-“আম্মা এক হাজার টাকায় কী হবে?” আম্মার কপালের শিরা টা চট করে ফুলে গেলো, আমার দিকে অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করে উত্তর দিলেন,
-” আমার আর তোর বাবার জন্য একজোড়া কাফনের কাপড় হবে, দয়া করে তা-ই নিয়ে আসিস! আমার মা ভদ্রমহিলা রেগে গেলে কেঁদে ফেলেন, এখনও তার ব্যাতিক্রম কিছুই হলোনা। তার বৃথা কান্না আটকানোর চেষ্টায় চোখের রগ গুলো লাল রঙ ধারণ করেছে। মুখের উপর দরজাটা ধপাস আওয়াজে বন্ধ করে দিয়ে চলে গেলেন তিনি।
এবার একটু বেশিই যেন অভিমান হলো আমার, হাজার টাকার আধো নোংরা মশলার ঘ্রাণ মাখা নোট টা কুঁচকে ছুঁড়ে ফেলে দিলাম মেঝেতে। দুঃখে বুক ফেটে যাচ্ছে তবুও চোখ ভিজছে না। এরকম টা হওয়ার একটা যৌক্তিক কারণ রয়েছে, যারা খুব বেশি দুঃখ পায় জীবনে, তারা কাঁদতে কাঁদতে একসময় চোখের জল হারিয়ে ফেলে। চোখের জল হারালেও তারা দুঃখ হারায় না, আবারও দুঃখ পায়! কিন্তু সে দুঃখ টা গলে গিয়ে জল হয়ে চোখে আসেনা। বুকের ভেতর উলট-পালট খেয়ে হাড় গুঁড়ো হওয়া ব্যথার যোগান দেয়।
লকডাউনে সব কিছু বন্ধ হয়েও যেন খোলা, সবাই চাকরি করছে। বাড়িতে বসা কেবল আমি আর আমার আব্বা৷ আব্বার বয়স হয়েছে এই অজুহাত দেখিয়ে উনার অফিসের পুরাতন কর্মকর্তাদের সাথে উনাকেও চাকরি থেকে ছাটাই করেছে অফিস কর্তৃপক্ষ। চাকরি ছাড়া গত দুইমাস সংসারের সব খরচ চালিয়ে আব্বাও এখন প্রায় রিক্তহস্ত। আমি টিউশন করিয়ে নিজের ভার্সিটি আর হাত খরচ চালাই। দেশের এহেন কষ্মিন কালে আমার চারটে টিউশনের সব বন্ধ। দুইজন টিউশনের পাওনা পুরোপুরি পরিশোধ করে পর দিন থেকে আসতে নিষেধ করেছে৷ তৃতীয় জন কে হাফ বেতনে পড়াই, এখন যে হাল! নিন্মবিত্ত সেই ছাত্রের পরিবার থেকে টাকা চাওয়া টাও এখন অমানবিকতার শামিল৷ চতুর্থ জন অষ্টম শ্রেণিতে পড়ুয়া একটা মেয়ে,তাদের আর্থিক অবস্থা একেবারে কোটিপতি ধাপের না হলেও আমাদের থেকে ভালো৷ ইদ উপলক্ষে গরু জবাই দিচ্ছে সবাই মিলে। তবুও আমার দুই মাসের টাকা বাঁধিয়ে ছাত্রীর মা আমাকে “ইদের আগে দিয়ে দিবো” বলে সান্ত্বনা দিয়ে প্রাইভেট বন্ধ করিয়েছিলেন। আজ চাঁদ রাত, হাত ফাঁকা! তাই তাদের বাড়িতে যাওয়া ছাড়া আর কোন উপায়ন্তর খুঁজে পাচ্ছিনা।
গত এক মাস আগে অনলাইনে একটা জামা দেখেছি, দামাদামি করার উপায় নেই একদাম আড়াই হাজার টাকা। এই জামা টার আগে আরও অনেক জামা চোখে লাগলেও মোটামুটি টাকার দিক থেকে কেনা সম্ভবের ভেতর এটাকেই পছন্দ করেছি। আম্মার কাছে টাকা চেয়েছিলাম, দু’দিন প্যানপ্যান করার পর আজ যেন আম্মা নিজের কলিজা ছিঁড়ে এক হাজার টাকার একটা নোট ধরিয়ে দিয়ে আমার সামনে থেকে বিদায় হলেন। বান্ধুবিদের সবার কেনাকাটা শেষ, আমিই কেবল বাকি । কারণ ঐযে একটাই আমি “মধ্যবিত্ত”!
মধ্যবিত্ত শ্রেনির মানুষ গুলোর শরীরে আলাদা একটা সহনশীল ফিচার থাকে, যা সব সময় সব কিছুতে তাকে মানিয়ে নিয়ে খুশি থাকতে বাধ্য করে। যার জীবনে এই দুঃখ টা থাকে যে পেলাম না! তার চেয়েও দ্বিগুণ দুঃখ থাকে তার জীবনে যে বলে, “পেয়েও পেলাম না!” না থাকার চেয়ে অর্ধেক থাকা টা আমার কাছে বরাবরই অনেক বেশি যন্ত্রনা দায়ক। ছাত্রীর বাড়ির বসার ঘরে বসে আছি প্রায় মিনিট বিশেক হলো, ভদ্রমহিলা মাঝে একবার শুধু পর্দা সরিয়ে উঁকি দিয়ে দেখে গিয়েছেন আমাকে। এরপর আরও পাঁচ মিনিট গড়ানোর পর তিনি বাধ্য হয়ে এলেন আমার সামনে। আমি কিছু বলার আগেই তিনি মায়া মিশ্রিত কন্ঠে বলেন,
-“মেহের, দেখছো-ই তো মা দেশের যা হাল, হাতে টাকা পয়সাও তেমন নেই! তুমি টাকা পাও তাতো জানি মা, হাতে টাকা হলে আমি নিজেই পাঠিয়ে দিবো চিন্তা কোরোনা তুমি।”
ভদ্রমহিলার কথার ছুড়ির পর আর উত্তর দেওয়ার মতো কিছু থাকেনা, তাই আমিও ফের আর কোন কিছু বলার সাহস করিনি। হাসি মুখে উঠে চলে এসেছি । আবারও কষ্ট পাচ্ছি কিন্তু কাঁদতে পারছিনা, কাঁদতে না পারার কারণ টা শুরুতেই স্পষ্ট করেছি। নিজেকে সবচেয়ে দূর্ভাগা লাগছে এই মূহুর্ত টায়। গত বছরও এভাবে কেনা হয়নি কিছুই। রাস্তার ফুটপাত ধরে এক পা দু’পা করে ধীরে ধীরে হেঁটে বাড়ি ফিরছি। আমার থেকে প্রায় বিশ গজ দূরে দাঁড়িয়ে একটা দশ-এগারো বছর বয়সী মেয়ে একটা ছোট বাচ্চার পিঠের উপর অনবরত চড় বসাচ্ছে আর বলছে,
-“কইত্থে আইন্না দিমু আমি? তোরে কানতে না করছিনা?” খালি গায়ের লাল হাফপ্যান্ট পরা মেয়েটা ধুলোতে গড়াগড়ি খাচ্ছে আর চিৎকার করে কাঁদছে। দেখে এটুকু ঠাওর করা যায় যে বাচ্চা দু’টো দুই বোন, ছোট বোন টা বায়না ধরছিলো। ওর বায়নার ধরনটা অনেক টা আমার ছেলেবেলার মতো। আমিও ছোট বেলায় খেলনার জন্য এভাবে গড়াগড়ি খেয়ে কাঁদতাম, ওদের দেখে ছোটবেলার কথা মনে হতেই হাসি পেলো। এগিয়ে গিয়ে কী হয়েছে জিজ্ঞেস করতেই “কিছু হয় নাই” উত্তর দিয়ে বড় মেয়েটা আমাকে এড়িয়ে যেতে চাইলো। হয়তো রেগে আছে নয়তো লজ্জা পাচ্ছে। ছোট বাচ্চা টাকে জিজ্ঞেস করার পর বাচ্চাটা উত্তর দিলো,
-“আমি ভাত খামু।”
মেয়েটা কালবিলম্ব না করে আবারও পিঠের উপর চড় বসালো বাচ্চাটার। এটুকু একটা বাচ্চা খাওয়ার জন্য এভাবে কাঁদছে শুনে আমার বুকের ভেতর টায় ধক উঠলো। “খেতে চাওয়ায় মারছে কেনো” এটুকু জিজ্ঞেস করতে যখন মেয়েটার দিকে তাকালাম দেখি তার চোখও ভেজা! ছিঃ ছিঃ এই অবুঝ মেয়ে দুইটা খেতে না পেয়ে কাঁদছে আর আমি নতুন জামার জন্য কাঁদছিলাম? আমি আর কোন প্রশ্ন করতে পারিনি ওদের, চোখ ভিজে আসছিলো আমার।
বাচ্চা দুটো আমার সামনে বসে গোগ্রাসে ভাত খাচ্ছে, আমি মাঝে শুধু একবার জিজ্ঞেস করেছিলাম,
-“নাম কী তোমার?”
-“লিমি আর ওর নাম রিমি।”
একবার মাথা তুলে উত্তর দিয়ে আবারও প্লেটে মনোযোগ দিলো লিমি, আমি তাকিয়ে আছি ওদের মুখের দিকে। উষ্কখুষ্ক চুলগুলো প্রায় জটা ধরে গেছে ময়লায়, গায়ে একটা টিয়া রঙের সেলোয়ার কামিজ। লিমি মেয়েটা সুন্দরী না হলেও এড়িয়ে যাওয়ার মতোও নয়, ধুলোবালি সরিয়ে দেখলেই যে কারো চোখে সে মায়াবতী।
-“আম্মা এহন আর মাইনষের বাসায় কাম পায় না কেউ নেয় না হেরে, একজনের বাসা থেইকা কয়ডা চাইল, ডাইল দিছিলো সব কাইল রাইতেই শেষ। কয়ডা চাইল আছিলো আম্মা সকালে ভাত ফুটায়া আমারে আর রিমিরে ফ্যান দিয়া ভাত কয়ডা আমার ছোডো ভাইরে খাওয়াইছে। সকাল থেইকা আর কিচ্ছু খাইনাই আমরা।”
প্রশ্ন করার আগেই উত্তর দিলো লিমি, হয়তো এতক্ষণে কিছুটা আপন লেগেছে তার আমাকে। আমি কিছু জানতে চেয়ে আর নিজেকে কষ্ট দিতে চাইনি। মেয়ে দুটোকে দোকানে নিয়ে গিয়ে এক সপ্তাহের বাজার করে দিলাম। ব্যাগ খুলে আধো নোংরা হাজার টাকার নোট টা বের করতেই আম্মার মুখ টা ভেসে উঠলো, টাকা টার গায়ে এখনও মশলার ঘ্রাণ। আম্মা সবসময় মশলার বৈয়ামে টাকা লুকিয়ে রাখে। রিমি আমার উড়না ধরে টানছে ওর চোখে মুখে সে কি তৃপ্তি । দেখলেই মন ভরে যায়। বাচ্চা দুটোকে এগিয়ে দিয়ে বাড়ি ফিরে এলাম, রান্নাঘর থেকে মুরগির গোশতের ঘ্রাণ ভেসে আসছে। রাগ করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়েছি তাই মা অসময়েই রান্না চড়িয়ে দিয়েছেন আজ। ইসস আমরা কতো ভালো আছি! অথচ এটা নিয়েও কত শত অভিযোগ আমাদের! ঘরে ঢুকে ফোনটা হাতে নিয়ে আগে জামা টার ছবি ডিলিট করলাম। মনের ভেতরটায় আজ এক অদ্ভুত শান্তি লাগছে। বিছানায় শুয়ে চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণ আগে ঘটে যাওয়া সবগুলো ঘটনার পুনরাবৃত্তি করছি। হঠাৎ মেসেঞ্জারের টুং আওয়াজ বান্ধুবি মেসেজ দিয়েছে,
-“মেহু, জামা কিনেছিস?” চোখ খুলে ফোনটা হাতে নিয়ে স্বস্তির নিশ্বাস ছেড়ে উত্তর দিলাম,
-“না রে , তবে সুখ কিনেছি!
গল্পের বিষয়:
গল্প