার মধ্যে যে এত মজা আছে সেটা সে জানেনা। ১ ঘণ্টা যেতেই সোলায়মান সব ঝরঝরা করে ফেললো। অক্ষর গুলোও এখন চেনে। লোকটা খাতায় সুন্দর করে লিখে দিলো..’Solaiman’ তারপর বলল…
–এটা তোর নাম, আস্তে আস্তে লিখবি।
-আইচ্ছা। তয় খাড়ান আপনেরে আরেক কাপ চা দেই।
সোলায়মান লোকটাকে চা দিয়ে আগ্রহ নিয়ে খাতায় নাম লেখার চেষ্টা করছে। লোকটা হাসছে। কি অদ্ভুত ছেলেটা৷ লেখাপড়ার প্রতি ছেলেটার কতই না আগ্রহ! অথচ সে সারাদিন কাজ করে এই চায়ের দোকানে৷ সোলায়মান নাম লিখতে সফল হয়। খুশিতে ওর চোখে পানি আসে। সোলায়মান খুশিতে বলে….
–আমায় আরো পড়ান, খুব মজা।
-এত তাড়াতাড়ি পড়লে তো বিজ্ঞানী হবি।
–আমি বিজ্ঞানী হইয়া আসমানে যামু।
-পারবি?
–হেরা পারলে আমি কেন পারুমনা?
-আচ্ছা দে খাতা তোকে মজার একটা জিনিস শেখাই।
সোলায়মান খাতাটা লোকটার দিকে এগিয়ে দেয়। লোকটা খাতার সুন্দর করে লিখে দেয়…’A ফর অ্যাপেল খায় সোলায়মান। B ফর বল নিয়া দৌঁড়ায় সোলায়মান।’ লিখে দিয়ে বলে….
–এইটা হচ্ছে A, A ফর অ্যাপেল খায় সোলায়মান। আর এইটা হচ্ছে B, B ফর বল নিয়া দৌঁড়ায় সোলায়মান। এভাবে বলবি পারবি?
-হয় পারমু। বলেই আগ্রহ নিয়ে পড়া শুরু করে। লোকটা উঠে দাঁড়ায়। সোলায়মান বলে…
–কালকে কখন আইবেন?
–জানিনা।
-তাড়াতাড়ি আইয়েন, চা’র টাকা দিতে অইবনা।
লোকটা মুচকি হেসে চলে যায়। সোলায়মান সাডার নামিয়ে দোকান বন্ধ করে। আজকে তার টিভি দেখতে ইচ্ছে করছেনা। তার খুব ইচ্ছে করে ইসস লোকটা যদি আরো কিছুক্ষণ থাকতো। সোলায়মান দু’টো বেঞ্চ পেতে তারউপর কাথা বিছিয়ে শোয়। আর অস্ফুট স্বরে বলতে থাকে’A ফর অ্যাপেল খায় সোলায়মান। B ফর বল নিয়া দৌড়ায় সোলায়মান।’ তারপর আপন মনেই হেসে ওঠে সে। সকালে ঘুম ভাঙ্গতে একটু দেরিই হয় সোলায়মানের। বিনিময়ে ঠাস করে চড় খায় গালে। সোলায়মান গালে হাত দিয়ে ছলছল নয়নে তাকায়, হাবিব মিয়া রাগ করে বলে….
 –শালার জানোয়ার সারারাত টিভি দেখস, আর ঘুম থেকে উঠতে দেরি করস। আরেকদিন দেরি করলে ঘাড় ধরে বের করে দিব।
-ভুল হইয়া গেছে কাকা।
–যা তারাতাড়ি গরম পানি বসা। কাস্টমার আইবো, তোর আজকে সকালের খাওন বন্ধ। এক্কেবারে দুপুরে খাবি।
সোলায়মান কিছু বলেনা৷ ছলছল নয়নে মাথা ঝাকিয়ে চায়ের কেটলিতে পানি ঢেলে চুলোয় বসিয়ে দেয়৷ চায়ের কাপ গুলো নতুন করে ধোয়। একটু পরই সোলায়মানের মনে পরে গতকাল রাতের কথা৷ আজকেও লোকটা আসবে? আসলে আবার নতুন করে মজার পড়া পড়ব। আপন মনেই হেসে ওঠে সোলায়মান৷ একটু আগের থাপ্পড়ের কথা সে ভুলে গেছে। সে মনে মনে বলছে… ‘A ফর অ্যাপেল খায় সোলায়মান। B ফর বল নিয়া দৌঁড়ায় সোলায়মান।’
সকালে আর হাবিব মিয়া সোলায়মানকে নাস্তা করতে দিলনা। এতে সোলায়মানের মন খারাপ হয়না। সে অভ্যস্ত হয়ে গেছে এসবে। দুপুরে আলু ভাজি আর ডাল দিয়ে পেটপুরে ভাত খেলো সে। সারাদিন কাটলো লোকটার অপেক্ষায়। ৯ টা বাঁজতেই হাবিব মিয়া চলে গেলো। তারপর যতগুলো কাস্টমার এসেছে সবাইকে সোলায়মান বলে দিয়েছে চা পাতা শেষ। আসলে তার আর কাউকে চা দিতে ইচ্ছে করছিলনা তার। সোলায়মান হাত-মুখ ধুয়ে পরিষ্কার হলো। খাতা কলম টেবিলের উপর রাখলো। ১১ টার দিকে লোকটা আসলো। সোলায়মান দৌঁড়ে গিয়ে বলল….
–এত দেরি কইরা আইলেন কেন?
-আমার অপেক্ষায় ছিলি নাকি?
–হ, আপনের পড়ায় অনেক মজা।
-তোর গালে দাগ কিসের?
–হাবিব কাকায় মারছে, ঘুমত্তন দেরি করে উঠছি তাই।
-তাহলে পড়ালেখা করে কাজ নাই, বাদ দে। পড়ার কারণেই দেরি হয় উঠতে আর মার খাস
–না আমি পড়মুই আপনে আমারে পড়াবেন।
-যদি না পড়াই আমি?
–আপনের পা ধরমু,
মাগনা চা খাওয়ামু, বিস্কুট খাওয়ামু৷ হাবিব কাকা আমারে মাসে ২০০ কইরা টাকা দেয়, হেই টাকা আপনেরে দিমু। পড়াইবেননা আমারে? সোলায়মানের চোখে পানি। লোকটা যদি এখন না করে সোলায়মান কেঁদে দিবে। নিজের সামান্য পাওয়া ২০০ টাকাও দিতে সে রাজি৷ কত অভাগা ছেলেটা৷ লোকটা সোলায়মানের মাথায় হাত রাখে। সোলায়মান কেঁদে দেয়। হাবিব মিয়া কত চড়থাপ্পড় মেরেছে কোনদিন টু শব্দও করেনি৷ আর আজ কোন কারণ ছাড়াই সে কেঁদেছে। কি অদ্ভুত কারণ। লোকটা মুচকি হেসে বলল….
–যা চা বানিয়ে নিয়ে আয়। তোকে আজ বাংলা পড়াবো।
-না ইংরেজি পড়ায় মজা বেশি।
সোলায়মান চা বানিয়ে আনলো। তারপর নিজ থেকেই A to Z পর্যন্ত বলল। তারপর বলল… ‘A ফর অ্যাপেল খায় সোলায়মান। B ফর বল নিয়া দৌড়ায় সোলায়মান।’ বলেই সে হাসলো। লোকটা অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে সোলায়মানের দিকে। তারপর খাতা নিয়ে আবার লিখে দেয়। তারপর বলে….
— এটা হলো C, C ফর ক্যাট, বিলাই খায় মাছের কাটা। এটা হলো D, D ফর ডল, পুতুলের মাথায় ছাতা।
সোলায়মান সাথে সাথে বলে উঠলো….
–আইজকার পড়ায় মজা বেশি। C ফর ক্যাট, বিলাই খায় মাছের কাটা। D ফর ডল, পুতুলের মাথায় ছাতা। হা হা হা, কত্ত মজা।
বলেই সোলায়মান পড়ায় মনোযোগ দেয়। এখন যদি দোকান চুরিও হয় সে টের পাবেনা। লোকটা মনটা হঠাৎ করেই খারাপ হলো। সে তো চিরদিন এখানে থাকবেনা। সে যে ভবঘুরে। স্ত্রী সন্তান হারিয়ে সে এখন দেশে দেশে ঘুরে বেড়ায়। কোথাও যদি তার ছেলে মেয়েরা মেলে৷ কিন্তু নিয়তি সেটা কখনো হয়না। তার মনে এখন একটাই চিন্তা সে চলে গেলে সোলায়মানের কি হবে। সোলায়মানতো রোজ তার অপেক্ষায় থাকবে। লোকটার কিচ্ছু ভালো লাগছেনা। এই জগত সংসারের বড্ড জ্বালায় তাকে। লোকটা উঠে দাঁড়ায় সে চায়না কোন কিছু তাকে আকৃষ্ট করুক৷ সোলায়মান তাকায় লোকটার দিকে, অবাক চোখে বলে….
–উঠলেন ক্যান? চা দিমু?
-নারে চা খাবনা। চলে যাব।
–কই যাইবেন? (আঁতকে ওঠে সোলায়মান)
-জানিনা, আমি আর আসবনা। ঠিকমত কাজ করিস।
–আমারে তাইলে পড়াইবো কেডায়? টেকা কি কম অইছে? আইচ্ছা আমি আরো বেশি দিমুনে।
-কিভাবে দিবি?
–ক্যাশ থাইকা চুরি করমু।
তাও আপনে আমারে পড়ান, যাইয়েন না। আমি এতিম দেইখা কি আমায় পড়াইবেননা? লোকটা সোলায়ামানের দিকে তাকায়। সোলায়মানের চোখে হুট করেই পানি এসেছে। হাতের উল্টো পিঠ থেকে চোখে পানি মুছে সে৷ লোকটা সোলায়মানের মাথায় হাত বুলিয়ে চলে যায়। সোলায়মান দোকানের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকে। তার চোখ বেয়ে পানি পরছে। লোকটা চলে যাচ্ছে! সোলায়মান আর দাঁড়ায়না। এক দৌঁড়ে গিয়ে লোকটার হাত চেপে ধরে। লোকটা অবাক চোখে তাকায়। দেখে সোলায়মান কাঁদছে। লোকটার বুকটা হঠাতই পূর্ণতায় ভরে উঠলো। সে বলল….
–কি হয়েছে কিছু বলবি?
-আমি আপনার লগে যামু।
–তাহলে দোকান কে চালাবে?
-থাকমু না দোকানে, হাবিব কাকায় খালি মারে।
–আমায়তো চিনিসনা, যাবি কেন?
-মাইরাতো আর ফালাইবেনননা? আমরে খালি একটু পড়াইবেন।
–আমারতো বাসা নেই।
-আমি আপনার লগে যামু, আমারে লগে নেন।
–যা দোকান বন্ধ করে আয়!
-না আপনে পালাইবেন।
–সত্যি যাবি আমার সাথে?
-হ যামু।
লোকটা কিছু বলেনা। সোলায়মান লোকটার অনামিকা আঙ্গুল চোপে ধরছে। যেমন করে ছেলে তার বাবার আঙ্গুল ধরে। লোকটার মনে হলো তার ছেলেটাকে সে খুজে পেয়েছে। লোকটার চোখেই হুট করে পানি আসে। সোলায়মানকে এই পানি দেখানো যাবেনা। সে চায়না তার চোখের জল কেউ দেখুন। মুচকি হেসে সামনের দিকে পা বাড়ায় লোকটা। সাথে যুক্ত হয় আরো দু’টো পা৷ যেই পা চলে যেতে চায় বহুদুর৷ যে এখন হাসছে, হাসতে হাসতে বলছে…’C ফর ক্যাট, বিলাই খায় মাছের কাটা। D ফর ডল, পুতুলের মাথায় ছাতা।’
গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত