অংশীদার

অংশীদার
– এই মামা যাবা? আধবয়সী রিক্সাওয়ালা তোরাব আলী মুখ তুলে তাকালো। দুইজন ছেলে দাঁড়িয়ে আছে।
– কই যাইবেন?
– নিউ মার্কেটের মোড়ে।
জায়গাটা এইখান হতে বেশ দূরে। ডাক্তার তোরাব আলীকে টানা ১৫-২০ মিনিটের বেশি রিক্সা না চালাতে বলেছেন। না হয় হার্টের সমস্যাটা বেড়ে যাবে। তাছাড়া এখন রোজার মাস। রোজা রেখে অতদূরে রিক্সা নিয়ে যাওয়া সম্ভবও না।
না বলতে গিয়ে তোরাব আলী হঠাৎ থেমে গেল। তার দশ বছরী ছেলেটা এইবার ঈদে নতুন জামা চেয়েছে। গত ঈদেও ছেলেটাকে কিছু কিনে দিতে পারে নি তোরাব আলী। বৌ টাও প্রতি ঈদে নির্বিকার থাকে। ঈদের দিনে ওদের দিকে তাকানো যায় না। এইবার ছেলে এবং বৌ এর আবদার রাখবে ভেবেছে সে। সে বলল, “যাবো মামা। চলেন।” ছেলেগুলো জিজ্ঞেস করল, “কত নিবা?”
– আশি ট্যাকা। সবাই যা নেয় তোরাব আলী সেটাই বলেছে। কিন্তু না! ছেলেগুলো আশি টাকায় যেতে নারাজ।
– আশি টাকা? সামান্য এই রাস্তা। তুমি আশি টাকা নিবা? আসার সময় তো পঞ্চাশ টাকা দিয়ে আসলাম।
তোরাব আলী স্পষ্টই বুঝতে পারছে ছেলেগুলো মিথ্যা বলছে। কারণ সে ভালোমতোই জানে এইখান হতে মার্কেটের মোড়ে কখনও পঞ্চাশ টাকা রিক্সা ভাড়া হয় না। সর্বনিম্ন সেটা সত্তর-আশি টাকায় আসে। বেশিরভাগ সময়ই নব্বই
-একশ টাকা পাওয়া যায়। রোজা রেখে ভাড়া নিয়ে কথা কাটাকাটি করতে ইচ্ছে করে না বলে তোরাব আলী শুরুতেই কমিয়ে বলেছিল।
এরপর সামান্য এদিকওদিক করে সে ষাট টাকায় ওদের নিল। ধীরে ধীরে রিক্সায় প্যাডেল মারতে মারতে সে ভাবতে লাগলো আর দুই একটা এইরকম ভাড়া মারতে পারলে আজকের দিনটা খারাপ যাবে না। একটু পর ইফতারের সময়। এরপর সবাই ঝাঁক বেঁধে কেনাকাটা করার জন্য বের হবে। সেখান হতে দুয়েকটা বড়সড় ভাড়া মারতে পারলেই হলো। প্যাসেঞ্জার গুলো নামিয়ে তোরাব আলী রাস্তার পাশে একটা বেঞ্চে গিয়ে বসলো। কোমড় হতে গামছাটা খুলে মুখের ঘাম মুছলো। ইফতারের আর বেশি দেরি নেই। তোরাব আলী যে বেঞ্চটাতে বসেছে সেটাতে পাঞ্জাবি এবং মাথায় টুপি দেওয়া একজন লোক এসে বসলো। দেখতে বেশ পরিপাটিই লাগছে উনাকে। এই ধরনের লোকদের সাধারণত ইফতারের আগে রাস্তায় দেখা যায় না। রিকশার গদি খুলে সেখান হতে মুড়ির একটা পুটলি বের করল সে। খালি বোতলটা নিয়ে কাছের একটা দোকান হতে পানি ভর্তি করে আনলো। এবার সে হাতমুখ ধুয়ে এসে বসল। লোকটি এখনও বসে আছে। তোরাব আলী লোকটিকে জিজ্ঞেস করল, “ভাইসাব রোজা রাখছেন নি? ” লোকটি বলল, “হ্যাঁ ভাই।”
তোরাব আলী জিজ্ঞেস করল, ” বাসায় যাইবেন না?” লোকটি নাসূচক মাথা ঝাঁকালো। সে তোরাব আলীকে বলল, ” আসেন আমি আর আপনি একসাথে ইফতার করি।” তোরাব আলী হালকা লজ্জিত হয়ে বলল, ” আমি তো খালি মুড়ি দিয়াই ইফতার করমু। আপনেও খাইবেন?” খানিক ইতস্তত হয়ে আবার বলল, ” মানে খাইতে পারবেন?” লোকটি মুচকি হেসে বলল, ” কেন পারবো না ভাই!” কিছুক্ষণ পরই সাইরেন দিল। দুজনে একত্রে ইফতার করে নিল। লোকটি তোরাব আলীকে জিজ্ঞেস করল, “কয়েকদিন পরেই তো ঈদ। কাপড়চোপড় কিনেছেন?” তোরাব আলী বলল, ” এহনও কিনতে পারি নাই। চান রাইতের দিন যামু। ঐদিন গেলে সস্তা পাওয়া যায় কাপড়।
পোলাডাও বহুত কাঁনছে এইবার। গতবার কিন্না দিতে পারি নাই কিছু। এইবার দিমু। বৌ ডারেও শাড়ি কিন্না দিমু। “
বলতে বলতে তোরাব আলীর চোখের মনি উজ্জ্বল হয়। লোকটি জিজ্ঞেস করল, ” আপনি কিছু নিবেন না?”
হালকা লজ্জিত হয়ে তোরাব আলী উত্তর দেয়, ” সেই সাত বছরে থাহার সময় বাপজান নিয়া দিসিলো। এরপর আর কিনা হয় নাই। ” লুঙ্গীর ছেড়া অংশটুকু আড়াল করতে করতে তোরাব আলী বলল, ” এহন তো বুড়া অইছি। আমগো কি আর ঈদে কাপড় কিনার বয়স আছে?” বলেই মুচকি হাসলো সে। লোকটি আবার জিজ্ঞেস করল, “তো যাকাত কেমন পান?” মুখখানা বিকৃত করে তোরাব আলী বলল, ” আমগো দিবো যাকাত? হারা বছর আমগো থেইকা চুইষা খাইয়া রমজান মাসে দুই তিনশ ট্যাকার যাকাত দিয়া লাভ কি? যারা যাকাত দেয় তাগো তো সারাবছর আমরাই যাকাত দিই।” বলতে বলতে চোয়াল শক্ত হয়ে উঠল তোরাব আলীর।
সামনে বসা লোকটি পাঞ্জাবির পকেট হাতড়ে একটা ছোট প্যাকেট বের করল। তারপর তোরাব আলীর দিকে তাকিয়ে বলল, ” মিয়াভাই এইটা রাখেন।” হালকা অবাক হয় তোরাব আলী। এক প্রকার জোর করেই তাকে প্যাকেট টা ধরিয়ে দিল লোকটি। কৌতূহল নিয়ে প্যাকেট টা খুলল সে। খুলেই বিশাল এক ধাক্কা খেল সে। কড়কড়ে নতুন দশটি এক হাজার টাকার নোট আছে এতে। চোখ তুলে আর পাশে বসা লোকটিকে দেখতে পায় না সে। প্যাকেট খোলার সময় হয়ত কোনো এক ফাঁকে চলে গিয়েছে লোকটি। তাড়াতাড়ি উঠে সে, “মিয়াভাই মিয়াভাই” বলে ডাকতে লাগলো। কিন্তু সে ছাড়া রাস্তায় আর কেউ নেই। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে টাকাগুলো হাতে নিয়ে সে আগের জায়গাতেই বসে গেল।
কাছের মসজিদ টা হতে আযান শোনা যাচ্ছে। দূর হতে তোরাব আলীকে খেয়াল করছিল প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী শমসের খান। টাকা গুলো দিয়েই তোরাব আলীর চোখের অলক্ষ্যে তিনি সরে এসেছেন। কাছাকাছি অন্ধকারে দাঁড়িয়ে তোরাব আলীকে দেখছেন তিনি। মোনাজাতের ভঙ্গিতে লোকটা বিড়বিড় করে কি যেন বলছে। স্পষ্ট বোঝা না গেলেও তোরাব আলীর চোখের জল ল্যাম্পপোস্টের আলোয় স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। আগামীকাল এমন আরেকজন তোরাব আলীর খোঁজে বের হতে হবে তাকে। শমসের খান ভাবতে লাগলেন এইভাবে যদি দেশের প্রত্যেক প্রতিষ্ঠিত মানুষ দুইচারজন তোরাব আলীর ঈদের অংশীদার হতো তাহলে হয়ত তোরাব আলী দের আর বৌ বাচ্চার মলিন মুখ দেখে ঈদ করতে হতো না। আমরা চাইলেই পারি। কিন্তু আমরা চাই না। আসলে হয়ত আমরা চাইতেই জানি না।
গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত