একশত টাকা

একশত টাকা
রাত দুইটার সময় পতিতা মেয়েটি আমাকে হাতের মুঠোয় চেপে ধরল। একটু আগেই নেশাখোর ভ্যান ড্রাইভার মজনু রেল স্টেশনের আশেপাশে খুঁজে বেড়াচ্ছিল কোনো পতিতা পাওয়া যায় কি না। অবশেষে খুঁজে পেয়ে মাতাল হয়ে দেহের চাহিদা মিটিয়ে আমাকে পতিতার হাতে তুলে দিলো। ও হ্যাঁ, আমি একটি একশত টাকার নোট। মেয়েটি আমার দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে রইলো। এরই মধ্যে মজনু বলল, বিশ টাকা বেশি নিয়ে গেলি। জবা আর কুসুম কিন্তু আশি টাকা নেয়। একশ টাকা দিলে বিশ টাকা ফেরত দেয়। মেয়েটি মুচকি হেসে আমাকে হাতের মুঠোয় চেপে ধরে হাঁটতে লাগলো। বহু বছর ধরে আমি একজনের কাছ থেকে আরেকজনের কাছে যাচ্ছি। তা বছর পনেরোর মতো তো হবেই। যখন আমাকে নতুন তৈরী করা হলো, বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে গাড়িতে করে আমাকে নিয়ে আসা হলো নরসিংদী ইউ,এম,সি জুট মিলের ভিতর। সেখানে প্রতি সপ্তাহের বৃহষ্পতিবার শ্রমিকদের সাপ্তাহিক বেতন পরিশোধ করা হয়।
সেখান থেকেই আমি প্রথমে মানুষের হাতে আসি। এক শ্রমিক তখন সাড়ে ছয়শত টাকা বেতন পেয়েছিল। আমার সাথে ছিল আমার বড় ভাই পাঁচশত টাকার নোট। আর ছোট ভাই পঞ্চাশ টাকার নোট। লোকটি বাজার করলো পাঁচশত টাকার নোট ভাঙ্গিয়ে। বাজার করার পর আসার পথে একজোড়া জুতোও কিনল। আমি তখনো লোকটির বুক পকেটে। বাড়িতে এসে ডাক দিলো, শ্রাবণ। কোথায় তুই? দেখে যা তোর জন্য নতুন জুতো এনেছি। বুঝতে পারলাম লোকটার ছেলের নাম শ্রাবণ। ছেলেটি জুতো পেয়ে অনেক খুশি। জুতো কোলে নিয়ে ছেলেটি তার মায়ের কাছে গিয়ে বললো, এই যে আমার নতুন জুতো। তিনজনের মুখেই তৃপ্তির হাসি। ছেলেটির মা একটু এগিয়ে এসে বলল, সব টাকা শেষ করে ফেললে নাকি? পাশের বাড়ির ভাবীর কাছ থেকে একশত টাকা ধার এনেছিলাম মনে আছে তোমার? লোকটি বুক পকেট থেকে আমাকে বের করলো।
-এই যে তোমার একশত টাকা। ভাবীকে দিয়ে দিও। আমার কাছে আর বিষ খাওয়ার পয়সাও নাই। মহিলা যখন শ্রাবণকে ডাকলো, শ্রাবণ নতুন জুতো পরে হাজির। সামনে এসে বলল, এই যে মা আমার নতুন জুতো।
-দেখেছি বাবা। একটা কাজ করো, এই টাকাটা জোনাকির মা’কে দিয়ে বলবা মা দিয়েছে। শ্রাবণ প্রথমেই আমাকে একটি চুমো দিলো। তারপর আমাকে তার হাফপ্যান্টের পকেটে ঢুকিয়ে নাচতে নাচতে জোনাকিদের বাড়ি যাচ্ছে। কিন্তু শ্রাবণের পকেট ছেঁড়া। আমি তার নাচনে পকেট থেকে মাটিতে আছড়ে পড়লাম। আমার খুব ইচ্ছে করছিল, শ্রাবণকে ডেকে বলি শ্রাবণ এই যে আমি এখানে রাস্তার ধারে। আমাকে তুমি নিয়ে যাও, নয়তো অন্য কেউ নিয়ে যাবে। কিন্তু আমি কথা বলতে পারি না। তাই শ্রাবণের কাছ থেকে আমি আলাদা হয়ে গেলাম। সে আমাকে প্রথম চুমো দিয়েছে, আমি তার কাছ থেকে আলাদা হতে চাইনি। আমাকে কুড়িয়ে পেয়েছে এক মহিলা। তার কাপড়ের আঁচলে আমাকে গিট্টু দিয়ে রেখেছে। আমার কষ্ট হচ্ছে, কিন্তু তবুও প্রকাশ করতে পারছি না। একটু পরই দেখি শ্রাবণের মা তাকে মারতে মারতে এদিকে নিয়ে আসছে। আর বলছে কোনদিক দিয়া গেছোস বল। নাই দিনের টাকা এখন কই পাব? বল কোথায় ফেলছস? শ্রাবণ কেঁদেই চলেছে। যে আমাকে প্রথম চুমু দিলো, সে আমাকে হারিয়ে কান্না করছে। অথচ আমি তাকে হারাতে চাইনি।
যে মহিলা আমাকে কুঁড়িয়ে পেয়েছিল সে আমাকে দিয়ে চুড়িওয়ালার কাছ থেকে বিশ টাকার চুড়ি কিনেছিল। চুড়ি বিক্রেতা আবারো বিক্রি করার জন্য যখন নতুন চুড়ি কিনতে গেল তখন আমাকে অন্যান্য টাকার সাথে দিয়ে দিল চুড়ির বড় দোকানটিতে। সেই থেকে বছর পনেরো ধরে আমি একজন থেকে অন্যজনে ঘুরে বেড়াচ্ছি। কখনো ভালো মানুষের কাছে কখনো খারাপ মানুষের কাছে। কখনো পুলিশের কাছে কখনো বা চোর ডাকাতের কাছে। কখনো নারীর কাছে কখনো পুরুষের কাছে। কত জেলা ঘুরে এসেছি আমি। শেষ পর্যন্ত এসে পৌঁছলাম এই পতিতার কাছে। যে আমাকে মধ্যরাতে হাতের মুঠোয় করে কোথায় যেন যাচ্ছে। সে কি ভোর হওয়া অবধি আর কারো জন্য অপেক্ষা করবে না? নাকি আমাকে দিয়েই তার আজকের রুটি রোজগাড় শেষ?
মেয়েটি আঁচলে মুখ ঢেকে একটি বাড়িতে ঢুকে পড়ল। হারিকেন জ্বালিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। একটি বাচ্চা ছেলে শুয়ে আছে বিছানায়। সাথে আরেকটি লোক। লোকটি মনে হয় মেয়েটির স্বামী। কিন্তু তার এক পায়ে ব্যান্ডেজ করা। হয়তো কোনো দুর্ঘটায় পা ভেঙ্গেছে। সারতে দুই চারদিন সময় লাগবে। এটা একটা ভাড়া বাড়ি। বাইরে একটা রিক্সা রাখা। রিক্সাটি মনে হয় এই লোকটিরই। এমন ভাড়াটিয়া বাড়ির মানুষের কাছেও আমি বহুবার পৌঁছে ছিলাম বিগত পনেরো বছরে।
লোকটি কাজে যেতে পারছে না, ঘরে খাবার নেই। গরীব মানুষ, পেট তো খাবার চায়। মানুষ মানুষকে দুয়েক বেলার জন্য সাহায্য করে, সবসময় করে না। “মেয়েটি মনে হয় তিনবেলার খাবারের জন্য একবেলা ইজ্জত বিক্রি করল।”
আমাকে পরদিনই এক মুদির দোকানে নিয়ে মেয়েটি এক কেজি চাল আর এ পোয়া ডাল নিয়ে গেল। এই মেয়েটির সাথে আর কোনোদিন দেখা হবে কি না জানি না। এই দোকানটি যেখানে অবস্থিত, এর আশেপাশের রাস্তাঘাট আমার খুব পরিচিত লাগছে। গতকাল রাতে মজনু ভ্যান চালিয়ে কোথা থেকে কোথায় নিয়ে এলো আমি জানি না। রাতের বেলা চিনতে না পারলেও এখন মনে হচ্ছে পরিচিত জায়গা। সেই পনেরো বছর আগে এই রাস্তা দিয়ে মানুষজন আমাকে পকেটে নিয়ে চলাফেরা করেছে।
দুইদিন পর একটি ছেলে এলো দোকানে সিগারেটের জন্য। পাঁচশত টাকার নোট দিলো। দোকানদার বাকি টাকা ফেরত দেয়ার সময় আমাকেও ছেলেটির হাতে দিয়ে দিলো। ছেলেটি টাকা গোনার সময় আমাকে উল্টিয়ে পাল্টিয়ে বলল, আওলাদ ভাই যত পুরাণ টাকা সব কি আমার জন্য রাখো? আমার মন খারাপ হলো কিছুটা। একসময় আমিও নতুন চকচকে ছিলাম। পনেরো বছর পেরিয়ে গেছে। আর কত নতুন থাকবো আমি? ছেলেটি আমাকে নিয়ে চলে আসার সময় দোকানদান আওলাদ ডেকে বলল, শ্রাবণ কাল নাকি তোর ফ্লাইট? একবার বললিও না।
-যাবার সময় সবাইকে বলেই যাব আওলাদ ভাই।
আমার যদি কান্না করার জন্য চোখ থাকতো আমি সত্যিই কেঁদে দিতাম। এটা সেই শ্রাবণ যে পনেরো বছর আগে আমাকে চুমু খেয়েছিল। যার কাছ থেকে আমি আলাদা হতে চাইনি। শ্রাবণ আমাকে চিনবে না। পনেরো বছরে তরতাজা যুবক হয়ে উঠেছে। ইচ্ছে করছে ডেকে বলি, শ্রাবণ দেখ আমি তোর সেই হারিয়ে যাওয়া একশত টাকা। দেখ আমার বুকে আঁকা আছে সেই শহীদ মিনারটি। দেখ লেখা আছে, বাংলাদেশ ব্যাংক ইহার বাহককে চাহিবা মাত্র একশত টাকা দিতে বাধ্য থাকিবে।
শ্রাবণ আমার গায়ের নাম্বারটিও তো তোর মনে নেই। ঙ ঘ ০২০৩১২১ শ্রাবণ আমাকে চিনতে না পারলেও আমি তার সাথে থাকতে পারব বহুদিন। সে আরব একটি দেশ বাহরাইনে চলে এসেছে। আমি তার পকেটে আছি সযতনে। আসার সময় ভাগনিকে আর খালাত ভাইকে নতুন একশত টাকার নোট দিলেও পুরাতন আমাকে রেখে দিয়েছিল তার মানিব্যাগে। এই বাহরাইনে বাংলাদেশের টাকা চলে না। বাহরাইনের দিনারে লেনদেন হয়। তাই এখনো আছি শ্রাবণের মানিব্যাগে, থাকব বহুদিন।
গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত