দুঃখের প্রেম কাহিনী

– গার্লফ্রেন্ড ফোন দিয়ে বললো, ‘আসো করি।’
– আমি লজ্জায় লাল, ‘ইস! এখন না। বিয়ের পরে।’
– লুচ্চার বাচ্চা আমি দেখা করার কথা বলছি। এক্ষণ আমার বাসার সামনে আসবি।
আমি হালকা পার্ট নিলাম, ‘গাড়ি নিয়াসবো, নাকি বাইক? আমার দুইটাই আছে।’
– বাইক নিয়ে আসো। জোস হবে।
– পালসার না ইয়ামাহা? আমার দুইটাই আছে।
– ইয়ামাহা।
– আরওয়ান ফাইভ নাকি এফজেডএস? আমার দুইটাই আছে।
গার্লফ্রেন্ড রেগে গেলো।
‘থাপ্পড় খাবি না লাত্থি? আমার কাছে দুইটাই আছে।’
– ইয়ে মানে, আসতেছি।
– তাড়াতাড়ি আয়।

চুলে জেল টেল মেরে বের হতে যাবো এমন সময় আম্মু ঘরে আসলেন। হাতে মাংসের ব্যাগ। ব্যাগটা আমার হাতে দিয়ে বললেন, আমাদের বাসার কাজের বুয়া ময়নার মা’র বাড়িতে দিয়ে আয়। কুইক।
আমি আমতা আমতা করে বলার চেষ্টা করলাম যে, পরে যাই?
কিন্তু আমার অনুরোধ আম্মুর হাইকোর্টে পাশ হলো না।

তো কি আর করা। আমি ময়নার মায়ের বাসায় মাংস দিয়ে দিয়ে খালি ব্যাগ হাতে নিয়ে ফিরছিলাম। রাস্তার পাশে এক বাড়ির গেট খুলে এক আঙ্কেল হাত ইশারায় আমাকে ডাক দিলো। আমি উনার কাছে যেতেই দুই টুকরো মাংস আমার ব্যাগের মধ্যে ছুড়ে দিয়ে গেট আটকায়া দিলো। আমি কিছু বলারও সুযোগ পাইলাম না। আশেপাশে ভালোভাবে খেয়াল করে শিওর হলাম, আল্লাহ বাঁচাইছে। কেউ দেখেনাই। ব্যাগের মধ্যে আড়চোখে তাকায়া দেখি দুইটাই হাড্ডি। শালা খচ্চর আর কারে কয়। নিজেরা যা খাইতে পারবে না সেইগুলা দিচ্ছে।
যাই হোক, এখন আমার অবস্থা শাকিব খানের বউ অপু বিশ্বাসের মত। আব্রাম খান জয় হলো আমার মাংসের টুকরা। এই টুকরা দুইটা নিয়ে এখন আমি কি করবো!

বাসায় নিয়ে গেলে তো মানসম্মান পুরাই শেষ। আইডিয়া আসলো। মাংস কুড়াচ্ছে এরকম একজন দরিদ্র ব্যক্তিকে দেখে দান করে দিলেই তো হয়। সেক্ষেত্রে অবশ্য সওয়াব আমার হবে নাকি যে আঙ্কেলের মাংস তার হবে, এইটা শিওর না। আমি আশেপাশে ভালোভাবে চেয়ে দান করার মতো কাউকে খোজার ট্রাই করলাম। ইয়েস, পেয়েছি। এক মহিলা আসতেছে ব্যাগ হাতে। আধাকেজি মত মাংস অলরেডি তুলে ফেলেছে। আমি তার কাছে গিয়ে ব্যাগটা খুলে ধরে বললাম, এই দুইটা মাংসও উঠায় নেন। আর দ্রুত ঐ লাল গেটওয়ালা বাসায় যান আরো দিবে।
আমাকে অবাক করে দিয়ে মহিলা তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলো।
“ঐ ছেলে ঐ, সমস্যা কি তোমার? চিন আমারে? জানো আমি কে? আমার বর এক লাখ তের হাজার টাকার গরু কুরবানি দিছে একা আর তুমি আমারে দিতে আসছো দুই টুকরো মাংস। তোমার সাহস তো কম না। বাসা কই তোমার, হ্যা? আমি তোমাকে পুলিশে দেব। আমি তোমাকে জেলের ভাত খাওয়ায়ে ছাড়বো। এতো বড় অপমান! আজ তোমার একদিন কি আমার একদিন!”

মানুষজন জড় হয়ে যাচ্ছে রাস্তায়। আল্লাহ এ আমি কার পাল্লায় পড়লাম। কাহিনী যেদিকে যাচ্ছে পাবলিক আমারে ইভটিজার বলে মাইর না দেয়।
পাশ থেকে এক আঙ্কেল বললো, ‘ছি ছি ছি, আজকালকার ছেলেপেলের হইছে টা কি? স্কুল কলেজের মেয়ে হইলে তাও একটা কথা ছিলো, তুমি তো বয়স্ক মহিলারেও ছাড় দাও না। রাস্তার মধ্যে তোমার মায়ের বয়সী একজন মহিলারে দিনে দুপুরে খারাপ প্রস্তাব দিতে একটুও বাধলো না তোমার? কেয়ামতের আর বেশি দেরি নাই। ছি ছি ছি!’

‘হোয়াট দ্যা এফ, কি প্রস্তাব দিছি আমি? এ তো বিশাল ঝামেলায় পড়া গেল!’

এদিকে ঐ মহিলা থেমে নেই, ‘আমার আপন চাচাতো ভাই পুলিশের এসআই। আমার মামার শালা আর্মি অফিসার। আমার বাপ এই খুলনা শহরে প্রথম উট কুরবানি দেয় সেই উনিশশো একানব্বই সালে। তখন তোমার জন্মও হয়নাই। আমার ছোট ছেলে বুয়েটে পড়ে, মেজটা আইএলটসে আটের উপর স্কোর করছে..!’

‘ওহ গড, এর সাথে বুয়েটের কি সম্পর্ক। আইএলটিএস এর কি সম্পর্ক। প্লিজ হেল্প মি।’

মহিলার গলার তেজ বাড়তেছে, ‘আপনারা কি দাঁড়ায় দাঁড়ায় দেখবেন খালি? কিছু করবেন না? এই দেশে কি বিচার নাই? আমি কি ফোন দেব কাউরে? আমার আপন ছোট ভাই উপজেলা ছাত্রলীগের উপ আপ্যায়ন সম্পাদক…’

‘খাইছে আমারে। আমি ডিসিশন নিয়ে ফেললাম। ব্যাগটা শক্ত করে ধরে দিলাম ঝেড়ে দৌড়। পাবলিক কিছু না বুঝেই আমার পেছনে দৌড়াচ্ছে। তবে তারা দৌড় শুরু করেছে একটু দেরিতে। তার উপরে আমি দৌড়াচ্ছি আমার জান হাতে নিয়ে। সুতরাং আল্লাহর অশেষ রহমতে আমি ধরা পড়লাম না। এক গলির মধ্যে ঢুকে আরেক গলি দিয়ে বের হয়ে মোটামুটি সেফ জায়গায় চলে আসলাম। ঘেমে নেয়ে অস্থির। মাংস দান করার শখ মিটে গেছে আমার।

দৌড়ের মধ্যেই গার্লফ্রেন্ড কল দিলো। আমি কোনোমতে রিসিভ করলাম। ওপাশ থেকে বললো, ‘এতো দেরি লাগতেছে কেন? আমি বাসার সামনে আধাঘন্টা ধরে দাঁড়ায়া আছি। তুমি কই?’
– এলাকায়।
– আচ্ছা থাকো, আমি তোমার এলাকায় আসতেছি।

না করতে যাবো, তার আগেই ফোন কেটে দিলো।
দৌড় থামিয়ে একটা দোকানের সামনে বেঞ্চিতে বসে বিশ্রাম নিচ্ছি এমন সময় একজন এসে পাশে বসলো।
– বস কি মাংস টোকাইতেছেন?
– না।
– কুরবানি দিছেন?
– হুম।
– আমারে কিছু দেন।
– আমি ব্যাগ উনার হাতে দিয়ে বললাম, ধরেন নেন।
– লোকটা খুশি হয়ে ব্যাগ খুলেই মুখ গোমড়া করে ফেললো, ‘ঐ ভাই হাড্ডি দেন ক্যান? হাড্ডি মাইনসে খায়? আপনারা বড়লোক হইছেন ঠিকই কিন্তু মানুষ হইতে পারেন নাই। ভালো গোশত সব ফ্রিজ ভইরা রাখছেন। ভাবছেন আপনাগো কুরবানি হইবো? বালডা হইবো। আপনি রাখেন আপনার হাড্ডি। আপনের মতো বড়লোকরে আমি থু দেই, থু!’
পাশ থেকে আরেকজন বললো, ‘আপনি মাংস কবরে নিয়া যাইয়েন। ঠিক আছে?’
যে দোকানে বসছি সেই দোকানদার চাচা আরো এক কাঠি সরেস, ‘গরীবের হক মাইরা খাওয়া মাংস আল্লাহ যেন আপনের গলা দিয়ে না নামায়। মানুষ গলায় হাড্ডি ফুইটা মরে আর আপনের মরন যেন হয় মাংস বাইধা!’

আমি কিছুই বললাম না। বলার ভাষা হারায় ফেলছি। দোকান থেকে উঠে চুপচাপ ঘোরাপথে এক মাঠের মধ্যে দিয়ে বাসার দিকে রওয়ানা দিলাম। মাঝপথে এক আন্টি এসে আরো দুই টুকরা মাংস আমার ব্যাগের মধ্যে দিয়ে গেল।

যাক এই দুইটাতে হাড় নাই। দুইটাই সলিড মাংস। শুকুর আলহামদুলিল্লাহ…!

কিন্তু ভাগ্য খারাপ থাকলে যা হয়। ঠিক এই মোমেন্টেই গার্লফ্রেন্ডের রিক্সা থামলো আমার পাশে।
গার্লফ্রেন্ডের গলায় আগুন, ‘ছি সোহাইল, ছি, তুমি মাংস টুকাইতেছ?’
– না মানে আসলে।
– আমি নিজের চোখে দেখলাম, এখন তো আমাকে উল্টাপাল্টা বুঝাইতে পারবা না। তুমি এতো ফকির?
– আসলে ব্যাপার হচ্ছে!
– রাখো তোমার ব্যাপার। বাইক আনবো না গাড়ি? তাইনা? ডায়ালগ দেয়ার সময় তো খুব দাও। এই তোমার বাইক আর গাড়ির অবস্থা? রাস্তায় মাংস টুলায়া কি গাড়িতে অকটেন ভরবা? ছি ছি, তুমি আমাকে মিথ্যা বলে ধোকা দিছ। আর কোনোদিন আমার সাথে কথা বলবা না, ব্রেকাপ।
– বাবু প্লিজ।
– আমার নাম বাবু না। আমার নাম রোজ। আর কোনোদিন আমার সাথে কন্টাক্ট করার ট্রাই করবি না তুই।
রোজ রিক্সায় উঠে চলে গেলো। কি আর করা! সবই কপাল। আমি বাসার দিকে রওয়ানা দিলাম।

পরিশিষ্ট: ক্লান্ত হয়ে বাসায় ফিরে ব্যাগটা টেবিলের উপর রেখে খাটে শুয়ে পড়লাম ফ্যান ছেড়ে দিয়ে। আম্মু ব্যাগ খুলে আমার দিকে চোখ গরম করে তাকালেন।
‘তোরে এই অল্প একটু মাংস দিয়ে পাঠাইলাইম তার মধ্যে আবার চার পিস ফেরত আনছিস? সমস্যা কি তোর? জীবনে মাংস খেয়ে থাকিস না? আমরা তোরে খাওয়াই না? আমাদের ফ্যামিলিতে তো কেউ এরকম কিপ্টে না। তুই কার মত হইছিস! তোরে তো আমার ছেলে বলে পরিচয় দিতেই লজ্জা হচ্ছে। ছিহ!’

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত